#আগাছা
#Khadija_Akter
#পর্ব_০৮
অনিক আমার ঘাড়ে মুখ গুজে দিল।ওর তপ্ত শ্বাস আমার ঘাড়ের উপর পড়তেই আমি শিউরে উঠলাম।দু’হাতে ওর পিঠ আরও শক্ত করে খামচে ধরলাম।
আমার চুলের মিষ্টি গন্ধ আর অনিকের শরীরের মাদকময় গন্ধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আমরা সব ভুলে দুজন দু’জনার মধ্যে ডুবেই যাচ্ছিলাম প্রায়।
–বউমা,অনিক আসেনি এখনো?
প্রশ্নটা করতে করতে রহিমা বেগম দরজা ঠেলে ঢুকে যায় তাদের রুমের ভিতর।
অনিক তখনো মাথা যথেষ্ট নিচু মেহেরের ঘাড়ে মুখ গুজে পড়ে ছিল।মায়ের কথা বা উপস্থিতি কোনোটাই সে টের পায়নি।
এদিকে মেহের দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকায়,সে-ই আগে দেখতে পায় কেউ একজন দরজা ঠেলে এইমাত্র ঢুকছে।
এক ঝটকায় সে অনিক কে দূরে সরিয়ে দেয়।মেহেরের এহেন অকস্মাৎ পরিবর্তনে অনিক হতভম্ব হয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
–কী হলো?
–কিছু না।আমি গরম পানি করে নিয়ে আসি।তুমি না গোসল করবা?
গরম পানি করার উছিলায় আমি আম্মার পাশ কাটিয়ে দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে পালিয়ে বাঁচি।
এদিকে অনিক মেহেরের যাওয়ার পথ অনুসরণ করতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই মায়ের মুখোমুখি হয়ে যায়।
এবার সে বুঝতে পারলো মেহেরের এরকম হঠাৎ প্রস্থানের কারণ।
থতমত খেয়ে সেও এবার ব্যস্ত হয়ে যায় তোয়ালে খুঁজতে।এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে মাকে প্রশ্ন করে,
–কেমন আছো মা?তোমার শরীর ঠিক আছে তো?ঘুমিয়েছিলে নাকি?কখন এলে?
রহিমা বেগম ছেলেরে অস্বস্তিটা বুঝতে পারেন বেশ ভালো করেন।আসলে উনারই উচিত হয়নি এভাবে না বলে কয়ে হুট করে ঢুকে যাওয়া।
আর একবার রুমে ঢুকে যেহেতু গেছেনই,এখন না পারছিলেন থাকতে আবার না পারছিলেন চলে যেতে।
তিনি ঠায় দাঁড়িয়েই রইলেন আর বললেন,
–সব কথা বলবো বাবা।সব প্রশ্নের উত্তর দিব।
তুই আগে ফ্রেশ হয়ে আয়।অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোকে।কত দূর থেকে এসেছিস বল তো।
তুই আয় ফ্রেশ হয়ে আমি নাস্তা বানাচ্ছি তোদের জন্য।
বলেই আর এক মুহূর্তও দেরী করেন না সেখানে রহিমা বেগম।তাড়াতাড়ি করে চলে এসে ছেলেকে ও নিজেকে অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচালো।
মা চলে যেতেই তোয়ালে হাতে অনিক ওয়াশরুমে চলে গেল।
পাকোড়া খুব পছন্দ করে অনিক।রহিমা বেগম ভাবলেন,ছেলের জন্য পাকোড়া আর স্যূপ তৈরি করবেন তিনি।তাই সোজা রান্নাঘরে চলে গেলেন।
শাশুড়ীকে কিচেনে আসতে দেখেই,একটু আগের ঘটনাটা ভেবে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গেলাম আমি।
আমার শাশুড়ী মনে হয় আমার অবস্থাটা বুঝলেন।তিনি ময়দা মাখাতে মাখাতে কথা না ঘুরিয়ে সরাসরিই বললেন,
–বউমা,এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?বিয়ের প্রথম প্রথম এরকম পরিস্থিতিতে আমি আর তোমার শ্বশুরও পড়েছি কতবার তার হিসাব নাই।
আমাদের সময়ে তো আর তোমাদের মতো এতো প্রাইভেসি রাখার উপায়ও ছিল না।
যে কেউ যখন -তখন যার তার রুমে ঢুকে যেতো।
আর দিনের বেলায় দরজা আটকানোটা তখন মুরব্বীরা বাঁকা চোখে দেখতো তাই দরজা লাগানোর উপায় ছিল না তখন।
তবে আমার ঐভাবে যাওয়াটা উচিত হয় নাই।আর তোমারাও একটু সাবধান হয়ো।তোমার সংসারের তো একজনের নজর পড়েই গেছে এর মধ্যে।
আমি কি জবাব দিব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম।একটু পর বললাম,
–আম্মা পানিটা দিয়ে আসি আপনার ছেলেকে।
–হ্যাঁ যাও।
পানিটা নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসলাম রান্নাঘর থেকে।আসলে লজ্জা লাগছিল খুব শাশুড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে।
অনিককে পানি দিতে গেলাম।অনিক আবার শুরু করলো আগের কাহিনী। হাত ধরে বাথরুমের ভিতরে টেনে নিতে চাইলো।
কিন্তু আমি চোখ পাকিয়ে নিষেধ করলাম।পরে ও আর জোর করলো না।মুচকি হেসে হাত ছেড়ে দিল।আর বললো,”রাতে প্রতিশোধ নিব।”
————–
সন্ধ্যায় সবাই বসে আছি ড্রয়িং রুমে।আমি আর অনিক একটা সোফায় বসেছি।আম্মা আর তরী আমাদের মুখোমুখি ২টা সিঙ্গেল সোফায় বসেছে।
অনিক ইন্ডিয়া থেকে নিয়ে আসা কিছু জিনিস একে একে আমাদের সবাইকে গিফট দিল।সবারই পছন্দ হলো গিফটগুলো।
টুকটাক কথা বলছি,টিভি দেখছি আর পাকোড়া খাচ্ছি।
একটুপর আম্মা উঠে চলে গেল নামাজ পড়তে।
কিছুক্ষণ ধরেই খেয়াল করছি আমার হাতে থাকা ইন্ডিয়ান “Chocolate Musk” সুগন্ধিটার দিকে একটুপর পর তরী তাকাচ্ছে শুধু।
একসময় হুট করেই এসে আমার পাশ ঘেষে সোফার হাতলে বসলো।তারপর খুব বিনয়ে গলে গিয়ে বলতে লাগলো,
–আপু,ঐ সেন্টটা আমাকে দিবা?ঐটা না আমার খুব পছন্দ। আমারটা শেষ হয়ে গেছে।দিলে খুব খুশি হতাম।
কথাটা বলেই তরী অনিকের অলক্ষ্যে মুখে শয়তানি হাসি নিয়ে আমাকে একটা চোখ টিপে দিল।
ও যখন বলছিল তখনি আমি বুঝেছিলাম,পছন্দ টছন্দ কিছু না আসলে আমার কাছ থেকে অনিকের দেওয়া গিফট ছিনিয়ে নেওয়াই ওর উদ্দেশ্যে।
আর যখন ও চোখ টিপ দিল,তখন তো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল।আমি বেশ কঠিন গলায়ই বললাম,
–না তরী।এটা আমার জন্য এনেছে তোমার জিজু।আর গিফটের জিনিস কাউকে দিতে হয় না।
–দাও না আপু প্লিজ।জি জু বলনা আপুকে এই স্প্রেটা আমাকে দিয়ে দিতে?তুমি যখন আবার যাবে তখন নাহয় আপুকে কিনে এনে দিও একটা।
তরীর এমন অভিনয় দেখে শুধু অনিক কেনো,যে কেউই গলে যাবে।আর হলোও তাই!
অনিক আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
–মেহের,তরীর যেহেতু এতোই পছন্দের এটা তাহলে ওকে দিয়ে দাও না?আমি তোমার জন্য আবার অর্ডার করে আনিয়ে দিব।
–না,এটা আমি দিব না।
দৃঢ় কণ্ঠে কথাটা বলেই আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম সেন্টের বক্সটা আমার হাতে।
কত বড় বজ্জাত মেয়েটা!বিকালেই আমার ফুলগুলো নিয়ে নিল,এখন আবার বেহায়ার মতো এটাও চাইছে।
শুধু চাচা-চাচী যাক দেশের থেকে তারপর একে আমি উচিত শিক্ষা দিব।
এদিকে মেহেরের এমন একগুঁয়েমি দেখে কিছুটা বিরক্ত হয় অনিক।সে আবারও বলে,
–কি হলো?এমন বাচ্চামি করছো কেন?দিয়ে দাও না এটা।
–না দিব না।বলেছি না একবার!
আমি চোখ লাল করে উঠে দাঁড়ালাম তারপর তরীর দিকে একবার কড়া চোখে তাকিয়ে রুমে চলে আসলাম।
বজ্জাত মেয়েটা তখন মিটিমিটি হাসছিল।
রুমে আসতে আসতে শুনলাম তরী বলছে,
–দেখলে জিজু,আপু আমার সাথে কেমন করে……..
————
রাতে খাবার টেবিলে আমি অনিকের দিকে একটুপর পর তাকাচ্ছি।আমার চোখে চোখ পড়তেই ও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বারবার।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,আমার তখনকার ব্যবহারে ও কষ্ট পেয়েছে।
একটু খাওয়ার পরেই আমি আর খেতে পারলাম না।
বমি চলে আসলো।দ্রুত উঠে পড়লাম খাবার টেবিল থেকে।
অনিক দেখলো মেহেরের কি যেনো হলো,হঠাৎ করেই ওয়াক ওয়াক করতে করতে উঠে চলে গেল।
মেহেরের সন্ধ্যার ব্যবহারের জন্য সে তরীর সামনে অনেকটা ছোট হয়েছে,তাই মনে ক্ষোভ ছিল ঠিকই।
কিন্তু মেহেরের এমন আকস্মিক প্রস্থানে অনিক আর চুপ করে বসে থাকতে পারলো না।
সেও খাওয়া রেখে দ্রুত উঠে হন্তদন্ত হয়ে মেহেরকে অনুসরণ করলো।
রহিমা বেগম মাথা নাড়লেন আর মনে মনে হেসে আবার খাওয়াতে মন দিলেন।
এদিকে অনিককে মেহেরীমার জন্য এমন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে যেতে দেখে তরী মনে মনে ফুঁসতে লাগলো।
“সব নাটক” বলেই সে ভাতের প্লেট টা ঠেলা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল।
তারপর সোজা রুমে গিয়ে অনেক জোরে ঠাস করে শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দিল।
অনিক পিছন থেকে দাঁড়িয়ে একহাত দিয়ে মেহেরের সামনের চুলগুলো মাথার উপরে গুছিয়ে ধরে রেখেছে আর মেহের মাথা নুইয়ে বেসিনের উপর ঝুঁকে আছে।
তার বমি বমি ভাব লাগছে কিন্তু বমি হচ্ছে না।
অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর যখন বমির ভাবটা অনেকটা কমে এলো তখন মেহের মুখ হাত ধুয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো।
অনিকও নিজের এটো হাতটা ধুঁয়ে নিল।
মা ডাইনিং থেকে ডাকলেন,
–তোরা কি আর খেতে বসবি না?সব গুছিয়ে ফেলবো নাকি?
অনিক চেচিয়ে করে জবাব দিল,
–হ্যাঁ মা সব গুছিয়ে শুয়ে পড়ো তুমি।
রহিমা বেগম সবকিছু গোছগাছ করে মেহেরীমার রুমে আসলেন।ওর মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলালেন।
–কেমন লাগছে এখন মা?
–এখন একটু ভালো লাগছে আম্মা।
–ঠিক আছে,চুপ করে শুয়ে থাকো।নড়াচড়া করো না।
রাতে বেশি খারাপ লাগলে আমাকে ডেকো।
আর অনিকের দিকে চেয়ে বললেন,
–বাবা তুইও শুয়ে পড়।সারাদিন অনেক দকল গেছে নিশ্চয়ই তোর উপর?বেশি রাত জাগিস না।
আয় দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে যা।
মা চলে যেতেই অনিক দরজা লাগিয়ে আমার পাশে এসে বসে।
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
অনিক আরেকটু এগিয়ে এসে আমার কাছে ঘেষে বসে বললো,
–হঠাৎ করে বমি হলো কেন?সন্ধ্যায় কতগুলো তেলে ভাজা জিনিস খেলে?কতবার বলেছি এসব তেলের জিনিস না খেতে।
আমি বেশ ঝাঁঝ দেখিয়ে বললাম,
–দুপুরেও তো বমি হলো।কই তখন কি ভাজাপোড়া কিছু খেয়েছিলাম নাকি!
–দুপুরেও বমি হয়েছে মানে!কি হয়েছে তোমার?অসুস্থ নাকি?আগে বলোনি কেন?ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে?এখন কয়টা বাজে;চলো তোমাকে ডাক্তার দেখিয়ে আনি।
অনিকের এরকম অস্থিরতা দেখে আমি এপাশে ঘুরে ওর হাতটা ধরলাম।তারপর কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,
–আমি ঠিক আছি।
তোমাকে একটা কথা বলি অনিক?
–হ্যাঁ বলো?
–তরীর মতিগতি না আমার একদম ঠিক লাগছে না।ও মনে হয় আমাকে সহ্য করতে পারে না তোমার পাশে।ওর চোখে তোমার প্রতি আমি অন্যরকম টান দেখি।
প্লিজ তুমি বিশ্বাস করো আমায়।আমার কথায় আমাকে ভুল বুঝো না,আমি সত্যি বলছি।
মেহেরের কথা শুনে অনিকের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।সে বিরক্তি নিয়ে বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়ায়।
–তরী তরী তরী!তোমার মাথা থেকে এই তরীর ভূত কবে নামবে বলো তো!এই তো সেদিন কত কথা বললে ওকে নিয়ে,আজ বিকালে স্যরিও বললে।এখন আবার শুরু করেছো। মানে সিরিয়াসলি মেহের!
সন্ধ্যায় তোমার বোন তোমার কাছ থেকে একটা ছোট্ট সুগন্ধির শিশি চেয়েছে মাত্র!আর তুমি কেমন ব্যবহারটা করে চলে এলে ভেবেছ!
তুমি তো আগে এমন ছিলে না মেহের!বরং মানুষকে দিতে পারলে আরও খুশি হতে।
এবার আমিও বিছানা থেকে নেমে গেলাম।অনিকের সামনে গিয়ে অসহায় কন্ঠে বললাম,
–তুমি আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছো না অনিক।
–আমি বুঝতে পারছি মেহের।
আর এটাও বুঝতে পারছি যে তুমি আমাকে আর তরীকে জড়িয়ে সন্দেহ করো।
তাই আজ আমি তোমার মন থেকে এই ইনসিকিউরিটিটা দূর করতে চাই।
ভেবেছিলাম কখনো বলবো না কিন্তু না বললেও তুমি এদিকে অন্যকিছু ভেবে বসে থাকবে।
তাই আজ তোমায় আমাদের একটা পারিবারিক ইতিহাস বলবো।যা শুনলে তুমি বুঝতে পারবে তোমার বোন তরীর প্রতি আমার ফিলিংসটা ঠিক কি!
–আমি সব জানি অনিক!
–জানো?কি জানো!
–সব জানি!তোমার একটা বোন ছিল তরীর মতো দেখতে!নাম আনিকা, একটা ইন্সিডেন্টে ও মারা যায়।
আর তরীকে তুমি তোমার বোনের চোখে দেখো,তাইতো?
আম্মা আমাকে সব বলে দিয়েছে।
অনিক মেহেরের দিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে মাথা চেপে ধরে বিছানায় বসে পড়ে।
আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে,”আমি মেরে ফেলেছি,আমি মেরে ফেলেছি বোনকে,আমি মেরে ফেলেছি।”
আম্মা বলেছিল আনিকার কথা উঠলেই অনিক কিছুটা এবনরমাল হয়ে যায় কিন্তু ও যে এভাবে হুট করে চোখের সামনে ভেঙে পড়বে সেটা ভাবতেই পারিনি।অনিকের চোখমুখ বেদনায় নীল হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে।মুখে একটা অপরাধীর ভাব।চোখ ছলছল করছে।
অনিকের এরকম অবস্থা দেখে আমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওর মাথাটা আমার বুকের সাথে চেপে ধরলাম।
অনিক একদম বাচ্চা ছেলের মতো আমার বুকে মাথা এলিয়ে দিল আর একটু পর পর ফুঁপিয়ে উঠছে।
অনেকটা সময় এভাবে থাকার পর আমি অনিকের মুখটা তুলে ধরলাম।ওকে বুঝাতে লাগলাম,
–তুমি কেনো কষ্ট পাচ্ছো?নিজেকে অপরাধী কেন ভাবছো?তোমার এখানে একদম দোষ নেই অনিক!তোমার জায়গায় যেকোনো ভাই হলে বোনকে ঐভাবেই শাসন করতো বিশ্বাস করো।তুমি এক্সট্রা কিছুই করোনি যার জন্য তোমার বোন মরেছে!নিজেকে এভাবে দোষ দেওয়া বন্ধ করো।
–স সত্যি বলছো?আ আমার জন্য মরেনি!আ আমি দা দায়ী নই!
–তুমি কেন দায়ী হবে বুঝাও আমাকে?তুমি তোমার বোনকে অনেক ভালোবেসেছ।যারা ভালবাসে তারা শাসন করার অধিকারও রাখে।
তুমি তোমার জায়গা থেকে শাসন করেছে।তুমি তো কোনো ভুল করোনি।
তোমার বোন আত্মহত্যা করেছে কিছু নরপিশাচের কারণে।ধোঁকা খেয়ে সে আর সহ্য করতে না পেরে এরকম স্টেপ নিয়েছে।
এখানে তোমাদের কারো কোনো দোষ নেই লক্ষ্মীটি।
অনেক্ষণ ধরে বুঝাতে বুঝাতে ওকে একসময় অনিক কিছুটা শান্ত হয়।
ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমিও পাশের বালিশে শুয়ে পড়ি।
এটাসেটা কথা বলে ওকে আরও স্বাভাবিক করে তুলতে থাকি।
একটুপর ও নিজের থেকেই আবার তরীর কথা উঠায়,
–তাহলে তো তুমি জানোই তরীর প্রতি আমার অন্য কোনো ফিলিংস নেই। আমি শুধু নিজের বোনের মতোই ওকে দেখি,আদর করি।
আমি বালিশ থেকে মাথাটা উঠিয়ে অনিকের বুকে চলে আসলাম।তারপর শান্ত কন্ঠে বললাম,
–আমি জানি,তোমার অনুভূতিতে কোনো অপবিত্রতা নাই।
কিন্তু তরীর চোখে আমি লালসা দেখেছি অনিক!তোমাকে পাওয়ার লালসা।
–কি বলছো এগুলো তুমি?এরকম কিছু না লক্ষ্মীটি।
আনিকা তো এর থেকেও বেশি আমার সাথে ফ্রী ছিল।আর আমিও ওকে অনেক ভালোবাসতাম।সে হিসেবে তরীর আর আমার মধ্যে তো যথেষ্ট দূরত্ব রেখে চলি আমি।
–কারণ আনিকা তোমার আপন বোন ছিল।
কিন্তু তরী কি তোমার আপন বোন বলো?তুমি তরীকে বোনের চোখে দেখলেও,তরী হয়তো তোমাকে ভাইয়ের চোখে দেখে না।এটা হতে পারে কিনা বলো?
–হ্যাঁ হতে তো পারেই।আপন বোন মা বলেই তো আমি তরীর সাথে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব রেখে চলি যা আনিকার সাথে রাখতাম না।
আর আমার চোখে কখনো তো তরীর অস্বাভাবিক আচরণ চোখে পড়েনি।মানে আমি খেয়াল করিনি ঐভাবে।
–শুনো অনিক,পুরুষ মানুষ অনেককিছুই খেয়াল করে না।বুঝতে পারে না।
কিন্তু একজন মেয়ে অন্য আরেকটা মেয়ের চোখ দেখেই বুঝে ফেলতে পারে সে কি করতে চাইছে।
আমার মনে হচ্ছে আমার সুখের সংসারের তরীর নজর পড়েছে।
বলতে বলতে আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলাম।
অনিক আমাকে ওর বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,
–ধুরর পাগলী,এসব চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দাও।
আর শুনো,তরীকে যেহেতু আমার মহারানী একটু কম পছন্দ করে, তাই এখন থেকে তার প্রজা আরও সতর্ক থাকবে,ঠিক আছে মহারাণী?
আমি মুচকি হেসে বললাম,
–ঠিক আছে।কিন্তু ওর সাথে কিন্তু বেশি হেসে হেসে কথা বলতে পারবে না।তোমাকে ওর সাথে দেখলে আমার খুব জ্বলে!
অনিক হেসে ফেললো।তারপর আমার গাল টেনে দিয়ে বললো,
–আচ্ছা এখন থেকে আর হেসে হেসে কথা বলবো না।কিন্তু তুমিও আর তরীর সাথে যেকোনো বিষয় নিয়ে অমন ওভার রিয়েক্ট করো না।
বাবা-মা ছেড়ে বেচারী মেয়েটা এখানে একা পড়ে আছে।আমরা যদি ওর সাথে দুর্ব্যবহার করি তাহলে তো ওর অনেক খারাপ লাগবে তাই না বলো?
আমি কোনো কথা বললাম না,শুধু চুপ করে রইলাম।
আর মনে মনে বললাম,”অনিক,তুমি এখনও অনেক সরল।কিন্তু তুমি যাকে বেচারী বলছো সে মোটেও এতোটা সরল না।
তুমি কিছু চিন্তা করো না,আমি সব সামলে নিব।কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলবো।”
—————
গভীর রাত
আমি আর অনিক দুজনেরর কারোরই চোখেই ঘুম নেই।
ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে আছি আর অনিকের কন্ঠে গান শুনছি। দারুন গায় অনিক!বিয়ের আগে অনেক শোনা হতো,বিয়ের পর আর তত একটা সুযোগ হয়না।
অনেকদিন মান অভিমান থাকার পর আজ যেহেতু দুজন দুজনকে কাছে পেয়েছে,তাই কেউই ঘুমাতে চায় না এতো তাড়াতাড়ি ।গান আর গল্প করেই অনেকটা সময় পার করে দিল।
আমার শীত লাগছিল হালকা হালকা,সেটা বুঝতে পেরে অনিক আর ওখানে থাকতে দিল না। আমাকে নিয়ে রুমে চলে আসলো।
–অনেক রাত জেগেছি,চলো এবার শুয়ে পড়ি।
মন আমার অন্য কিছু চাইছে।
–একটু অপেক্ষা করো অনিক।
অনিক বিছানার দিকে পা বাড়াতেই আমি ওর টি-শার্টের কোণাটা পিছন থেকে টেনে ধরে কথাটা বলি।
তারপর অনিকের সামনে দাঁড়িয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম,
–আমি তোমাকে কিছু জানাতে চাই।
কিন্তু তুমি ব্যাপারটা কিভাবে নিবে বুঝতে পারছি না।তুমি যদি রিয়েক্ট করো!
–রাগ কেন দেখাবো!রাগ দেখানোর মতো কিছু হয়েছে কি?কি বলবা বলো আমাকে?
আমি গিয়ে আলমারিটা খুলে একটা পেপার্স এনে অনিকের হাতে দেই।
অনিক দেখলো,এটা একটা প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট।
আর রিপোর্টটা পজেটিভ!
অনিক মাথা তুলে হতভম্ব হয়ে কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো…..
অনিকের চোখের দিকে তাকিয়েই আমার মুখ শুকিয়ে গেল।
সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেললাম।আমি ঠিক এটা ভেবেই ভয়ে ছিলাম।কারণ ও এখন বাচ্চা চায়না।ও চেয়েছিল,আমি যাতে ওকে আর কিছুটাদিন সময় দেই আরেকটু উঠে দাঁড়ানোর।
কিন্তু আমাদের ভুলের কারণেই বাচ্চাটা আমার গর্ভে চলে আসে।আমি অনিকের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মিনতি করে বললাম,
–অনিক আমি বাচ্চাটা চাই।আমার খুব শখ একটা বাচ্চার।আমি এটা নষ্ট করতে চাই না। তুমি আর যাইহোক আ্যবোরেশনের কথা বলো না প্লিজ।
বলতে বলতে কান্নায় আমার কন্ঠ বুজে এলো।
অনিকের দিকে চেয়ে দেখলাম অনিকের মুখ কঠিন থেকে আস্তে আস্তে আরও কঠিনতর হচ্ছে………..
#চলবে