পথের_কাঁটা পর্ব ২

#পথের_কাঁটা(২)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
গুমোট অন্ধকারে আজ চাঁদের দেখা নেই। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝেসাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সবচেয়ে বড়ো রুমটায় অপেক্ষা করছে সবাই। অঙ্কন এখনও আসেনি। জামশেদ রহমানকে চিন্তিত দেখালেও জেসমিন রহমান একদম নিশ্চিন্ত। পাথরের মূর্তির মতো এক ভঙ্গিতে বসে আছে জয়ী। নিরবে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। সে নিশ্চল। ত্রয়ী শক্ত করে বোনের এক হাত ধরে রেখেছে।

‘আর কতক্ষণ বসে থাকমু? ছেলেরে ডাকেন এবার।’ কাজীর গলায় বিরক্তি। দেরি হচ্ছে দেখে তাঁর মনে হচ্ছে এবারও বিয়েটা হবে না।

জেসমিন রহমান অঙ্কনকে ডাকতে যাওয়ার আগে অঙ্কন নিজেই এসে উপস্থিত হয়। ‘ঐতো অঙ্কন এসে পড়েছে। আয় বাবা। জয়ীর পাশে বোস।’ বললেন তিনি।

অঙ্কন সেখানেই দাঁড়িয়ে বলল,’আমার কিছু কথা আছে। যেগুলো সকলের জানা প্রয়োজন।’
‘কথা পরে বলা যাবে। আগে বিয়েটা হয়ে যাক।’
‘বিয়েটা আমি করব না মা।’

ঘরটায় যতটুকু নিরবতা ছিল এখন তারচেয়েও বেশি নিরব হয়ে গেল যেন। সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অঙ্কনের দিকে। জেসমিন রহমান ভাবতেও পারেনি এতগুলো মানুষের সামনে অঙ্কন এভাবে তাকে বেইজ্জতি করবে। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন,’এখন মশকরা করার সময় নয় অঙ্কন। একটা মেয়ের লাইফ নিয়ে কথা!’
‘এক্সাক্টলি মা। বিয়েটা যে কোনো ছেলেখেলা নয় এটাই আমি তোমায় বোঝাতে চাই। আমি এই বিয়েতে রাজি না। তোমরা কি একবারও জয়ীর মতামত নিয়েছ? ও এই বিয়েতে রাজি নাকি জানতে চেয়েছ কেউ?’

সকলে নিরুত্তর। আসলেই কেউ জয়ীর থেকে জানার প্রয়োজন মনে করেনি, জয়ী অঙ্কনকে বিয়ে করতে রাজি কী-না। সকলে তাড়াহুড়ায় আছে জয়ীকে পাত্রস্থ করার জন্য। অঙ্কন বলল,’বিয়েটা যেহেতু আমরা করব তাই আমাদের মতামতকে সবার আগে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। শুধু বিয়ে করলাম আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল না। বরং সমস্যা আরও বেশি বাড়বে। বিয়ের পর প্রতিনিয়ত অশান্তি হবে সংসারে। হয়তো একসময় দুজনেই মানিয়ে নেব কিন্তু মেনে নিতে পারব না। মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নেওয়া এক বিষয় নয়।’

অঙ্কনের ভেতর চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। জেসমিন রহমান ছেলের সাহস দেখে হতবিহ্বল। আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ছোটো তো হলেনই এমনকি নিজের ভাইয়ের কাছেও। জয়ী এ পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি। চুপ করে আছে পূর্বের ন্যায়। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।জেসমিন রহমান দ্বিগদিশা খুঁজে পাচ্ছেন না। ঠিক কোন কথাটা অঙ্কনকে বললে রাগ মিটবে সেটাও বুঝতে পারছেন না।

অপমানে মাথা হেট করে রেখেছেন জামশেদ রহমান। এক প্রত্যাখানের পর আরেক প্রত্যাখান কাম্য ছিল না। যে কষ্ট তিনি নিজে সহ্য করতে পারছেন না, সে কষ্ট জয়ী কীভাবে সহ্য করবে? তিনি ব্যাকুল হয়ে জেসমিন রহমানের উদ্দেশ্যে বললেন,’ওকে আর কিছু বলিস না জেসমিন। ভুলটা আমারই ছিল। রাজি হয়ে ভুল আমি করেছি। জয়ীর নিজেরও মতামত নেওয়া দরকার ছিল আমার।’

‘না, ভাইজান। ওর সমস্যা কী আমার জানতে হবে। কেন ও জয়ীকে বিয়ে করবে না? কোনদিক দিয়ে জয়ী কম ওর থেকে?’ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ছেলের প্রতি চরম ক্ষিপ্ত এখন। ঠাঁটিয়ে দুটো চড় গালে বসালেও রাগ মিটবে বলে মনে হয় না।

‘সমস্যা বিরাট। জয়ী কোনোদিক থেকেই কম না সেটা আমিও মানি। সমস্যাটা হলো আমি তো জয়ীকে ভালোবাসি না। আমি ত্রয়ীকে ভালোবাসি। জয়ী যদি ত্রয়ীর বোন না হতো তাহলেও হয়তো আমি বিয়েটার ব্যাপারে ভাবতাম। কিন্তু এক বোনকে ভালোবেসে আরেক বোনকে বিয়ে করা সম্ভব না। ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছায় ত্রয়ীর সঙ্গে দেখা হবে। আমি সহ্য করতে পারব না তখন।’

উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে অঙ্কনের দিকে। এমনটা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। আতঙ্কিত ত্রয়ী স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। এসব সে কী বলছে? বোধগম্য হয় না ত্রয়ীর। ত্রয়ী খেয়াল করল জয়ী ওর হাতটা আলগা করে দিয়েছে। জয়ী কি ভুল বুঝেছে? কিন্তু সে তো নিজেও এসব জানতো না। ক্ষুণাক্ষরেও টের পায়নি কখনও। অঙ্কন বুঝতেও দেয়নি।

‘অনেক হয়েছে। এবার থামো তোমরা। একের পর একেক নাটক আর সহ্য হচ্ছে না আমার। তোমরা কী শুরু করেছ? আমায় কী মনে হয়? পুতুল? যে পারছ যাকে পারছ তুলে নিয়ে আসছ বিয়ে করার জন্য। সে রাজি নাকি জানতে চাচ্ছ না। বাবা, তুমি কী করে রাজি হলে? কেন তুমি অঙ্কনের সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারে রাজি হয়েছিলে?
আর ফুপি! আমি তো তোমার থেকে এটা আশা করিনি। তুমি কি আমায় করুণা করছ? অঙ্কন রাজি না সত্ত্বেও তুমি ওকে জোর করেছ বিয়ের জন্য। তুমি যদি এই কাজটা না করতে তাহলে দ্বিতীয়বারের মতো মানুষের হাসি-তামাশার পাত্রী হতে হতো না আমার। অঙ্কন ত্রয়ীকে ভালোবাসে। সেই আমি অঙ্কনকে বিয়ে করব? নিজের বোনের পথের কাঁটা হব? আমি নিজেই করব না এই বিয়ে। আমি কারো পথের কাঁটা হব না।’ এতক্ষণ নির্বাক থাকা জয়ী মুখ ফুঁটে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল। ভেতরের সব ক্ষোভ, কষ্ট ঢেলে দিয়েছে কথার মাঝে।

ত্রয়ীর হাত ছেড়ে দিয়ে মাথার ঘোমটা এক টানে ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে। যত্নে মাথায় দেওয়া ঘোমটার স্থান হয়েছে এখন মেঝের কাঠের ওপর। লাল টকটকে ঘোমটাটা পড়ে রইল বড্ড অবহেলায়। জিদ্দে বড়ো ঘর থেকে হনহন করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় জয়ী। যাওয়ার আগে ত্রয়ীকে বলে,’তুই বোন হয়েও কাজটা করতে পারলি? সকলকে সুযোগ দিলি আমায় নিয়ে উপহাস করার?’

ত্রয়ী পেছন পেছন যেতে যেতে বলছে,’আপু আমায় ভুল বুঝিস না। সত্যিই আমি এসব কিছু জানতাম না।’
উঠোনের মাঝখান দিয়ে দৌঁড়ে যাওয়ার সময় ত্রয়ীর পায়ে কাঁটা ফুঁটে ওঠে। ঐ অবস্থাতেও সে দু’কদম আগায়। তারপর ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে সেখানেই বসে পড়ে। সামনে থেকে দেখতে পায় মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে জয়ী। বড়ো ঘর থেকে আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি করছেন,’জামশেদ, তোরে আগেই কইছিলাম মাইয়ারে দূরে পড়তে পাঠাইস না। যা পড়ানের কাম নিজের কাছে রাইখাই পড়া। দেখলি তো দূরে দিয়া কী হইল? আত্মীয়র কাছে রাইখাও কী হইল? ঐ পোলার লগেই তো প্রেম-পিরিতি করল। শ্যাষে আইসা নিজের বইনের পথের কাঁটা হইল। পড়া আরও মাইয়ারে ডাক্তারি!’
উঠানের মাঝামাঝি থাকায় বড়ো ঘরের কথাও ত্রয়ীর কানে আসে। এছাড়া তাঁরা উচ্চস্বরেই কথা বলছে। জয়ীর বলা কথাগুলোও কানে বাজছে। কাঁটার আঘাতে হোক কিংবা কথার আঘাতে…ত্রয়ী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। ব্যস্ত থাকায় ভেবেছিলাম আজ গল্প দিতে পারব না। তবুও ছোটো করে এক পর্ব দিয়ে দিলাম। সকলে মন্তব্য করে যাবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here