#বৃষ্টিপ্রিয়া
পর্ব- ০৬।
লেখা- জাহান লিমু।
ছেলে হয়েও আমি বড্ড অভিমানী ছিলাম। এখনো আছি অবশ্য। প্রীতির প্রতি আমার ভীষণ অভিমান হচ্ছিলো। মেয়েটা যে আমাকে কি পেয়েছে। যেন তাকে ভালোবেসে,আমি মস্ত ভুল করে ফেলেছি। আমি চাপা স্বভাবের, সেটারই সর্বোচ্চ ফায়দা সে লুটেছে। বরাবরই চালাকি করে চলেছে আমার সাথে। আমাকে তার আঙুলের ইশারায় নাচাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এভাবে আমাকে বারবার বোকা বানাতে তার খুব মজা লাগে না?
আমিও এবার তাকে বোকা বানাবো। দেখুক, কেমন লাগে। তারপর টের পাবা ময়না পাখি। কাউকে এভাবে বোকা বানালে কেমন অনুভূতি হয়। আসছি আমি।
আজ বিয়ে। আমাদের লুকোচুরি ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটবে।
তবে সেখানে স্পেশাল কিছু ঘটতে চলেছে। বিয়ে সম্পূর্ণ পারিবারিকভাবে হচ্ছে। শুধু নিকট কয়জন আত্নীয় স্বজন নিয়ে। আর সোহাগ আর আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব।
ভেবেছিলাম সোহাগকে বেশ কয়েকটা লাগাবো আসার পর। কিন্তু সেটা না করে,উল্টো জড়িয়ে ধরতে মন চাইলো তখন। এমন বন্ধু হয়তো আর দুটো নেই।
নিজের বোনের ব্যাপারে সব ভাইয়েরা যেখানে ভীষণ স্ট্রিক্ট থাকে,সেখানে সোহাগ যা করেছে, সেটা বর্ণনাতীত। আমি কোনদিনও সোহাগের ঋণ শোধ করতে পারবোনা।
ভাইয়েরা নিজে দশটা প্রেম করলেও,বোনের একটা প্রেমও মেনে নিতে পারেনা। এটাই সত্য।
আর সেখানে আমাদের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখনও বর আসার নামগন্ধ নেই। বিয়ে বাড়িতে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমার অবশ্য ভীষণ ভালো লাগছে। যদিও রুমে বন্দি হয়ে আছি। অবশ্য সেটা আমার প্ল্যান অনুযায়ীই। আর স্পষ্ট প্রীতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছি। এইমুহুর্তে প্রীতির মুখটা বিস্ময়ে ছেয়ে আছে। কারণ এতক্ষণে হয়তো খবরটা পেয়ে গেছে। ও হয়তো কোনকিছু ভেবে পাচ্ছে না। না পাওয়ারি কথা। আমিতো এটাই করতে চেয়েছিলাম। আমিও তো কোনকিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। এখন মজা টের পাবে বৃষ্টিকন্যা।বৃষ্টির জল নিয়ে খেলা করতে করতে,আমার সাথেও একের পর এক খেলা শুরু করেছে। এখন দাবার শেষ চালটা আমি চালবো। ভাবতেই অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে আমার। একটু তো দুষ্টুমি আমারও করা উচিত। অন্তত বৃষ্টিকন্যার দুষ্টুমির প্রতিউত্তরে।
তবে আমার সব ভাবনাতে জল ঢেলে দেওয়াই বোধহয় বৃষ্টিপ্রিয়ার কাজ।
ভেবেছিলাম প্রীতি কান্না করবে,কিন্তু আমি ভুল। সে স্বাভাবিক।
কিছুক্ষণ মুখ ভার করে রেখে, রুম থেকে সবাইকে বের করে দিলো। তারপর কিছুক্ষণ রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারী করলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করলো। মাথার ওড়নাটা ঠিক করলো। তারপর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে কি যেন নিলো। হাতে বোতলের মত কি একটা দেখা যাচ্ছে। তবে হাতের মুঠোয় চেপে রাখার কারনে,বুঝা যাচ্ছে না। আর ওড়নার কারনে আরো দেখা যাচ্ছে না। কি খিচুড়ী পাকাচ্ছে মাথায়?
এবার আমার একটু ভয় করতে লাগলো।
মজাটা বেশি হয়ে গেলো না তো?
এখন যদি প্রীতি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে?
আমি কিছুক্ষণ প্রীতিকে পর্যবেক্ষণ করলাম। এবার সে বিছানায় চুপচাপ বসে আছে। লাল শাড়িতে অপূর্ব লাগছে তাকে। তার চাহনি শীতল। চোখদুটো গভীর। কিন্তু সে কি করতে চাইছে?
এবার আমি ঘাবড়ে গিয়ে রুম থেকে বের হয়ে প্রীতির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে কেউ নেই। আমি পাশেই একটা রুমে বসে ছিলাম। সবাই সম্ভবত বাইরে খেতে গেছে। বাসার সামনে বাগানের পাশে ফাঁকা জায়গাটাতে ডেকোরেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আমি সিসিটিভির মাধ্যমে প্রীতির উপর নজর রাখছিলাম। ফোনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমি চমকে গেলাম। প্রীতির হাতে ট্যাবলেট জাতীয় কিছু একটা দেখতে পেয়ে। আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে, প্রায় সাথে সাথে দরজা ধাক্কা দিয়ে আমি ঢুকে পড়লাম। প্রীতি দরজার লক লাগায় নি।
আমি প্রায় হামলে পড়ে প্রীতির হাত থেকে ট্যাবলেটের বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। প্রীতি স্বাভাবিকভাবেই তাকিয়ে রইলো। আমি প্রীতির মুখেরটাও ফেলার চেষ্টা করতে লাগলাম। হাতের মুঠোয় করে কয়েকটা মুখে পুরতে দেখেছিলাম আমি।
আমি প্রীতিকে রিকুয়েষ্ট করতে লাগলাম যে, আর কখনো এমন মজা করবোনা। আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ, মুখের ট্যাবলেটগুলো ফেলে দাও। কিন্তু প্রীতি আমার কোন কথা না শুনে মুখের ট্যাবলেট গুলো খেয়ে ফেললো। আমি হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। সবাইকে ডাকতে যাবো,এমন সময় প্রীতি উঠে দাঁড়িয়ে রুমের এক কর্ণারে গেলো। সেখানে গিয়ে আমাকে বললো,
ঐ অফিসার,নিজেকে কি মনে করো? তুমি যদি চলো ডালে ডালে,তবে আমি পাতায় পাতায়। কি ভেবেছিলেন, আপনার ভাওতাবাজি আমি বুঝতে পারবোনা?
বিয়ে করবেনা,আসছে আমার মোঘল সম্রাট।
বিয়ে আপনি করবেন,আপনার ছেলের বাবাও করবে।
প্রীতির কথা শুনে রূপকের হেঁচকি উঠে গেলো।
ভেবেছিলো হয়তো বলে বসবে, আপনি করবেন, আপনার…!
কিন্তু এ মেয়ে তো তারও একধাপ উপরে।
একেবারে ছেলের বাপ বানিয়ে দিলো। আচ্ছা, সে জানে কি করে আমাদের ছেলেই হবে? জিজ্ঞেস করবো নাকি?
করেই দেখি। আমি প্রশ্ন করতে যাবো,তার আগেই আমার গলার সামনে ফল কাটার চাকুর উপস্থিতি অনুভব করলাম।
ভয়ে ভয়ে প্রীতির দিকে তাকালাম।
এই মেয়ে হঠাৎ এতো ক্ষেপে গেলো কেন?
মানছি আমার এমনটা করা ঠিক হয়নি। কিন্তু আমিতো বেশিক্ষণ এভাবে থাকতাম না। একটু পরেই কল করে সব বলে দিতাম। শুধু একটু তার রিয়াকশান দেখতে চেয়েছিলাম। তবুও কেন এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে!
আমি ভয়ে ভয়ে প্রীতির দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলতে লাগলাম,
বৃষ্টিকন্যা থেকে, অগ্নিকন্যা কেন হয়ে গেলে?
আমারতো আমার বৃষ্টিপ্রিয়ার শান্ত,স্নিগ্ধ রূপই ভালো লাগে। যাকে দেখলেই আমার মিষ্টি শীতল একটা অনুভূতি জাগে মনে।
কিন্তু এখনতো আমার মিষ্টি নয়,আগুন আগুন অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি একটু নড়াচড়া করলেই,অক্কা পাবো।
আমার কথা শেষ করতেই প্রীতি বলে উঠলো, ভাষণ শেষ হয়েছে অফিসার?
আমি শুধু চোখের ইশারায় হ্যা বললাম। প্রীতি লম্বায় পাঁচ ফিট ছয়। তাই ছুঁড়িটা আমার গলার কাছে ধরতে পেরেছে। একপাশ থেকে আমার গলায় ছুঁড়িটা ধরে রেখেছে। আমার কথা শেষ হওয়ার পরপরই সে বলতে লাগলো,
এতো সাধারণ বুদ্ধি নিয়ে কিভাবে যে এতো ভালো চাকুরী পেয়ে গেলে বুঝতে পারলাম না। নাকি ঘুষ-টুষ দিয়ে পেয়েছো?
চাকুটা সরিয়ে প্রীতি আবার রুমের এক কর্ণারে গেলো। সেখানে একটা টুল নিয়ে সেটার উপর দাঁড়ালো। আমি আশঙ্কা করতে লাগলাম, প্রীতি পড়ে যেতে নিবে আর আমি দৌঁড়ে গিয়ে ধরবো ওকে। নাটক, সিনেমার মতো। কিন্তু আমার সব আশাই গুড়েবালি। প্রীতি এতোটাও দুর্বল মেয়ে নয়। সে সুন্দর করে শাড়ি সামলিয়ে টুলের উপর দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কর্ণারের ফুলগুলো সরিয়ে আমাকে সেদিকে তাকাতে বললো। এবার আমার যা বুঝার, আমি বুঝে গেলাম। ম্যাডাম আগেই সব জেনে বসে আছেন। তাই আমিও আর কোন ভণিতা না করে প্রশ্ন করলাম,
মায়া সব বলে দিয়েছে?
না,এতো সহজে বলে দিবে নাকি? একটু বুদ্ধি খাঁটাতে হয়।
আমি আর কিছু বললাম না। ছিঁচকে চোরের মত অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কারণ এরপরে আমার আর কিছু বলার
থাকার কথা না। প্রীতি নেমে আসলো। টুল থেকে নেমে গেলেও,সামনে এগুতে গিয়ে শাড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিলো। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে ধরে ফেললাম। প্রীতির হাতে চাকুটা ছিলো তখনো,সেটা লেগে আমার হাতের কব্জির কাছে হালকা কেটে যায়। ওতোটা জুরে লাগেনি অবশ্য। তবে হালকা রক্ত বের হচ্ছিল। এবার প্রীতি বেশ ভয় পেয়ে গেলো। প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখ করে সরি বললো আমাকে। কি করবে,না করবে ভেবে পাচ্ছে না। এদিক ওদিক কি খুঁজতে লাগলো।
আচমকা আমি ওর হাত ধরে আমার কাছে নিয়ে আসলাম। প্রীতি ছুঁটতে চেষ্টা করলো,কিন্তু পারলোনা। বৃথা চেষ্টাও করলোনা আর। এবার ও অপরাধীর মত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার হাসি পাচ্ছে। একটু আগের বাঘিনী, এবার হরিণীর ন্যায় ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি প্রীতির মুখটা উপরে তুলে ধরলাম। প্রীতির চোখে জল। এবার আমারও খারাপ লাগতে লাগলো। তবে শরীরী ব্যাথায় নয়,মনের ব্যাথায়। নিজের জন্য নয়,বৃষ্টিপ্রিয়ার মলিন মুখের জন্য। আমি প্রীতির দু’গালে হাত রেখে বললাম,
” ভালোবাসি।”
#চলবে…