বৃষ্টিপ্রিয়া পর্ব ৫

#বৃষ্টিপ্রিয়া
পর্ব- ০৫।
লেখা- জাহান লিমু।

পাঁচ বছর পর।

আমি প্রীতির বাবার মুখোমুখি বসে আছি। ভয়ে, টেনশনে আমার ঘাম ছুটছে অনবরত। আমি ঘাম মুছার কোনরকম চেষ্টাও করছিনা। আসলে আমি সে সেন্সেই নেই। আমাকে কেন ডাকা হয়েছে,তার কিছুই আমি জানিনা। প্রীতির বাবাই আমাকে ফোন করে আসতে বলেছে। সোহাগকে ফোন করেছি, প্রীতিকে ফোন করেছি কেউই রিসিভ করেনি। সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়াশা লাগছে।
মনের মধ্যে একটা কুঁ ডাকতে লাগলো। একটা আশঙ্কা করতে লাগলাম যে হয়তো প্রীতির চাল চলনে তারা কিছু টের পেয়েছে। কিন্তু প্রীতির সাথে আমার খুব কমই কথা হতো। আর দেখা তো আরও কম। কারণ যখন আমার ছুটি থাকতো,তখন প্রীতির ভার্সিটি খোলা থাকতো। তাই সেভাবে দেখা সাক্ষাৎ হয়ে উঠেনি আমাদের। ঐ ফোনেই যা একটু আধটু কথা হতো। তবে আমি তাতেই খুশি ছিলাম। অনেক বেশি কিছু পেয়ে হারানোর চেয়ে,অল্প পেয়ে সেটা ধরে রাখতে পারাটা ঢের ভালো।
তবে আমার সাথে এখন কি ঘটতে চলেছে সেটা আমি একদম অনুমান করতে পারছিনা।
প্রীতি বা সোহাগ কেউই বাড়িতে নেই। সোহাগ ময়মনসিংহ,আর প্রীতি চট্রগ্রাম। আগামীকাল আসবে। আর আমি দু’দিন হলো এসেছি। হঠাৎ করেই প্রীতির বাবার ফোন পেয়ে বেশ চমকে গেলাম। উনার নাম্বার আমার কাছে ছিলো না। তাই প্রথমে চিনতে পারিনি। তবে কন্ঠটা চেনা চেনা লাগছিলো অবশ্য। পরে পরিচয় পাওয়ার পর কুশলাদি বিনিময় করলাম। তারপর আচমকা তিনি এ মুহুর্তেই তার সাথে দেখা করার কথা বললেন। যার দরুণ আমি এখানে বসে আছি এখন।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর, আমি চুপচাপ বসে ছিলাম।
তখন হঠাৎ আমার মা বাবাকে দরজায় দেখে বেশ ভড়কে গেলাম। হচ্ছেটা কি একের পর এক। আর আম্মা,আব্বা এখানে আসছেন কেন?
আমি পুরো হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলাম। আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। আমি কথা বলতে চাইছি,কিন্তু পারছিনা। শব্দরা গলার ভেতরেই থেমে যাচ্ছে এসে।
আমার মন চাইছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যায়। কিন্তু সেটা সম্ভব না। তাই নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা স্বাভাবিক রাখতে সচেষ্ট হলাম। বড় বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিলাম। যখন কিছু বলতে যাবো,তার আগেই যেটা শুনলাম, সেটা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। ফেব্রুয়ারির তিন তারিখ আমার বিয়ে,মানে আর দুইদিন পর। আমার এবার নিশ্চিত মনে হচ্ছে, আমি স্বপ্ন দেখছি। কারণ সবকিছু আমার কাছে ধোঁয়াশা ঠেকছে।
আমাকে একপাশে বসিয়ে রেখে, তারা তাদের মত কথা বলছে। মনে হচ্ছে আমি ছোট বাচ্চা। অথচ আমার বিয়েরই আলাপ হচ্ছে। কোন মানে হয় এসবের?
সোহাগ আসুক একবার। নিশ্চিত ঐ ব্যাটা সব জানে। ইচ্ছে করে বারবার আমাকে নাকানি-চোবানি খাওয়ায়।
আর প্রীতি?
সেও কি সব জানে?
সবাই একসাথে মিলেই কি আমাকে বুদ্ধু বানাচ্ছে?
আমি আর ভাবতে পারছিনা। আমি সেখান থেকে উঠে চলে গেলাম। যদিও সেটা অভদ্রতা দেখাচ্ছে, কিন্তু তবুও আমার পক্ষে সেখানে আর বসে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না।
সোহাগের রুমে যেতে নিয়ে, কেন যেন প্রীতির রুমে ঢুকে গেলাম। যদিও এটা ঠিক না। তবুও বেঠিক কাজটাই করলাম আমি।
চেয়ার টেনে প্রীতির টেবিলে বসলাম। কিছুক্ষণ প্রীতির বই ঘাটাঘাটি করলাম। অবশ্য সেখানে স্টাডি বইয়ের চেয়ে গল্পের বই বেশি ছিলো। বুঝলাম, প্রীতি গল্পের পোকা। অবশ্য আমাকে সেটা বলেছিলো ও। আমিও বই পড়ি,তবে এতোটা না। আমার কবিতা বেশি ভালো লাগে।
হঠাৎ একটা খাতা হাতে নিলাম। হাবিজাবি লিখতে মন চাইছে। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলাম। তারপর লিখতে শুরু করলাম,

চোখের পলকে, মনের অলকে
তোমার ঐ বৃষ্টিস্নাত রুপে
ঝাঁঝরা হলো মন,
দিবস প্রহর, কাটেনা আর
আসবে যে কখন!

একটু নিচে লিখলাম, আর কিছু মাথায় আসছেনা। তোমার কথা ভাবতে গেলে, আমি শব্দহীন হয়ে পড়ি। আমার হৃদয় থেমে যেতে চাই। যে মানুষগুলো সহজে ভালোবাসি বলতে পারেনা,সে মানুষগুলোই হুঁট করেই ভালোবাসা নামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যেমন আমি। আচ্ছা তোমার কোন অভিযোগ আছে আমার প্রতি?
আমিতো অন্য আর দশটা ছেলের মতো তোমাকে প্রপোজও করিনি। তার আগেই কিভাবে সব জেনে গেলে?
জাদু জানো?

অনেক কথা বলার ছিলো,
শব্দরা এলোমেলো,
তুমি যে অদ্বিতীয়া
শুধু আমারি বৃষ্টিপ্রিয়া।

আমি আর কিছু লিখলাম না। কিন্তু খাতাটা কোথায় রাখবো,বুঝতে পারছিলাম না। এমন জায়গায় রাখতে হবে,যেন সহজেই পেয়ে যায়। কথাগুলো আমি সরাসরিই বলতে পারতাম। কিন্তু কোনকিছু লিখে প্রকাশ করার মাঝে বেশি অনুভূতি কাজ করে। অন্তত আমার সেটাই মনে হয়। আগের দিনের চিঠিপত্রের যুগের প্রেমগুলো কত গভীর ছিলো। সেটা ঐ চিঠির লেখার আবেগের কারনেই। হয়তো যতবার চিঠিটা পড়তো,ততবার একই অনুভূতি কাজ করতো। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে কেন যেন সেই অনুভূতি গুলো খুঁজে পাওয়া যায় না।
সরাসরি কথা বলার চেয়ে,চিঠিতে বেশি আবেগ প্রকাশ পায়।
তাই আমি একটা ছোট্ট চিরকুট লিখলাম আমার বৃষ্টিপ্রিয়ার জন্য। এখন শুধুই অপেক্ষা।
ড্রয়িংরুমে কি কথা হচ্ছে এখন,আমি জানিনা। আর জানার প্রয়োজনও নেই। এ জীবনে অনেক কিছু না চাইতেই পেয়ে যাচ্ছি, তাই বড্ড ভয় হয়।
জীবন আমাদের একদিকে ঢেলে দিলে যে, অন্যসময় কেড়েও নেই। একটা মানুষ জীবনের পুরোটা সময় সুখে কাটাতে পারেনা। কিন্তু আমাকে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হলো আমার। ভালোবাসা,পরিবার সবাই আমার পাশে যে আছে। যেখানে মানুষ শত সংগ্রাম করেও ভালোবাসা টিকাতে পারেনা। কেউ ভালোবাসা ছাড়ে,কেউ পরিবার।
কিন্তু আমার দুটোই আছে।
তবে তো আমি নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ বলতেই পারি।
ভালোবাসি বলেও,ভালোবাসার মানুষকে হারানোর চেয়ে,না বলে পাওয়া ভালো। নিজেকে ভালোবাসার যোগ্য গড়ে তুলতে হয়। কারন জীবন একটাই। ভালোবাসা দ্বিতীয় বার আসতে পারে,তবে জীবন নয়।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনে তাকিয়ে দেখি মায়া ফোন করেছে। মায়া স্কলারশিপ নিয়ে চীন আছে এখন। সেখানে একটা ভার্সিটিতেই পড়াশোনা করছে। যাক,যেটা আমি পারিনি,সেটা আমার বোন অন্তত পেরেছে। ফোন রিসিভ করতেই মায়া কনগ্রেচুলেশান জানালো। তার মানে মায়া সব জানতো। নাকি মায়ায় সব কলকাঠি নেড়েছে?
আমার চারপাশের প্রত্যেকটা চরিত্রকে আমার এখন অবিশ্বাস্য লাগছে। মায়া আগামীকাল দেশে আসছে। ওর এমবিএ কমপ্লিট। তার মানে মায়া সব জেনেই আসছে।
তাহলে কি সবাই সব জানে?
আমি আর ভাবতে পারছিনা। আমি সেখান থেকে সোজা বেরিয়ে গেলাম। খাতাটার পাতাটা ছিড়ে প্রীতির বালিশের নিচে রাখলাম। আর কেউ এখানে আসবেনা নিশ্চয়ই।

তাদের মধ্যে আর কি কি কথাবার্তা হলো আমার জানা নেই। আমি বেরিয়ে নদীর পাড়ে খোলা জায়গাটায় একা একা হাঁটতে লাগলাম। শীতল বাতাসে মনটা জুরিয়ে গেল। একটা বেঞ্চিতে বসলাম। পাশের বেঞ্চটাতেই একটা কাপল বসা। এভাবে পার্কে,রাস্তায় ঘুরে ঘুরে প্রেম আমাদের করা হয়ে উঠেনি। সময়ই মিলতো না আমাদের। প্রীতিও কখনো কোন অভিযোগ করেনি। তাই আমিও এতোটা গুরুত্ব দেয় নি। এভাবে করলেই প্রেম হবে,এমনটাতো নয়।
একেকজনের প্রেম, একেক রকম। এখানে ধরাবাঁধা কোন নিয়ম নিশ্চয়ই নেই। আমরা আর দশটা জুটির মত প্রেম করিনি। কিংবা হয়তো আমরা প্রেমই করিনি।
আমরা ভালোবেসেছি।
যে ভালোবাসা আমাদের এক করে দিচ্ছে আজ।
প্রেমটা না হয়,বিয়ের পরেই হলো।
একেবারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে প্রেম করবো। যেখানে কোন হারানোর ভয় থাকবেনা। থাকবেনা কোন সংকোচ।
যেখানে থাকবো, শুধু আমি আর আমার বৃষ্টিপ্রিয়া।

আমি যেটা ভেবেছিলাম, সেটাই হলো। সবাই সব জানে। প্রীতির মা বাবা আমাকে বেশ ভালো করেই চিনতো। আমি কেমন,আচরণ কেমন,সব জানতো। তাই শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকলেও,তারা রাজি হয়ে গেল। যদিও আমি চাকুরীরত অবস্থায় অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছি। আর আমার মা বাবারও প্রীতিকে অপছন্দ করার কোন কারন ছিলো না। প্রীতির গায়ের রঙ শ্যামলা। সেসবে আমার মায়ের কোন সমস্যা থাকবেনা আমি জানি। আমার মায়ের কাছে যেটা বিষয় সেটা হলো ব্যবহার। আর মায়ার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম,প্রীতি আমার মা বাবার সাথে দেখা করেছে। কিন্তু আমাকে বলা হয়নি। আমার গল্পে,আমাকেই সবাই মিলে বোকা বানিয়ে দিলো। জীবন কত বিচিত্র না?

#চলবে…
#জাহান_লিমু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here