#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২২)
ক্লাস শেষ করে বের হলো ভ্রমর। চোখ,মুখে শক্তভাব! কাঁধের ব্যাগ বুকে চাপা দেওয়া। মাটিতে পা ফেলছে শব্দ করে। ফোঁস ফোঁস শব্দে লম্বা বিরতিতে নিশ্বাস ছাড়ছে। কলেজের গেইটের বাইরে এক পা ফেলতে হৃদ্য এগিয়ে আসল। ভ্রমরকে ক্লাসে পাঠিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিল সে। সময় পার করতে বাদাম কিনে খোসা ছাড়াচ্ছিল। হৃদ্য সহজস্বরে বলল,
“নে,বাদাম খা।”
ভ্রমর হৃদ্যের হাতের দিকে তাকাল। তালুতে খোসা ছাড়ানো বাদামের বিচি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খেতে বেশ লাগবে। বাদাম ভ্রমরের খুব পছন্দ। তার জিভ লাফিয়ে ওঠলেও সে চোখ ফিরিয়ে নিল। মুখ বাকিয়ে অন্য দিকে হাঁটা ধরলে হৃদ্য দ্রুত বলল,
“এটা কী হলো?”
ভ্রমর থামল না। হেঁটেই চলেছে। হৃদ্যের দিকে তাকানোর প্রয়োজনও মনে করছে না। হৃদ্য ভ্রমরের পিছ ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
ভ্রমর এবারও উত্তর দিল না। শক্ত চালে হাঁটছে। হৃদ্য আবারও কিছু বলতে চেয়ে থেমে গেল। ভ্রমরের ব্যবহার সন্দেহজনক! এটা তার প্রথম ক্লাস ছিল। কোনো অঘটন ঘটেনি তো? হৃদ্য উদ্বিগ্নচিত্তে ভ্রমরের কাছে ছুটে আসে। কিছুটা সামনে গিয়ে হাঁটছে আর ভ্রমরকে সুক্ষ নজরে পরীক্ষা করছে। ভাব খুব একটা সুবিধার ঠেকছে না। হৃদ্য আর চুপ থাকতে পারল না। জিজ্ঞেস করে বসল,
“কী রে পুচকি? মুখটা অমন প্যাচার মতো করেছিস কেন?”
ভ্রমর থামল। হৃদ্যের দিকে তাকাল। আগুন চাহনি! হৃদ্য খানিকটা ঘাবড়ে গেল। মনে হলো,এই আগুনে সে শেষ! ভস্ম করে দিবে তার শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ। সে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতে ভ্রমর কাঠগলায় বলল,
“Now I’m 18+. So, don’t call me পুচকি।”
হৃদ্যের মুখ হাঁ হয়ে গেল। ক্ষণকাল সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল। ততক্ষণে ভ্রমর কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে। হৃদ্য রসিকতার সুরে বলল,
“বাব্বাহ! একদিন ক্লাস করেই তোর এত উন্নতি? ফটাফট ইংলিশ ছাড়ছিস।”
ভ্রমর সেই পূর্বের আগুন চাহনি নিক্ষেপ করল। তারপর আবারও হাঁটা ধরলে হৃদ্য কাছাকাছি এসে বলল,
“আরে কোথায় যাচ্ছিস বলবি তো? ঐদিকে তোর কিংবা আমার কারো বাসাই থাকার কথা না।”
ভ্রমর থমকাল। এক পলক চারপাশে তাকিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। সত্যিই তো! সে কোথায় যাচ্ছে? রাগের বশে ভুল রাস্তা বেছে নিয়েছে? এখন কী হবে? ভ্রমর ভয় পেল। তবে নরম হলো না। কঠিন স্বরে বলল,
“জাহান্নামে।”
হৃদ্য ভ্রূ কুঁচকে ফেলল। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“ইবলিশের সাথে দেখা হয়েছিল নাকি?”
এ পর্যায়ে ভ্রমরের ভ্রূজোড়াও কুঁচকে এলো। বিরক্ত নিয়ে বলল,
“কেন?”
“কারণ দুনিয়াতে ইবলিশ ছাড়া আর কারো তো জাহান্নামের খোঁজ পাওয়ার কথা না। মানুষের আরো না। কিন্তু তুই পেয়েছিস। যার মানে দাঁড়ায়-”
হৃদ্য কথা শেষ করার পূর্বেই ভ্রমর নিজের ব্যাগটা তার হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর গরম চোখ করে বাসার রাস্তার দিকে হাঁটা ধরল। হৃদ্য কতক্ষণ ব্যাগের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“আজ কি হেঁটে যাওয়ার পণ করেছিস?”
ভ্রমর চোখ পাকিয়ে তাকালে হৃদ্য দমে গেল। কণ্ঠ টেনে টেনে বলল,
“বাসা কিন্তু অনেক দূর!”
ভ্রমর সে কথা কানে নিল না। সে হাঁটছে তো হাঁটছেই। হৃদ্যের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অগত্যা ভ্রমরকে অনুসরণ করে চলেছে। কিছু যে বলবে সে সাহসও পাচ্ছে না। হঠাৎ রণচণ্ডীর রূপ ধারণের কারণ খুঁজছে। বহুক্ষণ ভেবেও যখন পেল না তখন ভ্রমরের সামনে এসে দাঁড়াল। খানিকটা জোরালো গলায় বলল,
“কী হয়েছে বলবি?”
ভ্রমর কঠিন চোখে তাকাল। নিরুত্তরে হৃদ্যকে পাশ কাটাতে চাইলে হৃদ্য হাত বাড়িয়ে পথরোধ করল। এবার নরম স্বরে বলল,
“কী হয়েছে বল না। এমন করছিস কেন?”
ভ্রমর এক দৃষ্টিতে হৃদ্যের দিকে তাকাল। পলকহীন সেই দৃষ্টি স্থায়ী হলো কয়েক সেকেন্ড। অতঃপর হৃদ্যের হাতে দুটো কাগজ দিয়ে বলল,
“তোমার খচ্চর প্রেমিকারা প্রথমদিনও শান্তি দিল না!”
হৃদ্য কাগজ দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানে?”
ভ্রমর চলে যাচ্ছিল। হৃদ্যের প্রশ্নে আবার ফিরে এসে বলল,
“যেখানে প্রেমপত্রের ছড়াছড়ি সেখানে আমি পড়ব না। I want a transfer certificate immediately.”
ভ্রমর কথা শেষ করেই পেট চেপে ধরল। গালদুটো ফুলে আসতে হৃদ্য উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
“কী হয়েছে?”
“তোমার প্রেমিকাদের প্রেমপত্রের গন্ধে বমি আসছে। Please keep distance.”
ভ্রমর সত্যি সত্যি বমি করে দিল। হৃদ্যের উদ্বিগ্ন এবার দ্বিগুন বেড়ে গেল। ভ্রমরকে সামলাতে সামলাতে বিস্মিত মনে ভাবছে,’প্রেমপত্রেরও গন্ধ হয়? বমি পাওয়া গন্ধ!’
ভ্রমরের মাথায় পানি ঢালছে হৃদ্য। সেই সময় ভ্রমর চিৎকার করে বলল,
“Please keep distance!”
হৃদ্য অভিভূত! মনে মনে এই ভেবে ভীষণ খুশি হলো প্রেমপত্র হোক আর যাই হোক,এই কাগজ দুটোর ঐশ্বরিক শক্তি আছে। সেই শক্তির বলে মেয়েটা কী সুন্দর ইংলিশ বলছে! ভ্রমর একটু স্বাভাবিক হলেই কাগজ দুটোতে কয়েকশো চুমু খাওয়ার মানত করে ফেলল।
____________________________
এই মুহূর্তে শ্রাবণ,রিধিদের বাসার নরম সোফাতে বসে আছে। রিধির বাবা আজিজুল হকের জরুরী তলবে এখানে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,যার সাথে দেখা করতে এসেছে সে বাসায় নেই। অফিস থেকে এখনও ফিরেননি। এতে শ্রাবণের একটুও খারাপ লাগছে না। শায়লা হকের আপ্যায়নকে বেশ উপভোগ করছে। এক কাপ চা খেতেই সে আধ ঘন্টা পার করে দিল। বিস্কুট খেতে ভুলেই গেছে। চা খাওয়ার ফাঁকে কত বার যে রিধির রুমের দিকে তাকিয়েছে তার হিসেব নেই। এখনও তো সে সেইদিকেই চেয়ে আছে।
“বাবা,আরেক কাপ চা করে দিব? রিধির বাবার আসতে আরো বিশ,পঁচিশ মিনিট লাগবে।”
শ্রাবণ দ্রুত চোখ ফিরিয়ে আনল শায়লা হকের দিকে। মৃদু হেসে অত্যন্ত বিনয়ী স্বরে বলল,
“না,আন্টি। ঠিক আছে। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমি অপেক্ষা করব।”
শায়লা হক ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন। ছেলেটাকে একলা রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। হৃদ্য বাসায় নেই। থাকলে একটু এখানে বসিয়ে রেখে যেতে পারতেন। তাহলে কি রিধিকে ডেকে দিবে? তিনি শ্রাবণের সামনে আরেক কাপ চা রেখে রিধির রুমের দিকে অগ্রসর হলেন।
পুরো পঁয়ত্রিশ মিনিট পর আজিজুল হক বাসায় ফিরলেন। সোফায় শ্রাবণকে দেখে চট করে ঘড়িতে চোখ রাখলেন। সে কি আসতে দেরি করে ফেলেছে? শ্রাবণকে তো বলেছিল আটটার দিকে আসতে। এর মধ্যে শায়লা হক এসে জানিয়ে গেলেন শ্রাবণ দুই ঘন্টা যাবৎ তাঁর অপেক্ষায় বসে আছে। দেরি করে আসার জন্য কিছু কড়া কথাও শুনিয়ে দিলেন। অথচ ঘড়িতে এখনও আটটা বাজেনি। আজিজুল হকের খুব ভালো করেই মনে পড়ছে শ্রাবণকে আটটার পর আসতে বলেছিলেন। তিনি শ্রাবণের সামনে বসতে বসতে তার মন পড়ে ফেললেন। নিমিষেই তার মন ভার হয়ে আসে। ছেলেটার চোখের অস্থিরতা ধরা পড়ছে। একটিবারের জন্য রিধির দেখা পাওয়ার জন্য মনের কী ব্যাকুলতা! শ্রাবণের সাথে কথা শুরু করার আগে স্ত্রীকে দিয়ে মেয়েকে বসার রুমে ডাক পাঠালেন। আর কিছু না পারুক অত্যন্ত একটিবারের জন্য এই ছেলের চোখদুটোর অস্থিরতাকে শান্ত করতে চান। ব্যাকুল মনের অনুরোধ রাখতে চান। এরপরেই না হয় রিধির কথাগুলো যান্ত্রিকের ন্যায় শ্রাবণের সামনে ফেলবে।
মিনিট দুয়েক পরেই শায়লা হক এসে জানালেন,রিধি পড়ছে। সে পড়া রেখে আসতে পারবে না। এই মুহূর্তে পড়া ছাড়া অন্য কিছুকে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না। আজিজুল হক হতাশ হলেন। নিরাশ চোখে, মলিন মুখে শ্রাবণ বলল,
“আংকেল,জরুরী কিছু বলবেন বলে ডেকেছিলেন।”
আজিজুল হক হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। সময় নিয়ে সবটা গুছিয়ে বলার পর শ্রাবণ খুব সাধারন স্বরে সুধাল,
“রিধি কি ডিভোর্স চাচ্ছে?”
আজিজুল হক কী উত্তর দিবেন বুঝতে পারলেন না। রিধির সিদ্ধান্ত এখনও তার কাছে ধোঁয়াশা। মেয়েটা পরিষ্কার করে তেমন কিছুই বলেনি। তিনি কি নিজ থেকে হ্যাঁ বলে দিবেন? তিনি চৌকসে বললেন,
“তুমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করলে রিধিও করে দিবে।”
শ্রাবণ আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল। নীঃশব্দে সোজা সদর দরজার দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। তার এই অদ্ভুত আচরণে আজিজুল হক হতবাক। শায়লা হক স্বামীর উদ্দেশ্যে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতে শ্রাবণ সহসা বলল,
“আমি কি একটু রিধির সাথে কথা বলতে পারি?”
আজিজুল হক মুখে কিছু বললেন না। হাতের ইশারায় রিধির রুম দেখিয়ে দিলেন।
“ভেতরে আসব?”
রিধি পুরোদমে বইয়ে ডুবে ছিল বিধায় আচমকা পুরুষ কণ্ঠে চমকে ওঠে। পেছন ঘুরে শ্রাবণকে দেখতে ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গেল। শুকনো ঢোক গিলে বইয়ে চোখ রেখে নির্দয়ের মতো বলল,
“না। আমি ব্যস্ত।”
রিধির ধারণা ছিল শ্রাবণ চলে যাবে। কিন্তু না। শ্রাবণ অবাধ্য ছেলের মতো ভেতরে ঢুকল। দরজায় খিল দিয়ে রিধির সম্মুখে এসে বলল,
“আপনার সাথে কথা আছে।”
রিধি ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে প্রকাশ করছে না। অত্যন্ত রূঢ়স্বরে বলল,
“আপনি তো ভারি অভদ্র। বলছি ব্যস্ত আছি,তাও বিরক্ত করছেন। অনুমতি ব্যতীত রুমে ঢুকেছেন কোন সাহসে?”
“উঠুন।”
শ্রাবণের ভারি কণ্ঠের শব্দটি আদেশের মতো ঠেকল রিধির নিকট। সে চোখ সরু করে বলল,
“মানে?”
শ্রাবণ পূর্বের চেয়েও উঁচু গলায় বলল,
“উঠে দাঁড়ান।”
শ্রাবণের আদেশের অমান্য করে রিধি সভয়ে বলল,
“উঠব না। আমার সামনে চঁড়াগলা-”
“উঠুন বলছি!”
শ্রাবণের চিৎকারে রিধি প্রচণ্ড ভয় পায়। লাফিয়ে সটাং দাঁড়িয়ে পড়ল। শ্রাবণ ওর ডান হাতের কব্জী চেপে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আয়নায় দিকে ডান হাতের অঙ্গুলি তাক করে বলল,
“আমার সাধারণ জীবনের সুখ,শান্তি,ঘুম নষ্ট করে এই মেয়েটি মুক্তি চাচ্ছে। আমার কি উচিত তাকে মুক্তি দেওয়া?”
রিধি আড়ষ্ট চাহনি রাখে আয়নায়। অন্য কেউ নয়,শ্রাবণ তার প্রতিচ্ছায়ার উপরেই আঙুল তুলেছে। সত্যিই কি সে এই ছেলেটার জীবনের সুখ,শান্তি কেড়ে নিয়েছে? রিধির নিরবতায় শ্রাবণের রাগ তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। সে মৃদু চিৎকারে বলল,
“চুপ করে থাকবেন না। কিছু বলুন।”
রিধি নিজের প্রতিচ্ছায়া থেকে চোখ সরিয়ে নিল। শ্রাবণের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। মাথা হেঁট করে নিতে শ্রাবণ নিয়ন্ত্রণহীন হলো। অবস্মাৎ প্রচল জোরে ঘুসি বসাল আয়নায়। ভূমি কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল। ভয়ে রিধি হাত দিয়ে দুই কান চেপে ধরে। চোখ মেলতেই দৃষ্টি পড়ে শ্রাবণের মুষ্টিবদ্ধ হাতে। সে আতঙ্কিত স্বরে বলল,
“আপনার হাত থেকে রক্ত ঝরছে!”
#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৩)
পপি টেবিলের উপর প্লেট রাখতে ভ্রমর বলল,
“আমি ভাত খাব না,পপি আপা। নিয়ে যাও।”
পপি এক পলক ভ্রমরের দিকে তাকাল। অন্য হাতে থাকা পানির গ্লাস টেবিলে রেখে বলল,
“খাইয়া লন। ম্যাডামের মেজাজ আজ ঠিক নাই।”
ভ্রমর শোয়া থেকে উঠে বসল। চোখের দুই ধার ফোলা। শঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
“কেন?”
ভ্রমরের চোখে চোখ পড়তে খানিকটা ভয় পেয়ে গেল পপি। চোখ দুটো কিছুটা বড় করে বলল,
“আজও কানছেন? দেইখেন কাঁনতে কাঁনতে একদিন কানা হইয়া যাইবেন।”
পপির কথাকে গুরুত্ব দিল না ভ্রমর। পা দুলিয়ে খাটের কিনারে বসল। বলল,
“আম্মুর কী হয়েছে? তুমি কিছু করছো?”
“না।”
“তাহলে?”
পপি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
“আপনার বাজানের লগে মন কষাকষি চলতাছে।”
কথাটা বলেই পপি রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মুহূর্তেই ভ্রমরের মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠলো। ভেজা রক্তিম চোখদুটিতে ভর করল এক ঝাঁক বিষন্নতা,পাহাড়সম চিন্তা ও সীমাহীন কৌতুহল। বাবা,মায়ের মধ্যে ঝগড়া চলছে খবরটি এই প্রথম শুনেছে ভ্রমর। খরবটি যেমন তার মুখে দুঃখ ভাব এনে দিল তেমন উত্তেজনাও সৃষ্টি করল। হঠাৎই তার মন খারাপ উবে গেল। স্বচক্ষে বাবা,মায়ের ঝগড়া দেখার ইচ্ছে তৈরী হলো। এমন লাগামহীন ইচ্ছে তার আগে কখনও তৈরি হয়েছিল কি? ভ্রমরের মনে পড়ছে না। সে সোজা দরজার কাছে চলে যায়। বুকের ভেতরটায় ধকধকানি চলছে। দরজা খুললেই বসার রুমটা দেখা যাবে। বাবা,মা কি সেখানে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। দরজায় হাত পড়তে তার নিশ্বাস থেমে যায়। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করল,’আম্মু একবার,মাত্র একবার তোমার কথার অবাধ্য হচ্ছি। তুমি কি খুব কষ্ট পাবে? রাগ করবে? আমাকে শাস্তি দিবে? দিও। তবুও তোমাদের দুজনকে আমি একসাথে দেখতে চাই।’
ভ্রমর কাঁপা হাতে দরজা কিছুটা ফাঁক করল। সোফার এক অংশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে ভীত নিশ্বাস ফেলল। শুকনো ঠোঁট কামড়ে ধরে সাবধানে একপা বাইরে ফেলল। দেখতে হলে তাকে বাইরেই আসতে হবে! রুমের বাইরে এসে ভ্রমর হতাশ হলো। আশাহত দৃষ্টি শূন্য সোফাদ্বয়ে। নেই,কেউ নেই! তার ধারণা ভুল। বাবা,মা হয় তো রুমে। ভ্রমর কাঁদোপ্রায় চোখে আরেকবার শূন্য সোফাতে তাকাল। ভাগ্যের উপর আক্ষেপ ছুঁড়ে রুমে ফিরে আসতে পা চালায়। ঠিক তখনি কানে অস্পষ্ট কথা উড়ে আসে। সাথে সাথে ভ্রমরের মস্তিষ্ক সজাগ হয়। আশাপূর্ণ দৃষ্টি রাখে ডান পাশে। ভ্রমর অজান্তেই শব্দ অন্বেষণে নেমে পড়ে। মুখের ভাবভঙ্গি বলছে, আজ দুনিয়া উল্টে গেলেও সে বাবাকে দেখেই ছাড়বে। প্রায় দেখেই ফেলেছিল। মায়ের রুমের দরজা হাঁট করা ছিল। ভ্রমরও তো ছুটে দরজার কাছে যায়। সরাসরি দৃষ্টি ছুঁড়ে ভেতরে। ঠিক তখনি অগ্নিদৃষ্টি তাকে পুড়িয়ে দিল। মনের কঠিন শপথকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। ভ্রমর পুরো জমে গিয়েছে। মায়ের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ!
শরীফা খন্দকার তীরবেগে মেয়ের কাছে ছুটে এলেন। প্রথমে দরজা বাইরে থেকে আটকে দিলেন। মেয়ের হাত শক্ত চাপে ধরে সোজা ভ্রমরের রুমে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখ থেকে যেন অনল ঝরছে। দৃষ্টি বিন্দু পরিমানও পরিবর্তন হয়নি। বরঞ্চ তেজশ্রী হয়েছে। রাগে ঠোঁট কাঁপছে। চাইলেও মেয়েকে কিছু বলতে পারছেন না। এর মধ্যেই পপি পেছনে এসে দাঁড়াল। শরীফা খন্দকার কিছু বলার আগে ভ্রমর বলল,
“পপি আপা,আমাকে একটু নিচে দিয়ে আসবে? আজকে আমি রিধি আপুর সাথে থাকব।”
পপি, শরীফা খন্দকারের দিকে তাকাল। অনুমতি চাইছে। কিন্তু তাঁর অনুমতির তোয়াক্কা করছে না ভ্রমর। সে দিব্যি সহজ চালে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। শরীফা খন্দকার বললেন,
“ওর সাথে যা।”
_____________________
“জানিস রিধি? ছেলেটার হাতে সেলাই পড়েছে। তিন তিনটা সেলাই। তার সাথে জ্বর,ঠান্ডা,গরগরা বমি তো আছেই। অবস্থা খুবই খারাপ। এক সপ্তাহ ধরে হসপিটালে পড়ে আছে!”
চোখ বড় বড় করে খবরটা ঠিক এভাবেই রিধিকে জানিয়েছিল তার মা। তাও কাল রাতে। সেসময় রিধি খুব একটা পাত্তা দেয়নি। খুব সহজভাবেই খেয়েছে,পড়াশোনা করেছে। শেষ রাতের দিকে বাবার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে ঘুমিয়েও পড়েছিল। কিন্তু ব্যাঘাত ঘটল মাঝরাতে। ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে আসতেই এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখল। কী দেখল মনে করতে পারছে না। তবে বিরামহীন ঘাম ঝরছে শরীর থেকে। বার বার গলা শুকিয়ে আসছে। পানি খেয়ে কুল পাচ্ছে না। বিছানার উপর এপাশওপাশ করে রাত কাটিয়ে দিল সে। ভেবেছিল সকালে কুসুম গরম পানিতে গোসল করে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না,কিছু ঠিক হয়নি। মন্দিরের ঘন্টার ন্যায় বার বার মায়ের বলে যাওয়া কথাটাই বাজছে। শ্রাবণের বিষয়টা আপাতত ভুলে থাকার জন্য সে পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক কিছু করল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তিনবেলা রান্না,পুরো বাড়ি পরিষ্কার করা,রিদের ফুলগাছের পরিচর্যা করা। এর মধ্যে সে অনলাইনে দুটো পরীক্ষাও দিয়ে ফেলেছে। এতকিছু করে যখন ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিল। তখনি মায়ের কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে বাজল,’জানিস রিধি,ছেলেটার হাতে সেলাই পড়েছে। তিন তিনটা….’
রিধি বিরক্ত হয়ে উঠে বসল। আলসে দৃষ্টি ফেলল ঘড়িতে। দশটা বেজে কুড়ি। সে কি একবার মায়ের কাছে জানতে চাইবে শ্রাবণ এখন কেমন আছে? ভাবতে ভাবতে রিধি রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। মায়ের রুমের দিকে না গিয়ে হৃদ্যের রুমের সামনে হাজির হলো। আজকাল শ্রাবণের সাথে হৃদ্যের সখ্যতা বাড়ছে। মা ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি কে জানে! তার উপর শ্রাবণের কথা জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা লাগবে। তার থেকে ভালো হৃদ্যের থেকেই জেনে নেওয়া যাক।
“আসব?”
হৃদ্য দরজার দিকে না তাকিয়ে বলল,
“না,বাইরে দাঁড়িয়ে থাক।”
ভাইয়ের এমন মুখের উপর না বলে দেওয়াটা হজম করতে পারল না রিধি। ভ্রূকুটি করে বলল,
“সত্যি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব?”
এবার হৃদ্য বোনের দিকে তাকাল। মৃদু হেসে বলল,
“তোর ভদ্রতা শেষ না হলে দাঁড়িয়ে থাক। শেষ হলে আসতে পারিস।”
রিধি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ভেতরে আসল। হৃদ্যের গায়ে মৃদু কিল বসিয়ে বলল,
“ফাজিল!”
হৃদ্য হেসে বলল,
“তুই ভদ্র হলে,আমি ফাজিল হবই।”
রিধি হেসে ফেলল। বিছানার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বই আর মোবাইল একসাথে? গবেষণা চলছে নাকি?”
হৃদ্য জবাব দিল না। মুঁচকি হাসল। বই আর মোবাইল দুটোই পাশে সরিয়ে রেখে বলল,
“হঠাৎ আমার কাছে? কোনো দরকার?”
রিধি কথা বাড়াতে চাইল না। সরাসরি শ্রাবণের কথা তুলতে চাইল। কিন্তু তার আগেই ভ্রমর এসে উপস্থিত! রিধি বিস্ময় চোখে তাকাল। হৃদ্যও। কিন্তু ভাই এবং বোন দুজনের কেউ ভ্রমরের উদ্দেশ্য কিছু জিজ্ঞেস করল না। দুজনেই দৃষ্টি সরিয়ে আনল। মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। নীরবতা ভেঙে হৃদ্যই বলল,
“আপু,কী জানি বলছিলি?”
রিধি শ্রাবণকে ফেলে হঠাৎ বলল,
“বিয়ে করছিস কবে?”
আপুর কাছ থেকে এমন অপ্রকাশিত প্রশ্নে হৃদ্য বিষম খেল। অপ্রস্তুতি স্বরে বলল,
“বিয়ে?”
“হুম বিয়ে। কবে করছিস?”
হৃদ্য আপুর প্রশ্নটা এড়িয়ে অন্য কিছু বলতে চাইলে রিধি দ্রুত বলল,
“খবরদার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবি না। আমি জানি তুই কাউকে পছন্দ করিস৷ সেটা এখন না,অনেক আগে থেকেই।”
হৃদ্য আমতা আমতা করল কিছুক্ষণ। বোনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে মুক্তি পাবে না বুঝতে পেরে বলল,
“পছন্দ করলেই বিয়ে করতে হবে?”
রিধি ভ্রূ বাকিয়ে বলল,
“পছন্দ একজন,বিয়ের কনে আরেকজন। এমন কিছু চিন্তাভাবনা নাকি?”
হৃদ্য বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“সেটা কখন বললাম?”
“তাহলে বল বিয়ে করছিস কবে?”
“আশ্চর্য! হুট করে বিয়ে চলে এলো কেন? এখনও তো প্রেমই হলো না।”
কথা শেষ করেই জিভে কামড় বসাল হৃদ্য। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। রিধি ধরতে পারলেও ব্যাপারটা এড়িয়ে বলল,
“বিয়ের পরে হবে।”
হৃদ্য মাথা দুইদিকে নাড়িয়ে বলল,
“তুই পাগল হয়ে গেছিস,আপু!”
হৃদ্য একহাতে ফোন অন্যহাতে বই নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। সেখান থেকে লুকিয়ে ভ্রমরের দিকে তাকাল। আপনমনে বলল,’কাকে বিয়ে করব,আপু? মেয়ের তো বয়স বাড়ছে,শরীর বাড়ছে কিন্তু বুদ্ধি বাড়ছে না!’
রিধি চলে যাচ্ছে। তার পেছন পেছন ভ্রমরও যাচ্ছে। হৃদ্য মৃদু স্বরে ডাকল,
“ফুলপরি?”
উত্তর এল না। কেউ ফিরেও তাকাল না। হৃদ্য সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“ভ্রমর?”
এবারও কেউ ফিরে তাকাল না। হৃদ্য নিজ মনে প্রশ্ন করে বসল,’ফুলপরি না,ভ্রমরও না। তাহলে এই মেয়ে কে? ভ্রমরের মতো দেখতে তৃতীয় কেউ?’
______________________________
“তুই নিশ্চিত আজ আমার সাথে ঘুমাবি?”
রিধির প্রশ্নে ভ্রমর ভার কণ্ঠে বলল,
“হুম। যদি তোমার অসুবিধা না হয়।”
রিধি কিছুক্ষণ সুক্ষ দৃষ্টি রাখল ভ্রমরের উপর। মুখটা বড্ড শুকনো। চোখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। কণ্ঠ বসে আছে। আবার বলছে তার সাথে থাকবে। এই মা পাগল মেয়েটা সত্যি সত্যি তার কাছে থাকবে? রিধি বিশ্বাস করতে চাইছে না। সে ধরেই নিল মাঝরাতে উঠে চলে যাবে।
“তাহলে শুয়ে পড়। লাইট থাকবে নাকি নেভাব?”
“তোমার ইচ্ছে।”
কথাটা বলেই ভ্রমর ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বিড়ালের মতো হাত-পা গুটিয়ে নিতে রিধি পাতলা চাদর শরীরে জড়িয়ে দিল। ভ্রমর সামান্য নড়ল তবে চোখ মেলল না। রিধি সাদা আলো নিভিয়ে নীল আলো জ্বালিয়ে ভ্রমরের পাশে শুয়ে পড়ল। মিনিট কয়েক পেরোতেই ভ্রমর বিছানা থেকে নামল। গুটিগুটি পায়ে হাজির হলো হৃদ্যের বেলকনিতে।
“মানুষছেলে আমি কি তোমার পাশে একটু বসতে পারি?”
মাঝরাতে এমন সুমিষ্ট নারী কণ্ঠে হৃদ্য চমকে উঠল। হাত থেকে বই পড়ে গিয়েছে। ভ্রমর বইটা হৃদ্যের হাতে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা বসব না।”
হৃদ্য গাঢ় অভিমানের ছোঁয়া পেল। ভ্রমর রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে বলল,
“মানুষছেলে,দেখ তো তোমার পুষ্পবাগের পুষ্পগুলোর মন খারাপ নাকি?”
হৃদ্যের চোখ অন্য দিকে সরল না। সে ভ্রমরের কাছে এসে দাঁড়াল। কাঁধে আলতো করে হাত রাখল। সাথে সাথে ভ্রমর হৃদ্যের বুকে আঁচড়ে পড়ল। ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিল!
চলবে
চলবে
[গল্পটি আগের মতোই একদিন পরপর দিব। পর্বগুলো একটু ছোট হতে পারে। আরো কয়েকদিন ব্যস্ত থাকব আমি। ব্যস্ত থাকার কারণটা আপাতত বলছি না। সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দিলাম। অনেক দিন পর গল্প নিয়ে হাজির হলাম। কেউ কুণ্ঠাবোধ করবেন না। অবশ্যই মন্তব্য করবেন। সবার জন্য ভালোবাসা❤️]