#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া
২
সকালের আলো চারদিক আলোকিত করে তুলেছে। কিন্তু তার অন্ধকার জীবনে এই দিনের আলো আলোকিত করতে পারবে না। হেটে হেটেই তূবা ওখান থেকে এসেছে। ভেতরের মাঝে কি যে চলছে। নিজের উপর ঘৃণা হলেও তাচ্ছিল্য হেসে তা উড়িয়ে দিল। ব্যাগ থেকে খাম টা বের করে তূবা টাকা গুলি হাতে নিল। গুনে দেখল ৩০ হাজার টাকা। খুব অবাক হয় সে। এত টাকা? এক রাতের বিনিময়ে ৩০ হাজার টাকা কি করে দিল ভাবছে তূবা। “ঠিকি মনে করেছিলাম এই লোক সুস্থ নয়।” টাকার দিকে তাকিয়ে বুক ভরা কষ্ট নিয়েও খুশিতে তূবা হেসে উঠল। লোকটা কে নিয়ে ভাবছে সে। আহ কি দুনিয়া আর দুনিয়ার লোক। তূবা আবারও হেটে চলে বাড়ির দিকে।
লিলা কল ধরছে না। আহফিন রাগে ফোন টা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলল।
“ডেমিট কাল বেশি ড্রিংক হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটার নাম পরিচয় কিছুই জানা হলো না। আর এই লিলা পিলা কেন কল ধরছে না।”
নিজের অস্থিরতা দেখে আহফিন নিজেকেই প্রশ্ন করল
“ওয়েট আমি মেয়েটার জন্যে এমন করছি কেন? ওর কাজ করেছে টাকা নিয়ে গেছে ব্যস। কিন্তু..”
থেমে গেল আহফিন। আবার বিড়বিড় করতে লাগল।
“দেখে তো ভদ্রই মনে হয়েছে। ওমন মেয়ে এসব কেন করব? প্রথমই বোধহয় আমার কাছে নিজেকে তুলে দিয়েছে। ঘটনা এমনটাই সাক্ষী দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার মুখ বিষণ্ণ ছিল। কৌতূহলও ছিল। সবচেয়ে বড় কথা সে মায়াবী ছিল।”
তূবা সকালের খাবার নিয়ে যায়। সাথে বাড়িতে যা যা ছিল না সব। যেটা জরুরি তা হলো বোনের ঔষধ। বাড়ি ঢুকতেই শিরিন বলে উঠলেন।
“এত বাজার কই থেইকা আনছোস?”
“দেখে নাও যা যা লাগবে সব আছে কি না।”
“আমি তোরে কি জিগাইলাম?”
ব্যাগ থেকে তূবা ১০ হাজার টাকা বের করে শিরিনের হাতে তুলে দিল। আর বলল
“এই টাকা টা রাখো। যা দরকার খরচ করো আর বাকিটা তুসির চিৎকার জন্যে রেখে দাও।”
এত টাকা পেয়ে শিরিন অবাক।
“ওত টাকা কই পাইছোস তুই? হ্যাঁ রে তূবা হাছা কইরা কো তো আমারে।”
“টাকার দরকার এনে দিয়েছি। কোথা থেকে আনছি তা দেখার বা জানার দরকার নেই। নাস্তা এনেছি দেখো ওখানে।”
তূবা সুরসুর করে চলে গেল সোজা বাথরুমে। শাওয়ারের নিচে বসে ভিজতে লাগল। নিঃশব্দে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পরতে লাগল মুখ বেয়ে। দেখার শুনার বুঝার কেউ নেই। তার জীবন টা খুব অসহায়।
এটাই তার ভাগ্য।
লিলা কে কল করেই যাচ্ছে আহফিন কিন্তু তুলার নাম নেই। অবশেষে ঘুম জড়ানো কন্ঠে সে বলে উঠল
“আব্বে কে রে শালা ঘুমটাই নষ্ট করে দিলি।”
“আমি আহফিন চৌধুরী বলছি।”
লাফ দিয়ে লিলা বিছানা ছেড়ে উঠে বসল।
“আপনি? বলুন স্যার কি বলবেন?”
“কাল যে মেয়েটাকে আপনি পাঠিয়েছিলেন আমি তার নাম ঠিকানা জানতে চাই।”
“…
“কি হলো?”
“আমি আপনাকে ম্যাসেজ করে বলে দিচ্ছি সব।”
“তাড়াতাড়ি করবেন।”
“হুম।”
লিলা ফোন রেখে দুম মেরে বসে ছিল কিছুক্ষণ।
তূবা অনেক সময় পাড় করে বাথরুম থেকে ফিরে এলো। তার বোন তুসি এখনো ঘুমাচ্ছে। তূবা তার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। ফোনে কল আসতেই ব্যাগ থেকে বের করে রিসিভ করল।
“হ্যালো লিলা আপু বলো। আমি তোমাকে কল করতাম।”
“তূবা তুই কপিশপে আয় দেখা করব।”
“আচ্ছা।”
বলতেই লাইন কেটে গেল। তূবা ফোন রেখে বিছানায় বসে পরল। শরীর টা বড্ডা ক্লান্ত লাগছে, সারা শরীরে ব্যথা। শিরিন এসে বললেন
“খাইতি না?”
“না খিদে নেই তেমন।”
“তাইলে ডাব্বামারা খাওন আনছোস কেরে?”
“তোমরা খাও।”
“তূবা সত্য কইরা কো তো তুই কি কাম পাইছোস এহন?”
“তোমায় বলছি তো এত কিছু জানতে হবে না তোমার। আমি এখন থেকে নাইট ডিউটির একটা চাকরি পেয়েছি। বাঁচতে হলে সেটাই করতে হবে।”
শিরিন রাগে তূবা কে বাজে ভাবে কিছু কথা বলে চলে গেলেন। এতে তূবা কষ্ট পেল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিল। নিজের মা হলে বোধ হয় আরো বেশি বলতো জেরা করত।
শিরিন তূবার সৎ মা। শিরিনের মেয়েই তুসি। কিন্তু তূবা নিজের বোনই মনে করে তাকে খুব আদর করে। তুসিও তূবা বলতে প্রাণ। তূবার বাবা এক বছর হয় মারা গেছেন। দুঃখের ভয়াবহ সময় তখন থেকেই শুরু।
তূবার দিকে তাকিয়ে লিলা বলে উঠল।
“কিছু খেয়েছিস?”
“না খিদে নেই।”
“আরে কোনো পিল খেয়েছিস?”
“…
লিলা ব্যাগ থেকে একটা ইমার্জেন্সি পিল এগিয়ে দিল।
“এটা খেয়ে নেয়।”
তূবা বিনাবাক্যে তা খেয়ে নিল।
“লোকটা আমায় কল দিয়েছিল।”
“….
“তোর নাম ঠিকানা চেয়েছে।”
তূবা ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইল লিলার দিকে।
“আমি একটু আগেই তোর নাম্বার দিলাম।”
“…
তূবা তখনো চুপ।
“উনি হয়তো তোকে আবার ডাকতে পারেন।”
তূবা এবার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসল।
“লিলা আপু উনি এক রাতে আমাকে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছেন।”
“দিবেই বড়লোক উনি। টাকার অভাব তেমন নেই।”
“এই টাকা টা তুমি রাখো।”
“ওটা তোর কাছেই রেখে নে। দরকারে কাজে লাগবে। আর আমাকে এখন উঠতে হবে। বিষয়টা সুন্দর করে সামলে নিস। রাহান কল দিচ্ছে বারবার।”
“আচ্ছা।”
তূবা কপিশপ থেকে বের হবে তার আগেই ফোনে কল এলো।
“হ্যালো।”
“তূবা বলছো?”
“….
“হ্যালো।”
“বলুন।”
“রাতে গাড়ি পাঠিয়ে দিব তোমার বাসার সামনে চলে এসো।”
তূবা কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে বলল
“বাসার সামনে গাড়ি পাঠাতে হবে না। আমি চলে যেতে পারব।”
আহফিন কিছু না বলে কল কেটে দেয়। তূবা ফোনের দিকে তাকিয়ে সেটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রওনা দিল। গিয়ে একটা ঘুম দিবে। রাত দিন না ঘুমিয়ে তো আর মানুষ বাঁচে না।
তূবা হাটছে। তার মনে প্রশ্ন ঘুরছে। লোকটা কেন বলল সে ভার্জিন? ধর্ষিতা কি ভার্জিন হয়? তূবা কিছু মেলাতে পারছে না। মাথা ব্যথা উঠে গেছে তার এত চিন্তায়।
বিকাল বেলা তূবা ঘুম থেকে উঠল। তুসি তখন হুইল চেয়ারে বসে ছিল।
“আপা তোমার ঘুম হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ বোন।”
“আমি এখনো খাই নি। উঠো একসাথে খাবো।”
“সে কি তুই এখনো খাস নি? এতক্ষণ না খেয়ে ছিলি কেন?”
শিরিন এসে বললেন,
“কত কইরা কইছি ভাত খাইয়া ঔষধ খা খাইলোই না তোর লাইগা। কইছি ডাক দেই এইডাতেওও হে না করছে।”
“তুসি না কখনো এমন করবি না।”
“আম্মা যাও আমার আর আপার জন্যে ভাত নিয়া আসো।”
শিরিন চলে গেলেন খাবার আনতে।
ঘড়ির কাটা যখন সাতটায় তখন আহফিনের নাম্বার থেকে কল এলো। বাটন ফোনের ছোট্ট স্কিনে অন্ধকার নাম ভাসল। তূবা কল ধরেই বলল “আসছি।” তারপরই কল কেটে দিল। বের হওয়ার সময় তুসি বলল,
“আপা কই যাও?”
“কাজে।”
“রাতে কিসের কাজ আপা?”
তূবার বলতে ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে কোনো রকম বলল,
“নাইট ডিউটি। তুই বুঝবি না। আর আমার ফিরতে সকাল হবে খেয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমাবি কিন্তু।”
“আপা”
“বল। তোর কিছু লাগবে?”
“তোমার অনেক কষ্ট হয় না সারারাত কাজ করতে?”
বুক ফেটে আসছিল তূবার। শুকনো হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে তূবা বলল “না তুসি। আমি আমার বোনের জন্যে সব করতে পারি। আসছি। আমার লক্ষ্মী বোন।”
তূবা তুসির কপালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কান্না সব গলায় এসে দলা পাকিয়ে গেছে কষ্ট হচ্ছে খুব। কিন্তু দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে দিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে চলল। কুচকুচে অন্ধকার এক গন্তব্য।
চলবে♥