স্বপ্ন পর্ব ৯

#স্বপ্ন
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ০৯

— “বৃষ্টি, এই বৃষ্টি, বৃষ্টিই!”

রাত ১ টা কি দেড় টা বাজে। বোঝা যাচ্ছে না। বৃষ্টি ঘুমাবে না পণ করেই গেমস খেলতে বসেছিল। নতুন গেমস বানানোর যত আইডিয়া মাথায় আসছিল সবগুলোই কোন না কোন ভাবে অন্য গেমের সাথে মিলে যাচ্ছে; পরোক্ষ ভাবেই। তাই রাগে আর কিছু না ভেবে কম্পিউটার ধরেছিল। কোলের উপর ল্যাপটপটা রেখে পুরো মনোযোগ গেমের ভিতর রেখেছিল। তাই সময়ের দিকেও খেয়াল নেই। খেলতে বসেছিল ১১ টার দিকেই। কিন্তু হঠাৎ কারো কণ্ঠে নিজের নাম শুনতে পেয়েও সেদিকে নজর দেয়নি। মনের ভুল ভেবে আরও ১০-১৫ মিনিট খেলেছে। কিন্তু এবার নিজের নামে ডাকার পাশাপাশি ব্যক্তি দরজায়ও নক করছে। তাই বৃষ্টি বাধ্য হলো উঠে পড়তে। অন্ধকার রুম হওয়ায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেল দুবার। তারপর কোন মতে দরজা খুলতেই নিশান্ত হামলে পড়ল তার উপর যেন।

— “কখন থেকে ডাকছি, শুনতে পান না?”

— “জনাব নিশান্ত কি রাগ করেছেন? আপনি করে ডাকা ধরলেন আমাকে।”

— “অবশ্যই, জনাব রাগ করেছেন। কিন্তু সেসব বাদ দেও। কি করছ এখন?”

বৃষ্টি নিশান্তের প্রশ্নে দরজার সামনে থেকে সরে পিছনের দিকে তাকাল। নিশান্তও তার দৃষ্টি অনুসরণ করল। বৃষ্টি আবার সামনে ঘুরতেই নিশান্ত বলে,

— “আবার নিজের আবিষ্কার নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছ?”

— “না, গেম খেলছিলাম।”

— “তোমার ফোনটা নিয়ে উপরে ছাদে চলে আসো।”

— “ছাদে তালা ঝুলছে এখন। ছাদের কাজ চলছে।”

— “চাবি নিয়ে এসেছি। কথা না বাড়িয়ে চলে এসো। আর আসার সময় ফোনটা নিয়ে এসো।”

বলেই নিশান্ত সেখান থেকে চলে গেল। বৃষ্টি অন্ধকারের মধ্যেই তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল নিশান্ত পড়ে গেল কিনা হাঁটার সময়। সে নিজের যখন নিশান্তের জন্য দরজা খুলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছে, তেমনই নিশান্তেরও একবার তো পড়া উচিত। কিন্তু বৃষ্টি নিশান্তের হাঁটার কোন শব্দই পেল না। পড়ে যাওয়া তো দুরের কথা!

বেশি না ভেবে নিজের আধা খেলা গেমটা সেভ করে রেখে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল। তারপর ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে ছাদের জন্য পা বাড়াল। অন্তত জেনে শুনে আবার পায়ে ব্যথা পেতে চায় না সে অন্ধকারে।

ছাদে যেতেই অবাক হলো বৃষ্টি। মাঝে একটা চাদর বিছিয়ে তার উপর বসে আছে নিশান্ত। তার সামনেই একটা মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির নিচে প্লেট দেখে হাসল বৃষ্টি। হয়তো হুট করেই এসব করেছে। বেচারা রাতেই এই প্লেটে খাবার খেলো। আর এখন মোমবাতি রাখছে। বৃষ্টি সেখানে গিয়ে
নিশান্তের থেকে দুরুত্ব বজায় রেখে বসে পড়ল। আর নকল রাগ দেখিয়ে বলল,

— “প্লেটের উপর যে রেখেছেন এটা, পড়ে কিছু হয়ে গেলে কি করবেন?”

— “আমাদের বিয়েতে এই প্লেটটা যৌতুক হিসেবে চেয়ে নেব। আর কিছু নেব না। শেষ।”

— “আবার চাপা।”

— “আমার অনুভূতিকে তুমি এভাবে অপমান করতে পারো না বৃষ্টি।”

বৃষ্টি নিশান্তের কথা বলার ধরণ শুনে হাসল।

— “আজ সকালেই যেই মেয়েটাকে পটানোর চেষ্টা করলেন, সেটা কি ছিল?”

— “তুমি কি জেলাস?”

এবার দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করল নিশান্ত। বৃষ্টি আড়চোখে তাকাল সেকেন্ডের জন্য। নিশান্ত প্রতিবার এই লাইনটা বলার সময় অন্যরকম হয়ে যায়। তখন তার চোখের দিকে তাকাতে পারে না বৃষ্টি। চোখটা মোমবাতির জ্বলন্ত শিখার দিকের স্থির রেখে সে বলল,

— “আমি তো আর আপনাকে বিয়ে করছি না, আমি জেলাস হবো কেন?”

— “দুদিন আগেও তো তুমি বললে তুমি আমার শান্তর মা হবে।”

— “ওটা কথা জালে ফাসিয়েছিলেন আমায়।”

— “সত্যিই কি হবে না আমার শান্তর মা?”

— “কি জন্য ডেকেছেন সেটা বলুন।”

নিশান্তের খেয়াল হলো সে আবার অপ্রাসঙ্গিক কথায় চলে গিয়ে সময় নষ্ট করছে। তাই মূল কথায় ফিরল সে।

–“আবিরের নাম্বার আছে না তোমার কাছে?”

— “হ্যাঁ, আছে। কিন্তু কেন?”

— “তাকে এখন তুমি ম্যাসেজ করে বলবে- তুমি তার সাথে দেখা করতে চাও। খুব জরুরি। বলো কেউ তোমাকে তার ব্যাপারে কিছু এমন কথা বলেছে যেটা তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না বা বুঝতে পারছ না।”

— “কিন্তু আমি ওর সামনে যাব কি করে?”

— “ভয় পাও ওকে?”

— “জানি না, কিন্তু ওর সামনে থাকলে আমার কেমন লাগে জানি। মানে…”

নিশান্ত বৃষ্টির মুখটা দুই হাত দিয়ে ধরল। নিজের হাতের কাছে বৃষ্টির মুখটা খুব ছোট মনে হলো তার। ভেবেই হেসে ফেলল সে।

— “হাসছেন কেন?”

হুঁশ ফিরল নিশান্তের। সে আবার বাইরের বিষয়ে চলে যাচ্ছিল।

— “আমি থাকব তো তোমার সাথে বাবা।”

— “আমি আপনার বাবা?”

— “না বাবা, এখন হবু বউ, আর কয়েক দিন পর পার্মানেন্ট বউ। এবার কাজের কথায় আসি। আমি বলেছিলাম না তোমার সমস্যার সমাধান করব। আমি কিন্তু পেয়ে গিয়েছি সমাধান।”

— “কি সমাধান?”

নিশান্ত এর উত্তরে কিছু বলল না। নিজের কাঁধে হাত রেখে ইশারায় বৃষ্টিকে সেখানে মাথা রাখতে বলল। বৃষ্টি না করলেও পরে নিশান্তের কাঁধেই মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

— “বললেন না তো কি সমাধান।”

— “সময় হলে বলে দিব। বেশি দেরি করব না।”

— “আজ যদি আবার কোন স্বপ্ন দেখি?”

নিশান্ত এবারও চুপ থেকেই বৃষ্টি হাতের আঙুলে নিজের ৫ আঙুলে গলিয়ে দিল। মুঠ করে ধরেই চুপ করে বসে থাকল। কিন্তু বৃষ্টি চুপ থাকতে দিলে তো!

— “আপনি গ্লাভস পরে রেখেছেন কেন?”

— “আসলে… থাক, না বলি। নাহলে তুমি লজ্জা পাবে। আমি কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যাই এখ…”

— “আপনি না বড্ড পাজি।”
‘বৃষ্টি চুপ করে থাকতেই থাকতেই একসময় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল। নিশান্ত নিজের কাঁধটা হালকা নামাল যাতে বৃষ্টির মাথা রাখতে সমস্যা না হয়। সেভাবে বসে থাকতে নিশান্তের খুব বেশি সমস্যাও হলো না অভ্যাস থাকায়। মেয়েটার শান্তির ঘুম বড্ড প্রয়োজন। নিশান্ত আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে একটু পাগলামি করে ফেলল।

নিজের মুখটা বৃষ্টির কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল সে,

“আজ তুমি আরামে ঘুমাও আমার শান্তর মা। আর আমকে স্বপ্নে দেখ। ঠিক আছে?”

অদ্ভুত ভাবে বৃষ্টি ঘুমের মধ্যেও উপর নিচ মাথা নাড়ল।

‘মেয়েটা কি ঘুমায়নি?’

প্রশ্নটা মনেই থেকে গেল নিশান্তের।

_____

গত রাতে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে আবিরকে ম্যাসেজ পাঠানো হয়নি। আজ সকাল সকালই ঘুম থেকে বৃষ্টিকে তুলে কাজটা করিয়ে নিয়েছে নিশান্ত। তারপর আবার তাকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে আরও একটু ঘুমাতে। কিন্তু ঘুমায়নি বৃষ্টি। পুরোটা সময় গেম খেলে তারপর ঘর থেকে বের হয়েছে খাবার খাওয়ার জন্য। তারপর খাবার শেষে তৈরি হয়ে একেবারে অফিসের জন্য বের হয় সে। নিশান্তের সাথে যাওয়ার মাঝ পথে তার মনে পড়ে আজ তো ছুটির দিন। সে নিশান্তকে তাড়া দিয়ে বলে,

— “আজ শুক্রবার না?”

— “হ্যাঁ।”

— “আজ তো ছুটি, আমরা বের হচ্ছি কেন?”

— “বৃষ্টি, শুধু ভাবো, চারদিকে গাছ আর গাছ, গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলি…”

— “পাতা ছাড়া গাছ আর কাকের কা কা ডাক। ভাবলাম।”

— “মজা না, সিরিয়াস হও আর ভাবো। সামনে নদী। আর সেখানে সারি দিয়ে বেঁধে রাখা কয়েকটা নৌকা।”

— “নদীতে ময়লা পানি আর ভাঙা নৌকা।”

— “বৃষ্টি, জাস্ট ইমাজিন করো আমার কথা। বেশি ভেবো না। তারপর কোথায় ছিলাম যেন?”

— “ভাঙা নৌকা।”

— “ওহ হ্যাঁ, সারি দিয়ে নৌকা। বাতাসে মিষ্টি সুবাস। গাছের পাশেই একটা বেঞ্চ আর সেখানে তুমি আর আমি বসে আছি। হাতে হাত রেখে, তোমার মাথা আমার কাঁধে, ঠিক গত রাতের মতো।”

— “গত রাত দিয়ে ভালো কথা মনে করিয়েছেন। প্লেটের কি অবস্থা এখন? মোমবাতির জন্য নষ্ট হয়নি তো?”

— “ধুর, এই জন্যই তো অন্য মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করি। আমার কথা শুনতেই চাও না তুমি।”

— “ওলে বাবা। যাক আগে আসল কথা বলেন। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

— “ঘুরতে যাচ্ছি আমরা, একটা রোম্যান্টিক জায়গায়।”

— “ময়লা নদী। রাগ উঠাবেন না। ঠিক করে বলুন।”

— “আবিরের সাথে কোলাকুলি করতে।”

আবিরের নাম শুনে চুপ করে রইল বৃষ্টি। আর কোন কথা বলল না।

একটা সময় রিকশা থেমে গেলে বৃষ্টি নেমে পড়ে। নিশান্ত ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা ধরলে বৃষ্টিও তার পিছু নেয় নিরবে। নিশান্ত থেমে যেতেই বৃষ্টিও থেমে যায়। সামনে চোখ বুলিয়ে দেখে ওরা একটা ঘরে এসে থেমেছে। বিশাল কক্ষ কিন্তু আশেপাশে কিছুই নেই। শুধু দেওয়ালের সাথে কিছু বেঞ্চ রাখা। দেওয়ালে রয়েছে উল্টোপাল্টা নকশা। কালার স্প্রে দিয়ে। সামনে তাকাতেই ভ্রূ কুঁচকে এলো বৃষ্টির। কক্ষের মাঝ বরাবর একটা বর্গাকার টেবিল রাখা। তার দুই পাশে বরাবর দুটো চেয়ার রাখা। একটায় আবিরকে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার সামনে ও পেছনে ৩ টে লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওরা যেন ওদের অপেক্ষাই করছিল এতক্ষণ। বৃষ্টি নিজের বাম হাতে থাকা হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। আবিরের সাথে ১১ টায় দেখা করার কথা। এখন ১১ টা ২৩ বাজে। সে আবার নিশান্তের দিকে তাকাল। নিশান সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। হাতও মেলাল তারা। নিশান্তের কথা শুনে বুঝতে পারল ছেলেটার নাম প্রান্ত। কিন্তু তারা এখানে এসেছে কেন?

চলবে।

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here