#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২৫
বেলার কান্না আর আকুতিতে শাম্মীর মন খানিকটা নরম হলো। তিনি বেলাকে অনেক কষ্টে শান্ত করে নাইমুদ্দীন সাহেবকে ফোন দিবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। সেই সাথে তিনি এই বিষয়েও পরিষ্কার হলেন যে, বেলা তাঁর বরকে কতটা ভালোবাসে। নাইমুদ্দীন সাহেব হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। নয়তো কি তিনি এতোটা কঠোর হতেন? শাম্মী নিজের ফোনটা নিয়ে বেলার বাবার নম্বরে কল করলেন। দু-বার রিং হয়ে কেটে গেলো। তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চমবারের মাথায়ও নাইমুদ্দীন সাহেবের ফোন রিসিভ হলো না। শাম্মী ফোন কানে নিয়েই বেলার দিকে তাকালেন। আড়ষ্ট গলায় বললেন, ‘রিসিভ করছে না ফোন।’
বেলা অস্থির হয়ে পড়লো, ‘আবার চেষ্টা করুন না ফুপি।’
বেলার কথায় শাম্মী আবারও ফোন করলেন, কিন্তু এবারও ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেলো না৷ শাম্মী ফোন রেখে দিয়ে বেলাকে বললেন, ‘চিন্তা করো না। রাত অনেক হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো!’
‘কিন্তু ওনার অবস্থা তো আমার জানতে হবে। আপনি জানেন ফুপি? আব্বু আপনাকে কিছু বলেনি?’
‘ভাই তো তাড়ায় ছিলো। তোমার বিষয়ে টুকটাক কথা বলেছে, তোমার হাজব্যান্ডের কথা অবশ্য বলেনি। যা বলেছিলো তা ফোনেই সীমাবদ্ধ ছিল।’
বেলা ভাবতে পারছে না কিছু। বড় করে শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা কোথায় আন্টি?’
‘মোহাম্মদপুর।’
বেলা ঠান্ডা মাথায় ভাবলো মোহাম্মদপুর থেকে ধানমন্ডি যেতে খুব একটা বেশি সময় লাগবে না। তাছাড়া রাত হওয়ায় যানজট থাকার সম্ভাবনাও নেই। বেলা বসা থেকে সটান উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। গায়ের ওড়না গোছাতে গোছাতে বলল,
‘আমি এখন যাবো ফুপি। নিয়ে চলুন আমাকে।’
শাম্মী আঁৎকে উঠে বললেন, ‘সেকী! এত রাতে কোথায় যাবে তুমি?’
‘আমি ওনার কাছে যাবো। আমাকে নিয়ে চলুন ফুপি, আমার খুব ভয় করছে, ওনি আমাকে না দেখতে পেয়ে না জানি কি অবস্থা করছেন। থাকতে পারবে না আমাকে না দেখে। আমার সেখানে থাকতে হবে যে-কোনো মূল্যেই..!’
শাম্মী বলল, ‘এখন যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই মা।’
বেলা বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কেন ফুপি? আচ্ছা ঠিক আছে। আপনাদের যেতে হবে না। প্লিজ আমাকে যেতে দিন, আমি একাই যেতে পারবো।’
শাম্মী কপালে ভাঁজ ফেলে বেলাকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘এটা ঠিক হবে না মা। এত রাতে তোমার একা যাওয়াটা রিস্কি। তাছাড়া তোমার হেলথের কন্ডিশন ভালো নয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপে তুমি স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা হারিয়েছো। আর ভেবে দেখো, তুমি যাঁর জন্য এমন করছো সে যদি তোমাকে এই অবস্থায় দেখে তাহলে কী কষ্ট পাবে না? তোমার উদ্বিগ্নতাই প্রমাণ করে দিচ্ছে তুমি তাঁকে কতোটা ভালোবাসো। আর ভালোবাসার মানুষটার সামান্যতম কষ্ট কেউ মেনে নিতে পারে না। সেখানে তোমার হাজব্যান্ড যখন দেখবে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী নিজের প্রতি খেয়াল রাখেনি তাহলে সে কী ভাববে? তোমার যেমন কষ্ট হচ্ছে তাঁর ও নিশ্চয়ই তেমনই লাগবে। তোমার তো আরও স্ট্রং হতে হবে তাইনা? ওর সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে জানান দিতে হবে ওর জন্য তুমি ভেঙে পড়োনি, বরং ভালোবাসার জোরে আরও সাহসী হয়ে উঠেছো। আমার বিশ্বাস, তোমার হাসিমুখটাই ওর কাছে সবচেয়ে দামী। কী ঠিক বললাম তো?’
বেলা সম্পূর্ণ কথাটা মনোযোগের সহিত শুনলো। তারপর অসহায় কন্ঠে বলল, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না ফুপি, আব্বু ফোন ধরছেন না। আমি কোথা থেকে খোঁজ নিবো ওনার? আমার শুধুমাত্র ওনার খোঁজ চাই যেকোনো মূল্যে।’
বলতে বলতে বেলা কেঁদে ফেললো৷ শাম্মী মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। নাইমুদ্দীন সাহেবের ওপর রাগ উঠছে খুব। অবশ্য রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কোনো বুদ্ধিমান, বিবেকমান মানুষ কী এরকম কাজ করে? নাজনীন বেগমের মতো মহিলার কথা বিশ্বাস করে নিজের মেয়ের সংসার ভাঙতে উঠেপড়ে লাগে? নাইমুদ্দীন সাহেব এক্ষেত্রে বোকার পরিচয় দিয়েছেন। যদি শাইনির কিছু হয় তাহলে বাবাকে কোনোদিনও সে ক্ষমা করতে পারবে না।শাইনির জন্য চিন্তায় চিন্তায় মরে যাচ্ছে বেলা। হৃদযন্ত্র নামক অঙ্গটা রকেটের গতিতে ছুটে চলেছে। দ্রিমদ্রিম করে শব্দ তুলছে ছন্দের মতো। এভাবে মানুষ বাঁচতে পারে? একটুর জন্য হলেও শাইনির মুখটা না দেখলে বেলা বোধহয় মরেই যাবে! অবশ্য শাম্মীর কথাগুলোও ঠিক। বেলার এই অসুস্থ চেহারা নিয়ে শাইনির সামনে দাঁড়ালে ও ঠিকই কষ্ট পাবে। নিজেকে মনে মনে দোষী ভাববে। কী করবে বেলা এখন?
রাত বারোটা। প্রতিটি মিনিট, সেকেন্ড অস্থিরতায় কাটছে বেলার। শাম্মী ঘরে নেই। বেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শাইনির কথা ভাবছে। গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে সেদিকে ওর খেয়াল নেই। তখনই পেছন থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ শোনা গেল, ‘আপনি ঠিক আছেন এখন?’
বেলা তাকিয়ে দেখলো লম্বাচওড়া একজন যুবক ওর বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ব্লেজার, মুখে ক্রুর হাসি। দৃষ্টি বেলার ওপর। এ আবার কে? বিরক্তি চেপে বেলা বিষন্ন গলায় বলল, ‘জি। আমি ঠিক আছি। আপনি কে?’
প্রশ্ন শুনে যুবকটি মাথা হেলিয়ে উত্তর দিল , ‘আমি আরাফাত। আপনার শাম্মী ফুপি, ওনি আমার আম্মু।’
বেলার তখন মনে পড়লো শাম্মীর ছেলের কথা, ‘আপনি ফুপির ছেলে?’
যুবকটি সহাস্যে উত্তর দিল, ‘জি।’
‘ওহ। আমি বেলা।’
‘জানি আমি।’
বেলা আরকিছু বললো না। ও এখন একা থাকতে চাইছে।
‘আপনি বোধহয় আমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি নন?’
বেলা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘একদম না। আমি আসলে একটু একা থাকতে চাইছি!’
আরাফাত মাথা নাড়িয়ে হেসে বলল, ‘এজ ইউর উইশ। বাট আপনি এখন ঠিক আছেন তো? এই ক’দিন তো জ্ঞান ছিল না আপনার।’
বেলা বলল, ‘আমি ঠিক আছি।’
‘কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন। জানেনই তো, উকিল আর ডাক্তারের কাছে কোনো কথা লুকোতে নেই।’
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি ডাক্তার?’
আরাফাত হেসে বলল, ‘জি মেম। আমি, আমার বাবা-মা, এককথায় আমাদের ফুল ফ্যামিলি ডাক্তার।’
ওহ।’
এমন সময় শাম্মী এলেন। আরাফাত হসপিটাল থেকে ফিরেছে মাত্র। বেলার সঙ্গে আরও একদফা আরাফাতকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি ওকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললেন। তারপর বেলাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলেন ডাইনিংয়ে। টেবিলে সাজানো ভাত, তরকারি দেখে বেলার মন বিষন্ন হয়ে পড়লো। শাইনির জন্য খুব যত্ন করে খাবার বানাতো৷ নিজহাতে খাইয়ে দিতো। পুরোটা সময় ওকে বিভিন্নভাবে জ্বালাতন করতো শাইনি। অথচ লোকটার কোনো খবর আজ ওর কাছে নেই। শাম্মী ওকে নিজের পাশে বসিয়ে খাইয়ে দিলেন। তখন অন্যপাশের চেয়ারে এসে বসলো আরাফাত৷ প্লেটে খাবার নিতে নিতে আড়চোখে বেলাকে লক্ষ্য করলো। বেলার বিষন্ন মুখ দেখে মুহূর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বেলা যখন জানবে ওর প্রিয় মানুষটাকে আর দেখতে পাবে কি-না, সেই সম্ভাবনা অনেক কম তখন ওর রিয়েকশন ঠিক কেমন হবে! মেয়েটা বোধহয় খুব কষ্ট পাবে। বেলা শাইনির জন্য কতোটা ভালোবাসা পুষে রেখেছে, সবটা শুনেছে সে আলম সাহেবের মুখ থেকে। এই ভালোবাসাকে মূল্য দিয়ে শাইনি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনে আবার ফিরে আসতে পারবে কি-না জানে না আরাফাত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও খাবারে মনোযোগ দিলো।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে আরাফাত ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ওর ঘরে। হঠাৎ দেখলো বেলা দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে। আরাফাত বলল,
‘আপনি? দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? আসুন ভেতরে আসুন..’
বেলা ঘরে ঢুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আরাফাত সন্দিগ্ধ চোখে ওকে পরখ করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু প্রয়োজন?’
বেলা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আপনার ফোন আছে? আসলে ফুপি ঘুমিয়ে পড়েছে তাই ওনার ফোনটা.. ‘
আরাফাত ফোন এগিয়ে দিতেই বেলা তড়িঘড়ি করে ফোনটা নিয়ে নিলো। তারপর একবার নাইমুদ্দীন সাহেবকে ফোন করলেন, বরাবরের মতোই তিনি ফোন ধরলেন না। উপায় না পেয়ে বেলা আলম সাহেবের নাম্বারে ডায়াল করলো, আর বেলাকে অবাক করে দিয়ে সেই ফোনটা নট রিচেবেল বললো। সীমা বেগমের নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখলো সেটা বন্ধ। আসলে তিনি যখন প্রয়োজন হতো তখন বেলাকে কল করতেন, বাকিসময় ফোন বন্ধই থাকে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে নাইমুদ্দীন সাহেবর ফোন দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সবার ফোন একেএকে বন্ধ পেয়ে বেলার মন খারাপ দ্বিগুণ হলো। হচ্ছেটা কী ওর সাথে? বিরক্তি নিয়ে ফোনটা এগিয়ে দিলো আরাফাতের দিকে। তারপর বলল, ‘আর একটা হেল্প চাই আমার…’
আরাফাত ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো, ‘বলুন।’
‘আ আসলে আপনি তো ডাক্তার। আমার এই হেল্পটা করে দিন না প্লিজ..’
আরাফাত ওকে বসতে বলল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হেল্প?’
‘আপনি একটু ইউনাইটেড হসপিটালে যোগাযোগ করে দেখুন না, আই সি ইউতে এডমিট শাইনি আলম এখন কেমন আছেন?’
আরাফাত বলল, ‘আপনি সত্যিই ওনার খোঁজ জানতে চান?’
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি জানেন?’
‘হুম। সবটাই তো শুনলাম আপনার শ্বশুর আর মামার কাছ থেকে।’
বেলা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি আঙ্কেলকে চিনেন? আর মামা কে?’
‘মামা মানে আপনার আব্বু। ওনিই তো আলম আঙ্কেলের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।’
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আব্বু? আব্বু পরিচয় করিয়ে দিয়েছে?’
‘হুম।’
বেলা এবার ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে প্লিজ একটা খবর এনে দিন না ওনার! আমি খুব কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে..’
আরাফাত মুচকি হেসে বললো, ‘কৃতজ্ঞ থাকতে হবে না। আপনি নিজের যত্ন নিন। এতেই আমরা আপনার ওপর কৃতজ্ঞ থাকবো৷ এটলিস্ট আপনার আব্বুর কথাটা তো রাখতে পারবো।’
বেলা নিদারুণ অবাক গলায় বলল, ‘মানে?’
‘আপনার আব্বু আপনাকে আমাদের দায়িত্বে রেখে গেছেন। মেয়ের যাতে কোনো অযত্ন-অবহেলা না হয় সেজন্য বারবার রিকুয়েষ্ট করে গেছেন। আমার আম্মু তো অনেক অনুরোধ করে এখানে এনে রেখেছে আপনাকে।’
বেলা সন্দেহ নিয়ে বলল, ‘আব্বু কোথায়?’
আরাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল, ‘তিনি দেশের বাইরে।’
বেলা যেন আকাশ থেকে পড়লো। একটু জোরেই চেঁচিয়ে বলল, ‘দেশের বাইরে? কেন?’
‘আপনার হাজব্যান্ডের সুচিকিৎসার জন্য গত পরশু আপনার আব্বু এবং শ্বশুর দেশের বাইরে রওয়ানা হয়েছেন!’
বেলা আহত স্বরে বলল, ‘কী বলছেন আপনি? ওনি ঠিক আছেন তো? এখন কেমন আছেন?’
আরাফাত বলল, ‘বাকি চিকিৎসাটুকু দেশের বাইরে করালে বোঝা যাবে৷ বাকিটা আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন।’
বেলা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। নাইমুদ্দীন সাহেব শাইনির চিকিৎসার জন্য বাইরে গিয়েছে কথাটা কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। যাওয়ার সময় শাইনির সাথে দেখা হলো না বিষয়টা মানতে ওর কষ্ট হচ্ছে৷ আজ কতদিন সে শাইনিকে দেখেনা! পাঁচদিন…পাঁচটা দিনে কতকিছু পালটে গেলো! শাইনি কী সুস্থ হয়ে ফিরতে পারবে? নাকি বেলা আর ওকে দেখতে পাবেনা? ভয়ে কেঁপে উঠলো মন। ধীরপায়ে নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরটায় গিয়ে দরজা আটকে দিলো..দীর্ঘ অপেক্ষা যেন করছে শাইনির জন্য! কিন্তু আলম সাহেব কেন ওকে জানালো না? নাকি এখানে কোনো গন্ডগোল আছে? আ আর..সীমা বেগম কোথায়? নাইমুদ্দীন সাহেব যদি ওকে এখানে রেখেই যান তাহলে তো সীমা বেগমের থাকার কথা। বেলা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একটি নির্ঘুম রাত পার করে দেয়।
চলবে…ইনশাআল্লাহ! রিয়্যাক্ট করবেন আপনারা প্লিজ।