এই মুহূর্তে হাসপাতালের রিসিপশনে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিতা। তার হাত-পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। পরনের হলুদ জামা টকটকে লাল রক্তে ভরে গেছে। রিসিপশনের দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়ির দিকে তাকায় আদ্রিতা। ১০:০৩ মিনিট। ন’টার মধ্যে বাসায় ফিরার কথা আদ্রিতার। অলরেডি এক ঘন্টা লেট। মা হয়তো চিন্তায় মরছেন। এদিকে আদ্রিতার ফোন বন্ধ হয়ে গেছে।
রিসিপশনের দু’টো চেয়ারে দু’জন মানুষ বসে আছে। একজন ছেলে। অন্যজন মেয়ে। মেয়েটা আদ্রিতাকে প্রশ্ন করে,
“পেশেন্টের নাম কী?”
নাম বলতে গিয়ে থেমে যায় আদ্রিতা। একটু আগে যে ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে তার নাম জানে না সে। মেয়েটা কিছুক্ষণ আদ্রিতার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে বিরক্ত গলায় বলে,
“কী হলো? পেশেন্টের নাম বলুন!”
আদ্রিতা থেমে থেমে বলে,
“পেশেন্টের নাম, পেশেন্টের নাম কবি।”
মেয়েটা ভূত দেখার মতো তাকিয়ে কী-বোর্ডে টাইপ করে। হয়তো ভাবছে, কবি আবার মানুষের নাম হয় নাকি! এতে আদ্রিতার কোনো দোষ নেই। এমন পরিস্থিতিতে তার মাথা কাজ করছে না। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে তার মাথায় “কবি” নামটাই এসেছে।
রিসিপশনিস্ট মেয়েটা জোরে প্রশ্ন করে,
“পেশেন্ট কী হয় আপনার?”
আদ্রিতা কাঁপা গলায় বলে,
“পেশেন্ট আমার বন্ধু।”
“শুধুই বন্ধু?” বলে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসে মেয়েটা। আদ্রিতার গা রি-রি করে উঠে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ হাসতে পারে! একজন রক্তাক্ত মানুষকে নিয়ে এসেছে সে। আর তার দিকেই মেয়েটা এভাবে তাকাচ্ছে!
চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে আদ্রিতা। চারপাশে ছিমছাম নীরবতা। কোথাও কেউ হেঁটে গেলেও পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। বাতাসে ওষুধের মতো গন্ধ ভাসছে। গন্ধটা একদম পছন্দ না আদ্রিতার। টের পেতেই কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। ভ্যাপসা গরম পড়েছে। আদ্রিতা হঠাৎ খেয়াল করে, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে তার গায়ের জামা ভিজে যাচ্ছে। বিশেষ করে পিঠের দিকটা। সতর্ক হয়ে ওড়না ঠিক করে নেয় সে।
একজন ডাক্তার দ্রুত পায়ে আদ্রিতার সামনে এসে দাঁড়ান। তার চোখ-মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তিনি দ্রুত চোখের পাতা ফেলতে ফেলতে বলেন,
“পেশেন্ট কী হয় আপনার?”
এমন প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে যায় আদ্রিতা। ডাক্তার আর কিছু না জিজ্ঞেস করে সরাসরি এই প্রশ্ন করার কারণ খুঁজে পায় না আদ্রিতা। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“পেশেন্ট আমার বন্ধু।”
“আপনার বন্ধু!” ডাক্তার একটু অবাক হয়ে কথাটা বলেন। অবাক হওয়ার কারণ খুঁজে পায় না আদ্রিতা। সে কি ছেলেটার বন্ধু হতে পারে না? ছেলেটা কি তার থেকে বয়সে খুব বেশি বড়ো? না কি অন্য কোনো কারণ আছে?
ডাক্তার লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,
“উনার ইনজুরি খুব বেশি নয়। ব্লিডিং হয়েছে একটু বেশি। কপাল ভালো মাথায় হেলমেট ছিল। না হলে মারাত্মক কিছু ঘটতে পারত। আর ডান হাতটা ভেঙে গেছে।”
তিনি খানিক থেমে আবার বলেন,
“আপনি উনার বাসায় খবর দিন। তাঁকে অন্য হসপিটালে ভর্তি করতে হবে।”
আদ্রিতা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে,
“এই হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা করা সম্ভব না?”
“কেন সম্ভব না? কিন্তু তাঁর মতো মানুষ এই হসপিটালে চিকিৎসা নেবে কেন?” বলে মুচকি হেসে চলে যান ডাক্তার। আদ্রিতা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাঁর মতো মানুষ মানে? কে এই ছেলে, যাকে আদ্রিতা হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন? ভাবতে ভাবতে আদ্রিতা আবারো ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। এ-ছাড়া আর কিছু করার নেই। ফোন বন্ধ। তাছাড়া যে লোকটাকে এখানে নিয়ে এসেছে তাকে সে চেনে না। তার বাড়ির লোকদের চিনবে কীভাবে? ওঁদেরকে খবর-ই বা দেবে কীভাবে?
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার আবার আসেন। ব্যস্ত হয়ে বলেন,
“উনার বাসায় খবর দিয়েছেন?”
“না।” আদ্রিতা সংক্ষেপে জবাব দেয়।
“কেমন মানুষ আপনি? এখনও খবর দেননি! আচ্ছা, আমিই বলে দিচ্ছি।” বলে ফোন টিপতে টিপতে হেঁটে হেঁটে চলে যান তিনি। আদ্রিতা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। কী হচ্ছে তার সাথে? যাকে সে নিয়ে এসেছে সেই লোকটাই বা কে? ডাক্তার তার পরিবারের লোকদের চিনবে কীভাবে? প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত আদ্রিতা আবারো চেয়ারে বসতে যাচ্ছিল। তখনই ডাক্তার দ্রুত পায়ে এসে বলেন,
“চলুন, উনাকে অন্য হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।”
আদ্রিতা ডাক্তারের কথামতো উঠে দাঁড়ায়। অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদেরকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে কোনো হাসপাতাল নেই। বিশাল ফাঁকা জায়গায় অ্যাম্বুলেন্স দাঁড় করা হয়। কিছুক্ষণ পর অন্ধকার আকাশ থেকে শোঁ-শোঁ শব্দ করে বেরিয়ে আসে একটি হেলিকপ্টার। একটি বিশাল হেলিকপ্টার। আদ্রিতা এতটাই অবাক হয়, তার গায়ের লোম কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
ছেলেটাকে হেলিকপ্টারে তুলে দেবার পর হেলিকপ্টারটা আবার শোঁ-শোঁ শব্দ করে অন্ধকার আকাশে হারিয়ে যায়। আদ্রিতা পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে সেই ডাক্তার হাতে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করেন,
“সত্যি করে বলুন তো, উনি আপনার কী হয়?”
চলবে
গল্প : কবি বর | পর্ব : এক
মো. ইয়াছিন