কবি বর পর্ব ৩

গল্প : কবি বর | পর্ব : তিন

শহর থেকে একটু দূরে নির্জন এলাকায় একটি ফার্ম হাউস। সেটা পাঁচ বছর আগে হিমেলের নামে কেনা হয়েছিল। হিমেল কদাচিৎ সেখানে যায়। এক-দুই রাত থেকে চলে আসে। বাকি সারা বছর ফার্ম হাউসটা খালি পড়ে থাকে। অবশ্য ফার্ম হাউস দেখাশোনার দায়িত্বে একজন বিশ্বস্ত লোক আছেন। তাঁর নাম আকমল উদ্দিন। হিমেল তাকে আকমল চাচা বলে ডাকে।

আকমল চাচার বয়স কম করে হলেও আশি পেরিয়েছে। এখনও তিনি নিজেকে তাগড়া যুবক বলে মনে করেন। আদতে যখন যুবক ছিলেন তখন কোনো এক রমণীর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। সে-কথা প্রকাশ করার আগেই রমণীর বিয়ে হয়ে যায়। এরপর আর কোনো মেয়েকে ভালো লাগেনি তাঁর। তাই আজও তিনি সিঙ্গেল। এ-নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ চাপা আর্তনাদে কেঁদে উঠেন তিনি। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,

“মাইয়্যা মানুষ পানির মতোন। হাত পাইতা আস্তে কইরা ধইরা রাখো। সারাদিন তোমার হাতের তালুতে পইড়া থাকব। কিন্তু শক্ত কইরা ধরতে যাইলেই বিপদ। হাত মুঠ করতে দেড়ি হইব কিন্তুক আঙুলের ফাঁক দিয়া গড়ায়া পড়তে দেড়ি হইব না।”

হিমেল একবার প্রশ্ন করেছিল,

“এর মানে কী, চাচা? মেয়ে মানুষকে ধরতে নেই?”

“ধরতে নাই কে কইল? ধরণ যাইব। আলতো কইরা হাতের তালুতে রাইখা দাও। এইটাওতো একরকম ধইরা রাখা, না কি? তয় চাপ দিতে গেলেই ফুরুৎ।”

হিমেল কখনো মজার ছলে বলেছে,

“এতই যখন বুঝো, তখন তোমার জীবনে একটা মেয়ে নেই কেন? তুমি একটা মেয়েকে ধরে নিজের করে নিতে পারোনি কেন?”

তখন আকমল চাচা বহু, বহু বছর আগের কোনো এক রঙিন ভাবনায় ডুবে গিয়ে বলেন,

“ধরতে কি চাইনাই চাচাজান? ধরতে তো চাইছি। পারলাম কই? ধরণের আগেই অন্য একজন আইসা ছু মাইরা নিয়া গেল। আমি চাইয়া দেখলাম খালি। কিছু করতে পারলাম না। আহারে! ক্যান যে কিছু করলাম না! কেন যে ওঁর বিয়াটা আটকাইলাম না! চোউক বন্ধ করলে আইজও আমি তাঁর মুখটা পষ্ট দেখি। তাঁর ঘন ঘন চোউক। লম্বা লম্বা চুল। তাঁর পরনের শাড়ি। তাঁর হাতের চুড়ি… আহারে!”

আজ হিমেল সেই আকমল চাচার কাছে কিছু একটা বলতে এসেছে। এবং বলেছেও। মাসখানেক আগে তার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল এবং সেখান থেকে একটি মেয়ে তাকে কোলে করে রিকশায় বসায়। তারপর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে চলে যায়। সেদিনের কথা ভেবে ভেবে ঘুম নেই হিমেলের। রাত-দিন শুধু মেয়েটার কথাই মনে পড়ে। কিন্তু মেয়েটার নাম-পরিচয় কিছুই জানে না সে।

সব শুনে আকমল চাচা একদম সহজ গলায় বলেন,

“হাসপাতালে খোঁজ নিলেই তো পারেন। সেখানে কেউ না কেউ তো তারে চিনব। আর যদি না-ও চিনে, সিসি ক্যামেরা আছে না?”

আকমল চাচার কথা শুনে হিমেলের চোখদু’টো চকচক করে উঠে। সত্যিই তো! হাসপাতালে খোঁজ নিলেই তো হয়! এমন সহজ বিষয় এতদিন তার মাথায় আসেনি কেন!

দেড়ি না করে দ্রুত সেই হাসপাতালে ফোন দেয় হিমেল, যেখানে মেয়েটি তাকে ভর্তি করেছিল। কিন্তু সেখান থেকে মেয়েটির ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। পরবর্তীতে হিমেল সেই ডাক্তারের নাম্বার নেয়, যে ডাক্তার প্রাথমিক অবস্থায় তার ট্রিটমেন্ট করে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন।

সেই ডাক্তারের নাম অন্তর রয়। নাম বলার সাথে সাথে তিনি হিমেলকে চিনে ফেলেন। যার ফলে কাজটা আরো সহজ হয়ে যায়। কিন্তু হিমেল যতটা সহজ মনে করেছিল ততটা নয়। ড. অন্তর কিছুতেই মেয়েটির নাম কিংবা ঠিকানা বলতে রাজি নন। বলেন, মেয়েটি তাকে এসব বলতে বারণ করেছে। শেষমেশ হিমেলের জ্বালাতনে বাধ্য হয়ে তিনি মেয়েটির ফোন নাম্বার দিতে রাজি হন।

হিমেল খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে,

“থ্যাংক ইউ চাচা! থ্যাংক ইউ সো মাচ! তোমার জন্য আজ নাম্বারটা অন্তত পেলাম! এবার বলো তুমি কী চাও? আজ যা চাইবে তা-ই দেব।”

এতক্ষণ আকমল চাচা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিমেলের ফোনে কথা বলা শুনছিলেন। এখন তিনি দু’পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে পড়েন। হিমেল সোফায় বসে আছে। তিনি হিমেলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“আপনে তাঁরে বউ কইরা আনেন চাচাজান। আমার আর কিচ্ছু লাগব না।”

“ধুরু চাচা! অতদূর ভাবিনি! আমার ভেতরে শুধু কৌতূহল জেগেছে। কী করে একটা মেয়ে আমার মতো একজনকে অনায়াসে কোলে তুলে নিতে পারে!”

আকমল চাচা আরো একটু এগিয়ে বসে বলেন,

“বয়স তো কম হয়নাই চাচাজান। সবই বুঝি। যেই মাইয়্যা আপনের বিপদের সময় আগায়া আইছে। আপনে মন্ত্রির পোলা জাইনাও এখন পর্যন্ত পরিচয় দেয়নাই। আমার মনে লয়, হেই মাইয়্যার দিল ভালা। আর আপনেরওতো বয়স হইতাছে। বিয়াশাদি শুভ কাজ। আর শুভ কাজে দেড়ি করতে নাই।”

“কিন্তু চাচা, মেয়েটি যদি বিবাহিত হয়? কিংবা তাঁর বয়ফ্রেন্ড-টয়ফ্রেন্ড কিছু থাকে?”

মুহূর্তেই আকমল চাচার মুখ মলিন হয়ে যায়। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,

“আমার মনে লয়, মাইয়্যা বিবাহিত না। আর আপনের মতো পোলারে হেয় ফিরায়া দিব না।” তিনি খানিক থেমে আবার বলেন,

“আপনে উল্টা ভাবতাছেন ক্যান? ভালা জিনিস ভাবেন। সব সময় ভালাটাই ভাববেন। ওই যে, ইংরাজিতে কী জানি কয়?”

“বি পজিটিভ।”

“হ, ওইটাই। সব সময় পজিটিভ ভাববেন। দেইখেন, পজিটিভই হইব।”

সেদিন রাতে হিমেল মেয়েটির নাম্বারে তিনটি কল দেয়। তিনবারই ফোন বন্ধ। পরদিন সকালে ফোন রিং হয়। টুট-টুট শব্দ শুনতেই হিমেলের ভেতরে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে বহু মেয়ের সাথে ফোন কথা বলেছে সে। সরাসরি কথা বলেছে। মেয়েদের হাত ধরেছে। কিন্তু কখনো এমন হয়নি। আজ এতটা নার্ভাস হয়ে সে নিজেই অবাক।

হঠাৎ ওপাশ থেকে কোমল নারীরণ্ঠের মৃদু আওয়াজ ভেসে আসে,

“হ্যালো, কে বলছেন?”

“আমি হিমেল। হিমেল হাসান।”

[গত পর্ব পড়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, হিমেল যে স্কুলে পড়েছে সেই স্কুলের রাস্তা চেনে না? উত্তরে বলব, এমন অনেক স্কুল আছে যা আগে এক স্থানে ছিল, এখন অন্য স্থানে। আমার ব্যাপারেই বলি, আমি যে স্কুলে পড়েছি সেই স্কুলটা গত কয়েক বছর আগে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্কুলের নাম-দাম সব ঠিকই আছে। শুধু স্থান পরিবর্তন হয়েছে।

গল্পে সব বিষয় আলোচনা করা হয় না। কিছু বিষয় ইচ্ছে করেই পাঠকের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ সব বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে গেলে গল্প পড়তে বিরক্ত লাগবে।
পরিশেষে : পাঠকদের জন্য শুভকামনা।]

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here