#প্রিয়ংবদা🧡
#চতুর্থ_পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়
[বিঃদ্ররঃযাদের কাছে গল্প পৌঁছোবে, তারা দয়া করে নিচের নোটটুকু পড়বেন।অনুরোধ রইলো!]
“জানোতো দিদিভাই, আমি সেদিন জঘন্য সব শব্দ উচ্চারণ করে ওনার ভেতরটা ঝাঁঝড়া করে দিয়েছিলাম। ওনার কাছে আমি শুধুমাত্র একটা ভোগ্য পণ্য,এটা বলতেও বাঁধেনি।
তারপর নিজেই নিজের মনে অনুতপ্ত ছিলাম।
পরেরদিন সকালে চায়ের কাপ হাতে ওনার কাছে ক্ষমা চাইতেও গিয়েছিলাম। তবে ক্ষমা পাইনি।
উনি মুখ ফিরিয়ে চলে গেছিলেন! ”
কাদম্বিনী দেবী একটা চাঁপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। হৃদিতা উৎসুক হয়ে চেয়ে আছেন ওনার দিকে। তার মন সবটা জানার জন্য আকুল।কাদম্বিনী দেবী সে দৃষ্টির অর্থ বুঝলেন। তারপর আবার অতীতের সব চাঁপা রুপকথায় ডুব দিয়ে বলতে শুরু করলেন,
“তারপর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। তবুও ওনার রাগ ভাঙাতে পারিনি। আমার সাথে ওনার সম্পর্কটা এমন একটা পর্যায়ে রুপ নিয়েছিল যে, আমি সামান্য হাতে জলের গ্লাসটা নিয়ে গেলেও আমার হাত থেকে উনি তা নিতেন না। হাত সরিয়ে নিতেন। যার মানে, উনি আমাকে স্পর্শও অবধি করতে চাননা।
আমিও আর চেষ্টা করিনি। ওভাবেই দিন চলছিল।
ওনার সাথে একই ঘরে থাকার পরেও দুজন বিছানার দুদিকে মুখ ফিরে শুতাম। আর মাঝখানে বেড়া দিয়ে রাখা ছিল একটা সাদা চাদরের পর্দা।
সকালে ঘুম থেকে উঠতাম, বাড়ির সব কাজ করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে ডেকে চলে যেতাম। উনি নিজের মতো খেয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতেন।
যত দিন যাচ্ছিল, আমার আর ওনার সম্পর্কটা ততটাই তিক্ত হচ্ছিল। আমি প্রথমটা সামলে নেবার চেষ্টা করেও পরে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।
এমন একটা অবস্থায় ছিলাম, আমিও আর সামনে আসতাম না ওনার।নিজের মনটাই ভেঙে গিয়েছিল।সাথে নিজের ওপর ভর করে তীব্র তিক্ততা। বারবার মনে হত কেন ওভাবে বললাম। তবে ঐ যে, ধনুক থেকে নির্গত তীর আর মুখ থেকে নির্গত কথা দুটোই সমান। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। যা যা বলেছি তা ফিরিয়ে নেবার কোন উপায় ছিল না। তাই সম্পর্কটা ধীরে ধীরে শেষ হবার পথে যাচ্ছে তা বোঝার পরও কিছু করার ছিল না।
এভাবেই চলছিল, ঠিক কতদিন, তা মনে নেই।
তারপরে একদিন ঘটলো এক অঘটন।
আমি ঘর মুছছিলাম। পাকা মেঝের সিড়ির সামনে বেশ অনেকটাই জল পড়ে পিচ্ছিল হয়ে গেছিল তাই তবে সেদিকে চোখ পড়েনি আমার।আর অসাবধানতায় সেখানেই পা পড়ে পিছলে গেল আমার।
আমি আকস্মিক এমনটা হওয়ায় আর টাল সামলাতে পারিনি।পড়ে গিয়েছিলাম, সিড়ি বেয়ে গড়াতে গড়াতে।
বাড়িতে তখন শশুড়মশাই বা উনি কেউই ছিলেন না।
একা বাড়িতে অমন একটা দুর্ঘটনা ঘটায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম।
আমি পড়েছিলাম একদম মাথা নিচ দিক হয়ে, সেজন্য মাথার পেছনটাতে বেশ আঘাতও পেয়েছিলাম, খানিকবাদে বুঝলাম রক্ত বেরোচ্ছে। ভয় বেড়ে গেল। অসম্ভব যন্ত্রণাতে ছটফট করতে করতেই বুঝলাম জ্ঞান হারাচ্ছি, চোখ দুটো বুজে আসতে আসতে দেখতে পেলাম তোর দাদু ছুটে আসছে আমার দিকে। কিছু বলছেনও, তবে ওনার ওষ্ঠদ্বয়ের নড়ন দেখতে পেলেও কোন শব্দই কানে পৌঁছলো না। উনি এসে মাথাটা ধরে কোলে তুলে নিলেন। ওনার চোখেও জল। আমাকে কিছু একটা বলে স্বান্তনা দিতে চাচ্ছেন তবে তা তো বুঝতে পারছিনা আমি।
তবে আর বেশিক্ষণ ওনার মুখটা দেখতে পারিনি। চোখ বন্ধ করে নিলাম।
তারপর ঠিক কত সময় কত দিন৷ জ্ঞান হারা ছিলাম মনে নেই।
যখন চোখ মেললাম, দেখলাম আমাদের ঘরের বিছানাতে শুয়ে আছি।
চোখে সবটা ঝাপসা দেখছিলাম, তবে একটু বাদেই ঝাপসা অস্পষ্ট ভাবটা কেটে যেতেই দেখলাম, ডান হাতের পাতায় এখনো স্যালাইনের ক্যানোলা লাগানো। মাথাটা একটু তোলার চেষ্টা করলাম তবে পারলাম না, কেন জানি বড্ড ভার ভার লাগছিল।
বাঁ হাতে মাথায় হাত রেখে দেখলাম তখনো ব্যান্ডেজ বাঁধা।
হঠাৎ দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি কছু ভাবতে ভাবতে ভেতরে আসছেন।
আমায় চোখ মেলে থাকতে দেখে প্রায় ছুটে আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“তোমার জ্ঞান ফিরেছে? তুমি চোখ মেলেছো কৃষ্ণকায়া!”
আমি আবার কেঁপে উঠলাম, ঠিক বিয়ের পরেরদিনের মতো। আমি কতবছর পর ওনার মুখে এই ডাকটা শুনলাম তার হিসেব নেই।
সেই যে সেদিন এ নামে ডাকলেন তারপর আর কোনদিন না।
আমাকে সচরাচর সম্বোধন করতেন না উনি। দরকার থাকলে সামনে এসে বলতো এটা করতে হবে, বা এটা লাগবে।
আর সেই বৃষ্টিরাতের ঘটনার পর তো কথাই বলতেননা।
আমার যে সেই মুহূর্তে কি পরিমাণ আনন্দ হচ্ছিল বলে বোঝাতে পারবোনা দিদিভাই।
এক অমায়িক শান্তি গ্রাস করেছিল আমাকে।
খুশিতে কেঁদেই দিয়েছিলাম, আর সেই মহাশয় ভেবেছিলেন আমি হয়তো কোথাও কষ্ট হচ্ছে, বা ব্যাথা করছে তাই কাঁদছি।
তারপর তার সে কি চিন্তা। একবার মাথা নাড়ছে একবার পা, কি একটা অবস্থা।
আমি মনে মনে হেসে ফেললাম। উনি ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“মাথায় ব্যাথা করছে, পায়ে ব্যাথা করছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে, বলো! কি কষ্ট হচ্ছে?”
আমার সেদিন কি হয়েছিল জানিনা, তবে পাগলামি করে বলেছিলাম,
“না বলবো না,আগে কৃষ্ণকায়া বলে ডাকুন!আপনি আমার সাথে কথা বলেননি কেন এতদিন হুম? কেন? আমার কত্ত কষ্ট হতো জানেন? রাগ করে কটা কথা শুনিয়েছিলাম বলে এমন করবেন নাকি? একটুও ভালোবাসেন না আমাকে। নিষ্ঠুর পুরুষ!”
উনি হালকা হেসে বললেন,
“টানা ১০দিন সেন্সলেস ছিলে তুমি? মাথায় ভীষণ জোড়ে আঘাত পাওয়ায় আর প্রচুর ব্লাডলস হওয়ার জন্য এমনটা হয়েছে। ডক্টররা বলেছিলেন কবে জ্ঞান ফিরবে তা জানা নেই। নিশ্চিত ভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না।তুমি ভাবতেও পারবেনা আমি এই ১০টা দিন কিভাবে ছিলাম প্রতিটা মুহুর্ত তোমার কাছে এসে তোমাতে ডাকতাম, অনবরত, বিরতিহীন, তবে তুমি, সাড়া দিতে না।
একটুও না। তো তুমি কি কৃষ্ণকায়া? তুমিও কি পাষাণ নারী নও? ”
আমি চটে গিয়ে জবাব দিলাম,
“একদম বাজে কথা বলবেন না। আমার তো জ্ঞান ছিলনা। থাকলে ঠিকই জবাব দিতাম বরং এতদিন পরে আপনি আমার সাথে কথা বলছেন দেখে হুমরি খেয়ে আপনার বুকে লাফিয়ে পড়তাম।
আপনার পরিস্থিতি আর আমার পরিস্থিতি এক না। আপনি তো ইচ্ছে করে আমাকে এড়িয়ে যেতেন! ”
ঠোঁট উল্টে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। উনিআবার বললেন,
আচ্ছা মানলাম, আমার আর তোমার পরিস্থিতি এক না। তবে আমি তোমাকে এড়িয়ে যেতাম, এটা ভুল কৃষ্ণকায়া।বরং আমি নিজেকেই ঘৃণ্য মনে করতাম। আমার সত্যিই মনে হতো, কোন নারীর অনুমতি না নিয়ে তাকে স্পর্শ করা অন্যায়।মারাত্মক অন্যায়। নিজেকেই পারশ্ন করতাম আমি কি সত্যিই তোমাকে অসম্মান করে ফেলেছিলাম, সত্যিকি তোমাকে কোন সস্তা ভোগের পণ্য মনে করেছিলাম। উত্তর পেতাম না জানো? আর তখন নিজের প্রতি থাকা ঘৃণাটা আরো বেড়ে যেত। তাই পালিয়ে বেড়াতাম, তোমার থেকেও আর নিজের থেকেও।
তোমাকে এড়ানোর মতো দৃষ্টতা যে আমার নেই। কৃষ্ণকায়াদের এড়িয়ে চলা যায় না! কৃষ্ণকায়ারা সবসময় তাদের প্রেমিক পুরুষের হৃদয়ে থাকে, তাদের প্রতিটা স্পন্দনের তালে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায়। আর যারা স্পন্দনে নিয়োজিত তাদের কি এড়িয়ে চলার উপায় আছে বলো! নিজের জীবনের অস্তিত্বটুকুকে কি এড়ানো যায়? যায় না। কখনোই না!
আর তোমাকে ভালোবাসিনা কে বললো হুম?
আজ থেকে তো না, বিয়ের পরের দিন সকালে ঐ কৃষ্ণবতীর মায়া ভরা মুখটা দেখেই ভালোবেসেছি!বিদেশে থাকার প্রতিটা মুহুর্ত সবচেয়ে বেশি তার সেই কাজললতা রুপটাই মনে করেছি।
কৃষ্ণকায়াদের না ভালোবেসে থাকা যায় না বুঝলে। কৃষ্ণকায়াদের ভালোবাসতে হয়, ভালোবেসে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতে হয়,আগলে রাখতে হয়।তবে আমি তা পারিনি। তোমাকে আগলানোর ক্ষমতা ছিলনা বলেই এত বড় দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল তোমার সাথে।
নিজের কাছে আরেকবার ছোট হয়ে গেলাম।”
ওনার চোখে অশ্রুবিন্দুর উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। যেকোন সময় টুপ করে তা গাল বেয়ে ঝড়ে যাবে মনে হলো।আমি ওনার একহাত আকড়ে নিয়ে বললাম,
“কাঁদবেন না প্লিজ!আপনার তো কোন দোষ নেই।ওটা তো অসাবধানতাবশত হয়ে গেছে। আর বাড়িতেও তো আপনি ছিলেন না। তাই একদম নিজেকে দোষী মনে করবেন না।আর খবরদার আমার সামনে কাঁদবেন না, বুঝলেন!একদম না।আমার মোটেও আপনার কান্না সহ্য করার কষমতা নেই। আপনি কাঁদলে কিন্তু আমিও কাঁদবো। তখন মাথা ব্যাথা করবে। ভালো লাগবে তখন? বলুন? যদি ভালো লাগে তো বলুন, দুজনে গলা ধরাধরি করে কাঁদছি। কি কাঁদবো?”
উনি চোখের পলক ঝাপটে আসতে চাওয়া কান্নাটাকেও আটকে দিলেন। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
“আচ্ছা, কাঁদছিনা আমি। তোমাকেও কাঁদতে হবেনা।”
আমি ওনার দিকে তাকিয়েই বললাম,
“এই তো লক্ষী ছেলে। কখনো কাঁদবেন না বুঝলেন। কোন পরিস্থিতিতেই না।এমনকি আমি মরে গেলেও না।”
উনি মুখে হাত রেখে বাঁধা দিয়ে বললেন,
“এসব বলা যাবেনা। তাহলে আবার কথা বলা বাদ দেব।”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
“আচ্ছা আর বলবনা!”
তারপর দুজনের মুখেই হাসি ফুটলো। এতদিনের জমে থাকা সব কষ্ট,দুঃখ,অভিমাণ যেন নিমেষেই মিলিয়ে গেল, আর তারপর ধরা দিল একরাশ আনন্দ,একগুচ্ছ প্রশান্তি, আর এক পৃথিবী ভালোবাসা।
ঠিক সেই মুহুর্তে, জানো তো দিদিভাই,ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে বরাবরের মতো এই বিশ্বাসটা নিজের জন্য একটা পাঁকাপোক্ত জায়গা করে নিল,
“ভগবান যাই করেন, তা আমাদের মঙ্গলের জন্য! ”
আর আজও আমার এই বিশ্বাসের ওপর আস্থা অটল। তাই তো পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় যখন নিজের বাড়ি,সংসার ছেড়ে এই বৃদ্ধাশ্রমে এসে ঠাঁই হলো, তখনো আমার বিশ্বাসের ভীত একটুও টালমাটাল হয়নি, মেনে নিয়েছি, আজকের এই কষ্টও কখনো না কখনো কোন মঙ্গলের আহ্বায়ক! কোন কল্যাণকর কার্যের সূচনা।”
#চলবে
[