আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ৪
.
সেই সিনেমা ঘটিত ঘটনার পর প্রহর ভাই আমাকে পড়ানোর টাইম ডিউরেশন কমিয়ে আনলেন। রাত সাতটা থেকে নয়টা। কিন্তু এতে আমার পাগলামিগুলো সমানুপাতিক হারে বাড়তে লাগলো।
.
গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষ আমার রূপের প্রশংসা করত। আমি যখন রাস্তা দিয়ে হেটে যেতাম রাস্তার পাশে দাঁড়ানো যুবকেরা বুকে হাত দিয়ে হা করে আমার দিক চেয়ে থাকতো। ভয়ে সামনে আসতো না। আগে পিছে আব্বার পাঠানো লোক ছিল যে। আমি নিজেও জানতাম আমি সুন্দরী। কিন্তু প্রহর ভাই আমার সুন্দরতায় গ্রাস হচ্ছে না কেন আমি সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।
আমার কাছে তখন রূপ গুণের চেয়েও বড়।
“আগে দর্শনধারী পরে গুণ বিচারী”- এই একটি প্রবাদ আমার স্নায়ুতন্ত্রকে বশ করে ফেলেছিল। ঘরের আলু, শসা, গাজর, টমেটো এমন কোন সবজি নেই যা আমি রূপ চর্চার কাজে ব্যবহার করিনি।
.
একদিন নিজের সব সাহস সঞ্চয় করে খাতায় লিখলাম
“প্রহর ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি…
I love u….মুঝে আপসে পেয়ার হে।”
তিন ভাষায় লিখে ছিলাম যাতে বুঝতে সুবিধা হয়। কিন্তু প্রহর ভাইয়ের সামনে খাতা দেওয়ার পর সে খাতার পৃষ্ঠাটা ছিড়ে নিজের টেবিল মুছতে শুরু করে। পৃষ্ঠায় বড় বড় করে লিখা অক্ষরগুলোতে চোখ বুলানোর প্রয়োজনই মনে করে নি। আমার অবুঝ হৃদয় আবার কাঁচের টুকরার মতো ঝনঝন করে ভেঙে যায়। হৃদয়ের কাঁচ ভাঙার শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলাম।
প্রহর ভাইয়ের এই একটি মাত্র কাজ আমার জেদ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। মনের মাঝে তখন কলিজা জ্বালানো গান বাজতে থাকে,
“তুমি দেখিয়াও দেখলা না,,
তুমি শুনিয়াও শুনলা না,,
তুমি জ্বালাইয়া গেলা মনের আগুন,
নিভায়া গেলা না..”
.
সেদিন ছিল শনিবার। প্রহর ভাইয়ের কাছে পড়ার একমাস সম্পূর্ণ হয়েছে। ক্যালেন্ডারে তারিখ দেখে আমি মুখে ফেস পাউডার ঘষা শুরু করি। নিজের সবচেয়ে পছন্দের জামাটা বের করে পড়ি। সেই প্রথম দিনের পর আমি আর মেকআপ করিনি কখনো।
কিন্তু ছাতার ডাক্তার প্রহর আমার রূপের কোন প্রশংসায় করলো না। একবার বললোও না অনেক সুন্দর লাগছে। আচ্ছা প্রশংসা না করলেও সাজগোজের কারণ তো জিজ্ঞেস করতে পারতো?
আমি ক্ষেপে উঠি। জোরে ধুর ছাই বলে ফেলি।
-” কিছু বললে?”
-” আই লাভ ইউ।”
মাত্র তিনটি শব্দ ছয়টি অক্ষর উচ্চারণ করেছিলাম। কত্ত সহজ বলা। আ ই লা ভ ই উ। এই তো। কিন্তু এই তিনটি শব্দ যেন প্রহর ভাইকে জাপানের ভূমিকম্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। খুক খুক করে কাশতে শুরু করে সে।
আমি ব্যাগ থেকে পানির বোতলের মুখ খুলে আগিয়ে দিয়ে বলি,
-” ওই দিক দিয়ে খাবেন না প্লিজ। নিন এদিক দিয়ে খান।”
-” কেন?”
পানি দেখে এমনিতেও প্রহর ভাইয়ের কাশি থেমে গেছিল।
-” এই দিক দিয়ে আমি খেয়েছি তো তাই।”
-” মানে?”
-” আরে আমি সিনেমাতে দেখেছি। প্রেমিক প্রেমিকার জুঠা খাচ্ছে আবার প্রেমিকা প্রেমিকের জুঠা খাচ্ছে। এতে ভালোবাসা আরও গভীর হয়। নিন বোতলের এই দিক দিয়ে পানি খান।”
প্রহর ভাই ভালোবাসা গভীর না করে পানির বোতল ছুড়ে মাটিতে ফেলে দেয়।
“গেট আউট” বলে বিকট শব্দে চিল্লিয়ে উঠে। আমি ভয়ে চুপসে যাওয়া কলিজা নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। প্রহর ভাই রেগে গিয়েছে। যদি আব্বাকে বলে তো আব্বা আমার চামড়া ছিলে নিবে।
সারারাত ঘুমাতে পারিনি ভয়ে। পরের দিন সকালে সব স্বাভাবিক দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচি। যাক কিছু বলেনি।
.
আমার ভালোবাসার রেলগাড়ি চলছিল খুব ধীরে ধীরে। প্রথম ও শেষ প্রেম অসফল হবে এটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। আমি জানতাম আমার প্রারম্ভ সমাপ্তিতে শুধুই প্রহর নামটি লিখা।
পরের বৃহস্পতিবার আমি বান্ধবীদের নিয়ে প্রহর ভাইয়ের ডাক্তারখানা থেকে একটু দূরে দাঁড়াই। এর পিছনে কারণ ছিল প্রহর ভাই আসার পথে তাকে আটকিয়ে আমার মনের কথা জানানো ও তার মনের কথা জানা। মনের কথা সেদিন আবার আমি জানিয়ে ছিলাম। উপহার স্বরূপ একটা চড় খেয়েছিলাম। রাগে দুঃখে প্রহর ভাইকে ধাক্কা মেরে পাশের পুকুরের পানিতে ফেলে দেই। কিন্তু তাকে ফেলতে যেয়ে দুজনেই একসাথে পানিতে পরেছিলাম। ওই যে কথায় আছে না? “পরের জন্য গর্ত খুঁড়তে গেলে নিজেই সে গর্তে পড়তে হয়।” ঠিক এমনটাই হয়েছিল আমার সাথে। আমি আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। যেই প্রহর ভাই না বলবে আমি সাথে সাথে ধাক্কা মেরে পুকুরে ফেলে দিব। ভীষণ জেদি ছিলাম যে।
.
আমি সাঁতার কাটতে পারতাম না। আব্বা কখনোই আমাকে পুকুরে গোসল করতে যেতে দেয়নি। গ্রামের দশজন লোকের সামনে মেয়ে- মানুষের গোসল করার কোন মানেই হয়না। তার উপর আমরা উচ্চ বংশের। যখন ডুবার ভয়ে আমি হাত পা ছুড়ছিলাম প্রহর ভাই তখন মনে করেছিলেন অতিথি হয়ত নাটক করছে। তবে সে আমাকে ঠিক বাঁচিয়ে ছিল। এই ঘটনার পর আবার উপহার স্বরূপ একটা থাপ্পড় পেয়ে যাই। মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিলাম তখন।
.
সেদিন রাতের বেলা পড়ানোর সময় প্রহর ভাই আমাকে পড়ানো বাদ দিয়ে বুঝাতে বসলেন। আমি অবুঝ, বাচ্চা একটা মেয়ে। ভালোবাসা কী আমি জানিই না। এসব হলো ছোট বয়সের আবেগ। একজন টিনেজ মেয়ের ইনফ্রাচুয়েশন। আমার এখন পড়ালেখা করার সময়। এই প্রেম ভালোবাসার চিন্তা বাদ দিয়ে আমাকে পড়তে হবে। আমার আব্বার স্বপ্ন আমাকে পূরণ করতে হবে। আমার মাথায় এখন যা ঘুরপাক খাচ্ছে তা সিনেমার পোকা। এই পোকা আমাকেই মারতে হবে। সিনেমা দেখা বন্ধ করতে হবে। বাসায় যেয়ে সিনেমার সিডিগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। ডিভিডি প্যাকেটে মুড়িয়ে রাখতে হবে।
আরও অনেক অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আলোচনা বললে ভুল হবে। আলোচনাতে উভয় পক্ষের মতামত নেওয়া হয়। কিন্তু এখানে শুধু প্রহর ভাই কথা বলেছিলেন। এক কথায় বললে ভাষণ দিয়েছিলেন। আমি ছিলাম নির্বাক শ্রোতা।
এতো এতো বিষয় বুঝানোর পর তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি সব বুঝেছি কীনা।
“বুঝেছি” শব্দটির পরিবর্তে আমার সরল মুখ থেকে আবার “আই লাভ ইউ” শব্দ তিনটি বের হয়। প্রহর ভাই এই শুনে দুই হাত দিয়ে মাথা চাপড়াতে থাকেন। আর আমি হা করে তাকে দেখতে থাকি। আহা, কী সুন্দর করে মাথা চাপড়াতে পারেন উনি!
তার এই সুন্দরতা দেখে আমার মনের রেডিওতে গান বাজতে থাকে,
“আমি জ্ঞান হারাবো
মরে যাব
বাঁচাতে পারবে না কেউ।”
.
চলবে….