#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১৮
~”আমার বিরুদ্ধে তোমার মনের কোণে যদি জমে থাকে অজস্র অভিমান তবে সেটা অতি যত্নসহকারে ভেঙে দিব আমি। সবটুকু নিঃশেষ করে দিয়ে আবারও তোমাকে ফেলব আমার প্রেমের মোহতে।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল আদ্র। তুলি বরাবরই নিশ্চুপ। তবে আদ্রর বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হতেই হৃদয়ে উতালপাতাল ঢেউ গর্জে উঠছে। অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। সবকিছু যেন গলায় আঁটকে যাচ্ছে। আদ্রর অসহায় দৃষ্টি মাথা নিচু করে বসে থাকা তুলিতেই নিবদ্ধ। মেয়েটার অস্থিরতা চোখের দিকে না তাকিয়ে ও আদ্রর মনের কোণে দৃশ্যমান। তুলির মাঝে অভিমানের ছাপ দেখতে পাচ্ছে না বরং দেখতে পাচ্ছে এক মুঠো অস্থিরতা, অস্বস্তি। দুপুর থেকে অভিমান ভেবে তুলির নিকট উপস্থিত হলেও এখন ব্যাপার টা অন্যরকম ঠেকছে। আদ্রর বিচক্ষণ মস্তিষ্ক ধারণ করছে তুলি অভিমানী নয় বরং কোনো কারণে লজ্জিত। ধীরে ধীরে নিজের হাত টা দিয়ে তুলির হাতে স্পর্শ করল। কেঁপে উঠল তুলি। চেপে ধরল আদ্রর হাত টা শক্ত করে। সকাল থেকে বিতৃষ্ণায় অশান্ত হওয়া মনটা নিমিষেই এক ফোঁটা বৃষ্টির পানির মতো ঠান্ডা ছোঁয়া পেয়ে শান্ত হয়ে গেল। প্রিয়তমের হাত টা আঁকড়ে ধরে নিজেকে লজ্জা থেকে নিবারণ করল। আদ্রর স্পর্শে আজ কোনো লজ্জা হচ্ছে না তুলির। এই হাত টা যেন তুলি কে শান্ত করার জন্য আস্বস্ত করার জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন হাত টা কিভাবে ফিরিয়ে দিবে তুলি? আঁকড়ে না ধরলে যে নিজেই ধুকে ধুকে মরবে। অন্য হাত দিয়ে তুলির থুতুনি ধরে মুখটা উপরে তুলে নিজের চক্ষুদ্বয়ে স্থাপন করল আদ্র। সুড়সুড় করে শীতল ঢেউ আছড়ে পড়ল আদ্রর বক্ষপিঞ্জরে প্রবলভাবে। তুলির দু গালে ছেয়ে আছে রক্তিমার গাঢ় প্রলাপ। শুকিয়ে থাকা ঠোঁটে লজ্জাতুর সরু হাসির রেখা। কি আশ্চর্য মেয়েটা এমন রূপ ধারণ করে রেখেছে কেন? কোথায় অভিমান আর কোথায় লজ্জালু এই সৌন্দর্য! আদ্রর নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। তুলির মুখশ্রীতে ফুটে থাকা রূপ আদ্র কে অসম যন্ত্রণা দিচ্ছে। হৃদস্পন্দন ক্ষণে ক্ষণে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। থুতুনি থেকে তড়িৎ বেগে হাত টা সরিয়ে নিল আদ্র। তুলির হাতের ভাজে আবদ্ধ থাকা হাত টাও ছুটিয়ে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে এল বেলকনিতে। নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। অন্তরজুড়ে থাকা অনুভূতি গুলো এলোমেলো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উত্তপ্ত একটা শ্বাস ছেড়ে বহু বিড়ম্বনা কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিল আদ্র। গলার স্বর টা নিচু রেখে বিড়বিড় করল,,
~ “তুমি আজকাল বড্ড সর্বনাশী রূপ ধারণ করছো তুলা। প্রতিমুহূর্তে পোড়াচ্ছ আমাকে তোমার প্রেমের অনলে।”
হতবাক হয়ে মূর্তির ন্যায় স্থির হয়ে রইল তুলি। আচমকা আদ্রর এহেন আচরণ তার মনের প্রতিটি ভাজে ভাজে বিষাদ ছড়িয়ে দিল। আদ্র কি রেগে গেল? সকাল থেকে তার সম্মুখীন না হওয়ায় কি এরূপ আচরণ? রেগে গেলে তো হাতটা আকড়ে ধরত না। তবে! তবে হুট করেই কি হয়ে গেল? উঠে দাঁড়াল তুলি। বেলকনিতে এসে আদ্রর পাশে দাঁড়াল। কন্ঠে দৃঢ়তা এনে প্রশ্ন করল,,,
–“কি হয়েছে? ”
চোখের পলকেই তুলি কে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দাঁড় করাল আদ্র। দু পাশে দু হাত রেখে তুলি কে আবদ্ধ করে নিল নিজের মাঝে। হচকচিয়ে উঠল তুলি। প্রচন্ড বেগে কেঁপে উঠল হৃদপিণ্ড। বুকে হাতুড়ি পিটা শব্দ হতে লাগল। আদ্রর আকস্মিকভাবে করে বসা কান্ড গুলো তুলির অন্তরে ঝড় তুলে। শুকিয়ে যায় কন্ঠ নালি। আদ্র স্পর্শ করে নি তবুও রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ জেগে উঠছে। মানুষ টা সামান্য একটু কাছে থাকলেই তুলির কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। ছোট্ট মনটা অনুভূতি গুলো ঠিক সামলে উঠতে পারে না।কিছুটা কঠিন স্বরে আদ্র বলে উঠল,,
–” তোমার কি হয়েছে? অভিমান তো নেই আমার প্রতি তা তোমার চোখ দুটোই জানান দিচ্ছে। তাহলে আসার পর থেকেই আমাকে তোমার সান্নিধ্য থেকে কেন বঞ্চিত করছো?”
অতিশয় জড়তায় আদ্রর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক নজর দিতে লাগল তুলি। আদ্র তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে তুলির পানে।
–“কি হলো এদিকে তাকাও? আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছ কেন তুলা?”
নিশ্চুপ হয়ে কিছুটা স্থিতিশীল হল তুলি। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগল,,,
—” আসলে আদ্র,,!”
এটুকু বলে আবারও মৌনতা পালন করতে লাগল। কপালে ভাজ ফেলে ভ্রু কুঁচকে তাকাল আদ্র। নিজের এক হাত দিয়ে তুলির কোমরের এক পাশে হাত রেখে অত্যধিক জোরে অতি কাছে টেনে নিল। বিস্মিত হয়ে উঠল তুলি।হঠাৎ করেই আদ্রর স্পর্শ কোমরে পেয়ে শিউরে উঠল পুরো দেহ।আদ্রর বুকে হাত রেখে এক পলকে তাকিয়ে রইল নীল বর্ণের নেশা মিশ্রিত দু চোখে।
–” থেমে গেলে কেন?”
দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে আদ্রর চোখের নেশার রেশ কেটে গেল তুলির। নিচু স্বরে জবাব দিল,,
–” গতকাল সাগর ভাইয়াদের বাড়িতে আমি নেশার ঘোরে যা করেছি তা আজ আমরিনের কাছ থেকে জানতে পেরে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি আপনাকে! আপনার সাথে যা করেছি তার জন্য লজ্জিত আমি। লজ্জায় ভীতি আমায় ঘিরে ধরেছিল। তার জন্যই আসার পর থেকেই,,
–“তাই আসার পর থেকেই ঠুনকো একটা কারণে আমার থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলে। রাইট?”
মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোধক বুঝাল তুলি। সাথে সাথেই তুলির দিকে ঝুঁকে পড়ল আদ্র। নাকে নাক ঘষতেই আদ্রের বুকে সজোরে আঁকড়ে ধরল তুলি। তুলির নখ বিঁধছে তবুও কোনো পরোয়া নেই আদ্রর। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠল,,
–” এতো লজ্জা কেন তোমার? এই লজ্জা তো আমার দম নিয়েই ছাড়বে। তুমি রাগ করার বদলে লজ্জায় লুকিয়ে রইলে। ”
–” রাগ কেন করব? আমি যা করেছি তা নেশার ঘোরে হোক আর চেতনায় খারাপ কাজ করেছি। তাই আমাকে শাসন করার পুরো অধিকার আপনার আছে। আপনার রাগই তো আমার মনে ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি জাগিয়েছিল। যেদিন আপনার রাগী ফর্সা মুখ টা দেখেছিলাম সেদিনই এক অজানা অনুভূতি জড়ো হয়েছিল আমার মনের কুঠিরে।”
–” কালকের কান্ডে অস্বস্তি পাওয়ার কিছু নেই বরং আমি দুঃখিত। রাগ সামলাতে না পেরে তোমাকে চড় বসিয়ে দিয়েছি। আমাকে ক্ষ,,,”
সম্পূর্ণ কথা বলতে আদ্র কে বাঁধা প্রদান করল তুলি। নিজের নরম হাত টা দিয়ে আদ্রর মুখে কুলুপ এঁটে দিল। তুলির নরম হাতের ছোঁয়া ঠোঁটে পেতেই দু চোখ বুঁজে নিল আদ্র। তুলি আদ্রর দিকে নিষ্পলক চোখে চেয়ে বলল,,
–“আপনি কখনও ক্ষমা শব্দটা উচ্চারণ করবেন না। এতে আমি খুব কষ্ট পাব। যদি আমায় কখনও ভুলেও কষ্ট দেন তাহলে নিজের ভালোবাসা দিয়ে সবটুকু দূর করে দিবেন। টেনে নিবেন আমাকে পরম শান্তির স্থানে।”
ঠোঁট থেকে হাত টা টেনে নিয়ে একটা চুমু খেল আদ্র। জমে থাকা অনুভূতি গুলো আনন্দ অশ্রু হয়ে ভিড় জমাল তুলির চোখের কার্ণিশে। হাতটা মুঠোয় পুরে নিল আদ্র।
–” চোখের কার্ণিশে জমে থাকা জল কিন্তু আমার বুকে আছড়ে পড়বে কষ্ট হয়ে। কোনোভাবেই যেন গড়িয়ে না পরে।”
অন্য হাত দিয়ে তুলি তাড়াতাড়ি করে জল টুকু গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নিল। মুচকি হাসল খানিকটা। আদ্রর ঠোঁট দুটো ও প্রসারিত হল।
–” খুব খিদে পেয়েছে তুলা।”
আদ্রর মলিন কন্ঠ শুনে প্রচন্ড অবাক হল তুলি। চোখ ছোট ছোট করে বলে উঠল,,
–“খিদে পেয়েছে মানে? দুপুরে খান নি?”
–” খাই নি। যেখানে আমার তুলা অনাহারে ভুগছে সেখানে আমি খেয়ে পেট ভরিয়ে নিব সেটা ভাবলে কি করে?”
বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তুলি। কোনোকিছু না বলে আদ্রর শক্ত হাত টেনে পা বাড়াল নিচে যাওয়ার জন্য। কিন্তু!কিন্তু থেমে যেতে হল আদ্রর বলিষ্ঠ হাতের টানে। সম্মুখে এসে দাঁড়াতেই আদ্র ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠল,,
–” আমার তোমার কোমল ঠোঁটের স্পর্শ চাই। ”
আদ্রের আবদারে মুহুর্তেই ক্ষণিকের জন্য হৃদস্পন্দন থেমে গেল তুলির। পা দুটো ও জমে গেল বরফের মতো। এক পা নাড়ানোর শক্তি পাচ্ছে না। লজ্জার ছাপ ফুটে উঠল মুখে। আপনমনেই উচ্চারণ করল,,–” এভাবে কেউ বলে আদ্র?”
ঘনঘন শ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ঠোঁট চেপে রাখল। ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল,,
–“কোথায় দিতে হবে?”
এটুকু বলেই তুলি ভারী একটা নিশ্বাস ছাড়ল। জিজ্ঞেস করতেই যেন তার শ্বাস আঁটকে যাচ্ছিল। গলা টাও কাঁপছিল। আদ্র সূক্ষ্ম হেসে বলল,,
–“তোমার ইচ্ছে।”
বিলম্ব করল না তুলি। দ্রুত বেগে হেঁটে এসে নিজের সবটুকু লজ্জা দূরে ঠেলে দিয়ে আদ্রর পায়ের উপর পা রাখল। পিছন থেকে দু হাতে আদ্রর গলা জড়িয়ে ধরে নাগাল না পেয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল,,
–” দেখতেই পাচ্ছেন আরেকটু উঁচুতে তুলতে হবে আমায়। তাহলে মুখে কেন বলতে হচ্ছে? ”
প্রতুত্তর করল না আদ্র। কোমর জরিয়ে তুলি কে একটু উঁচু করতেই তুলি নিজের নরম ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরল আদ্রর কপালে। সাথে সাথেই সরিয়ে আনল না। বরং আরেকটু গভীরভাবে চুমু খেল। আদ্রর কোনো রেসপন্স নেই। ভিতরে তুফান শুরু হলেও বাহিরে শীতলতা। কোনো কথা না বলেই তুলি কে নামিয়ে দিল। তুলিও অভিশঙ্কায় নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এক দৌড়ে নিচে চলে আসল। সেখানে দাড়িয়ে থাকলে তো জড়তায় তলিয়ে যেত। আদ্র ও নিঃশব্দে নিচে নেমে এল।
______________
নিচে আসতেই তুলির চোখ গেল ড্রইং রুমে। রাদিফ সাহেব ও সায়েরা বেগম বসে বসে কথা বলছেন। তুলি তাদের দিকে এগিয়ে গেল। নম্র স্বরে বলল,,
–” চা খাবেন খালু?”
হালকা হাসলেন রাদিফ সাহেব। হাসি বজায় রেখেই বললেন,,
–” শুনেছি তোর হাতের চা দারুন হয়। খেতাম তবে সেটা খালু না বলে বাবা বলে সম্বোধন করলে।”
তীব্র অবাকতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল তুলি কে। বুকটাও ধুক করে উঠল। চোখে অশ্রুকণারা ভিড় জমাল। কতগুলো বছর ধরে বাবা- মা ডাকটা ডাকতে পারে না সে। আজ রাদিফ সাহেবের মুখে বাবা ডাকতে হবে শুনে আনন্দের চেয়ে তুলির যন্ত্রণা টাই বেশি হচ্ছে। এটা সেই যন্ত্রণা নয় যেই যন্ত্রণায় তুলি ব্যাথিত হবে। এটা না চেয়ে ও পেয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। অদ্ভুত হলেও তুলির জন্য তা-ই সত্য। কিছুটা ভেজা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,
–” চা খাবেন আব্বু – আম্মু?”
দু’জনেই এক গাল হেসে বললেন,,
–” খাব মা।”
ডাইনিং রুমে দাড়িয়ে সবটা দেখল আদ্র। বাবার প্রতি জমে থাকা অভিমানগুলো হালকা সরে যেতে লাগল। সেদিনের পর বাবার মুখোমুখি টাও হয় না। অভিমানে নয় নিজের করা আচরণে অনুতপ্ত অনুভব হয়। একটাই চিন্তা ছিল রাদিফ সাহেব তুলি কে ছেলের বউ রূপে মেনে নিতে পারবে কিনা! তাও আজ দূর হয়ে গেল। তুলির পিছু পিছু কিচেনে চলে আসল। তুলি খেয়াল করে নি। ফ্রিজ থেকে তরকারির বাটি বের করে ফিরতেই লাফিয়ে উঠল আচমকা আদ্র কে দেখে। বাটি টা পড়ে যেতে নিলে আদ্র তুলির হাত থেকে নিয়ে নিল। চুলার কাছে গিয়ে তরকারি অন্য একটা পাত্রে ঢেলে গরম করতে করতে বলল,,
–“বউ তুমি তোমার শশুর শাশুড়ির জন্য চা বানাও আমি খাবার গুলো গরম করে ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছি।”
আহা! সংসার সংসার অনুভূত হচ্ছে তুলির মনে। চমকায়নি তুলি। আর কত চমকাবে? মাত্র তিন মাস পর তো সত্যি সত্যিই বউ হয়ে যাবে। আদ্রর বউ! শব্দটা মনে উদয় হতেই ঠোঁট হাসির রেখা দেখা দিল। চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে পলকবিহীন আদ্রর দিকে তাকিয়ে রইল। যতই দেখে ততই যেন হারিয়ে যায় আদ্রর মাঝে। তবুও মনটা ভরে না।মনের খাতা টা শূন্যই থেকে যায়। আবারও ইচ্ছে জাগে আদ্র কে দেখে শূন্যতায় ভোগা মনটা পূর্ণ করে নিতে।
।
।
রাদিফ সাহেব ও সায়েরা বেগম কে চা দিয়ে জলদি ডাইনিং টেবিলের কাছে আসল তুলি। আদ্র অলরেডি নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে বসে আছে কিন্তু মুখে তুলছে না। তুলি বুঝতে পারছে ও নিজে খেতে না বসলে আদ্র খাবে না। তাই পাশের চেয়ারে বসে প্লেটে খাবার নিতে গেলে হাত ধরে থামিয়ে দিল আদ্র। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই হাসোজ্জল চেহারা নিয়ে আদ্র বলে উঠল,,
–” আমায় খাইয়ে দাও।”
তুলি সাথে সাথেই আওয়াজ করে বলে উঠল,,
–“আমি খাব না আদ্র? ”
–” খিদে তো আমার লেগেছে তো তোমার খাওয়ার কি দরকার?”
আদ্রর উদ্ভট কথা শুনে থমকে গেল তুলি। তুলি কে বেশিক্ষণ থমকে থাকতে না দিয়ে আদ্র বলল,,
–” আমায় খাওয়াবে নিজেও খাবে। বহুদিনের ইচ্ছে বউয়ের হাতে খাব। সুযোগ পেয়ে আজ ইচ্ছে টা বহুগুণ বেড়ে গেছে। ”
প্লেট টা টেনে নিজের কাছে এনে ভাত মাখিয়ে আগে নিজে খেল। তারপর আদ্রর দিকে বাড়িয়ে দিল খাবার। তুলির হাতটা ধরে মুখে পুরে নিল খাবার টা আদ্র। ছোট্ট করে একটা কামড় দিল তুলির আঙ্গুলে। লজ্জায় চুপ করে রইল তুলি। কিন্তু মনে মনে বিড়বিড় করল,,–“অসভ্য লোক।”
খাবার শেষ করে আদ্র ও তুলি ড্রইং রুমে এসে নিবিড় কে দেখে কিছু টা চমকে গেল। নিবিড় শুধু একা আসে নি সাথে নিজের মা কেও নিয়ে এসেছে। যিনি হাসি মুখে কথা বলতে মগ্ন সায়েরা বেগমের সাথে। আদ্র কে দেখেই উঠে এল নিবিড়। হাসি মুখে বলল,,
–“আমার তোর ও আংকেল আন্টির সাথে জরুরি কথা আছে আদ্র।”
আদ্র কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে নিবিড়ের ভাবভঙ্গি। নিবিড়ের মায়ের সাথে কথা বলে সোফায় বসল। তুলি পাশে দাঁড়াতেই ক্ষীণ স্বরে বলল,,
–“দাড়িয়ে আছো কেন?”
—“এমনি।”
–” পা দুটো ভেঙে দিব তখন এমনি এমনি দাড়িয়ে থাকতে পারবে?”
–“কিন্তু!”
একটু সরে বসল আদ্র। এই সোফা টায় দু’জন অনাসয়ে বসা যায়। ইতস্ত করে আদ্রের চোখ রাঙানোর সাথে না পেরে বসে পড়ল তুলি কিছুটা দূরত্ব রেখে। নিবিড়ের মায়ের নজর তুলির উপর পড়তেই বললেন,,
–” মাশাল্লাহ! তোমার হবু স্ত্রী প্রচন্ড মায়াবী আদ্র।”
মাথা নত করে ফেলল তুলি। প্রশংসা শুনে ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। লাজুক লাজুক ভাব চলে এসেছে। আদ্র হেসে জবাব দিল,,,
–” ধন্যবাদ আন্টি। দোয়া করবেন আমাদের জন্য। ”
–“অবশ্যই। আমরিন কে দেখছি না যে?”
কথাটা বলতে দেরি হলেও আমরিনের হাজির হতে দেরি হয় নি। নিজের প্রাণ টা নিয়ে দৌড়ে এসেছে। দু তলা থেকে নিবিড় কে দেখেই ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম তার। নিবিড় তার কথানুযায়ী চলেই এল। আমরিন কিভাবে সামলাবে এসব। তুলিকে বলতেও তো ভুলে গেছে বিয়ের চক্করে। নিবিড় সব বলে দিবে নাতো? হাফাতে হাফাতে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াতেই নিবিড়ের আম্মু ডেকে উঠলেন আমরিন কে।
–” এদিকে আসো আমরিন।”
ওনার পাশে গিয়ে বসল আমরিন। রাদিফ সাহেব ও সায়েরা বেগম বুঝতে না পারলেও আদ্র ও তুলি বুঝতে পেরেছে বিষয় টা। নিবিড় আমরিনের দিকে এক পলক চেয়ে রাদিফ সাহেব কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
–“আমি আমরিন কে বিয়ে করতে চাই আংকেল। আমি ওকে ভালোবাসি। অবশ্য আমরিন একদম অজ্ঞাত এই ব্যাপারে। দুটো বছর ধরে ওকে ভালোবাসি আংকেল। শুধু ওর আর আমার বয়সের পার্থক্যের জন্য ভয় হতো প্রস্তাব নিয়ে আসতে। আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি ওকে ছাড়া নিঃশ্বাস তো ফেলব কিন্তু সুখে থাকব না আংকেল। বেঁচে থেকেও নিঃশেষ হয়ে যাব ভিতর থেকে।”
নিবিড়ের অকপটে ভালোবাসা জাহির করতে দেখে ভীষণ অবাক হলেন সবাই। আমরিন তো একদম বিস্মিত হয়ে আছে। নিবিড়ের অসহায় দৃষ্টি মনে দহন রুপে বিচরণ হতে লাগল। সে তো ভেবেছিল নিবিড় সব বলে দিবে কিন্তু তার তো পুরোই উল্টো হল। নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে আমরিনের। ক’জন ছেলে এভাবে মেয়ের বাবার কাছে এমন করে ভালোবাসার মানুষ টা কে চাইতে পারে? তুলিও অবাক চোখে তাকিয়ে রইল নিবিড়ের দিকে। নিবিড়ের অসহায় চাহনি বলে দিচ্ছে কতটা চাই সে আমরিন কে। পাশে থাকা আদ্রর হাত টা চেপে ধরে তুলি করুন স্বরে বলে উঠল,,
–“নিবিড় ভাইয়া কে ফিরিয়ে দিবেন না আদ্র। ”
তুলির বলা বাক্য টা কে উপেক্ষা করে আদ্র গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,,
–“বাবা ফিরিয়ে না দিলেও আমি ফিরিয়ে দিব নিবিড়। ”
নিমিষেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল নিবিড়ের সবটুকু সাহস। আমরিনের চোখে সঞ্চারিত হল জল। তুলিও ছলছল নয়নজোড়া নিবদ্ধ করল আদ্রর রাগান্বিত চেহারায়।
#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১৯
রাতের আঁধারে একজোড়া যুগল হাতে হাত রেখে বসে আছে। কারো ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি তো কারো ঠোঁটে লাজুকতার রেখা। আমরিন দের বাগানের দিকটায় বসে আছে নিবিড় ও আমরিন। আমরিনের হাত টা আলতো করে ধরে রেখেছে নিবিড়। খানিকক্ষণ আগেও সবকিছু এলোমেলো লাগলেও এখন আর বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরিনের বেশ লজ্জা লাগছে। ইশ! এতো লজ্জাকর পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হল? নিবিড় টাও কেমন বেহায়া প্রকৃতির। তার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে তার ভাই। কি অবলীলায় বোন কে সারাজীবনের জন্য বেঁধে দিল নিবিড় নামক ছেলেটার সাথে।
ফ্লাশব্যাক~
তুলির ছলছল নয়ন জোড়া দেখে মৃদু হাসল আদ্র। নিবিড়ের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,
–” ফিরিয়ে কেন দিব জানিস?”
–” জানি। আমি অপরাধ করেছি আদ্র। বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও তোর কাছ থেকে লুকিয়েছি। কিন্তু আমি তোর বোনটা কে ভীষণ ভালোবাসি।”
–” আমার বোন ও তোকে ভালোবাসে তা আমরিনের চোখের জলেই প্রতীয়মান।”
আদ্রর কথা শুনে আমরিন মাথা নত করে ফেলল। এতোক্ষণ বিষাদ লাগলেও এখন বড় ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে লজ্জা তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। রাদিফ সাহেব, সায়েরা বেগম,ইনশিতা প্রচন্ড অবাক আদ্রর মুখের কথা শুনে। রাদিফ সাহেবের মনটা অসম্ভব ভালো লাগায় ভরে গেল। আদ্র শুধু সম্পর্কে ভাই হিসেবে থাকে নি ভাইয়ের দায়িত্ব টা ও যথাযথ পালন করে। দু মেয়ে মুখ ফুটে কখনও ওনার কাছে কিছু না বললেও আদ্র ঠিকি দুই বোনের মনের কথাগুলো, চাওয়া গুলো অনাসয়ে বুঝে নেয়। আবদার করার আগেই পূরণ করে দেয়। আচ্ছা আজও কি আদ্র সঠিল বুঝতে পেরেছে? আমরিন সত্যিই নিবিড় কে পছন্দ করে? নাকি ভুল! প্রশ্ন টা মনে উদয় হতেই রাদিফ সাহেব স্নেহার্দ্র স্বরে মেয়েকে প্রশ্ন করলেন,,
–” তোমার ভাইয়া কি সঠিক বুঝেছে আমরিন?”
বাবার আদর ভরা কন্ঠ কর্ণপাত হতেই আমরিন মাথা নেড়ে সঠিক বুঝাল। রাদিফ সাহেব চুপ করে রইলেন। আদ্রর উপরই সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিলেন বিনাবাক্যে। তিনি ভালো করেই জানেন বোন কে কখনও কষ্টের দিকে ঠেলে দিবে না আদ্র। বরং বোনের জন্য যা সবচেয়ে ভালো হবে তাই করবে। তাছাড়াও নিবিড় কে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছেন তিনি। নিবিড় নিঃসন্দেহে আমরিনের জন্য একজন যোগ্য পাত্র। তবুও মেয়েদের নিয়ে প্রচন্ড চিন্তা হয় ওনার। তাই নিজে সিদ্ধান্ত নিতেও হিমশিম খেয়ে যান। ছেলে যখন এতোটা বিচক্ষণ তখন তিনি নিজের মস্তিষ্কে আর চাপ দিতে চাইছেন না। সাময়িক নীরবতা কাটিয়ে আদ্র মোলায়েম কন্ঠে রাদিফ সাহেব কে জিজ্ঞেস করল,
–” আপনি কি চান বাবা?”
ছলছল চোখে ছেলের দিকে চাইলেন রাদিফ সাহেব। দীর্ঘ সময় পর ছেলের মুখ থেকে বাবা ডাক টা শুনে দু চোখ ভরে এল তার। ঠোঁটে হাসিয়ে ফুটিয়ে বললেন,,
–“তুমি যা চাইবে তাই হবে আদ্র। ”
–” ঠিক আছে বাবা।”
সবার মাঝে একটা ভয় কাজ করছে। আদ্র কি বলবে? সত্যিই কি ফিরিয়ে দিবে? তুলির অবস্থা তো দম আঁটকে যাওয়ার মতো। আদ্র আজ কেন এতো কঠোর হয়ে পড়েছে একদমই বুঝতে পারছে না সে। আচ্ছা ভাই গুলো কি বোনের বেলায় এমন কঠিন রূপ ধারণ করে? তুলির ইচ্ছে করছে আদ্র কে বলতে–” আপনি যদি আজ নিবিড় ভাইয়া কে ফিরিয়ে তবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।” আদ্র নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল। সাবলীল কন্ঠে বলল,,
–” তুই ফিরে যা নিবিড়। আর,,”
এটুকু বলে থামতেই অসহায় দৃষ্টিপাত করল নিবিড়। বুকে চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘ শ্বাস। পলকেই হৃদয় টা জ্বলে পুড়ে যেতে লাগল। ইচ্ছে জাগল আমরিন কে জোর করে নিজের করে নিতে। কিভাবে বাঁচবে এই মেয়েটা কে ছাড়া সে? আদ্রর কঠোরতা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে আদ্র অসমাপ্ত কথাটা শেষ করে দিল।
–” কাজী নিয়ে তাড়াতাড়ি আসিস। এখন না ফিরলে কাজী নিয়ে আসবি কিভাবে?”
চমকিত নয়নে সবাই আদ্রর দিকে তাকাল। সবার ঠোঁটে ফুটে উঠল আনন্দের হাসি। আমরিন তো পুরোই স্তব্ধ হয়ে গেছে। নিবিড় উঠে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আদ্র কে। বুকে ঘুষি বসিয়ে দিয়ে বলে উঠল,,
–” শালা তুই তো আমাকে মেরেই ফেলছিলি। জীবনে এতো কঠিন পরিস্থিতি তো মেডিক্যাল এক্সামে ও ফেইস করি নি।”
–” এতো সহজে বোন দিয়ে দিব নাকি? ভাই হয়েছি অথচ একটু কঠোর হব না তা কি হয়?”
–” আজকেই তোর বোন টা কে আমার হাতে তুলে দিবি? ওর তো আঠারো হয়ে গেছে। কখন আবার তোর মতামত পাল্টে যায় আমার তো ভয় হচ্ছে। তুই অনুমতি দিলে আমি এখনই কাজী সাহেব কে নিয়ে আসব।”
আমরিন লজ্জায় চুপসে গেল। নিবিড় কি বলল এটা? আজকেই বিয়ে মানে? আদ্র কি মানবে? মানবে না। বিয়ে কি হুট করে বললেই হয়ে যায় নাকি! কিন্তু আমরিন কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আদ্র বলল,,
–” নিয়ে আয়।”
রাদিফ সাহেব ও সম্মতি জানালেন। তুলি তো খুশিতে আত্মহারা। সায়েরা বেগম আমরিন কে রুমে নিয়ে গিয়ে একটা শাড়ি পড়িয়ে দিলেন। আমারিন মূর্তির মতো দাড়িয়ে। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে! কাজী সাহেব আসতেই বিয়ের কার্য সম্পন্ন হল। তবে আমরিন এখানেই থাকবে। ইনশিতা ও আমরিন দু জনের বিয়ের অনুষ্ঠান এক দিনেই হবে। তুলি যেন স্বপ্ন দেখছে। সেও আদ্রর বউ হতে চায় তবে এমন করে নয়। খুব ইচ্ছে খুব বড় করে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। আদ্র বর সেজে আসবে। তুলি লাল বেনারসি পড়ে আদ্রর অপেক্ষার প্রহর গুণবে। আর তো কয়েক মাস। এতটা ধৈর্যহারা হতে চাই না তুলি। ভালোবাসার শুদ্ধতম প্রতীক তো অপেক্ষা। আর মাস তিনেক অপেক্ষার পর তো সুন্দর একটা মুহুর্ত পাবে দু’জন।
।
।
গালে ঠোঁটের উষ্ম স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠল আমরিন। উঠে যেতে নিলে নিবিড় হ্যাঁচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল তাকে। পিঠ বুকে গিয়ে ঠেকতেই আমরিন অভিমানী কন্ঠে বলে উঠল,,
–” আপনার বুক তো আমার বাপের কেনা সম্পদ না তাহলে এভাবে বুকে টানছেন কেন?”
বিস্মিত হল নিবিড়। চাপা অভিমান টুকু বুঝতে পেরে আমরিনের শাড়ি ভেদ করে পেটে হাত রেখে নিজের আরও কাছে টেনে নিল। তৎক্ষনাৎ আমরিনের হৃদপিন্ডে তীব্র বেগে কিছু একটা ছুটে চলতে শুরু করল। শরীরের প্রত্যেক টা ভাজে ভাজে শুরু হল কম্পন। নিবিড়ের হাতটা ক্রমশই বিচরণ করতে লাগল পুরো পেট জুড়ে। দু চোখ বুঁজে ফেলল আমরিন। এই অনুভূতি গুলো তার জীবনে প্রথম। নিশ্বাস টাও আটকে আসছে। নিবিড়ের হাতটা চেপে ধরতেই ধীর কন্ঠ ভেসে এল।
–” তোমার বাপের কেনা সম্পদ না হলেও বুকটা এখন তোমার কেনা সম্পদ। চিরকাল এটা তোমারই থাকবে।”
কথাটা বলেই আমরিনের ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়াল । এক অজানা ঘোরে ডুবে যেতে লাগল দু’জন। আমরিন কে একটানে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। দু চোখ এখনও বন্ধ। ফর্সা চেহারায় লজ্জার ছাপ যা নিবিড় কে টানতে লাগল অনবরত। দোষের তো কিছু নেই। আমরিন তো তার বউ। কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই আমরিন খামচে ধরল নিবিড়ের হাত টা। প্রস্ফুটিত হাসি নিবিড়ের ঠোঁটে। আমরিনের তিরতির করে কাঁপতে থাকা গোলাপি ঠোঁট দুটো মুহুর্তেই বিক্ষিপ্ত করে দিল তার হৃদয় টা কে। নিজের ঠোঁট দুটো দিয়ে চেপে ধরল আমরিনের দু ঠোঁট। সাথে সাথেই ধপ করে চোখ মেলে তাকালো আমরিন। তীব্রভাবে আকড়ে ধরল নিবিড়ের ঘাড়ে। নিবিড় হালকা কামড় দিতেই ছিটকে সরে এল। লজ্জায় সেখানে আর এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল। ভাগ্যিস কেউ দেখে নি। নিবিড় ও ঘোর থেকে বেড়িয়ে ভিতরে চলে এল। একটু পরই চলে যাবে। সায়েরা বেগম ডিনার করা ছাড়া যেতে দিচ্ছিলেন না। হুট করে বিয়ে হলেও তিনি মেয়ের জামাই আদরে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
_________
রোদের প্রখরতায় ঘেমে একাকার তুলির কলেজ ড্রেস টা। কাঠফাটা রোদের তাপে আজকাল তুলি প্রচন্ড বিরক্ত। তার চেয়ে ও বেশি বিরক্ত পরীক্ষা নামক প্যারায়। কিছুই ভালো লাগছে না তার। আজ শেষ পরীক্ষা। আমরিনের সাথে দাঁড়িয়ে আছে কলেজ গেইটে। আমরিন আজ পরীক্ষা শেষে বাসায় যাবে নিবিড় কে বলেই এসেছে। তিন তিনটা মাস কেটে গেছে বিয়ের। আর সংসারের পুরো দুইটা মাস। আজ ইনশিতা ও আসবে বাসায়। গাড়ি তে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে তাই ড্রাইভার ঠিক করতে নিয়ে গিয়েছেন। তপ্ত দুপুরে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে আমরিনের ও ভালো লাগছে না। তুলির দিকে তাকাতেই দেখল মেয়েটা গরমে কেমন হাসফাস করছে। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। কলেজে মোবাইল আনা নিষেধ হওয়ায় মোবাইল টা ও আনা হয় নি নয়তো নিবিড় কে বলত গাড়ি পাঠাতে। টিস্যু বের করে তুলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল–” আজকাল তুই অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছিস না তুলি?”
কপালের ঘামটুকু মুছে তুলি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল-” আমার ক্লান্তির কারণ কি বুঝতে পারছিস আমরিন? তোর ভাই টা এতো খারাপ কেন? আমায় এক রাশ ক্লান্ত মাখা অনুভূতি দিয়ে উদাসীন হয়ে আছেন। আমি হাফিয়ে উঠেছি। অবিশ্রান্ত হয়ে উঠেছে মনটা।”
তুলির অভিমানে ভরপুর কথা শুনে আমরিন ম্লান হাসল। মুখ খুলে কিছু বলতে নিবে তখনি একটা গাড়ি এসে থামল। দু’জন চোখ ছোট করে চাইতেই গাড়ি থেকে হাসি মুখে বেরিয়ে এল সামিরা। দু’জনেই এক গাল হাসল সামিরা কে দেখে। ইনশিতার বিয়ের পর থেকে সামিরার সাথে বেশ ভাব হয়েছে তুলির। সামিরা কে ভীষণ পছন্দ তার। নিজের বড় বোনের আসনে বসিয়ে ফেলেছে। সত্যি বলতে সামিরা মেয়েটাই এমন যার তার সাথে মিশে যেতে পারে অনাসয়ে। আদ্র মিশতে বারণ করলেও তুলির কাছে সামিরা কে ভালো লাগে। তুলির ধারণা সামিরা আদ্র কে ভালোবাসত বলেই হয়তো খারাপ কিছু করতে পারে তাই আদ্র বারণ করে। কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না তুলির কাছে। সামিরা এগিয়ে এসে বলল—দু’জন রৌদ্দুরে দাড়িয়ে আছো কেন? বাসায় যাবে না?”
আমরিন হেসে জবাব দিল–” আসলে আপু আমাদের গাড়ি টা নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করে আনলে তারপর যাব।”
–“আমার সাথে চলো। আমি দিয়ে আসছি। এতো সময় ধরে রোদে দাড়িয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে। তুলিও কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে রোদে দাড়িয়ে থেকে।”
দু’জনেই সায় জানিয়ে সামিরার সাথে গাড়িতে উঠল। পুরো রাস্তা কোনো কথা বলল না তুলি। বুকটা বড্ড হাহাকার করছে আজকে। হৃদপিণ্ডের প্রতিটা স্পন্দন যেন আদ্র কেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যেই মানুষ টা প্রতিটা নিশ্বাসে মিশে আছে তাকে ছাড়া নিশ্বাস নিতেও অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে তুলির। গাড়ি বাড়ির গেইটে আসতেই আমরিন ও তুলি নেমে পড়ল। সামিরা কে অনেকবার সাধলো ভিতরে আসার জন্য কিন্তু জরুরি কাজ থাকায় সামিরা আসে নি। তুলি বাড়িতে ঢুকেই চারদিকে চোখ বুলাল। হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে সোফায় বসে পড়ল। সায়েরা বেগম আমরিন ও তুলির জন্য লেবুর শরবত নিয়ে আসতেই তুলি অভিমানী কন্ঠে বলে উঠল,,
–” তোমার ছেলে আজও আসে নি আম্মু তাই না? ”
–“নারে।তবে চলে আসবে। কিন্তু তুই যে গত কাল থেকে আমার ছেলেটার ফোনটা ধরছিস না ও কিন্তু ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।”
–“কেন ধরব? তোমার ছেলে তো বিখ্যাত হার্ট সার্জন হয়ে গেছে। অন্যের হার্টের চিকিৎসা করে কি হবে? ওনি তো আমার হার্ট টা কেই অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছে।”
আমরিন ও সায়েরা বেগম হাসলেন। ওনি তুলির পাশে গিয়ে বসে তুলি কে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন–” ছোট্ট তুলি টা আমার ছেলেটা কে এতো ভালোবেসে ফেলেছে। আদ্র আসলে বকে দিব আমি৷ কত বড় সাহস ওর আমার মা টা কে কাঁদিয়ে অন্যের সেবা করতে লেগে পড়েছে।”
তুলি কাঁদতে কাঁদতে হালকা হেসে বলল–” অন্যের সেবা করা তো জরুরি আম্মু তবুও তোমার ছেলে দূরে গেলে আমার অসম্ভব কষ্ট হয়। মনে হয় কেউ ওনাকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়ে যাবেন।”
–” কেউ কেঁড়ে নিবে না। আর তো পাঁচ দিন। আল্লাহ ব্যতীত তোকে আমার ছেলের কাছ থেকে কারো কেড়ে নেওয়ার সাহস নেই মা। আর না তোর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার। ”
তুলি আর আওয়াজ না করে চুপ করে রইল।পাঁচ দিন পর ওদের বিয়ে। সময় কত তাড়াতাড়ি গড়িয়ে যায়। পিছনে ফেলে যায় কিছু বিষাদময় স্মৃতি আবার কিছু মুগ্ধময় প্রহর। তুলির জীবনে বিষাদ ছিল যা সময়ের স্রোতে কাটিয়ে দিয়েছে আদ্র। গড়েছে তুলির মনে নিজের জন্য জায়গা। ধীরে ধীরে মিশে গেছে তুলির অস্তিত্বে। একটা দিনও না দেখে থাকতে পারে না তুলি। গতকাল ভোরে আদ্র চট্টগ্রাম গিয়েছে তখন থেকেই মুখ ভার তুলির। আদ্র কে দেখতে না পেরে ঝেকে বসেছে অজস্র অভিমান।
_____________
রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। তুলি ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই চোখের কার্ণিশ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। ভেবেছিল আদ্র হয়তো আজ আসবে কিন্তু তার ভাবনা ভুল ছিল। মনের গহীনে থাকা অভিমান দ্বিগুণ হয়ে গেল। চাপা কষ্ট গুলো জলে পরিণত হয়ে বালিশ ভেজাতে লাগল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘড়ির কাটায় যখন এগারোটা পঞ্চান্ন তখনই চোখ লেগে এল তুলির। চোখের জল গুলো শুকিয়ে ছাপ পড়ে আছে। হঠাৎ মুখের উপর গরম উত্তাপ অনুভব করতেই সদ্য লেগে আসা চোখ মেলে তাকাল। চোখের মণি তে দৃশ্যমান হল আদ্রর হাসিমাখা উজ্জ্বল মুখটা। নিমিষেই বুক টা প্রচন্ড গতিতে কেঁপে উঠল। কল্পনা ভেবে মুখ ফিরিয়ে নিল তুলি। তখনই নিজেকে শূন্যে অনুভূত করতেই পিলে চমকে উঠল। ভয়ে আদ্র কে আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। চোখ মুখ কাচুমাচু করে রইল। নিজের রুমে এনে তুলি কে বিছানায় বসিয়ে দিল আদ্র। একটা কাগজ হাতে নিয়ে এসে তুলির সামনে বসল চেয়ার টেনে। দু চোখ লাল হয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। মুখ জুড়ে ক্লান্তির ছাপ। দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে মাত্র এসেছে। মোলায়েম কন্ঠে আদ্র উচ্চারণ করল,,
–” শুভ জন্মদিন আমার তুলা।”
নিমিষেই জেগে উঠা অভিমান চাপা পড়ে গেল তুলির। কেঁদে দিল শব্দ করে। কাঁদবেই না কেন? আদ্রর ক্লান্তি মাখা চেহারা, রক্তিম চোখ দুটোই বলে দিচ্ছে শুধু মাত্র তার জন্যই এতো পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে আদ্র। তুলি নিজের শরীরের সবটুকু ভর ছেড়ে দিল আদ্রর উপর। ভেজা স্বরে বলে উঠল-
“শুধুমাত্র সামান্য একটা মুহুর্তের জন্য এভাবে ছুটে এলেন কেন ডাক্তার সাহেব? আমার অভিমান করা নিছক ছিল। নিজেকে এতো কষ্ট দিয়ে কেন আসতে গেলেন?”
“তুমি কি জানো এই মুহুর্তটার জন্য আমি কতগুলো সময় অপেক্ষা করেছি?”
“জানিনা। জন্মদিনে আপনার থেকে আগে উইশ পাওয়া টা আমার কাছে জরুরি ছিল না। জরুরি তো আপনি এবং আপনার ভালো থাকা।”
তুলির মুখটা বুক থেকে তুলে এক হাত নিয়ে গালে রাখল আদ্র। নিজের ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে শুষে নিল তুলির চোখের জল। মুগ্ধময় স্বরে বলল–” আজ তোমার জন্মদিন তাই আমার কাছ থেকে উপহার পাওনা তুমি। কিন্তু উপহার টা তুমি আজই গ্রহণ করতে পারবে না।”
তুলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রর দিকে। পাশ থেকে কাগজ টা আদ্র বাড়িয়ে দিল তুলির কাছে। তুলির মস্তিষ্ক কিছুই ধারণ করতে পারছে না। কি করতে চাইছে আদ্র? উপহার কি এই কাগজ টা? আবার গ্রহণ করতে পারবে না এটা কেমন কথা? কলম এগিয়ে দিতেই তুলি না পড়েই সাইন করে দিল কাগজ টা তে। তারপর আদ্রর হাতে ধরিয়ে দিল। একটু ঝুঁকে তুলির কপালে কপাল ঠেকাল আদ্র। দু’জনের ঠোঁটের কিঞ্চিত মাত্র দূরত্ব। নিজের মাদকতাময় চোখ গুলো আদ্র স্থাপন করল তুলির ডাগরডাগর আঁখি তে। কোনোভাবেই চোখ সরিয়ে নিতে পারছে না তুলি। তড়িৎ বেগে ছুটে চলেছে হৃদপিণ্ডের হৃৎস্পন্দন। কেন সে পারে না আদ্রর মোহ উপেক্ষা করতে? আবার কেন এতো ঝড় উঠে আদ্র কাছে আসলে? এই ঝড় কি সারাজীবন বয়ে যাবে অন্তর জুড়ে? প্রশান্তির আবেশিত বাতাসে তুলির মনে প্রবলভাবে ভেসে বেড়াতে লাগল একটু একটু করে জড়ো হওয়া অনুভূতি গুলো। আদ্রর কন্ঠস্বর শুনে ঠোঁটের কার্ণিশে হাসি ফুটল।
–” না পড়েই সাইন করে দিলে?”
–” আপনার প্রতি অগাধ বিশ্বাস আছে তো আদ্র। সবকিছু ধোকা দিলেও আমার অস্তিত্ব আমাকে ধোঁকা দিবে না।”
স্নিগ্ধ সুবাসিত হাওয়ায় ছেয়ে গেল আদ্রর হৃদপিণ্ড। ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। তুলির কৃষ্ণবর্ণী চোখের মায়ায় ডুব দিতে ইচ্ছে করছে তার। কারো সাধ্য নেই আঁটকে রাখার তবুও কোনো তাড়াহুড়ো চায় না সে। গুছিয়ে শুরু করতে চায় সবকিছু। তুলির ঘাড়ের পিছনে হাত রেখে নিজের আরেকটু কাছে টেনে নিল। ঠোঁটে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল–” তুমি নিজের উপহার টা না দেখেই আমায় রিটার্ন গিফট দিয়ে দিলে তুলা।”
আদ্রর কথাটা তুলির কর্ণধার হয় নি। তুলি তো আদ্রর নীলাভ চোখের মাদকতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। আলতো সেই স্পর্শ টা শরীরে শিহরণ জাগিয়ে তুলছে। মনটা ক্রমাগত চাইছে আরো গভীরভাবে হারিয়ে যেতে। চোখ বুঁজতেই প্রচন্ড বেগে কিছু আওয়াজ এসে ধাক্কা খেল তুলির কানে। হকচকিয়ে উঠল তুলি। চোখ মেলতেই সামনে আর আদ্র কে আবিষ্কার করল না।
#চলবে,,,
(