ধূসর রঙের প্রজাপতি পর্ব ২১+২২+২৩

#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_21

গুগল ম্যাপ লোকেশনে ডিমের চরে আকৃতি টা খানিকটা ডিমের মতোই বটে অর্থাৎ ডিম্বাকৃতির । চর টি খুব ই নির্জন আর পরিচ্ছন্ন। বেলাভূমি জুড়ে দেখা যায় কাঁকড়ার শিল্পকর্ম। অন্য পাশে রয়েছে বিশাল কাশবন।
ঝিল মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। কাশফুল গুলো যেন ওকে ডাকছে ।
চরের বেশ খানিকটায় ঢেউয়ের আস্তরন পরে আছে। এগুলো হলো জোয়ারের চিহ্ন। জোয়ার আসলে ঐ পর্যন্ত ঢেউ আসে।
আস্তরনের উপর পলি মাটি জমে কালচে রঙ ধারন করেছে। ঝিল খানিকটা ঝুঁকে আঁকি বুকি করতে লাগলো। অভিনব ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। ঝিল কে উবু হয়ে থাকতে দেখে অভিনব ভ্রু কুঁচকালো। ক্যামেরা হাতে চলে আসলো ঝিলের কাছে। ঝিলের ডান পাশে একটু ধাক্কা দিলো। ঝিল ঘুরে পাশে ঘুরে দেখলো কেউ নেই। আবার বা পাশে ধাক্কা অনুভব করলো। এবারো কেউ নেই। ঝিল উঠে পেছন ঘুরে তাকালো। না কেউ নেই। ঝিল খানিকটা ভরকে গেল। এতো মানুষের মাঝে ভুত কি করে আসবে ?
অভিনব মুখ চেপে হাসতে লাগলো। ঝিলের ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে বলল
_ ঝিল।

ঝিল চমকে তাকালো। অভিনব পেট চেপে হাসতে লাগলো। ঝিল সরু চোখে তাকিয়ে বুকে থু থু দিলো।

_ অভিনব আপনি আমার সাথে মজা নিচ্ছেন ?
আমি ভয় পেয়ে মরে যাচ্ছিলাম। আর আপনি কি না হেসে যাচ্ছেন।

অভিনব এখনো হেসে যাচ্ছে। ঝিলের রাগ হলো। খানিকটা বালু নিয়ে অভিনবর দিকে তাক করলো। অভিনব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল
_ নো নো প্লিজ ঝিল। প্লিজ প্লিজ ডোন্ট ডু দিস।

ঝিল ডেভিল স্মাইল দিলো। অভিনব অসহায় মুখ করে নিলো। ঝিল কারো কথা শুনতে নারাজ। ভেজা বালুর মুঠো অভিনবর দিকে ছুঁড়ে দিলো। অভিনবর পাশ কাটিয়ে বালু গুলো পরলো। ঝিল আবার বালু উঠিয়ে নিলো। অভিনব খপ করে ঝিলের হাত ধরে ফেললো।

_ অভিনব হাত ছাড়ুন , অনেক মজা উড়িয়েছেন। আজ আপনার রেহাই নেই। আমার হাতে আপনার অন্ত নিশ্চিত।

_ ঝিল ডোন্ট ডু দিস। বালু গুলো ফেলে দিন। অনেক জায়গায় যাবো আমরা।

_ উহহহু ফেলবো না। আপনার গাঁয়ে বালু ফেলেই আমার শান্তি।

_ ফেলবেন না তাই তো ?

_ উহুহহ

ওয়েট দেখাচ্ছি মজা। অভিনব এক হাতে ঝিলের হাত চেপে ধরে কোলে তুলে নিলো। ঝিল নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। কিন্তু অভিনব ছাড়তে নারাজ। নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাঁকা হেসে বলল
_ ফেলে দেই এবার ?

_ অভিনব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। দেখুন আমি ভিজে যাবো। আর ভেজা গাঁয়ে এতো টা পথ।
না না ছাড়ুন প্লিজ। প্লিজ অভিনব

_ ওকে ছেড়ে দিচ্ছি।

_ আরে আরে কি করছেন আমি তো পানিতে পরবো।

_ কেন আপনি ই তো বললেন ছেড়ে দিতে।

_ অভিনব।

ঝিলের ভ্যাগা ভ্যাগা মুখ দেখে অভিনব ফিক করে হেসে দিলো। ঝিল রিকোয়েস্ট করে যাচ্ছে যাতে পানি তে না ছাড়ে ওকে।
বেশ কিছুক্ষণ পর অভিনব ঝিল কে কোল থেকে নামিয়ে দিলো।
ঝিল সরু চোখে তাকিয়ে পানিতে হাত ধুইয়ে ফেললো। অভিনব ফিস ফিস করে বলল
_ এতো সহজ ? আমার সাথে লাগবেন তো সিউর ফাঁসবেন। একদম নদীতে ফালায় দিবো।

_ অভিনব ।

_ হুমম।

_ আমি নদীতে পরে গেলে আপনি খুশি হবেন ?

ঝিলের কথাতে অভিনব মুখ টা কুঁচকে নিলো। অভিনব স্পষ্ট লক্ষ্য করলো মেয়েটার চোখে পানি চিক চিক করছে। কিন্তু হুটহাট কেন এমন করে মেয়েটা ?

_ কি হলো বলুন ?

_ আপনি কাঁদছেন ?

_ কই না তো। আমি কেন কাঁদতে যাবো।

ঝিল পেছন ঘুরে ফেললো। অভিনব হেচকা টান মেরে ঝিল কে ঘুরিয়ে নিলো। ঝিল দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘোরাতে লাগলো। অভিনব দু হাতে ঝিলের মুখ টা কাছে নিয়ে আসলো । ঝিল চমকে তাকালো। অভিনবর দৃষ্টি স্থির। ঝিলের হাত পা কাঁপনি দিয়ে উঠলো।

_ অভিনব

_ হুসসস

_ কি করছেন

অভিনব রাগি চোখে তাকালো। ঝিল দমে গেল। অভিনব ধীরে ধীরে ঝিলের মুখে ফু দিলো। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো ঝিল। অদ্ভুত ভালো লাগায় ছেয়ে গেল পুরো শরীর। অভিনব অধর কোনে হাসি রেখে বলল
_ হুটহাট চোখে পানি একদম পছন্দ নয় আমার। ঠাস করে থাপ্পর লাগিয়ে দিবো কিন্তু।

ঝিল ভ্রু কুঁচকে নিলো। অভিনব হাসলো। ঝিলের হাত ধরে খানিকটা দৌড়ে কাশবনের দিকে গেল। ঝিল ও অভিনবর পায়ের সাথে পা মেলাতে লাগলো। একটু পর কাশবনে এসে পরলো। ঝিল হাঁফাতে লাগলো। অভিনব লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলল
_ এতো তাড়াতাড়ি হাঁফিয়ে যাওয়া ভালো কথা নয় । নিয়মিত এক্সাইজ করবেন। কেমন যেন মুটিয়ে যাচ্ছেন।

_ হোয়াট ? আমি মুটিয়ে যাচ্ছি ? আপনি নিজেকে দেখুন তো। দৈত্যের মতো দেখতে। ইয়া লম্বা, আর চরা বডি। আমার মতো দুজন আপনার পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারবে।

অভিনব হো হো করে হেসে উঠলো। ঝিল দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। অভিনবর থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো সাথে অভিনব কে দু চারটা গালি ও মেরে দিলো।
অভিনব কাশ ফুলের ছবি তুলে নিলো। ঝিল কাশবনে বাচ্চাদের মতো করতে লাগলো। অভিনব যত্ন সহকারে ছবি ক্লিক করে নিলো। মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত টান অনুভব করে ওহহ।
অভিনব ক্ষীন হাসলো। মোহনীয় দৃষ্টিতে ঝিলের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছিম ছাম উজ্বল রঙের মেয়েটা ওর বউ ভাবতেই অভিনবর হাসি পাচ্ছে। তা ও আবার পাক্কা দশ বছরের ছোট ভাবা যায় ?

*

কাশবন থেকে ঝিল কে টেনে বের করলো অভিনব। ঝিল যেন কাশবনের মধ্যে ই লুটিয়ে পরছিলো। বেশ কাঠ খড় পুরিয়ে ঝিল কে বের করলো অভিনব। চরের একটু দূরে ঘন জঙ্গল। সেখানে প্রচুর হরিন দেখা যায় তাছাড়া বন্য শুকর তো রয়েছেই।
একজন গাইড সবাই কে ডেকে পাঠালেন ।সবাই এক সাথে জড়ো হতেই ওনি ব্রিফিন দেওয়া শুরু করলেন।

” ধন্যবাদ সবাই কে। এখন অব্দি আপনাদের আচারনে আমরা বেশ সন্তুষ্ট। মনে হচ্ছে আমরা ও যেন বন্ধুদের সাথেই এসেছি। তো যাই হোক আপনারা জানেন এই চরের নাম ডিমের চর। এর আশে পাশে ও অনেক চর রয়েছে। আমরা বেশ কয়েকটায় ঘুরবো। সাথে পক্ষী খালে ও যাবো। একটু পাশেই দেখুন গভীর জঙ্গল। জঙ্গলে বিভিন্ন প্রানী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা ওদের সাথেই দেখা করতে এসেছি। আশা করি কোনো প্রানী কে কেউ আঘাত করবেন না। আর একটা কথা এখানে বাঘের পদচিহ্ন ও পাওয়া গেছে। বাঘ থাকতে পারে , তাই সবাই সাবধান। দলবদ্ধ হয়ে সবাই ঘুরবেন। আর একে অপরের সাহায্য করবেন। আমরা একটু পর গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করবো।
এখানে বড় বড় গাছ নেই তবে ছোট গাছের অভাব ও নেই। তাই পোকা মাঁকড় থেকে সাবধান। আর যাদের এলার্জির সমস্যা আছে তারা গাছের সংস্পর্শে আসবেন না । ”

ব্রিফিন দেওয়া শেষে সবাই আবার ঘুরতে লাগলো। মাহেরা বার বার অভিনবর সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। আর তা দেখে ঝিলের রাগে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার মতি গতি সুবিধার নয়। নিঃসন্দেহে মেয়েটা ঝিলের থেকে অধিক সুন্দরী। আর তার জন্যি ই ঝিলের চিন্তা। তবে এই চিন্তার আসল কারন ঝিলের জানা নেই।
অবশ্য ওহ মাথা ঘামাচ্ছে ও না। তবে অভিনব মাহেরার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে তা আর ও নিতে পারছে না ঝিল। হাতে থাকা কাশ ফুল টা ঝটকা মেরে ফেলে দিলো। একা একাই হাঁটতে লাগলো।

অভিনব সব কিছুই লক্ষ্য করেছে। ঝিলের দিকে ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে অভিনব ও ছুট লাগালো। এই মেয়েটা উল্টো দিকে যাচ্ছে কেন ?

অভিনব ঝিলের পাশে এসে দম ফেললো। ঝিল এক পলক তাকিয়ে আপন মনে হাঁটতে লাগলো। অভিনব মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল
_ এই দিকে যাচ্ছেন কেন ? সবাই তো এখন জঙ্গলে যাবে।

_ তো কি হয়েছে? আমি যাচ্ছি না ব্যাস।

_ হোয়াট।

_ এতো চেঁচাচ্ছেন কেন ? আপনি সরুন আমার কাউকে দরকার নেই। আমি একাই ঘুরতে পারি।

_ ঝিল। একটু পর পর ই রেগে যাচ্ছেন কেন ? সমস্যা টা খুলে বলুন প্লিজ।

ঝিল রেগে গেল। কাঁধের ব্যাগ টা খুলে ধুম করে অভিনবর হাতে রাখলো। অভিনব প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো।

_ শুনুন আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনার ই বরং আমাকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। মাহেরা আপু কে ঠিক ঠাক সময় দিতে পারছেন না। একটু পর পর ই আমার দিকে চলে আসতে হচ্ছে।

_ ঝিল।

_ একদম কথা বলবেন না আমার সাথে। জান আপনি আমার লাগবে না আপনাকে।

_ কি হয়েছে এমন করছেন কেন ?

ঝিল মুখ ফিরিয়ে নিলো। একা একাই হাঁটতে লাগলো। অভিনব তাচ্ছিল্যর হাসি দিলো। একটু দূর গিয়েই আহহ বলে চিৎকার করে উঠলো। দৌড়ে এসে অভিনব কে জড়িয়ে ধরলো। অভিনব বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ঝিল চোখ খিচে বন্ধ করে আছে।

_ কি হয়েছে ? চিৎকার করে উঠলেন কেন ?

_ আমার পায়ে কি যেন উঠেছিলো।

_ দেখি , কোথায় এখন তো নেই।

_ ছিলো তখন।

_ আচ্ছা আমার সাথে আসুন দেখছি আমি।

ঝিল অভিনবর জ্যাকেট খামচে ধরলো। অর্থাৎ সে যাবে না। অভিনব ফোঁস করে দম ফেলে বলল
_ যদি এমন কোনো প্রানী হয় যার জন্য আপনার এলার্জি উঠে যেতে পারে। তাই আমাকে দেখতে যেতেই হবে।
আসুন আমার সাথে

_ অভিনব

_ আমি আছি তো ? কিচ্ছু হবে না। এবার ব্যাগ টা ধরুন।

ঝিল কাঁদো কাঁদো মুখ করে অভিনবর জ্যাকেটের হাতা ধরে হাঁটতে লাগলো। ঝিল যেখানে ছিলো এখানে এসে অভিনব ভ্রু কুঁচকালো। কোন এক প্রানী দেখা যাচ্ছে । খানিকটা কচ্ছপ এর মতো। তবে একটা লম্বা সুর ও দেখা যাচ্ছে।
অভিনব উবু হয়ে সেটা কে ধরতে যেতেই ঝিল বাঁধা দিলো। অভিনব আশ্বস্ত করলো ঝিল কে। কিন্তু ঝিল মানতে নারাজ। ওহহ কিছু তেই অভিনব কে এই প্রানী টা কে ধরতে দিবে না।
অভিনব ঝিল কে উপেক্ষা করে ধরতে যেতেই ঝিল ডুকরে কেঁদে উঠলো। অভিনব বুঝতে পারে না এই মেয়েটা এতো কাঁদে কেন ?
ন্যাকা কান্না করলে ও হতো। তবে এটা সত্যি সত্যি ই কাঁদে । কি আজব

একটা গাইড এসে অভিনব আর ঝিল কে ডাকলো। অভিনব সরস হেসে বলল
_ আচ্ছা দেখুন তো এটা কোন ধরনের প্রানী ।

লোকটা ভ্রু কুঁচকে প্রানী টা কে উল্টোলো। তারপর লম্বা হেসে বললেন
_ আরে এটা তো কাঁকড়া ।

ঝিল অবাক হয়ে বলল
_ কাঁকড়া ?

_ হ্যাঁ এটা সামুদ্রিক কাঁকড়া।

অভিনব লম্বা হেসে বলল
_ ওহহো এটা কে তো রাজ কাঁকড়া বলে।

গাইড লম্বা হেসে বললেন
_ আপনারা আসুন।

অভিনব মাথা ঝাঁকালো , লোকটা চলে গেল। ঝিল তাজ্জব বনে গেল। অভিনব মৃদু হেসে বলল
_ সামুদ্রিক কাঁকড়া বেশ প্রয়োজনীয়।
বঙ্গোপসাগরের অন্যতম জীবন্ত জীবাশ্ম রাজ কাঁকড়ার রক্ত শুধু নীলই নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। রাজ কাঁকড়ার প্রতি গ্যালন নীল রক্তের দাম প্রায় ৫০ লাখ টাকা।

_ 50 লাখ টাকা ?

_ হুমমম

_ তাহলে তো আমি কাঁকড়ার রক্তের বিজনেস করে বড়লোক হয়ে যাবো।

ঝিলের কথা তে অভিনব মৃদু হাসলো।মেয়েটার বাচ্চা সুলভ আচারন অভিনব কে টানছে খুব। অভিনব নিজে কে সামলে নিয়ে বলল
_ ইংরেজিতে ‘ব্লু ব্লাড’ নামে একটি শব্দগুচ্ছ রয়েছে, যার অর্থ হলো অভিজাত বংশীয়। সপ্তদশ শতকে নীল রঙ ছিল খুব দামি। শুধুমাত্র অভিজাতরাই এই রঙের কাপড় কিনতে পারতো। সেখান থেকেই এসেছে শব্দগুচ্ছটি। তবে প্রকৃতিতেও এরকম এক প্রাণি আছে যার রক্ত সত্যিই নীল। রাজ কাঁকড়াই সেই জীব।

বঙ্গোপসাগরের অন্যতম ‘লিভিং ফসিল’ (জীবন্ত জীবাশ্ম) রাজ কাঁকড়ার রক্ত শুধু নীলই নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ৪৫০ মিলিয়ন বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে বাস করে আসা এই প্রাণিটির অস্তিত্ব আজ সঙ্কটে। অভিযোগ রয়েছে, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট বাংলাদেশের বিভিন্ন উপকূল এলাকা থেকে রাজ কাঁকড়া ধরে থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। ফলে ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রাণিটি।

তবে, বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে প্রাণিটি হারিয়ে গেলেও এখনও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন দ্বীপ ও ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদঘেরা কাদা-বালুময় অঞ্চলে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে প্রাণিটি। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর পর্যবেক্ষণেও বাংলাদেশে প্রাণিটির অবস্থান লাল তালিকায়।
তবে এটার সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এটা এ দেশের বিশাল এক সম্পদ ।

অভিনবর দিকে ঝিল হা করে তাকিয়ে আছে। অভিনব গলা ঝেরে বলল
_ কি ?

_ একটা কথা বলুন তো । আপনি কি মাথায় বই নিয়ে ঘুরেন নাকি ? এতো সব জানেন কি করে ?

_ মাথায় বই নিয়ে না ঘুরলে ও ব্যাগে বই নিয়ে অবশ্যই ঘুরি।

কথা টা অভিনব রসিকতার ছলেই বললো। ঝিল ভেঙ্চি কেঁটে বলল
_ একদিন আমি ও বলবো আর আপনি শুনবেন দেখে নিয়েন।

_ আচ্ছা দেখে নিবো।

_ কি ?

_ এই যে বললেন। আপনি বলবেন আর আমি শুনবো।

_ ইসস ঢং কম করুন আর চুলন।

অভিনব অলসের মতো হাঁটতে লাগলো। ঝিল মুখ বাঁকিয়ে অভিনবর হাত টা ধরলো। অভিনব বোকার মতো চেয়ে রইলো। ঝিল জ্বিভ দিয়ে ভেঙ্চি কেঁটে অভিনব কে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো।
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_22

ডিমের চরের বনের গহীনে সবাই একটু ঘোরাঘুরি করলো। ছোট ছোট জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সবাই নিঃশব্দে হাঁটা খানিক টা গা ঝমঝম ভাব ছিলো। অবশ্য সারা টা সময় ঝিল অভিনবর বাহু তে ঝুলে ছিলো।
ডিমের চরে ওরা বেশ কিছু পাখি দেখতে পেল। শীতের শেষ সময় হলে ও এই সব পাখিরা এখানেই রয়ে গেছে।
একটা কিংফিশার দেখতে পেয়ে লাফিয়ে উঠলো ঝিল। পাখিটার মুখে ছোট কোনো মাছ । বোধহয় নদী থেকেই তুলে এনেছে এই মাত্র।
দুটো ব্ল্যাক হেডেড কাকু শালিক দেখতে পেল ওরা। যাদের মাথার অংশ টা কুচকুচে কালো। কমন রেড শ্যাংক , কেন্দিশ প্লোভার , লেসার স্যান্ড প্লোভার , কারলিউ স্যান্ডপাইপার , কারলিউ , হুইমবার্ল , গ্রেট থিকনি , রিভার টার্ন , হুইস্কার্ড টার্ন সহ নানা ধরনের পাখি। জঙ্গলের ভেতর এইসব পাখি নিজ হাতে ধরিয়ে ধরিয়ে দেখিয়েছে অভিনব ।
তা দেখে মাহেরার মুখ টা ছোট হয়ে গেছে। ঝিলের তখন বেশ মজা লেগেছে।
সবাই মিলে টেউয়ের মাঝে পা ও ভিজিয়েছে তারপর তিনকোনা দ্বীপ নামে এক দ্বীপে ও গিয়েছে।

সুন্দরবন প্রায় পাঁচ জেলাকে স্পর্শ করেছে। এখানে ছোট বড় প্রায় দুই শত দ্বীপ রয়েছে একটি ট্যুরে সব গুলো দ্বীপে যাওয়া কোনো কালেই সম্ভব নয়।
সাধারনত কয়েকটা দ্বীপেই ঘোরা হয়।

ডিমের চর থেকে সবাই কে নিয়ে বোর্ট এ উঠা হলো। এবার গন্তব্য পক্ষী খাল। পক্ষী খালের আসল সৌন্দর্য থাকে ভোরবেলা। তবে এখন নয়টা বেজে গেছে । তবু ও পাখির কিচির মিচির শোনা যাবে। পাখির কথা শুনেই ঝিলের কি লাফালাফি। ছোট সময়ে ওহ যখন ভোর বেলা আরবি পড়তে যেত তখন পাখির কিচির মিচির শুনতে পেত। দল বেঁধে গেলে ও একটা শব্দ ও করতো না ওরা। যাতে পাখির কলরব শুনতে পাওয়া যায়।
পক্ষীর খালের দিকে বোর্ট চলতে লাগলো। কুয়াশার কারনে এখনো সূর্য উদয় হয় নি। বোর্টের কর্নারে ঝিল আর অভিনব পাশা পাশি বসে আছে। ঝিল ছোট বাচ্চা দের মতো পানি দিয়ে খেলা করছে। অভিনব সর্তক চোখে তাকিয়ে আছে। যাতে ঝিল পানি তে উল্টিয়ে না পরে। পক্ষীর খালে প্রবেশ করতেই সূর্য যেন চোখ মেলে তাকালো কুয়াশার চাঁদর সরিয়ে। এক ফালি রোদ্দুর এসে অভিনবর গাল ছুঁইয়ে যাচ্ছে। অভিনব ঝরা হেসে আলো কে গায়ে মাখতে লাগলো। ঝিলের ডাগর ডাগর চোখ গুলো অভিনবর দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। অতিরিক্ত ফর্সা মুখ টা তে রোদ্দুর যেন খেলা করছে। সাদা রঙ টা হলুদ আভায় ছেয়ে গেছে।
ঝিলের এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো তার চোখে দেখা অভিনব পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর পুরুষ।
ঝিলের ইচ্ছে হলো অভিনব গাল ছুঁইয়ে দিতে। ঝিল নিজের ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রাখতে পারলো না । টুপ করে অভিনবর গাল ছুঁইয়ে দিলো। অভিনব অবাক চোখে তাকালো । ঝিল তখনো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। অভিনব তার ঘায়েল করা মারাত্মক হাঁসি ফুটালো। ঝিলের হাত দুটো মুঠো বন্দী করে সময় নিয়ে চুমু খেল। ঝিল চমকালো , লজ্জার সাথে ভয়ের মিশ্র অনুভূতি তে ঝিল নুইয়ে পরলো। এই মুহুর্তে কি হলো ঝিলের মাথার নিউরন গুলো আচ করতে পারলো না। অভিনব দারুন হাসি তে হাসলো।
সেই হাসি তে যেন মুক্ত ঝরে।ঝিল অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো।
ইসস কি দারুন অনুভূতি।

অভিনব লক্ষ্য করলো মাথার উপর দিয়ে ঈগল উড়ে যাচ্ছে। তবে ঈগল টা সাদা রঙের । ঝিল অভিনবর দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকালো। একে একে সবাই ঈগল টিকে দেখতে পেল। সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
ঝিল অভিনবর বাহু তে ধাক্কা মেরে বলল
_ ওয়াও এটা কি রকমের ঈগল ?

_ সাদা ঈগল এটা র আরেক নাম সাগর ঈগল।

ঝিল কোনো কথা বলল না। মোহনীয় চোখে পাখিটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ঈগল টার পাশে কোথা থেকে যেন আরেক টি ঈগল চলে আসলো। সবার মাথার উপর এক চক্কর দিয়ে ঈগলের জোড়া উড়ে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ঝিল। নিঃসন্দেহে এই পাখি দুটো কাপল। ঝিলের হঠাৎ করেই ভীষন লজ্জা লাগলো। অভিনব ঝিলের লজ্জা মাখা মুখ টা দেখতে পেয়ে সরস হাসলো।

সাগর ঈগল Accipitridae পরিবারে অন্তর্ভুক্ত Haliaeetus গোত্রের ৬৮ সে.মি. দৈর্ঘ্যের একটি শিকারী পাখি। পূর্ণবয়স্ক পাখির পিঠ ধূসর ও দেহের নিচে সাদা। মাথা, ঘাড়, বুক, পেট ও লেজ সাদা। এদের ডানা সম্পূর্ণ গোটানো অবস্থায় লেজ পর্যন্ত পৌঁছে থাকে। উড়ার সময় ডানার প্রান্ত ও মধ্য পালক স্পষ্ট দেখা যায়। এদের ডানার আকৃতি ভি চিহ্নিত থাকায় সবার নজর কাড়ে। ঠোঁট কালচে। পা ও পায়ের পাতা ধুসর-সাদা। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির একটু ভিন্নতা আছে। এদের পিঠ বাদামি ও লালচে-পীতাভ বর্ণের হয়। বুকের উপরের অংশ সম্পূর্ণ সাদা না হয়ে বাদামি হয়। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েপাখি পুরুষপাখির চেয়ে একটু বড় আকারের।

সাগর ঈগল উপকূলীয় পাখি হলেও নদীর তীর থেকে দূরের চরে, সুন্দরবনে আবার কখনো মিঠাপানির হ্রদে বিচরণ করে। সচরাচর এরা জোড়ায় বা একা থাকে। গাছে বসে বা আকাশে উড়ে নিচের খাবার খোঁজে। শিকার দেখামাত্র লম্বা নখ দিয়ে পানি থেকে শিকার তুলে নেয়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে সাপ, মাছ, কাঁকড়া, ইঁদুর ও অনান্য ছোট প্রাণি। মাঝে মাঝে সুন্দরবনের ছোট পাখিগুলোও এদের শিকার হয়। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এদের প্রজননকাল। উপকূলের পাড়ের উঁচু গাছে ডাল ও পাতা দিয়ে বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়েপাখি ২টি ডিম পাড়ে। মেয়েপাখি একাই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়।

সাগর ঈগল বাংলাদেশের সুলভ ও বিপদমুক্ত আবাসিক পাখি। বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের উপকূলে সচরাচর পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন ও মালয়েশিয়াসহ এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশেই এদের বিচরণ রয়েছে।

পাখি দুটো চোখের আড়াল হতেই ঝিল নুইয়ে পরলো। অভিনব ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করতেই ঝিল কেমন লজ্জা পেয়ে গেল। অভিনব মুগ্ধ দৃষ্টি তে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। চুল গুলো এলেমেলো হয়ে আছে। অভিনব ধীর হাতে চুল গুলো গুছিয়ে দিলো।
ঝিল শুধুই হাসলো, মেয়েটার এই হাসিতে অভিনব চোখ ফিরিয়ে নিলো।
তার মনের অবস্থা ভয়ঙ্কর। নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য চোখে মুখে পানি দিয়ে নিলো।

ঝিল লক্ষ্য করলো গাছের ডালে একটা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাচ্ছে। অভিনব কে প্রশ্ন করতেই অভিনব সে দিকে তাকালো। উত্তর না দিয়ে টপ করে একটা ফটো ক্লিক করলো। ঝিল প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো।

_ এটা এ দেশের বিরল আবাসিক পাখি চিত্রিতবুক কাঠঠোকরা। ডোরাবুক পাকড়া কাঠঠোকরা নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম স্টিক-ব্রেস্টেড উডপেকার। পিসিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Picus viridanus। সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চল থেকে মিয়ানমার হয়ে মালয়েশিয়া উপদ্বীপ পর্যন্ত পাখিটির বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।

সচরাচর এটার দেখা পাওয়া যায় না। ঝিল এক ব্রিবতি কর প্রশ্ন করে ফেললো।
_ অভিনব এটা মেয়ে না ছেলে ?

অভিনব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। গলা ঝেরে দৃষ্টি লোকালো। ঝিল আবার প্রশ্ন করলো। অভিনব তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল
_ দেখে তো মনে হলো পুরুষ পাখি।

ঝিল ঠোঁট দুটো প্রশস্ত করলো। পাখির কিচির মিচিরে ঝিল চোখ বন্ধ করে নিলো। দারুন এক পরিবেশ। মনে হচ্ছে পাখির রাজ্যে প্রবেশ করেছে ওরা। সাধারনত পক্ষীর খালে পানি খেতে আসে এইসব পাখি। শীত হওয়াতে বিদেশী পাখির আনা গোনা ও রয়েছে। ঝিল একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তবে সমস্ত পাখির নাম অভিনব বলতে পারলো না।
দুটো বক খালের পারে পানি খাচ্ছে। ঝিল সাদা বকের দিকে তাকিয়ে রইলো। এক মুহূর্তের জন্য অভিনব কে বকের সাথে তুলনা করে ফেললো।
তারপর ই খিল খিল করে হাসি। অভিনব ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলো। ঝিল পেট চেপে হাসছে । অভিনব খপ করে ঝিলের কোমর জড়িয়ে ধরে ফেললো। একটুর জন্য মেয়েটা পানিতে পরে যায় নি। ঝিল নিজেকে স্বাভাবিক করে ফিসফিস করে হিম শীতল কন্ঠে বলল
_ আপনাকে বকের মতো দেখতে লাগছে।

অভিনব তাজ্জব বনে গেল । সত্যি ই কি তাকে বকের মতো লাগছে ? অভিনব নিজ প্রশ্নে নিজেই বোকা বনে গেল। ঝিল ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগলো।

ঝিল সামান্য আশাহত হলো কারন এখানে তার পরিচিত পাখি গুলোর আনা গোনা কম। তবে একটা পাতিবাটান পাখির দেখা ও মিললো। কেন যেন পরিচিত পাখি গুলো কে দেখতে ইচ্ছে করছে।
ঝিলের মাথায় হঠাৎ এক প্রশ্ন আসলো। অভিনব বুঝলো কি করে কাঠঠোকরা টা পুরুষ পাখি।

_ এই যে শুনুন ।

_ হুম

_ আপনি জানলেন কি করে কাঠ ঠোকরা টা পুরুষ ছিলো।

_ তাই তো। আসলেই এটা ভাবার বিষয়।

_ মজা করছেন আমার সাথে ?

_ উহুহহ ।

_ তাহলে বলুন না কি করে বুঝলেন । আমি ও জানতে চাই। প্লিজ অভিনব , প্রমিস আপনাকে যাওয়ার আগে আমি চকলেট দিয়ে যাবো ।

_ সত্যি ?

_ হুমম পাক্কা।

_ তাহলে শুনুন ।

অভিনব বিজ্ঞ দের মতো গলা ঝেরে নিলো। ঝিল জানার জন্য তাকিয়ে আছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে মনোযোগী শ্রোতা হচ্ছে ঝিল।
অভিনব ফিক করে হেসে দিলো। ঝিল কোমরে হাত গুঁজে বলল
_ বলুন।

অভিনব দমে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো। তার স্টুডেন্ট এর বয়সী মেয়েটা তার বউ। আর সেই পিচ্ছি বউ টাকেই লেকচার দিবে ওহহ। তবে একটা পার্থক্য হচ্ছে স্টুডেন্ট রা ওর ধমক খায় আর ওহহ ঝিলের ধমক খায় । আপন মনেই হাসতে লাগলো অভিনব।

_চিত্রিতবুক কাঠঠোকরার দৈর্ঘ্য ৩০-৩৩ সেন্টিমিটার ও ওজন ৯০-১২০ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপরের অংশ হলুদাভ সবুজ। গাল ধূসর ও গোঁফরেখা কালো। অসংখ্য সাদা ছিটসহ ডানার ওড়ার পালক ও লেজ কালো। ঘাড়, গলা ও বুকের ওপরের অংশ হলুদাভ- জলপাই রঙের। সাদা আঁশের মতো ছোপসহ পেট, ডানার নিচ বা বগল ও পায়ু জলপাই রঙের। চোখ কালচে লাল। দুরঙা চঞ্চুর ওপরেরটি কালচে ও নিচেরটি হলদে। পা, পায়ের পাতা ও নখ কালচে। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও পুরুষের মাথার চাঁদি লাল ও স্ত্রীরটি কালো। দাগবিহীন ঘাড়-গলা-বুক, ধূসর গাল এবং সুস্পষ্ট দুরঙা চঞ্চুর মাধ্যমে চিত্রিতগলা কাঠঠোকরা থেকে পৃথক করা যায়।

ঝিল বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো।
অভিনব প্রশস্ত হেসে বলল
_ বুঝলেন এবার ?

ঝিল মাথা কাত করে সম্মতি জানালো।

বাংলাদেশে এদের কেবল সুন্দরবনেই দেখা যায়। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। গাছের কাণ্ড আঁকড়ে ধরে কিংবা মাটিতে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়িতে লাফিয়ে লাফিয়ে

পিঁপড়া, উইপোকা, গুবরেপোকা এবং এদের ডিম ও রসাল শূককীট খুঁজে খায়।
আর ভাগ্য থাকলে তখনি এদের দেখা মিলে।

পক্ষীর খালের কিছু দূর পর গোলপাতা গাছ রয়েছে। ঝিল বুঝতে পারলো না এ গাছ কে কেন গোলপাতা গাছ বলা হয়। এদের পাতা তো খানিকটা নারিকেল গাছের পাতার মতোই দেখতে। ঝিল আর মাথা ঘামালো না। নিঃশব্দে পাখির আনা গোনা উপভোগ করতে লাগলো। তবে সবাই হালকা উল্লাসে মেতে উঠেছে। যেহেতু সবাই ঢাকার ব্যস্ত নগরীর বাসিন্দা তাই পাখির দেখা সচরাচর তাঁদের মিলে না। গাইড সবাই কে চুপ করতে বললেন। না হলে পাখির কলধ্বনি শুনতে পাওয়া যাবে না। কিছুদূর পর পর বোর্ট থামানো হচ্ছে যাতে করে সবাই পাখির কিচির মিচির শুনতে পায়। পাখির কিচির মিচিরের শব্দে কানে এসে বিঁধে গেছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সেরা গান পাখি রাই গায়। পাখির কলধ্বনি এভাবে শোনা হয় নি কখনো। ঝিল ঠিক করলো এখন থেকে খুব ভরে উঠে বাগানে চলে যাবে। তারপর প্রান ভোরে পাখির গুনগুন শব্দে সকাল পার করবে।
ঝিলের দু চোখ চকচক করে উঠলো। অভিনব বুঝতে পারলো মেয়েটা কোনো গভীর ভাবনাতে মত্ত।

রাডি কিংফিশার , ম্যানগ্রোভ পিট্টা ও চোখে পরলো।
কিছু দূর যেতেই গহীন জঙ্গলে চোখে পরলো একটি মায়া হরিন। সবাই চুপ হয়ে গেল। হরিন টি জ্বিভ দিয়ে পানি খাচ্ছে। অভিনব সুন্দর করে সে দৃশ্য তুলে নিলো। ঝিল মাথা উচিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। অভিনব সামান্য রসিকতার হাসি দিয়ে বলল
_ আমার থেকে বয়সে আর হাইটে আপনি অনেক পিচ্ছি। সব সময়ে পা উচিয়েই দেখতে হবে।

এ কথা শুনেই ঝিলের প্রচন্ড রাগ হলো। ঝিল মোটে ও খাটো নয়। বাংলাদেশের পরিসংখ্যানে ঝিল কে মোটা মুটি লম্বা বলা যায়। ঝিল 5’3 আর অভিনব 6 ফিট। তো কি হয়েছে ঝিলের কলেজের ফাংশনে এক বিদেশী এসেছিলো যে 6’4 । আর ঐ বিদেশী ঝিলের সাথে নিজে সেলফি নিয়েছে।
ঝিল মুখ ফুলিয়ে রাখলো। অভিনব ঝিলের বাহু তে ধাক্কা মেরে ফিসফিস করে বলল
_ স্যরি।

ঝিল মানতে নারাজ। অভিনব হঠাৎ করে বোম ফাটিয়ে দিলো।
_ বউ রা বরের বুক পর্যন্ত হলেই মজা। যাতে করে এদের আষ্ঠে পৃষ্ঠে বুকে জড়িয়ে নেওয়া যায়। আর অন্য সব এডভানটেঞ্জ তো আছেই।

ঝিলের হার্ট বিট হাজার গুন বেড়ে গেল। অভিনবর মুখে বউ কথা শুনে অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে।
ওহহ কি সত্যিই অভিনবর বউ ? হ্যাঁ তাই তো ওদের তো বিয়ে হয়েছে। ঝিলের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।
অভিনব মৃদু ছন্দে গুনগুন করছে। ঝিলের হঠাৎ করেই মনে হলো অভিনবর বলা সেই কথাটা।
” আপনাকে মুক্ত করে দিবো ঝিল ”
ঝিলের হৃদপিন্ড কেঁপে উঠলো। চোখ দুটো ভিজে গেল। খুব ইচ্ছে হচ্ছে অভিনব করে জড়িয়ে চিৎকার করতে। ইচ্ছে হচ্ছে বলতে আমি মুক্তি চাই না অভিনব । আমি চাই না ডিভোর্স। কিন্তু কোথাও এসে চিৎকার গুলো থেমে যাচ্ছে। ঝিল হতাশ চোখে অভিনবর দিকে তাকালো। তখন অভিনবর দৃষ্টি ছিলো ঝিলের দিকেই। দুজনের চোখা চোখি হয়ে গেল। দুজনের চোখেই হতাশার ছাঁপ। আচ্ছা দুজনের অনুভূতি গুলো কি একি দিকে যাচ্ছে ? নাকি এখানেই ওদের পথ চলার সমাপ্তি ঘটবে ?
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_23

দুবলার চর বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ যা চর নামে হিন্দুধর্মের পূণ্যস্নান, রাসমেলা এবং হরিণের জন্য বহুল পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর।[১] এই চরের মোট আয়তন ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয় এবং মেহের আলির চর নিয়ে দুবলার চর গঠিত। দুবলার চরে শুধু মাত্র টেলিটক এর নেটওয়ার্ক রয়েছে।
ভ্রমন গাইড দের কাছেই টেলিটক সিম আছে । যা দেখে সবাই আফসোস করছে। সবার এই বিষয়ে তেমন আইডিয়া ছিলো না। তাই টেলিটক সিম ও নেই। কিছুক্ষণ আগেই দুবলার চরের উদ্দেশ্যে বোর্ট ছাড়া হয়েছে। বরাবরের মতোই অভিনব ঝিল কে নিয়ে কর্নারে বসেছে। ঝিল বায়নার সুরে বলছে সে পানি তে পা ভেজাবে। অভিনব বার বার নাকোচ করে যাচ্ছে।যার জন্য ঝিল মুখ ভার করে রইলো। অভিনব তপ্ত শ্বাস ফেললো। এই মেয়েটা কোনো কথাই শুনবে না।
_ ঝিল ।

_ কি ?

_ যান ।

_ কোথায় যাবো ?

_ পানিতে পা ভেজান ।

_ সত্যি ?

অভিনব মৃদু হেসে সম্মতি জানালো। ঝিল উঠে দাঁড়ালো। অভিনব দাঁড়িয়ে ঝিল কে ঘুরিয়ে বসালো। ঝিল কে ব্যালেন্স করতে অভিনব নিজে ও ঝিলের পাশে বসলো।
ঝিল জিন্স টা ফোল্ড করে পানিতে পা ভিজাতে লাগলো। অভিনব ও পানি তে পা রাখলো। ঝিল কিছু টা পানি অভিনবর দিকে ছিটিয়ে দিলো। অভিনব রাগি চোখে তাকালে ই ঝিল খিল খিল করে হাসতে লাগলো।
এতোটাই হাসছিলো যে বোর্ট থেকে পরেই যাচ্ছিলো। অভিনব রাগী চোখে তাকিয়ে ঝিলের কোমর জড়িয়ে বসলো। ঝিলের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। অভিনব একটু আলগা করেই ধরলো। ঝিল কাচু মাচু করতে লাগলো। অস্বস্তি আর শিহরনে নুইয়ে যাচ্ছে। অভিনব সে দিকে পাত্তা দিলো না। মেয়েটার চরম শাস্তি হওয়া দরকার । এতো বেশি বাচ্চামো শুরু করেছে যে অভিনব হিম শীম খাচ্ছে।
_ অভিনব।

_ হুসসস একটা কথা ও না। অস্বস্তি হলে হোক।

_ কিন্তু

_ আমি ছুইয়েছি দেখে কোনো সমস্যা ?

অভিনব কথা টা রগরগা কন্ঠেই বললো। ঝিল সামান্য ভরকে গেল। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
_ না।

অভিনব হাসলো। ঝিলের অস্বস্তি কমলো না। অভিনব তবু ও ঝিল কে এক হাতে জড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে অস্বস্তি দিতেই মজাই লাগছে। অভিনব কিছু টা পানি উঠিয়ে ঝিলের মুখে ছিটিয়ে দিলো। ঝিল রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই অভিনব মুখ চেপে হাসতে লাগলো।
ঝিল আর কিছুই বললো না। ধীরে ধীরে অভিনবর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো। অভিনব মৃদু হাসলো। মেয়েটা বড্ড চাঁপা স্বভাবের। এভাবে চলতে লাগলো অন্ত নিশ্চিত।
আলতো হাতে ঝিল কে আরেকটু কাছে টেনে নিলো। ঝিল ও কোনো প্রতিক্রিয়া না করে অভিনব কে অনুভব করতে লাগলো।
দারুন এক অনুভূতি বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে সময় টা এখানেই থেমে যাক।
এই মানুষটার হাতে হাত রেখে আরেকটু পথ চলা যাক।
আচ্ছা এই মৃদু ছন্দে মাতাল করা হাওয়া গুলো কি থেমে যাবে ?
কয়েক দিনের মাঝেই যে ওরা পুরোপুরি আলাদা হয়ে যাবে ।
তখন ও কি পাখির কূজন শোনা যাবে ? নাকি থেমে যাবে সকল প্রক্রিয়া। কোনো এক ধূসর আকাশ থেকে ডানা মেলে এক ঝাঁক ধূসর রঙের প্রজাপতি এসে কি স্পর্শ করে যাবে। অনুভূতি তে কি শিউরে উঠবে ঝিল। আর অভিনব বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ঝিল কে আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে নিবে। নাকি সব এখানেই শেষ।
ঝিল হাসলো, মৃদু ছন্দে দু এক লাইন গান ও আওরালো।
অভিনব অনুভব করলো সে সুর। যে সুরে প্রেমের আহ্বান। যে সুরে পরিপূর্নতার আহ্বান। অভিনবর শ্বাস ঘন হয়ে গেল। এ কেমন অনুভূতি হচ্ছে ?
কিসের এতো ভয় ? কাছে আসার নাকি হারিয়ে ফেলার ?
অভিনবর উত্তর মিললো না। তার ই আগে দুবলার চরে এসে বোর্ট ভিরে গেল।

*

দুবলার চর মূলত শুঁটকির কারবার। পর্যটক দের শুঁটকি মাছ বানানোর প্রক্রিয়া দেখানো এবং শুঁটকি কেনার জন্য ই এখানেই নামানো হয়।
অভিনব বরাবর ই বাঙালি কালচার বেশ পছন্দ করে। আমেরিকান হলে ও রক্তের টান তো থেকেই যায়।
অভিনব খুব বেশি এক্সাইটেড তবে শুঁটকি মাছের কথা শুনেই ঝিলের মন খারাপ হয়ে গেছে।
শুঁটকি মাছের উগ্র গন্ধ ঝিলের অপছন্দ। এই দিকে বিদেশী ফর্সা বকের নাকি শুঁটকি মাছের প্রতি ঝোঁক রয়েছে। ঝিল অবাক হয়ে তাই ভাবছে। তার ভাবনার ছেদ ঘটলো অভিনবর ধাক্কাতে।
ঝিল সরু চোখে অভিনবর দিকে তাকালো। এই ছেলেটা যখন তখন ধাক্কা মারে। ক্যান রে সুন্দর করে নাম ধরে ডাকলেই তো হয় ?

ঝিলের দৃষ্টি অনুসরণ করে অভিনব তাকালো। সামনে বেলাভূমি ছাড়া তো কিছু নেই। এই মেয়ে দেখে টা কি ?
_ ঐ দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন ?

_ দেখছি না ভাবছি ।

_ আচ্ছা তো কি ভাবছেন ?

_ এই যে আপনি যখন তখন আমাকে ধাক্কা মারেন। সুন্দর করে ডাকলেই তো আমি সাড়া দেই তাই না ?

_উমম তা ঠিক। তবে আপনাকে যে কয়েক বার ডেকেছি আপনার ধ্যানের ছন্দপতন কি ঘটেছে ?

_ ডেকেছিলেন বুঝি ?

_ না ডাকি নি। এবার চলুন , সবাই এগিয়ে গেছে।

_ অভিনব আমি যাবো না। প্লিজ প্লিজ , শুঁটকি মাছের উগ্র গন্ধ তে আমার গা গুলিয়ে আসে।

অভিনব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল
_ আপনি তাহলে বোর্ট চালকের সাথে বোর্ট এ গিয়ে বসুন।
আমি মাহেরার সাথে যাচ্ছি। কোথাও যাবেন না কিন্তু।

বলেই অভিনব হাঁটা লাগালো। কাজ টা অভিনব ইচ্ছে করে করলো নাকি তা বোঝার উপায় নেই। ঝিল কোমরে হাত গুঁজে দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। নিশ্চয়ই এখন মাহেরার সাথে ঢলাঢলি করবে। শালার সবাই এক , এই বিদেশী বক টার ও চরিত্রের দোষ আছে।
ঝিল লম্বা করে শ্বাস নিলো। শুঁটকির সাথে আজ মহা যুদ্ধ করবে ওহ। তবু ও অভিনব কে জ্বলন্ত লাভা মাহেরার হাতে ছাড়বে না।
সুযোগ পেলেই খপ করে অভিনবর গাঁয়ে এসে পরবে।
ঝিল আল্লাহর নাম স্মরন করে দৌড় দিলো। কি জানি আজ শুঁটকির সাথে মহাযুদ্ধ তে হেরে গিয়ে প্রান টা না দিতে হয়।
ঝিল হাঁফাতে লাগলো। অভিনব ক্যামেরা দিয়ে ফটো ক্লিক করতে করতে বলল
_ কি হলো ? চলে আসলেন কেন ? আরে বোর্টের মামা রোগা পাতলা মানুষ। কিছু করতে আসলেই খপ করে ফেলে দিবেন।

তাছাড়া আপনি তো এই টুকু বলেই ঝিলের পকেটের ভাঁজে থাকা লুকিয়ে রাখা ছোট্ট নাইফ টা টান মেরে বের করে ফেললো অভিনব।
নাইফ টা ফোল্ড থেকে একটু একটু করে খুলে বলল
_ এটা দিয়ে না হয় পেট ফুটো করে দিবেন।

ঝিল ভয়ার্ত চোখে তাকালো। অভিনব এটার খোঁজ পেল কি করে ?
ঝিল কে ঘামতে দেখে অভিনয় হাসলো। অভিনবর হাসি দেখে ঝিল আরো ভরকে এলো। অভিনব খানিটা ঝুঁকে নিয়ে ঝিলের কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল
_ আমি ছুঁইয়ে দিলে বুঝি এই নাইফ দিয়ে আমার পেট ফুটো করে দিবেন ?

ঝিলের রন্ধে রন্ধে শীতল এক তরল নেমে গেল। লজ্জা তে একদম মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। অভিনব ঝিল কে আরেকটু অস্বস্তি দিতে ঝিলের চুল গুলো যত্ন করে গুছিয়ে দিলো।
একটু কাছে এসে ঝিলের পিঠ জড়িয়ে বলল
_ এখন ? এই যে আমি ছুঁইয়ে যাচ্ছি?

ঝিল চোখ নামিয়ে ফেললো। অভিনব মৃদু হেসে ঝিলের জিন্সের পকেটের ফোল্ডে যত্ন করে নাইফ টা রেখে দিলো।
ঝিল মৃদু শ্বাস ফেলে বলল
_ আসলে

_ আসলে আপনি নিজের সেফটির জন্য এই সব কিছু শিখে রেখেছেন।
কিন্তু লাভ কি হলো আমি তো সব ধরে ফেললাম।

ঝিল চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। অভিনব ঝিলের হাতার ফোল্ডে রাখা একটা মিশ্র পাউডারের মতোন বের করে সামনে রাখলো।
ঝিল ফাঁকা ঢোক গিলে নিলো।
অভিনব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যাকেট টা দেখে বলল
_ আচ্ছা এটার ব্যবহার কি এটা কি চোখে মেরে দেয় ?

ঝিল মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বোঝালো। অভিনব এক ফালি হেসে ঝিল কে নিয়ে হাঁটা লাগালো।
ঝিলের কাছে এসব আছে তা প্রথম দিন ই বুঝেছিলো অভিনব।
মেয়েটার সাহসিকতার প্রশংসা অবশ্য ই করতে হয়।
তবে অভিনব এ ও জানে ঝিল ওকে পরিপূর্ন বিশ্বাস করে। অবিশ্বাসের খাতায় অভিনবর নাম টা কাঁটা পরে গেছে।
ঝিল নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল
_ স্যরি। আমি আসলে

_ ইটস ওকে। এটা কোনো অন্যায় নয়। নিজের সেফটির জন্য ছোট নাইফ এসিড এই সব অবশ্যই রাখা উচিত। ঘরে থাকতেই আপনি সেইফ নন। আর এটা তো বাইরের জগত। এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের খেলা চলবেই। আর বিষাক্ত হায়নার অভাব নেই। যারা মেয়ে মানুষ পেলেই ঝাঁপিয়ে পরে।
ঝিল ফোস করে দম ফেললো। অভিনব তাকে ভুল বুঝে নি তাহলে।

কিছুদূর যেতেই অভিনব বলল
_ বালির দিকে তাকান ঝিল ।

ঝিল তাকাতেই কেমন এক অদ্ভুত প্রানী দেখতে পেল। অভিনবর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তে তাকালো । অভিনব ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে বলল
_ এটা জেলি ফিস

*

সবাই দুবলার চরের বিখ্যাত নিউ মার্কেটে যাওয়া শুরু করেছে। শীত কালে এখানে খড়ের কিংবা গোলপাতার ছাউনি দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়।
সেখানে নানা রকমের দ্রব্য বিক্রি করা হয়। অভিনবর হাতে ভর করে হাঁটছে ঝিল। ক্লান্ত লাগছে খুব। খানিক টা খিদে ও পেয়েছে। আরেকটু হাটতেই একটা দোকানে মিষ্টির মতো একটা জিনিস দেখতে পেল ঝিল ।
চোখ দুটো যেন চকচক করে উঠলো। অভিনবর হাত ধরে বাচ্চা দের মতো বায়না করতে লাগলো।
অভিনব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল
_ আচ্ছা চলুন। কিন্ত বেশি খাওয়া যাবে না।

ঝিল মাথা ঝাঁকালো। দোকানদার অভিনব কে দেখে জড়সড়ো হয়ে পরলো। এমন সুন্দর বিদেশী দেখে সাধারন মানুষের অবস্থা যা হয় আর কি।
অভিনব পাত্রে রাখা ছোট আকারের মিষ্টি দেখিয়ে বলল
_ এটা কি ধরনের মিষ্টি?

লোকটা ভারী অবাক হলো। এতোটাই আশ্চর্য হয়েছে যে অভিনবর দিকে ড্যাপ ড্যাপ করে তাকিয়ে রইলো।
হয়তো ভেবেছিলো বিদেশী ছেলেটা ইংরেজি তে এক গাঁদা বুলি ছুড়বে আর সে থমথমে মুখ করে তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু তার ভাবনার বারো টা বাজিয়ে দিয়ে অভিনব বাংলা বললো।
অভিনব আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো। এবারো কোনো উত্তর দিলো না। ঝিলের মনে দারুন এক সন্দেহ জন্ম নিলো। আচ্ছা লোকটার কি গে দোষ আছে ?
ঝিল গলা ছেড়ে বলল
_ মামা এই মিষ্টির নাম কি ?

এবার লোকটা জবাব দিলো।
_ মধু জাম।

অভিনব মিষ্টি গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল
_ বাহহ বেশ ভালো নাম তো।

আচ্ছা চারটে চারটে আটটা মিষ্টি দিন আর সাথে দুটো পরোটা।

পরোটার সাইজ ছোট তাই অভিনব দুজনের জন্য দুটো পরোটাই নিলো।
এখান থেকে ফিরে আবার লাঞ্চ করতে হবে।
লোকটা মাথা ঝাঁকিয়ে মিষ্টি আর পরোটা দিলো। ঝিল আর অভিনব পাশা পাশি বসে খেতে লাগলো।
ঝিল গোগ্রাসে খাচ্ছে। অভিনব একটা প্রশ্ন করেই ফেলল
_ একটা কথা বলুন তো আপনি কি সব সময় ই ক্ষুধার্ত থাকেন ?

_ কেন ?

_ যখনি খেতে দেই কেমন গোগ্রাসে খেতে থাকেন ।

ঝিল ভ্রু কুঁচকে নিলো। পরটো মুখে পুরে দিয়ে বলল
_ শুনুন আমি অল্প অল্প করে খাই। তাই হুটহাট আমার খিদে পায়। আপনি তো একবেলাই আমার মতো তিনজনের খাবার গিলে ফেলেন।

অভিনব ঝিলের কথা তে ক্ষীন হাসলো। মেয়েটা ঝগড়ায় বেশ পারদর্শী। অভিনব কল্পনা করলো তার ফ্যামিলি পঞ্চাশ জন সদস্যর জয়েন ফ্যামিলি।
সেখানে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে ঝিল। আর সবাই একটার পর একটা কথা বলছে। হঠাৎ করেই জ্বলন্ত লাভার মতো ঝিল তেতে উঠলো।
কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে ঝগড়া করতে লাগলো।
অভিনব ফিক করে হেসে দিলো। নিজের ভাবনাতে নিজেই আশ্চর্য হলো। ঝিল শুধু মাত্র ওর সাথেই ঝগড়া করতে পারে। আর সবার সামনে মাথা নিচু করে থাকে।
সবাই হেসে ছিলো দেখে কি কান্না টাই না করলো সেদিন।

ঝিল খাবার খেয়ে ঢকঢক করে পানি গিলে নিলো।
অভিনব বিল পে করে আবার হাঁটতে লাগলো । নদীর ধারে অনেক গুলো বোর্ট দাড় করানো।
মূলত জেলেরা বোর্ট কিংবা নৌকা দিয়ে মাছ ধরে আনে। আর তারপর ই সেগুলো কে শুঁটকি করা হয়।
দুবলার চরের মানুষের অর্থনীতির প্রধান অংশ এই শুঁটকি থেকেই আসে।
শুঁটকি পল্লি তে ঢুকেই ঝিলের গা গুলিয়ে আসলো। অভিনব বিষয় টা বুঝতে পেরে কড়া ধাঁচের লেমন ফ্লেবার মাস্ক এ লাগিয়ে দিলো।
তারপর মাস্ক টা ঝিল কে পরিয়ে দিলো। ঝিল যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
পুরো মাঠ জুড়ে শুঁটকি শুকানো হচ্ছে । তবে ছুড়ি মাছের সংখ্যা বেশি ।
দুবলার চরের নিউ মার্কেটে সিঙ্গারা আর জিলাপি দেখে ও ঝিল বায়না ধরলো। কিন্ত অভিনব এবার তা খেতে দিলো না। এভাবে খেলে নির্ঘাত পেট খারাপ হবে।
আর অভিনব বরাবর ই খাবারের ব্যপারে সচেতন।
তাছাড়া আজ বিকেলে আস্ত খাসি বারবিকিউ করা হবে।
ঝিল তাই নুইয়ে গেল। দুবলার চরে মোটামুটি সব রকম জিনিস ই পাওয়া যায়।
এখানের অধিকাংশ মানুষ ই জেলে। সবাই শুঁটকি পল্লি ঘুরে ফিরে আসলো। এখন মোটামুটি সাড়ে এগারোটা বাজে।
সবাই বোর্টে উঠে বসলো। তবে এবার বিপত্তি ঘটলো মাহেরা কে নিয়ে । সে অভিনবর পাশে গিয়ে বসলো। অভিনব কে রিকোয়েস্ট করলো যাতে ঝিলের মতো ওকে ও ধরে রাখে আর পানিতে পা ভেজাতে সাহায্য করে।
ঝিল রগরগে মেজাজ নিয়ে দাড়িয়ে থাকলে ও কিছু বলতে পারছে না।
কোথাও একটা বাঁধা কাজ করছে। কারন এখন সে অভিনবর পরিচিত বই কিছুই নয়। ঝিলের খুব রাগ হলো। কেন ওহহ অভিনবর কেউ নয় ?
কেন অধিকার খাটিয়ে বলতে পারছে না কিছু। অভিনব জানে ঝিল ভেতরে ভেতরে জ্বলছে। তবু ও এক পলক ঝিলের দিকে তাকালো। ঝিল চোখ ফিরিয়ে নিলো । অবশেষে মাহেরার দিকে ফিরে নাকোচ করবে তখনি ঝিলের উদ্দেশ্যে মাহেরা বলল
_ ঝিল আমি এখানে বসলে নিশ্চয়ই তোমার কোনো সমস্যা হবে না ?

ঝিল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অভিনবর দিকে। অভিনব ইশারা করলো যাতে মাহেরা কে না করে দেয়। কিন্তু ঝিল তো ঝিল ই প্রচন্ড রাগে আক্রোশে বলল
_ না আপু আমার কোনো সমস্যা নেই।

মাহেরা তো বেজায় খুশি। অভিনব ঝিলের দিকে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ঝিল ছলছল নয়নে চোখ ফিরিয়ে নিলো। অভিনব ঝিলের দিকে আবেক মাখা চোখে তাকিয়ে আছে । মেয়েটা এতো বোকা কেন ?
ঝিল মাহেরার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে স্থান ত্যাগ করতে চাইলো। কিন্তু অভিনব ঝিলের হাত আঁকড়ে ধরলো। ঝিল কিছু বলবে তার আগেই ঝিল কে অভিনব এক পাশে বসিয়ে নিলো। মাহেরার দিকে তাকিয়ে বলল
_ ঝিল তো সবার সাথে কমফার্টেবল নয় তাই ঝিল এই পাশে বসুক তুমি আমার এই সাইডে বসো ।
আমি তোমার হাত ধরে রাখবো।

মাহেরা মুখ টা কালো বর্ন করে ফেললো ওহহ প্লাস্টিকের হাসি রেখে অভিনবর ডান পাশে বসে পরলো। অভিনব একটু নিচু হয়ে ঝিল কে বলল
_ একদম পানি তে ফেলে দিবো। এতো বোকা কেন হুহহ ?

ঝিল কিছু বললো না। অভিমানের পাল্লা টা ভারী হয়ে গেছে। অভিনব ধীর হাতে ঝিল কে পাশে বসিয়ে দিলো। মাঝে বসে ঝিল কে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো। আর অন্য হাতে মাহেরার হাত ধরে রাখলো। মাহেরা স্পষ্ট লক্ষ্য করলো অভিনব ঝিলের কোমর জড়িয়ে আছে।
যা দেখে মাহেরার রাগ হলো। ওহহ চাইছিলো অভিনব ঝিলের মতো করে ওকে ধরে রাখুক। কিন্তু অভিনব শুধু হাত ধরে রাখলো।
মাহেরা মিনিট কয়েক পা ভিজিয়ে সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে উঠে চলে গেল। অভিনব এক ফালি হেসে ঝিলের সাথে লেপ্টে বসলো।
ঝিল অভিনবর শার্ট খামচে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো।
ঝিলের কেন জানি বলতে ইচ্ছে হচ্ছে
_ অভিনব আমার হিংসে হচ্ছিলো।

কিন্তু আর বলা হলো না। কিছুক্ষণ পর অভিনব ফিস ফিস করে বলল
_ মাহেরার হাত ধরেছিলাম বলে হিংসে হচ্ছিলো ?

ঝিল না বোঝার ভান করে তাকিয়ে রইলো। অভিনব মৃদু হেসে বলল
_ আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন ঝিল।
আমি কাউকে টাচ করবো না। এই যে শুধু আপনাকেই জড়িয়ে আছি।

অভিনবর কথাতে ঝিল মৃদু হাসলো। কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি এসে দরজায় কড়া নেড়ে যাচ্ছে। সুখ সুখ অনুভূতি তে নুইয়ে যাচ্ছে ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here