#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪৪
আনভীরকে কড়াকড়িভাবে এড়িয়ে যাচ্ছি আমি। কেনো এড়াচ্ছি তা আমি নিজেও জানিনা। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছি চুমু দেওয়ার পরিবর্তে উনি যে এমন রিয়্যাকশন দেবেন সেটা জানলে আমি কখনোই ওই লোকের দিকে এমন একটা ভয়ঙ্কর চিন্তা নিয়ে এগোতাম না। একে তো উনি মানুষটা যেমন ভয়ঙ্কর, কথাবার্তায় সেই ভয়ঙ্করতার পরিমাণ ট্রিপল ক্রস করেছে। আমি নিশ্চিত উনি এ ব্যাপার নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন। তাই ভয়ে উনার ধারে কাছে যাওয়ার সহস পাচ্ছিনা। না জানি আবার কি উল্টাপাল্টা বলে বসে!
রাফিদ ভাইয়ার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটি বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই এখানকার কয়েকটা ছবি তুলে শিউলি ভাবিকে পাঠিয়ে দিলাম। ভাবি খুব মিস করছে আমাদের। এদিকে অনুষ্ঠানের গান বাজনার জন্য এত হৈ চৈ যে ভাবির সাথে ফোনে কথা বলার আর সুযোগ পেলাম না। অদূরেই ব্যস্তভাবে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে চলছেন আনভীর। হলুদের অনুষ্ঠান বিধায় অন্য চার পাঁচজন যুবকের মতো উনিও হলুদ রঙের পান্জাবি পড়েছেন। হাতাগুলো খানিকটা ওপরে তোলা। আমি কিছুক্ষণ দূর থেকে আড়নজরে ব্যস্ত এই মানুষটার দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিলাম। কথা বলতে থাকলাম বাকি সবার সাথে। রাফিদ ভাইয়ার ছোট বোন রুনি আমার থেকে দেড় বছরের ছোট। সেই সুবাদে ওর সাথেই আমার ভাবটা একটু বেশি হয়েছে। বাকি সবার কথা শুনেও একটা জিনিস বুঝতে পারলাম আনভীরকে সবাই যমের মতো ভয় পায়। উনি কথা বলেন কম, ধমকি ধামকি দেন বেশি। আর ওদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে পাড়া-শহর ঘুরে বেড়াতেই দেখলেই যেনো আরও বেশি ক্ষেপে যান। আমি ওদের প্রত্যেকের কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। এটা অবশ্য সত্য। কেননা আমার স্কুল পড়াকালীন সময় আনভীরের পরিবার যখন আমাদের এলাকায় প্রথম আসলেন উনার ব্যবহারেই একটু অবগত হয়েছিলাম। আমি ছিলাম এক নাম্বারের পড়া চোর আর ইনি তো রীতিমতো বিদ্যাসাগর। তাই দু’চোক্ষে দেখতে ইচ্ছে করতো না উনাকে। কিন্ত কপাল আমার ! ঘুরেফিরে উনার ভাগ্যেই আমি উড়ে এসে জুড়ে বসলাম।
আনভীরের চাচি এবার আমায় আর রুনিকে ডাক দিলেন রাফিদ ভাইয়াকে হলুদ দেওয়ার জন্য। আমি কথা না বাড়িয়ে তাই স্টেজের কাছে গেলাম। আমি আলতো করে উনাকে হলুদ মাখিয়ে দিলেও রুনি ভাইয়ার মুখ হলুদ দিয়ে জুবুথুবু অবস্থা করে ফেলেছে। সে কি কান্ড! রাফিদ ভাইয়ার প্রতিক্রিয়া দেখে আমার প্রচন্ড হাসি এসে পড়লো। কোনোমতে হাসি দমিয়ে অপর পাশে তাকাতেই হঠাৎ আনভীরের সাথে চোখাচোখি হলো আমার। উনি একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হাত ভাঁজ করে। তীব্র চোখজোড়ার প্রখর দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার দিকে। ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে একটা স্মিত হাসির রেশ। উনার এমন চাহিনী দেখে আমার হার্টবিট রীতিমতো মিস হয়ে গেলো যেনো। চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আনভীরের এ দৃষ্টির সাথে প্রথম পরিচিত আমি। কেননা উনাকে এতটা এগ্রোসিভ হতে আমি এর আগে কখনোই দেখিনি। আমার ধ্যান ভাঙলো চাচির ডাকে। অতঃপর আমরা স্টেজ থেকে নেমে আসার সময়েও আড়নজরে একবার দেখে নিলাম উনাকে। উনি তখনও দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের শীতল দৃষ্টি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, তখনকার কান্ডের জন্য আমার একটা ব্যবস্থা করেই ছাড়বে।
_______________
রাত প্রায় সাড়ে ১১ টা বাজে। প্রায় সব অতিথিরাই একে একে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে এখন। আমাদের মতো যারা দূরপাল্লার মেহমান তাদের জায়গা হয়েছে বড় ঘরটিতে। রাফিদ ভাইয়া ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবস্থায় একপ্রকার ঢুলু ঢুলু হয়েই চলে গেলো নিজের ঘরে। বেচারাকে উনার দস্যু ভাই বোনগুলো হলুদের দিনই জ্বালিয়ে মেরেছে। না জানি বাসর রাতে আবার কি করে বসে ! আমার সেদিকে ধ্যান নেই। আমি ভীত সতন্ত্র চোখে আশপাশে ভালোমতো দেখে নিলাম আনভীর আছেন কিনা। না, উনাকে দেখা যাচ্ছে না। এটাই মুখ্য সময় দ্রুত ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার। তাহলেই আর উনার মুখোমুখি হয়ে কোনো জবাবদাহীতা করতে হবে না ভেবেই আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। নাহিদ ভাই ,যে কিনা আমাদের বাস থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলো সে আমায় এভাবে উকি ঝুঁকি মারতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কারে খুঁজছেন ভাবি?’
নাহিদ ভাই বয়সে আমার বড় হবে বেশ। তবুও আমায় ভাবি ডাকছে দেখে আমি অপ্রতিভ গলায় বললাম,
-এভাবে আপনি করে বলছেন কেনো? আমি আপনার বয়সে অনেক ছোট হই।
নাহিদ ভাইয়া পরোয়া করলো না আমার কথায়। বলে ওঠলো,
-আপনারে নাম ধরে ডাকার সাহস নেই গো ভাবি। এমনিতেও আনভীর ভাই কড়ায় গন্ডায় বলে দিয়ছে, আমারে যদি আপনার সাথে টিটকারী করতে দেখে, থাপড়াইয়া আমার দাঁত সব ফালায় দিবে। এহন এটা কি ঠিক কথা কন তো? কাল ভাইয়ের বিয়ে , কই মেয়ে পটাবো আর আমার আনভীর ভাইয়ের ডরে লুকায় লুকায় থাকতে লাগতেসে।
আমি একটা চাপা হাসি দিলাম। বেচারার মতো প্রায় সবাইকে উনি এমন কথা বলে অতিষ্ঠ করে ফেলেছেন। এ বাড়িতে তো আমি অতিথি হিসেবে না, আছি দ্য মেন্টাল ম্যান আনভীর রেজওয়ান খান এর বউ ওরফে উনাদের ভাবিসাহেবা হিসেবে। নাহিদ ভাইয়া হঠাৎ আমার দিকে একটা কোকের বোতল এগিয়ে দিলো। বললো,
-‘কোকাকোলা খাবেন ভাবি?’
আমি না বলতে গেলেই হঠাৎ পেছন থেকে একটা পুরুষাত্নক কন্ঠ ভেসে এলো আমার কানে,
-‘কিরে নাহিদ, তোরে না বলেছি ভাবি হয় তোর। ভাফির সাথে এত কিসের কথা হ্যাঁ?’
আমি পেছনে ফিরলাম। আনভীর পান্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নাহিদ ভাইয়া কিছুক্ষণ বোকা হয়ে রইলো আনভীরের কথায়। অতঃপর জড়ানো গলায় বললো,
-আমি তো ভাবিরে শুধু কোকাকোলা খাওয়ার জন্য অফার করলাম।
উনি এগিয়ে আসলেন নাহিদের দিকে। অগোছালো চুলগুলো আরও আগোছালো করে বলে ওঠলেন,
-তুই কি চাস এই রাতে এসব হাবিজাবি খেয়ে আমার বউয়ের পেট খারাপ হোক?
-মোটেও না। আমি এমন কেনো চাইবো? আপনার বউ মানেই আমার বউ….(আনভীর চোখ রাঙানি দিতেই)ইয়ে মানে, আপনার বউ মানেই আমার ভাবি ; জাতির ভাবি। উনার সাথে আমি এমন করতে পারি?
-পকর পকর টা ইদানীং একটু বেশিই করস তুই। শোন, তোর ভাবি তো এমনিতেও পিচ্চি। তুই হলি আরেক দামড়া পিচ্চি। তাই তোরে ওয়ার্নিং দিলাম আমার পিচ্চি বউটার সাথে কম কম কথা বলবি।যদি আমি আবার শুনি, তুই আমার বদনাম করে ওর ব্রেইনওয়াশ করছোস , তোরে আমি নিজেই নর্দমায় ফেলে দিবো।
আনভীরের এ কথায় নাহিদ ভাইকে আর পায় কে।সে পাতলা গলি দিয়ে টুপ করে কেটে পড়লো এবার। আনভীর এবার কথা না বাড়িয়ে আমার হাত চেপে ধরে নিয়ে এলেন বেডরুমে। আমার তো আতঙ্কে রীতিমতো জান শুকিয়ে যাচ্ছে। রুমে আসতেই আমি কোনোমতে হাত ছাড়িয়ে বলে ওঠলাম,
-আমার…….আমার ঘুম পাচ্ছে। যাই ফ্রেস হয়ে আসি।
কিন্ত আমার কাজ বাধা দিলেন আনভীর। মিহি কন্ঠে বললেন,
-তখনকার সারপ্রাইজড গিফটে আমি তো শকড হয়ে গিয়েছিলাম আহি বেবি। এখন তাহলে রিটার্ন গিফট নিয়ে যাবে না?
-আমি অনেক দয়ালু বুঝেছেন? আমার রিটার্ন গিফটের প্রয়োজন নেই।
-বাট আমার প্রয়োজন।
বলেই উনি আমার কোমড় চেপে টেনে নিয়ে এলেন নিজের কাছে। নিজের গালে কপালে থাকা হলুদগুলো সন্তর্পণে আমার গালে কাধে গলায় লাগিয়ে দিতে মশগুল হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় শরীরে আমার এক আলাদা শিহরণ বয়ে গেলো। বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দ ক্রমশ যেন বেড়েই চলেছে। উনি আর এগোলেন না, বরং আমার ঠোঁটের কোণে গভীর একটা স্পর্শ করে আমার খাটে শুয়িয়ে দিলেন। গলায় মুখ গুঁজে নিরাময় করতে থাকলেন নিজের সকল ক্লান্তি। উনি ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে মগ্ন। সেই সাথে আমিও। উনি গলায় ঠোঁটজোড়া লাগিয়েই নেশাক্ত গলায় বললেন,
-‘একটু চুলে হাত বুলিয়ে দাও তো আহি?’
উনার ‘আহি’ সম্বোধনটা বরাবরই আমায় পাগলপ্রায় করে দেয়। আমি আনমনে উনার ক্লান্তিমাখা চুলে হাত বুলাতে থাকলাম।উনার চোখজোড়া বন্ধ। নিঃশ্বাসের দরুন পিটপিট করছে পাপড়িগুলো। নিঃসন্দেহে সুন্দর একটি সময়। সেই সাথে সুন্দর আমার গলায় মুখ গুঁজে থাকা আমাতে পাগল এই মানুষটাও।
.
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪৫
গলার দাগটা ঢাকার কোনোরকম ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছি আর আয়না দিয়ে চরম বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছি আনভীরের দিকে। উনি এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এই দাগের কারন উনি। তাই উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চেহারায় এমন একটা ভাব যে উনি একটা নিষ্পাপ শিশু। আমি আরেকবার চোখ রাঙানি দিতেই উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
-আজব তো! এভাবে তাকাচ্ছো কেনো? ওই দাগ তো এক্সিডেন্টলি হয়ে গিয়েছে।
আমার রাগ যেন এবার সীমা অতিক্রম করলো উনার এমন বেপরোয়া ধরনের কথা শুনাতে। উনার দিকে ভেজা তোয়ালে ছুঁড়ে মেরে কড়া গলায় বললাম,
-তো এটা কে করেছে বলেন তো? স্বপ্নে কি ব্যাম্বো চিকেন দেখেছিলেন যে আমার গলা কে ব্যাম্বো চিকেন ভেবে বাইট দিলেন?
উনি গলা খাকারি দিলেন এবার চরম অস্বস্তি নিয়ে। আমি একগাদা বিরক্তি নিয়ে চুল দিয়ে দাগগুলো ঢাকাতে মগ্ন হয়ে গেলাম।আমি জানি এই মহাশয়ের মাথাতে ভুড়ি ভুড়ি অংক ছাড়া কিছুই নাই , রোম্যান্টিকতা তো দূরের কথা। এক্সিডেন্টলি একটা কামড় দিয়েছেন বলে আমায় সরি বলতে বলতে পাগল করে ফেলেছেন। আজীবন মুভি নাটকে দেখেছি সুন্দর ছেলেগুলো উপর দিয়ে ভদ্র আর ভেতর দিয়ে থাকে চরম লেভেলের অসভ্য। আমারটা বেরিয়েছে উল্টা। সবার সামনে অসভ্য অসভ্য কথা বলে আর ভেতরে খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে রোম্যান্টিকতার এক ফোটাও এর মধ্যে নই। দুপুর হয়ে যাওয়াতে পুরো বাড়িতে তোরজোর শুরু হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরই রাফিদ ভাইয়ার সাথে আমরা বরপক্ষ হয়ে কনেপক্ষের বাড়িতে যাবো। এদিকে আনভীর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। মামুন ভাইয়া আর নাহিদ ভাইয়ার সাথে বরের সবকিছু গুছগাছ করে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছেন খাটে। উনার ভার্সিটি থেকে অনবরত কল আসছে যে কবে ফিরবেন ঢাকায়। কারনটাও স্বাভাবিক।পরীক্ষা শেষ আর উনার একসেট খাতাও দেখা নেই। এদিকে জমা দেওয়ার ডেট ঘনিয়ে আসছে। সবমিলিয়ে উনার ওপর বিশাল চাপ। আমি নিজেকে সুন্দরভাবে গোছগাছ করে উনার কাছে এসে পড়লাম। কপালে হাত দিয়ে পরখ করলাম শরীরে জ্বর রয়েছে কিনা। সবকিছু স্বাভাবিক দেখে মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
-শরবত নিয়ে আসবো আপনার জন্য?
-উহু।
আড়ষ্ট কন্ঠে বলে উঠলেন উনি। চোখজোড়া বন্ধ। উনাকে এমন দেখে আমার নিজেরও কেন যেন ভালোলাগছে না। এদিকে চাচী এসে অলরেডি ডাক দিয়ে গিয়েছেন সবাই কনেপক্ষের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে। অগত্যাই উঠে বসলেন উনি। আমি লাগেজ থেকে একটা নেভি ব্লু রঙের পান্জাবী বের করলাম। উনি চোখজোড়া সরু করে বললেন,
-এটা কেনো?
-এটা কেনো মানে? আপনি পান্জাবী পড়বেন না?
-পড়বো তো। তবে তোমার জামার কালারের সাথে ম্যাচ করে। সবুজ রঙের টা বের করো।
-ওটা তো আনি নি।
আমতা আমতা করে বলে ওঠলাম আমি। আনভীরের চোখজোড়া আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। চোখে মুখে বিরক্তির চরম আভাস। পরিবেশ রুদ্ধকর দেখে বুঝলাম মহাশয় এখনই দু’চারটা ভাষণ দিবেন।যেটা ভাবলাম হলোও তাই। উনি নিজের শুষ্ক অধরজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলে ওঠলেন,
-আমায় হতাশায় না ফেললে তোমার ভালোলাগে না? এমনিতেও জানো তোমায় নিয়ে পাহাড় সমান চিন্তার সাথে এখানে এসেছি যাতে ওই বজ্জাত বজ্জাত মহিলা গুলোর ঘটকালি দৃষ্টি থেকে তোমায় দূরে রাখতে পারি। আর তুমি? আমি আসার সময়েই বলেছিলাম যে প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে তুমি আর আমি ম্যাচিং করে ড্রেস পড়বো যাতে আনভীরের এই পিচ্চি বউটার দিকে কেউ আড়নজরে তাকাতে না পারে আর তুমি কি করেছো?’
আমি মুখ কালো করে বসে রইলাম। দোষটা আমারই। আমি আসলে উনার তখনকার কথা এত গভীরভাবে নেইনি। আর এটার শাস্তিই এখন আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। উনি তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। বলে ওঠলেন,
-ব্লু শাড়ি আছে তোমার?
-হ্যাঁ।
-ওটা পড়ে আসো ফটাফট।
আমার চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেলো। বলে কি পাগলটায়? আমি পুরোপুরি রেডি এখন উনার আমার সাথে ম্যাচিং করা পান্জাবি নেই বলে উনি আমায় পাল্টাতে বলছেন?
-কি হলো যাও?
-আপনি ওয়াশরুে ফ্রেস হয়ে আসেন, পান্জাবি পড়েন। ততক্ষণে আমি চেন্জ করে ফেলবো।
মিহি কন্ঠে বললাম আমি। উনি কথা বাড়ালেন না। শুধু তীক্ষ্ণ নজরে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠলেন,
-নেক্সট টাইম কখনোও যেন এমন ভুল না হয়…..
উনাকে কথা বলতে না দিয়ে উনার থুতনিতে আলতো করে চুমু দিলাম আমি। এভাবে হঠাৎ উনি বোকা বনে গেলেন।আমি ঠোটঁ উল্টে বললাম,
-সরি বললাম তো। প্রমিস এ ভুল আর হবে না।
উনার চোখ মুখে তখনও বিষ্ময়ের আভাস। অতঃপর শান্ত করলেন নিজেকে।কালো সিল্কি চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে আহাজারি কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-এখন শান্তিমতো বকতেও পারবো না। ওয়ার্ন করে দিলাম কিন্ত আহি আমার উইকনেসের সুযোগ নিবে না।
বলতে বলতেই উনি খাট থেকে উঠে চলে গেলেন ওয়াশরুমে। আমি তখনকার জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
______________________
কনেপক্ষের বাড়িতে কিছুক্ষণ আগেই গেট ধরার টাকা নিয়ে সবার মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে। আপুরা, নাহিদ ভাইয়ারা কেউই ২ হাজারের বেশি এক টাকা দিত রাজি নয়। এদিকে কনেপক্ষের মেয়েরা সবাই তো রীতিমতো হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ছে। পরে কে জানে কি হলো, আমি বুঝতে পারার আগেই আনভীর টেনে আমায় ওখান থেকে একটু দূরে রুনি আপুর কাছে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। গভীর ফিসফিসালো ভাবে বললেন,
-ওদিকটা আমি দেখছি। তুমি এখানেই থাকো।
উনি ওদিকে যাওয়ার পর ম্যাজিকের মতো সব সংঘর্ষ ভ্যানিশ হয়ে গেলো। ব্যাপারটা অলরেডি চলে গিয়েছে আমার মাথার ওপর দিয়ে। তারপর ভেতরে অনেকগুলো কার্যক্রম সম্পন্ন হলো। বিয়েও পড়ানো হয়ে গেলো। কনেকেও দেখে নিলাম। মেয়েটা ভারী মিষ্টি। রাফিদ ভাইয়ার সাথে দারুন মানিয়েছে এককথায়। তবে এখানে একটা জিনিস খেয়াল করলাম। এখানকার মেয়েগুলো চরম লেভেলের চালু। কেমন করে নাহিদ ভাইয়ের থেকে পটকে বরের জুতা হাতিয়ে নিলো আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। এখানে আমি থাকলে এতকিছুই হতো না কিন্ত সেগুলো আর পারলাম কই? আনভীর তো আমায় ভদ্র মেয়ের মতো মরুব্বিদের সাথে থাকতে বলেছেন আর উনি এখন উধাও। কিছুক্ষণ খোঁজাখুজির পর নাহিদ ভাইয়াকে দেখেই আমি ডাক দিলাম তাকে। অদ্ভুতভাবে আমার ডাক শুনে ভাইয়া উল্টোপথে পা বাড়ালো।আমি অবাক। উনার পথে বাধা হয়ে চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-এভাবে আমার ডাক দেওয়াতে চলে যাচ্ছেন কেনো?
নাহিদ ভাইয়া মাথা নিচু করে মিনমিনিয়ে বললো,
-ভাই আপনার সাথে কথা বলতে না করসে ভাবি।
-আপনার ভাই কথা বলতে না দেওয়ার কে? আমি যখন ডাক দেবো ফটাফট এসে পড়বেন। নাহলে বলে দেবো আপনার ভাইকে যে আপনি আমার কথা শোনেন না।
-আচ্ছা বলে দিয়েন ভাইকে। আমি গেলাম। মা ডাকে।
উনি কোনোমতে ছুটে পালালেন আমার কাছ থেকে। আমি হতভম্ব। মানে সিরিয়াসলি? আনভীরকে এত ভয় পান উনি যে একবার না করতেই এভাবে ছুটে পালালেন? আমার আর কি করার। রুনি আপু আর বাকিদের সাথেই ঘুরতে থাকলাম আশপাশে। এর মধ্যে সৌজন্যতার খাতির কনেপক্ষের বেশ কয়েকজনের সাথে পরিচিতও হয়ে নিলাম। এর মধ্যে হঠাৎ একজন যুবক আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-আপনার নাম কি আহি?
-জ্বি। কেনো?
উনি আমার কাছে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিলেন। বলেলেন,
-আমার দুলাভাই , মানে রাফিদ ভাইয়া আপনাকে দিতে বলেছে।
আমি নিয়ে নিলাম ব্যাগটা। বুঝলাম উনি হয়তো ভাবির কোনো ভাই-টাই হবে। উনি মিহি হেসে বললেন,
-আপনার নামটা কিন্ত সুন্দর।
আমি প্রতিউত্তরে শুধু ধন্যবাদ বলেই ইগ্নোর করার চেষ্টা করলাম। বুঝেছি এই গুণোধর লোক আমার সাথে লাইন মারতে এসেছে। আমি চরম বিরক্ত হলেও শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে কথা বাড়ানোর চেষ্টা করলাম না। মিহি হেসে প্রতিটা কথার প্রতিউত্তর দিলাম। একপর্যায়ে উনি বললেন,
-আপনি কি হুমায়ূন আহমেদের রূপার ভক্ত নাকি? কেননা আপনাকে নীল শাড়িতে দেখে পুরোই হিমুর রূপার মতো লাগছে।
-তাই নাকি? জানতাম না তো? আমি তো এটা জাস্ট আমার বরের সাথে ম্যাচ করে পড়ে নিলাম।
আমার শেষ কথাটি শুনে অবাক হয়ে গেলেন ওই ভাইয়াটি। চরম লেভেলের অভাক যাহাকে বলে। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন,
-আপনি,,,,,,,,,,,বিবাহিত?
-জ্বি হ্যাঁ।
উনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠলেন,
-আপনাকে দেখে তো মনে হয়না। কেমন যেন একটা পিচ্চি পিচ্চি ভাব। তাকিয়ে থাকলে শুধু তাকিয়ে থাকতেই মন চায়।
আমি মেকি হাসলাম। পেয়েছি এবার জব্দ করার পালা। আমি উনার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বলে ওঠলাম,
-জানেন? আমার হাজবেন্টও সারাদিন আমায় পিচ্চি বউ পিচ্চি বউ বলে ক্ষেপায়। তবুও আমি কিছুই বলিনা, কেন জানেন? কারন উনি পুরাই আইসক্রিম টাইপ। এমন হাজবেন্ট কার ভাগ্যে জোটে বলেন?
বেচারার দেবদাস ওয়ালা মুখ দেখে আমার দম ফেটে হাসি আসার মতো উপক্রম। আসলেই চরম লেভেলের ছ্যাকা খেয়েছে। তৎক্ষণাৎ আমাদের মাঝে আনভীর এসে পড়লেন। আমি ওই ছেলেটাকে দেখে উনার বাহু জরিয়ে বললাম,
-এইযে, আমার বরসাহেব। বলেন তো! সুন্দর না?
আনভীর আমাদের কোনো কথাই বুঝতে পারলেন না। তাই জিজ্ঞেস করলেন,
-‘কি হয়েছে আহি?’
-‘আরে এই ভাইয়া বলছিলো যে আমি যে বিবাহিত এটা উনার বিশ্বাস হয়না। আমার চেহারা পিচ্চি পিচ্চি টাইপ বলে তাকিয়েই থাকতে মন চায়।
বলেই জিভ কাটলাম আমি। ইয়া আল্লাহ! কারে কি বলে ফেলেছি৷ আনভীর প্রথমে সৌজন্যতা নিয়ে থাকলেও আমার কথা শুনে চোয়াল শক্ত করে ফেললো। ছেলেটার দিকে আড়চোখে তাকাতেই তারে আর পায় কে, যেভাবে নাহিদ ভাইয়া কেটে পড়েছিলো ওমনেই ছেলেটা ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে পালালো৷ আমি পরপর কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলে তাকালাম উনার দিকে৷ আনভীর চোখ রাঙানি দিয়ে বললেন,
-আজকাল তুমি কিন্ত বড্ড ফাজিল হয়ে যাচ্ছো আহি!(তারপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে) বাসায় চলো, তারপর দেখাচ্ছি আমি কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম টাইপ?
আমার শরীর রীতিমতো জমে পাথর হয়ে গিয়েছে। এই লোকরে ভালোমতো আমার চেনা আছে৷ দেখা যাবে সারারাত স্কুলের স্যারের মতো কান ধরে উঠবোস করাবে। আল্লাহ! এবারের মতো বাচায় দাও। কসম! এই পাগলটারে ছাড়া জীবনেও কারও সাথে ফ্লাটিং করবো না।
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ!
কথামতো আজ কিন্ত পার্ট বড়ো করে দিয়েছি। ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।