#রংধনুর_রঙ_কালো
পর্ব ৩৩
লিখা: Sidratul Muntaz
আজ ছুটির দিন। সপ্তাহের এই দিনটিতেই অরিন সারাক্ষণ তার মেয়ের সঙ্গে কাটায়। সাদিকা তার যত প্রিয় এনিমেশন সিরিজ, মুভিজ, কার্টুন আছে সব জমিয়ে রাখে মায়ের সাথে দেখবে বলে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মা-মেয়ে ল্যাপটপে এনিমেশন দেখে। বিকালে তিনজন ঘুরতে যায়। সাদিকা তৈরী হওয়ার সময় হালিমার দিকে আঙুল তাক করে বলে,” তোমাকে নিবো না।”
হালিমাও কান্না কান্না ভাব করে বলে,” আমি যাবোই।”
নানু-নাতনীর খুঁনশুটি দেখে অরিনের মন ভরে যায়। এভাবেই জীবন সুন্দর। সুখী হয়ে বেঁচে থাকার জন্য লাইফ পার্টনারের প্রয়োজন নেই। সাদিকার মতো ছোট্ট এক জ্যান্ত পুতুল হলেই চলে। আজকের সকালটা নিত্যদিনের তুলনায় অন্যরকম হলো। অরিন সাদিকাকে মাত্র ঘুম থেকে উঠিয়ে ব্রেকফাস্ট খাওয়িয়েছে। এখন মা-মেয়ে গোসলে যাবে। অরিন সাদিকার চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। তখনি মোবাইল ফোন কানে নিয়ে দৌড়ে এলেন হালিমা। একটা দুঃসংবাদ। বাংলাদেশ থেকে খবর এসেছে শায়িখ সাহেব মাগরিবের আযানের সময় ইন্তেকাল করেছেন। লন্ডনে এখন সকাল আটটা বাজে। অর্থাৎ বাংলাদেশে রাত আটটা। খবর এসেছে অন্বয়ের বাবা আমানত সাহেবের কাছ থেকে। অরিন মনে মনে উচ্চারণ করল,” ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলহাইহি রাজিউন।”
তার চোখ দু’টো জলে ভরপুর। হালিমা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,” দ্রুত তৈরী হো। বাংলাদেশে যেতে হবে।”
অরিন তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারল না। একটু সময় নিয়ে বলল,” কি হবে গিয়ে? আমাদের জন্য কি কেউ অপেক্ষা করে থাকবে? কবর দেওয়া হয়ে যাবে না? দেখতেই যদি না পারি তাহলে গিয়ে লাভ কি?”
” তবুও যাওয়া উচিৎ। তোর শ্বশুর মারা গেছে অরিন। একমাত্র পুত্রবধূ হিসেবে তোর যাওয়া উচিৎ না?”
” না, উচিৎ না। তুমি কি বারবার ভুলে যাও মা? ইলহানের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি এখন কারো পুত্রবধূ না। আমি শুধুই সাদিকার মা।”
” আচ্ছা বুঝেছি। তবুও আমি বলবো তোর যাওয়া উচিৎ। ”
” বাবা যখন মারা গেছিল তখন কি ওদের বাড়ি থেকে কেউ এসেছে? তাহলে আমরা কেনো যাবো?”
” ওরা তো জানতেই পারেনি। আসবে কি করে? আমরা তো জেনেছি। তাও যাবো না? এতোটা অমানবিক হতে পারবি তুই?”
” এখন ওই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের কাছে আমি চক্ষুশূল। ওরা কেউ আমাকে পছন্দ করে না। তাছাড়া আমি এখন গিয়ে তো বাবার মুখ দেখতে পারব না। হয়তো দেখতে হবে ইলহানের নতুন বউয়ের মুখ! সোফিয়ার মুখ!”
” তাতে তোর কি? তুই তো ওকে ডিভোর্স দিয়েছিস। এবার ও একটা বিয়ে করুক কি দশটা বিয়ে করুক তোর তো কিছু যায় আসার কথা না।”
সাদিকা হঠাৎ প্রশ্ন করল,” ডিভোর্স কি মাম্মাম?”
অরিনের এতোক্ষণে টনক নড়ল। মেয়ের সামনে এসব কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। অরিন চোখের পানি মুছে বলল,” মা, এই বিষয়ে পরে কথা বলবো। এখন অফ যাও প্লিজ।”
সাদিকাকে নিয়ে গোসলে চলে গেল অরিন। হালিমা নিশ্চুপ বসে রইলেন। দিনে দিনে অরিন বড্ড পাষাণ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের এতো পাষাণ হতে নেই।
বাংলাদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্তে শেষমেষ রাজি হয়েছিল অরিন। তাদের পৌঁছাতে একদিন লেগে যায়। মরাবাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের অভাব নেই। নুসাইবা শেষ বয়সে সঙ্গী হারিয়ে পরিপূর্ণ ভেঙে পড়েছেন। বিছানায় থম মেরে শুয়ে আছেন সারাদিন। কাঁদেনও না, হাসেনও না। তেমন কথাও বলেন না। শায়িখ সাহেবকে কবর দেওয়া হয়েছে তার নিজস্ব গ্রামের বাড়িতে। তাই সেখানেই সবাইকে উপস্থিত হতে হয়েছে। অরিনরাও সেই গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। ঢাকার এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে আবার মাইক্রোবাস জার্নি করে গ্রামের বাড়িতে আসতে আসতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে যায় অরিনদের। এয়ারপোর্ট থেকে ওদের রিসিভ করেছিল অর্ণভ, সুমনা আর মিহরীমা। মিহরীমা অরিনের ছোটবোন। আর অর্ণভ অরিনের বড়ভাই। সুমনা অর্ণভের স্ত্রী। সাদিকা মিহরীমাকে পেয়ে খুশিতে ঝলমল। সে তার মিহি আন্টিকে খুব পছন্দ করে। মিহরীমার বয়স এখন দশ বছর। মেয়েটা ভালোই লম্বা হয়েছে। অরিনের বাবা ফয়সাল সাহেবের মৃত্যুর পর অর্ণভ লন্ডন এসে মিহরীমাকে তার সাথে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল। গ্রামের বাড়িতে প্রবেশ করার পর বিদেশ ফেরত অরিনকে দেখে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ কেউ বাঁকা চোখে তাকায়। তাদের চাহনী দেখে মনে হলো অরিন ভয়ংকর অপরাধী। তার কারণেই শায়িখ সাহেবের মৃত্যু হয়েছে। এই বাড়িতে অরিন ঢুকেছে আধঘণ্টাও হয়নি। এর মধ্যেই পাড়া-প্রতিবেশী কানা-ঘুষা শুরু করেছে। এখন ইলহান তাদের কাছে নিষ্পাপ। সমস্ত দোষ শুধু অরিনের। নুসাইবার সাথে অরিনের মাত্র একবার দেখা হলো। তখন দুইজন মধ্যবয়স্কা মহিলা নুসাইবার মাথায় পানি দিয়ে তাকে দুইদিক থেকে ধরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অরিন উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল নুসাইবাকে। সাদিকাকে দেখিয়ে বলল,” মা, এইতো আমার মেয়ে।”
নুসাইবা একটা শব্দও করলেন না। এমনভাবে সাদিকার দিকে তাকালেন যেনো ঘৃণিত কোনো বস্তু দেখছেন। তারপর দুজনকেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন নুসাইবা। অরিন মনে মনে প্রচন্ড আহত হলো। নুসাইবা তখন ক্লান্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি যে চেতনায় ছিলেন সেটা বোঝা যাচ্ছিল। সবার সাথেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পেরেছেন। তাহলে অরিনের সাথে একটু কথা বললে কি হতো? সাদিকার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলে কি হতো? অরিনের মন একদম খারাপ হয়ে গেল। ইলহানের সাথে অরিনের একবার শুধু চোখাচোখি হয়েছিল। কয়েক মুহুর্তের জন্য হৃদয়ে কম্পন, সবকিছু ঝাপসা, তারপর আস্তে আস্তে আবার সব স্বাভাবিক। ইলহানকে দেখে এখন কেউ চিনতে পারবে না। আগাছার মতো দাড়ি বেড়েছে। অরিন প্রথম দর্শনে চেহারা চিনতে পারেনি। উচ্চতা দেখেই বুঝেছে এটা ইলহান। মুখভর্তি ঘন-কালো দাঁড়ি, চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গেছে। চোখের চারপাশে ঘন কালো। চুল বেড়ে কাধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ওই চুলে ঝুটি করা যাবে। অরিন শুনেছে ইলহান নাকি আর বিয়ে করেনি। অবশ্য ওর মতো ছেলের বিয়ের দরকার কি? অবৈধ সম্পর্ক যে করতে পারে তার বিয়ের দরকার হয় না। অরিন সাদিকাকে খুব লুকিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিছুতেই ইলহানের সামনে যেতে দেয়নি। তার ধারণা ইলহান সাদিকাকে দেখলেই কেড়ে নিবে।
মরাবাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক নেই। একটু পর পর শুধু মানুষ জন আসে আর কান্নাকাটি করে। এই শোক পালন কমপক্ষে এক সপ্তাহ চলবে।অপ্রয়োজনেই মানুষ কাঁদবে। কেঁদে কোনো লাভ নেই। তাও মানুষ কাঁদে। অরিন সাদিকাকে সাথে নিয়ে উঠানের কোণায় বসে ছিল৷ অর্ণভ এসে সাদিকাকে কোলে নিয়ে বলল,” আমার মামাটা কি করে?”
সাদিকা মুখভর্তি হাসি এনে বলল,” মাম্মামের সাথে বসে আছে।”
” তাই? এবার মামার সাথে চলো। মামা তোমাকে একজন স্পেশাল পারসনের সাথে দেখা করাবে।”
স্পেশাল পারসনটি কে হতে পারে সেটা আন্দাজ করেই অরিন ঝেঁঝে উঠলো,” ভাইয়া, ওকে এখানে রাখো বলছি। কোথাও নিবে না আমার মেয়েকে।”
” কেন? মেয়ে কি শুধু তোর একার? আমার ভাগ্নী না? মামা, তুমি যাবে না আমার সাথে? মাম্মামকে শাটআপ করে দাও তো।”
সাদিকা হি-হি করে শুধু হাসল। অর্ণভ আঙুলের সাহায্যে একটু দূরে ইশারা করে বলল,” ওই লোকটাকে চিনো?”
সাদিকার সাথে সাথে অরিনও তাকালো। ঝিলপাড়ে ইলহান দাঁড়িয়ে আছে। ওর আউল বাউল চুল মৃদু বাতাসে উড়ছে। উড়ছে দাড়ির গোছাও। সাদিকা বলল,” হ্যাঁ চিনি। এইটা ইলহান মামা।”
অর্ণভের চক্ষু চড়কগাছ। কপালে তিন-চারটা ভাজ ফেলে বলল,” মামা?”
” হ্যাঁ। মাম্মাম বলেছে তোমার মতো এটাও আমার একটা মামা। কিন্তু ওইটা পচা মামা। আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। আমি ওই মামার কাছে যাবো না। ওইটা ভুতু মামা।”
অর্ণভ একবার অরিনের দিকে তাকালো। অরিন ঠোঁট বাকা করে হাসছে। অর্ণভ সাদিকার মাথায় আলতো করে চাটি মেরে বলল,” ধূর বলদী। ওইটা তোর মামা না, তোর বাপ লাগে। তোর মামা খালি আমি।”
অরিন জোরে ধমক দিল,” ভাইয়া প্লিজ, আমার মেয়ের সামনে তুমি এইসব কথা বলবে না।”
” তুই ওকে এইসব কি শিখিয়ে রেখেছিস অরিন? মেয়ে বাপের কাছে যাবে না? এটা তো তুই না- ইনসাফী করছিস।”
” আমার সাথে যা হয়েছে সেই তুলনায় এটা কিছুই না।”
” তুই এখনও ওইসব মনে রেখে বসে আছিস?”
অরিন তাজ্জব হয়ে বলল,” তো এগুলো কি মনে রাখার বিষয় না?”
” না। অতীত সবারই থাকে। তার মানে এই না যে সেই অতীত মনে করে সারাজীবন জেদ পুষে রাখতে হবে। তুই অতিরিক্ত জেদী অরিন। এইবার জেদ একটু কমানোর সময় হয়েছে।”
” তুমি কি বলতে চাও ভাইয়া?”
” ইলহানকে তুই মাফ কর। অনেক হয়েছে, ছেলেটাকে আর মারিস না।”
অরিনের চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এটা কি আসলেই তার ভাই? মুখে হাত দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টায় অরিন অন্যদিকে মুখ ফেরাল। অর্ণভ কাছে এসে বলল,” প্লিজ অরিন, আমার লক্ষী বোন। যা হয়েছে সব ভুলে যা এইবার। এইভাবে তোরা কেউই ভালো নেই। আমি তোর ভালো চাই সেজন্যই বলছি। কি হয় যদি আবার তোরা একসাথে জীবনটা শুরু করিস?”
” ভাইয়া, ইলহানের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।”
” আমি মানি না এই ডিভোর্স। ইলহান ডিভোর্স পেপারে এখনও সাইন করেনি।”
অরিন উচ্চকণ্ঠে বলল,” তাতে আমার কিছু যায় আসে না ভাইয়া। আমি তো সাইন করেছি। একজন সাইন করলেই ডিভোর্স কার্যকর হয়।”
এইকথা বলে অরিন সাদিকাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলো। এই মাত্র সে একটা মিথ্যে বলেছে। ডিভোর্স পেপারে সে নিজেও সাইন করেনি। অন্বয় অরিনের নাম লিখে সাইন করেছিল।
চলবে