প্রেম পায়রা ২ পর্ব ১৭

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____১৭

‘তিথি তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না। চাবিটা বোধ হয় সত্যি সত্যি হারিয়ে গেছে। কোথায় রেখেছিলাম মনে নেই। এখন খুঁজে পাচ্ছি না।’

সম্পদের কথা শুনে তিথি চমকে উঠলো। স্বপ্নাবিষ্টের মতো বলল,

‘বলছেন কি? চাবি হারিয়ে গেছে?’

‘হুঁ! আমি মিথ্যে বলি না।’

‘আপনি শান্ত হয়ে বসুন তো। মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা করুন কোথায় রেখেছিলেন।’

‘ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে করতে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। আমি আর চিন্তা-ফিন্তা কিছু করতে পারবো না।’

‘আপনি এখানে বসুন। আমি খুঁজে দেখি পাই কি না।’

সম্পদ দুঃখী দুঃখী চেহারা নিয়ে বিছানায় বসলো। তিথি চিন্তিত মুখে সম্পূর্ণ রুমের আনাচে কানাচে খুঁজতে লাগলো। তার দিকে চেয়ে সম্পদ অনুতাপ বোধ করলো। যতই খোঁজাখুঁজি করুক, চাবিটা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি স্বয়ং সে চাইলেও চাবিটা পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। চাবিটা সে কমোডে ফেলে ফ্ল্যাস করে দিয়েছে। কাজটা করে ভালো হয়েছে। তা না হলে আবেগের বশে এতক্ষণে চাবিটা তিথির হাতে ধরিয়ে দিতো। কিছুক্ষণ ইতি-উতি করে সে তিথিকে ডাক দিল। বলল,

‘তিথি। বেশি খোঁজাখুঁজি করার দরকার নেই। পাওয়া যাবে না।’

তিথি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে চোখ সরালো। সম্পদের দিকে ঘুরে বলল,

‘এত জোর দিয়ে বলছেন কেন? চাবি কি উড়ে যাবে? কোথাও তো নিশ্চয়ই আছে।’

‘তাহলে খুঁজো! পেলে তো আমারই ভালো। কতগুলো টাকা নষ্টের হাত থেকে বেঁচে যাবে।’

‘আপনি না বললেন বাবা আসবে। বাবা আসলে কোথায় ঘুমাবে?’

‘এটা তো মাথায় আসেনি! সমস্যা হয়ে গেল দেখছি। কি করা যায় বলোতো?’

তিথির স্বাভাবিক হওয়া চোখ মুখ পুনরায় কুঁচকে গেল। মনটা অশান্ত হয়ে গেল। উগ্র স্বরে বলল,

‘আপনাকে রুমে তালা দিতে বলেছিল কে?’

‘আমার মন! মন বলেছিল।’

তিথি ভীষণ আহত হলো। হতবুদ্ধিকর বিস্ময়ে সম্পদের দিকে চেয়ে রইলো। পরমুহূর্তে এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য আবার চাবি খোঁজাতে মনোনিবেশ করলো। সম্পদ বাইরে চলে এলো। তিথিকে এত ব্যস্ত দেখতে তার ভালো লাগছে না। আবার সত্যি কথাটাও বলতে পারছে না। দ্বিধান্বিত হয়ে সে ফ্রিজ খুলল। ঠান্ডা এক বোতল পানি বের করলো। তারপর কাউচে বসে টিভি অন করলো। কিছুক্ষণ রঙিন ডিসপ্লের দিকে চেয়ে থেকে চোখকে ক্লান্ত করার চেষ্টা। চোখ যতবেশি ক্লান্ত হবে, ততদ্রুত ঘুম আসবে। এখন তিথির মুখোমুখি হওয়া যাবে না। মুখ ফসকে বলে দিলে সব শেষ!

টিভির খবর শোনার পাশাপাশি সম্পদের চোখ দুটো বার বার নিজের রুমের দিকে ঘুরপাক খেতে লাগলো। তিথি বাইরে বের হচ্ছে না কেন? এখনো কি চাবি খুঁজছে? তার মনের ভেতর প্রচ্ছন্ন এক অপরাধ বোধ জেগে উঠলো।

টিভিতে রাত বারোটার খবর আরম্ভ হতে সে উঠে দাঁড়ালো। রান্নাঘর, ড্রয়িং রুমের বাল্ব বন্ধ করলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে মুখ দিয়ে অস্ফুট এক শব্দ বের হলো। বিস্ফারিত নয়নে বিছানার দিকে চেয়ে রইলো। তিথি ইতোমধ্যে ব্লাঙ্কেট জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে।

সম্পদ হাতে চিমটি কাটলো। স্বপ্ন দেখছে না তো? এ-ও সম্ভব? যখন বুঝতে পারলো এটা স্বপ্ন নয়, খুশিতে মন ভরে উঠলো। কেমন কেমন সুখ সুখ অনুভূত হলো। নিজেকে অনেক হালকা মনে হলো। মুচকি হেসে রুমের বাল্ব বন্ধ করলো। বেলকনির সবুজ বাতি জ্বালাল। গায়ে হালকা করে বডি স্প্রে দিয়ে সে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি গিয়ে টের পেল তিথি ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বীকার করতেই হবে, মেয়েটা সত্যি সত্যি অনেক ক্লান্ত ছিল।

বড়সড় খাটের মাঝামাঝি তিথি শুয়ে আছে। সম্পদ কোনপাশে ঘুমাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কিছুটা সময় চিন্তা করে সে তিথির বাম পাশে শুয়ে পড়লো। মিনিট দুই হাঁসফাঁস করে উঠে পড়লো। কয়েক সেকেন্ড পর আবার ডান পাশে শুয়ে পড়লো। তিথির আবছায়ায় ঘেরা মুখের দিকে চেয়ে স্মৃতির চিলেকোঠায় জমানো মুহূর্ত গুলো রোমন্থন করলো। মিনিট পাঁচেক পরে সে ধুম করে উঠে দাঁড়ালো। এ পাশে নয়, ঘুরে আবার বাম পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। এ পাশ থেকে তিথির মুখটা পরিষ্কার বোঝা যায়। রাতের মতো প্রগাঢ় রহস্যে আবৃত মুখোচ্ছবির দিকে সে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো।

চেয়ে থাকতে থাকতে দু চোখে ঘোর লেগে এলো৷ চারপাশে নেমে এলো রাজ্যের নিরবতা। হাত বাড়িয়ে তিথির মুখটা ছুঁয়ে দিল সে।তৎক্ষনাৎ শরীরের ভেতর বিদ্যুৎ খেলে গেল৷ তিথিকে আরো গভীর স্পর্শের ইচ্ছে জাগলো মনে। ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ থম মেরে রইলো সম্পদ। আচমকা এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এসব কি ভাবছে সে? তার মন এতটা দূর্বল হলো কবে থেকে? অন্যদিকে তাকিয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হলো।

কাউচে গা এলিয়ে দিয়ে সম্পদ চোখ বন্ধ করলো। লম্বা করে শ্বাস টানলো। ঠিক এই মুহূর্তে সে বুঝতে সক্ষম হলো যে সমস্যা তিথির নয়। সমস্যা হলো তার নিজের। সে নিজেই তিথির সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে পারবে না। ঘুমাতে গেলে উল্টাপাল্টা কাজ করে বসবে। যার ফলে সে তিথিকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজের রুমের দিকে এক পলক চেয়ে কপালে হাত রাখলো।

২০.

ঘুম ভাঙতে মুখের উপর এলোমেলো চুলের বহর টের পেল তিথি। হাত দিয়ে সরিয়ে ফেলতে চাইলো। কিন্তু মস্তিষ্ক সচল হলেও শরীর সচল হলো না। কিছু সময় অতিবাহিত হলো। এক হাতে মুখের উপরের চুলগুলো সরিয়ে ফেলল। চোখ খুলতে ঝাপসা ভাবে একটা পুরুষ অবয়ব দৃষ্টিগোচর হলো। অবয়ব টা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো৷ সে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,

‘সম্পদ!’

প্রখর দৃষ্টিতে সে সম্পদের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। এতগুলো দিন একসাথে থাকার পরো সম্পদের নাক কেমন, চোখের রঙ কেমন, ভ্রুযুগল কেমন তা সে বলতে পারবে না। ঠিকমতো দেখা হয়নি। কেন জানি মানুষটার প্রতি সে এক পলকের বেশি সময় চেয়ে থাকতে পারে না। নিজের কাছে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। আজ সম্পদের ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে চেহারা মুখস্থ করার চেষ্টা করলো৷

নিঃসন্দেহে সম্পদের নজর কাড়া চেহারা। তার গৌড় বর্ণের মুখের দিকে চেয়ে তিথির মনটা আফসোসে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সেদিন যদি সে নিজের মনের কথা না শুনতো, সবুজের ডাকে সাড়া দিয়ে পালানোর চেষ্টা না করতো তাহলে জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতো। অন্য রকম সুভাসে ভরে যেতো। চারপাশ সর্বদা বসন্ত বাতাসে মুখরিত থাকতো। তখন তার কয়েক ইঞ্চি দূরে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটাকে নিজের বলে দাবি করতে পারতো। যখন খুশি তখন তার ঘন চুলে হাত বুলিয়ে দিতে পারতো। জীবন কত সুন্দরই না হতো!

অথচ নিজের ভুলে একটা সাজানো, গোছানো পুতুল সংসার সে হারিয়ে ফেলেছে। দুঃখজনক একটা ঘটনা মনস্তাত্ত্বিক চিহ্ন হিসেবে সারাজীবন তাকে বহন করতে হবে। মৃত্যু অবধি! সেসব কল্পনা করে ভোরবেলাতে তিথির মন কালো মেঘে ছেয়ে গেল। সম্পদ আর সে একই ব্লাঙ্কেটের ভেতর। মাঝে কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব। অথচ মনে হচ্ছে যোজন যোজন দূরত্ব৷ দুজনের কেউ কাউকে চিনে না। পরিস্থিতি মানুষকে কাছাকাছি রেখেও কতটা পর করিয়ে দেয়!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সম্পদের থেকে দৃষ্টি সরালো। উঠতে নিতে অল্প কিছু চুলে টান পড়লো৷ প্রচন্ড ব্যথায় মুখটা চুপসে গেল। মাথা নিচু করে সম্পদের বাহু পেঁচিয়ে রাখা চুলগুলো টেনে বের করলো।

ওয়াশরুমের জন্য এগিয়ে গিয়ে তিথি ফিরে আসলো। রুমে শীতল পরিবেশ বিদ্যমান। পেট অবধি পড়ে থাকা ব্লাঙ্কেট টেনে সম্পদের গলা পর্যন্ত ঢেকে দিল। মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞ সে। এই মানুষটার জন্য তার ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন, অনিদ্রা রোগ, মনের মধ্যকার রেষারেষি সব কিছু থেকে কিছুটা পরিত্রাণ মিলেছে। পুরনো তিক্ততার জগদ্দল থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি না মিললেও বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহন করছে এই মানুষটার জন্য। অন্তত বেঁচে রয়েছে সে। সেদিন যদি সম্পদ বিয়েটা না করতো তাহলে এতদিনে সে পৃথিবী থেকে হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। মানসিক রোগী হয়ে শ্বাস নিতে হতো। এই মানুষটা তার অন্ধকার তিথিতে এক মুঠো আলো নিয়ে হাজির হয়েছে। আশার আলো, বাঁচার আলো!

ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে তিথি মাথা নিচু করলো। সম্পদের কপালের বামপাশের কেঁটে যাওয়া অংশ পরখ করলো। ক্ষত সেরে গেছে। শুধু দাগটা রয়ে গেছে। আবারো মন খারাপ হয়ে গেল। মানুষের জীবনটা এমন কেন? কত ঝড়-ঝাপটা, দুঃখ, বেদনা, দুঃসময় আসে! একটা সময় পর সেগুলো চলে যায়। কিন্তু সে যে এসেছিল তার চিহ্নস্বরূপ একটা কালো পট্টি বেঁধে রেখে যায়।

সরে আসার সময় সম্পদের মাথার চুল হালকা করে ছুঁয়ে দিল সে। পরণের ওড়না টা কাঁধের দুপাশে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।

২১.

স্টেশনে সম্পদের হাত ধরে তিথি বাস থেকে নামলো। নেমেই আরেক দফা বমি করলো। ট্রলি ফেলে রেখে সম্পদ তাকে ধরলো। চিন্তিত মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এই নিয়ে মেয়েটা ষষ্ঠ বারের মতো বমি করলো। তিথি কিছুটা ঝিমিয়ে আসতে সে পানির বোতল মুখে তুলে দিল। কুলি করে এক ঢোক পানি খেল। শরীর কাঁপছে তিথির। সম্পদ প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। প্রাইভেট কারে তিথি যাতায়াত করতে চায়নি। বাসে উঠার জন্য বায়না ধরেছিল। সেজন্য বাধ্য হয়ে বাসে করে তারা রওনা দিয়েছিল। কিন্তু বাস জার্নিতে তিথির অবস্থা এতটা খারাপ হবে সে কল্পনা করতে পারেনি।

রিকশা ডেকে তিথিকে টেনে তুলল। পায়ের নিচে ট্রলি রেখে সে রিকশায় উঠলো। পাশে বসতে তিথি সম্পূর্ণ ভর তার উপর ছেড়ে দিল। সম্পদ কাঁধের পাশ দিয়ে এক হাত দিয়ে তাকে আগলে নিল। প্রায় দেড় মাস পরে তারা গ্রামে ফিরছে। কিন্তু সম্পদ তেমন আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছে না। হয়তো তিথি অসুস্থ বলে! তার অফিসের ছুটি তিনদিন বেড়ে গেছে। ভাঙা পা ঠিক হয়ে গেছে। সেজন্য সে ছুটির সময়টা গ্রাম থেকে ঘুরে আসার কথা বলেছিল। একবার বলাতে তিথি সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছিল। তার বদৌলতে আজ রওনা দেয়া। কিন্তু তিথির কারসিকনেস এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে জানলে সে আসতো না।

রিকশা দ্রুত বেগে চলছে। তিথি নেতিয়ে পড়া বনলতার মতো সম্পদকে জড়িয়ে আছে। বাতাসের তালে তালে তার এলোমেলো চুলগুলো তার চোখে মুখে এসে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে নিল সে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here