শিশিরের বিন্দু পর্ব ১৫

শিশিরের বিন্দু
১৫ তম পর্ব

ঠিক এমন সময় দরজা নক করল কে জানি। শিশির টাওয়ালের উপরে টিশার্ট পরে দরজা খুলেই দেখলো সামনে বিন্দু দাঁড়ানো। শিশিরের যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এ কি সম্ভব? বিন্দু প্রথমে শুরু করল কথা,
___ ” আপনার সাথে আমার ফোনের চার্জার একচেঞ্জ হয়ে গেছে।”
___ ” কই না তো “।
শিশির প্রতিবাদ করল। বিন্দু হঠাৎ শিশিরের হাত থাবা দিতে ধরে হাতের উপরে চার্জার রেখে বলল,
___ ” তাহলে এটা কার চার্জার? ”
শিশির ভাল করে তাকিয়ে দেখে যে এটা ওরই চার্জার। এখন আর কথাই খুঁজে পাচ্ছে না ও। বিন্দু কোন মতে হাসি আটকে রেখে বলল,
___ ” যান যেয়ে আমার চার্জারটা দেন “।
শিশির তড়িঘড়ি করে চার্জারটা এনে বিন্দুর হাতে দিল। বিন্দু ঘুরে চলে যাচ্ছিল এমন সময় শিশির পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলল,
___ ” শাওয়ার নেও নি তুমি? ”
___ ” হঠাৎ আমার শাওয়ার নিয়ে পড়লেন কেন আপনি?”
শিশির মনে মনে বলতে লাগল, ” ভেজা ওই চোখ মুখটা যে বড়ই সুন্দর লাগে তাই বারেবার দেখতে চাই”। বিন্দু আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল ওর রুমে। শিশির দরজাটা লক করেই সোজা বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। মেয়েটা এত কিউট কেন সেটাই ওর মাথায় ধরে না। একেই বুঝি ভালবাসা কয়। সবাই ফ্রেশ হয়ে চলল বাইরে খেতে। নিচের লবিতে আবির আর বিপ্লব দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। শিশিরকে আসতে দেখেই দুজনেই হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। শিশির কাছে এসে ওদের দুজনকে অমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
___ ” কি রে তোরা এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন? ”
আবির ঢোক গিলে বলল,
___, ” দোস্ত আজ জীবনে প্রথম আফসোস হচ্ছে মেয়ে হলাম না কেন। মেয়ে হলে সোজা তোকে হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করে বসতাম। সেই মাপের হ্যান্ডসাম লাগছে তোকে।”
সত্যিই সাদা টিশার্ট আর কালো ব্লেজারে শিশিরকে এক কথায় অসাধারণ দেখাচ্ছিল। বিপ্লব হেসে বলল,
___ ” আজকে বিন্দু হ্যাঁ বলেই ছাড়বে দেখিস।”
ওরা তিন বন্ধু মিলে হাসাহাসি করছি এমন সময় তুলি নিনা আর বিন্দু নেমে এলো নিচে। সাদা কালো থ্রিপিসে বিন্দুকে যেন অন্যরকম লাগছে। বিন্দু আড়চোখে শিশিরের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল সত্যিই আজ শিশিরকে অসাধারণ লাগছে। সবাই মিলে আরাকাশন রোডের নবাব বিরিয়ানিতে চলল খেতে। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে একেবারে লাঞ্চ করে বের হবে ওরা। আজ বিপ্লব আর আবিরের প্রচুর কাজ। তাই ওরা বেরিয়ে যাবে খেয়েই৷ খাওয়াদাওয়া হাসাহাসি সব চলল। খাওয়ার পরে মেয়েরা গেল হোটেলে আর শিশির গেল ওর বন্ধুদের সাথে। সারাদিন কাজের পরে রাত সাড়ে নয়টার দিকে ওদের কাজ শেষ করে ওরা চলে এলো হোটেলে। রাতে খেয়ে যার যার মত শুয়ে পড়ল কারন পরদিন এক বিশাল শিডিউল আছে ওদের। শিশির সারাদিন উষ্কখুষ্ক করেছে বিন্দুকে দেখার জন্য।এসেও বিন্দুকে দেখতে পায় নি। কারন বিন্দু আগেই খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। সবাই শুয়ে পড়লে শিশির ধীরে ধীরে বিন্দুর রুমের দরজায় নক করে। বিন্দু যেন শিশিরের অপেক্ষাতেই ছিল। দরজা নক করার সাথে সাথেই খুলে দিল।কিছু না বলে আস্তে করে সরে দাঁড়ালো দরজা থেকে। শিশির চুপ করে বিন্দুর খাটের উপরে যেয়ে বসতেই বিন্দু চেয়ার টেনে ওর সামনে বসল। শিশির হঠাৎ ওর সামনের ফ্লোরে বসে বিন্দুর হাতটা জড়িয়ে ধরল। আজ যেন শিশিরের চোখের মেঘ গুলো বর্ষনের রুপ ধারন করল। বিন্দুর হাতটা ওর হাতের মধ্যে নিয়ে অঝোরে বাচ্চাদের মত কাঁদতে কাঁদতে বলল,
___ ” বিন্দু আমি তো আর পারছি না। আর দূরে রেখো না আমাকে। আমার তো আর সহ্য হচ্ছে না বিন্দু প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দেও”।
____ ” পারবেন গত তিন বছরের অসহ্য যন্ত্রণাগুলো মুছে দিতে। পারবেন আমার আর আপনার ফ্যামিলির উপরে মানুষের অভিযোগ গুলো ফিরিয়ে দিতে।পারবেন না তাহলে কেন ক্ষমা চাইছেন? আছি তো ভাল আপনিও ভাল আছেন তাহলে কেন এত অনুযোগ। ”
বিন্দু কাঠের মত উওর দিল। শিশির কিছু না বলে বিন্দুর হাতে মাথা দিয়ে কাঁদতে লাগল। ওর কাছে কিছুই যে বলার নেই আজ। বিন্দু যেন বুকটা ফেটে যাচ্ছে আজ পারছে না যেন নিজের সাথে। শিশিরকে এভাবে কাঁদতে দেখে বিন্দু যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। শিশির উঠে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। শিশির দরজার কাছে পৌঁছে দরজা খুলবে এমন সময় বিন্দু পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল শিশিরকে। প্রত্থম কিছু মূহুর্তে শিশির যেন বুঝে উঠতে পারল না হচ্ছেটা কি। পরে যখন বুঝলো যে এটা বিন্দু ওর বিশ্বাসই হচ্ছিল না। শিশির ঘুরে বিন্দুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল,
___ ” মাফ করে দেও আমাকে আর কখনও ছেড়ে যাব না তোমাকে “।
___ ” এই বার ছেড়ে গেলে সোজা মরে যাব আমি “।
শিশির আর কিছু না বলে সজোরে জড়িয়ে ধরল বিন্দুকে। বুকের উপর থেকে বিশাল এক পাথর যেন নেমে গেল শিশিরের। কতক্ষন এভাবে থাকার পরে শিশির বিন্দুর মুখ উঁচু করে ধরে বলল,
___ ” বিয়ে করবে আমাকে আজ এখন? ”
___ ” মানে কি? ”
বিন্দু অবাক হয়ে বলল। শিশির ওর চোখে চোখ রেখে বলল,
___ ” হ্যাঁ বা না “।
___ ” আমাদের দুইজনের বাসার কেউ মেনে নেবে না “।
___ ” বিন্দু আমি জানি তুমি আমাকে ভালবাসো না হলে এই তিনবছর একা থাকতে না৷ আর কষ্ট দিও না আমাকে।”
___ ” কিন্তু……”
___ ” কোন কিন্তু নয় বিন্দু আর তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না “।
বিন্দু কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইল। শিশির কল দিল আবিরকে। আবির বেশ কিছুক্ষন পরে ফোন ধরে বিরক্তির স্বরে বলল,
___ ” তোর না হয় বউ নাই আমার তো আছে। এমন এমন সময় ফোন দিস না তুই…….. সে যাই হোক বল কল দিছিস কেন? ”
___ ” আবির আমি বিয়ে করব এক্ষুনি “।
___ ” সালা তুই কি মদ গাঞ্জা খাইছিস নাকি কিছু? কি কি বলতেছিস তুই বিয়ে করবি মানে? ”
___ ” আমি সিরিয়াস আমি বিয়ে করব ”।
আবির নিনাকে গায়ের উপর থেকে সরিয়ে উঠে বসল।ভাল করে মাথা ঝাড়া দিয়ে বলল,
___ ” একবার বিন্দুকে কষ্ট দিয়েছিস আবার এখন আরেক মেয়েকে বিয়ে করে বিন্দুকে কষ্ট দিবি?”
___ ” ” আমি বিন্দুকেই বিয়ে করব। তাও আবার এক্ষুনি!”
এবার আবিরের মুখ হাঁ হয়ে গেল। নিনা আবিরের অবস্থা দেখে বলল,
___ ” কি ব্যাপার তুমি এমন করছ কেন? কি হইছে? ”
___ ” নির্ঘাত শিশির গাঞ্জা খাইছে তাও আবার ডেট ওভার গাঞ্জা কি কি বলতেছে ও “।
নিনা কিছু বলতে যাবে এমন সময় শিশির ফোনের অপর পাশ থেকে বলতে লাগল,
___ ” তুই বিপ্লবকে নিয়ে বিন্দুর রুমে চলে আয়। আমি অপেক্ষা করতেছি”।
এই বলেই শিশির ফোন কেটে দিল। আবির কিছুক্ষন হতবিহবল হয়ে বসে রইল। পরে বিপ্লবকে নিয়ে ওর রুমে যেতেই বিন্দু এক কোনায় চুপ হয়ে বসে আছে আর শিশির অস্থির ভাবে পায়েচারী করছে। সব শুনে ওই রাতেই ওরা একজন কাজী ধরে নিয়ে আসে হোটেলের লোকদের সহযোগীতায়। যেহেতু ইন্ডিয়াতে আছে তাই আর রেজিষ্ট্রি করাতে পারলো না। শুধু কলমা পড়ে ১০ লাখ টাকা মোহরানা ধার্য্য করে ওদের বিয়ে হয়ে গেল। সবাই মিষ্টি মুখ সেরে যখন চলে গেল। আবির বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” দোস্ত আমারে একটা চিমটি দেতো। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এদের দুইটার বিয়ে হয়ে গেছে। ”
___ ” দে তোর হাত দে চিমটি দেই “।
বিপ্লব হাসতে হাসতে বলল। আবির তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিল৷ তখন তুলি হেসে বলল,
___ ” তো নতুন বউকে সাজিয়ে দেই আজকে ওদের বাসর রাত তো “।
___ ” রাত বাজে দুইটা আর আছেই কয়েক ঘন্টা। সকাল সাড়ে সাতটায় গাড়ি আসবে খেয়াল আছে। ”
আবির তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো। শিশির এতক্ষন চুপ ছিল ও হঠাৎ বলে উঠলো,
___ ” বিয়েটা করলাম বিন্দুকে বেঁধে রাখার জন্য। বাসর আর সংসার দেশে যেয়েই শুরু করব। ”
এই বলে ও বেরিয়ে গেল রুম থেকে।সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শিশিরের যাওয়ার পথে দিকে চেয়ে। বিন্দুর ঠোঁটের কোনায় হঠাৎ একটা হাসি ফুটে উঠলো। এ যেন শিশিরকে অন্য দৃষ্টিতে দেখার প্রতিচ্ছবি। সেদিন সারারাত দুটো মানুষ পাশাপাশি রুমে শুয়ে জেগে থাকলো। কাছে যাওয়ার কোন বাঁধা নেই, নেই কোন বারন তাও দুজন মানুষ এক হয়েও আজ আলাদা। এমন বাসর বোধ হয় এই প্রথম কারো হল।

পরের দিন সকালে সবাই নিচে এসে হাজির হল। আজকে সারাদিন ওরা আগ্রার তাজমহল দিল্লী ফোর্ট এসব ঘুরে রাত্র ১০ টায় জম্মুর ট্রেন ধরবে। একটা দশ সিটের মাইক্রোবাস ভাড়া করেছে ওরা। সারাদিন ওটাতেই জার্নি করে রাতে রেল স্টেশনে দিয়ে আসবে ওদের। ১১০০০ রুপির চুক্তি। ওর হোটেলে চেক আউট করে একেবারে ব্যাগেজ সহ বের হয়ে আসলো। দিল্লী থেকে আগ্রা প্রায় ২২০ কিঃমিঃ। সোজা একটা ফোর লেনের হাইওয়ে আছে দিল্লি থেকে আগ্রা যাওয়ার যেটার নাম যমুনা এক্সপ্রেস হাইওয়ে। যে শিশির ইউরোপ থেকে এসেছে সেও প্রশংসা করল এই রাস্তার।খুব সুন্দর স্মুথ একটা রাস্তা। এই রাস্তা ধরে আগ্রা যেতে প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগে। বিন্দু গাড়িতে উঠে শিশিরের কাধে মাথা দিয়ে রইল চুপ করে। শিশিরে বিন্দুর কোমর জড়িয়ে ধরে আরো কাছে নিয়ে আসলো। রাস্তার দু ধারে দেখার মত কিছু নেই। কেমন জানি মরুভূমি টাইপের। মাঝে মাঝে কিছু হাই রাইজড বিল্ডিং এই আর কি। ওরা সকালে নাস্তা করে আসে নাই তাই ড্রাইভারকে বলল,রাস্তার পাশের কোন রেস্টুরেন্টে থামাতে। রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্টগুলোকে এখানে ধাবা বলা হয়। তেমনি একটা ধাবায় ওদের ড্রাইভার গাড়ি থামালো। ধাবাটার নাম শিবা ধাবা। ওখানে ওরা আলু পরাটা চা আর হালকা আরো কিছু খেয়ে আবার রওনা দিল। গাড়িতে উঠেই শিশির আস্তে আস্তে বিন্দুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। বিন্দু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল………

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here