#কাছে_দূরে ♥️🥀
#moumita_mehra
#পর্ব_১০
হীরের কপাল বন্দুক তাক করে রাখা লোকটা হীরের সামনেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। আর সঙ্গে সঙ্গে লোকটার বুক থেকে গলগল করে রক্ত ঝড়তে লাগল। আকস্মিক ঘটনায় বাকিরাও আতংকে কেঁপে উঠলো। হীর কিছুক্ষণের জন্য ভেবে নিয়েছিলো গুলিটা তার কপাল ফুটে বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। গুলির বিকট আওয়াজে তার ভয় হলো না আজ। সে চমকেও উঠেনি। বরং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো। লোকগুলো দ্রুত পেছনে তাকাতেই দেখল পরপর ছয়জন দাঁড়িয়ে আছে। শুধু একজন বাদে বাকি সবার গায়েই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থ্রি-স্টার জেপিজি এর ইউনিফর্ম। উপস্থিত প্রত্যেকের মনেই ভয়ের রেশ ঢুকল। সবাই এক এক করে বন্দুক তাক করল লোকগুলোর দিকে। লোকগুলো একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এখান থেকে পালাবে নাকি অর্ধেক কাজ সম্পূর্ণ করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। হীরের সামনে থেকে লোকগুলো পাশে সরে দাঁড়াতেই হীর ঘোলাটে চোখে দেখতে পেলো সাবাবকে। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সে একগাল হাসল। এখন তার মরে যেতেও আপত্তি নেই। কারন তাকে বাঁচাতে স্বয়ং সাদমান সাবাব উপস্থিত হয়েছে। হীরের চুলের মুঠি ধরে রাখা লোকটা হীরকে ধাক্কা মেরে দিলো ভো দৌড়। সঙ্গে সঙ্গে তাদের পেছনে দৌড় লাগালো সাবাবের বাকি টিম মেম্বাররা। হীর ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল পাশে। তাদের ভেঙে মুচড়ে যাওয়া গাড়িটার উপর পড়তেই আবারও আঘাত লাগল মাথায়। পাশেই কাঁচ ভাঙা গুলো গুড়িয়ে ছিলো বলে শেষ রক্ষা আর হলো না। কাঁচ ভাঙা গুলো বিঁধে গেলো মাথার ডান পাশটায়। যার দরুন আবারও গলগল করে রক্ত ঝড়তে লাগল হীরের মাথা থেকে। হীর গাড়িটাকে আঁকড়ে ধরতে পারল না। অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলো মেয়েটা। নীচে গড়িয়ে পড়ে রাস্তায় পড়তেই সাবাব এসে ধরল তাকে। হীরের অবস্থা দেখে নিজের মধ্যে নেই সাবাব। চোখে রক্ত উঠে টগবগ করছে। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। গলা শুঁকিয়ে মরুভূমিতে হয়ে উঠেছে। হীরের রক্তাক্ত শরীরটা দেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল সাবাব। দু’হাতে হীরকে জড়িয়ে ধরে জীবনে এই প্রথমবার চোখের জল ফেললো সে। নিঃশ্বাস আঁটকে ধরে বারবার বলতে লাগল হীরকে, “তোমার কিচ্ছু হবে না হীরপাখি। তোমার কিচ্ছু হবে না!” সামনে থেকে গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসতেই চমকে উঠলো সাবাব। মনে হলো এই মুহুর্তে হীরকে নিয়ে হসপিটালে না গেলে তাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। দরদর করে ঘামছে সাবাব। অস্থিরতায় নিজেকে পাগল পাগল লাগছে তার। হীরকে পাঁজা কোলে করে তুলে নিতেই হেলে পড়ল সে নিজেও। তাকে পড়ে যেতে দেখে পেছন থেকে দৌড়ে এলো একটা মেয়ে আর একটা ছেলে। সাবাবকে ধরে সামলে অস্থিরতা দমিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—-” স্যার আপনি ঠিক আছেন তো?”
সাবাব ঘোলাটে ভরাট চোখে তাকালো। ছেলেটার হাত ধরে গাড়ির সামনেই অচেতন দেহটার দিকে ইশারা করে বলল,
—-” ইভান! ফিরোজকে ফাস্ট গাড়িতে তোলো! গো। আর কিরন প্লিজ হেল্প মি। গাড়ির দরজাটা একটু খুলে দাও।”
সাবাবের অর্ডারে দৌড়ে গেলো ইভান। ফিরোজের কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আগে ফিরোজের হার্টবিট চেক করল। কিন্তু ফিরোজের হার্টবিট বারবার মিসিং হচ্ছে। ইভান আর দেরী না করে ফিরোজকে কাঁধে তুলে নিয়ে দ্রুত গাড়ির দিকে অগ্রসর হলো। ফিরোজকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতেই সাবাব বলল,
—-” কিরন, তুমি এখানেই থাকো আভিক আর মাহদীর সাথে। আমাকে আপডেট জানাতে থাকো। আর ইভান তুমি আমার সাথে চলো।”
কিরন গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে সাবাবকে স্যালুট করে বলল,
—-” ওকে স্যার।”
ইভান কিরনের জায়গায় উঠে বসে ফিরোজকে ধরল। আর সাবাব হীরকে আগলে ধরে বসল। ড্রাইভারকে হসপিটালের দিকে যেতে বলাতে সেও হাই স্পিডে গাড়ি স্টার্ট দিলো। হীরের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে পড়ছে। শরীরটা যেন বরফ হয়ে উঠেছে মুহুর্তেই। তবুও সাবাব আশা ছাড়তে পারছে না। হীরের কিছু হতেই পারেনা! এদিকে ফিরোজেরও একই অবস্থা! ঠান্ডা বরফ শীতল শরীর নিয়ে সেও অচেতন হয়ে পড়ে আছে।
দশমিনিটের মাথায় হসপিটালের সামনে গাড়ি এসে থামতেই ইভান দৌড়ে গেলো হসপিটালের ভেতরে। সঙ্গে করে ডাক্তার এবং নার্সদের নিয়ে হাজির হলো। সাথে এলো দুটো স্ট্রেচার। দু’জনকে দুটো স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে ডাক্তাররাও ছুটলেন ইমারজেন্সিতে। অটির সামনে এসে পাথরের মতো জমে বসে রইল সাবাব। হীরের এই অবস্থা বাবা মাকে কি করে জানাবে সে? এই মুহুর্তে মাথাই যে কাজ করছে না তার। স্টিলের চেয়ারগুলো ধপ করে বসে পড়ল সাবাব। দাঁড়িয়ে থাকারও যে শক্তি নেই তার মাঝে। চেয়ারে বসে পড়ে দু’হাতে পুরো মুখটা একবার মালিশ করে ডায়াল করল মায়ের নাম্বারে। সবাইকে হসপিটালের নাম বলে আসতে বলে চুপচাপ মাথা হেলান দিয়ে বসে রইল সে। ইভান আস্তেধীরে এগিয়ে এসে বসল সাবাবের পাশে। সাবাবের হাতের উপর হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
—-” স্যার! বি স্ট্রং প্লিজ। জানি প্রোপারলি পসিবল না বাট ইমপসিবল নয়। আমি আপনাকে কি বলে সান্ত্বনা দিবো আমার জানা নেই কিন্তু এটুকু বলবো প্লিজ এভাবে হাল ছেড়ে দিবেন না।”
সাবাব চাপা আর্তনাদ করে উঠল। কষ্টে তার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। স্টিলের চেয়ারগুলোতে ধুমধাম করে কতগুলো বারি মেরে আবারও দু’হাতে মুখ চেপে ধরল। নিজের মনকে কি করে বুঝ দেওয়া যায় জানা নেই সাবাবের। ইভানও আর কিছু বলে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলো না! ইভান উঠে গেলো ফোন দিয়ে। ওদিকের আপডেট দিয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে কিরন। সাবাবের মনের উপর দিয়ে কি যাচ্ছে সেটা ভেবেই ইভানকে ম্যাসেজ পাঠালো সে। ইভান ফোন নিয়ে চেক করতে করতে বাইরে চলে গেলো। সাবাব এখনও পাথরের মতো বসে আছে। ভেতরটা যেন অনুভূতি শূন্য হয়ে যাচ্ছে! বুঝতে পারছে না কষ্টের পাহাড়টা ঠিক কতটুক আকাশ ছুলো।
অস্থিরতা আর বিস্ময় নিয়ে একপ্রকার দৌড়ে ঢুকে এলেন আজিম সাহেবরা। পুরো হসপিটাল ছানমান করে অবশেষে অটির সামনে এসে খুঁজে পেলেন সাবাববে। এভাবে শক্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন সবাই! নাজমা বেগম ছেলেকে ডাক দিতেই চমকে উঠলো সাবাব। আশেপাশে মায়ের গলা খুঁজতেই একটু দূরেই আবিস্কার করল মাকে। তার পাশে বাবাকে আর তাদের পেছনে বোনকে। মাকে দেখতেই মনটা কেঁদে উঠল সাবাবের। দাঁড়িয়ে গিয়ে মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নাজমা বেগম অবাক কন্ঠে বলে উঠলেন,
—-” কি হয়েছে বাবা? তুই হসপিটালে কেন? কার কি হয়েছে? আর আজ সকাল সকাল কোথায় বেরিয়ে গেলি বলতো? এখন আবার হসপিটালে? তুই ঠিকাছিস তো বাবা?”
সাবাব তৎক্ষনাৎ মাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মনকে বোঝালো ভেঙে পড়লে চলবে না। এক্ষনি সে যে খবরটা তার পরিবারকে দিতে যাচ্ছে তারপর তো সবাইকে তাকেই সামলাতে হবে৷ সে ভেঙে পড়ল চলবে কি করে?
আজিম সাহেব হাসফাস করে বলে উঠলেন,
—-” কি রে কথা বলছিস না কেন? তুই এখানে কেন? আর আমাদের হঠাৎ কল দিয়ে হসপিটালে কেন আসতে বললি? সব ঠিকাছে তো বাবা?”
ভাইয়ের চুপ থাকা দেখে সানিয়ার মনে সংশয় জাগল। শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
—-” হীর ঠিকাছে তো ভাইয়া?”
সানিয়ার প্রশ্নে কেঁপে উঠলো সাবাব! সেই সাথে টনক নড়ল নাজমা বেগম আর আজিম সাহেবের! নাজমা বেগম হঠাৎই ভয়ংকর হয়ে উঠে ছেলের শার্টের কলার্ট চেপে ধরে কঠিন স্বরে বললেন,
—-” কি হয়েছে আমার হীরের? চুপ করে থাকবি না সাবাব? বল!”
আজিম সাহেব ভেঙে পড়ে বললেন,
—-” চুপ করে আছিস কেন? কি হয়েছে হীরের?”
সাবাব জবাব দিতে পারল না। ঠিক তখনই অটি থেকে বেরিয়ে এলেন একজন ডাক্তার। সঙ্গে বের হলো আরও দু’জন ডাক্তার এবং দু’জন নার্স। তারা সাবাবের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
—-” পেসেন্টের বাড়ির লোক কারা?”
ডাক্তারের প্রশ্ন সাবাব তুমুল বেগে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
—-” ইয়ে,,সস।”
ডাক্তাররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বললেন,
—-” উই আর সরি! পেসেন্ট একজন স্পট ডেড হয়ে গিয়েছে। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি।”
ডাক্তারের কথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল সবার মাথায়। নাজমা বেগম হোঁচট খেয়ে স্বামীকে আঁকড়ে ধরলেন। সানিয়াও বাবাকে শক্ত করে ধরে দাঁড়াল। সাবাব শুঁকনো গলায় ঢোক গিলে বলল,
—-” ক,,কে?”
ডাক্তাররা আলোচনা করতে করতে বললেন,
—-” পুরুষ যিনি ছিলেন তিনি স্পট ডেড।এন্ড পরে যাকে নেওয়া হলো মানে মেয়েটা? তার কন্ডিশনও খুব একটা ভালো নয়। প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে। আমাদের আগে ব্লাড কালেকশন করে উনাকে দিতে হবে। আর তাছাড়া মাথায় অনেক ইনজুরি আছে। জানিনা কতটুকু ঠিক করতে পারব। তবে আমরা আশাবাদী কিন্তু ভরসা দিতে পারছিনা।”
এই বলে উনারা সবাই হেঁটে চলে গেলেন। সাবাব মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। এক মুহুর্তের জন্য সে ভেবেই ফেলেছিলো হীর আর বেঁচে নেই। যেভাবে বারবার মাথায় আঘাত লেগেছে তাতে প্রচুর ব্লাড লস হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাবাব যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন নাজমা বেগম। উপস্থিত সবাই চমকে উঠলো তার কান্নার শব্দে। আজিম সাহেব অসহায় চোখে তাকালেন বউয়ের দিকে। তাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে আরও ভেঙে পড়লেন নাজমা বেগম। অন্য পাশ থেকে সানিয়াও বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। সবাই যেন কয়েক মুহুর্তের জন্য ঘোরে পড়েছিলো মৃত্যুসংবাদ শুনে। তাদের মস্তিষ্ক তাদের ভাবতে বাধ্য করেছে হীর আর বেঁচে নেই। আবার হীর বেঁচে আছে শুনতেই হীরকে হারানোর তীব্র ভয় কাজ করল সবার মনে! যা কিছু হয়ে যাক না কেন! কেউই যে হীরকে হারাতে চায়না! সবাই হীরকে আঁকড়ে রেখে বাঁচতে চায়।
—-” মা! মা, কেঁদো না প্লিজ। হীর একদম সুস্থ হয়ে উঠবে মা। এখানকার ডক্টররা হাল ছেড়ে দিলে আমি হীরকে নিয়ে অন্য হসপিটালে যাবো! যদি এই দেশের কেউ-ই না পারে হীরকে সুস্থ করতে তাহলে আমি ওকে নিয়ে আমেরিকা, লন্ডন, মালেয়শিয়া,স্পেন, জাপান সব দেশে নিয়ে হাজির হবো মা। ওর চিকিৎসা করিয়ে ওকে সুস্থ করবই। হীর বাঁচবে মা। ওকে যে বাঁচতেই হবে।”
নাজমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে ছেলের বুকে মাথা ঠেকালেন। শেষ পরিনতি ভাবতে সবারই দম আঁটকে আসছে। কিন্তু সাবাব আশা ছাড়ছে না। নাজমা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠেই বলে উঠলেন,
—-” আ,,আমি সবাইকে বারন করেছিলাম মেয়েটা যেন আজ বের না হয়! কিন্তু আমা,,র কথা কেউ শুনলোই না! ব,,বিশ্বাস কর বাবা আ,,মার মনটা কেমন যেন করছিলো! আমার একদম ভালো লাগছি,,লো না হীর আজ বের হোক! ত,,বুও যে কেন বের হতে দিলাম আমি!”
আবারও শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন নাজমা বেগম। সাবাব মায়ের কান্না দেখে নিজেকেও সংযত করতে পারছে না! কিভাবে যে সবটা হয়ে গেলো মাথায় ধরছে না কারোরই।
মাকে জড়িয়ে রাখা অবস্থাতেই সাবাব দেখলো ইভান অস্থির চোখ মুখ করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। সাবাব মাকে ছেড়ে ইভানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ইভান চাপা স্বরে কিছু একটা বলল সাবাবকে। যা শুনতেই সাবাবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। রাগে কপালের দু’পাশের রগ দুটো ফুলে ফেঁপে উঠল। ইভানকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই কঠিন স্বরে ডেকে উঠলেন আজিম সাহেব। সাবাব বাবার ডাক পেয়ে পেছনে তাকাতে তাকাতে কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন তিনি,
—-” সাবাব, উনি কে?”
সাবাবের চোখ শান্ত হয়ে গেলো। বাবার দিকে তাকিয়ে ইভান কে ইশারা করে বলল,
—-” ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাদমান সাবাবের সিক্রেট টিম মেম্বার আলভি ইভান।”
কথাটা বলতেই কঠিন মূর্তি ধারন করে সাবাবকে স্যালুট করল ইভান। সবাই কান্না বন্ধ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ইভানের দিকে। আজিম সাহেব রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সাবাবের দিকে। গলার স্বর খানিকটা নীচু করে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
—-” তোমায় আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিলো তোমার ভালো একটা ফিউচারের জন্য সাবাব। কিন্তু তুমি এসব কি করলে? কি প্রফেশন চুজ করলে তুমি? আমাদের একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি? এই যে আমি তোমার বাবা, এই যে তোমার মা? তুমি আমাদের কিচ্ছু জানালে না সাবাব!”
সাবাব ছোট্ট করে জবাব দিলো,
—-” এটা আমার স্বপ্ন ছিলো বাবা। আর আমেরিকা আমার স্বপ্ন পূরনের ছোট্ট একটা মাধ্যম।”
কথাটা বলেই হুড়মুড় করে চলে গেলো সাবাব। তার পেছন পেছন ছুটে গেলো ইভানও। আজিম সাহেব চেয়ার ধরে বসে পড়লেন। তার বুকে ব্যাথা করছে। এই একই পেশার জন্য বারো বছর আগে সে তার সবচেয়ে আদরের ছোট ভাইটাকে হারিয়েছে! শুধু ভাইকে হারিয়েই তার হারানো শেষ হয়নি! ভাইয়ের একমাত্র সন্তান হীর, তাকে যাকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুপুরী থেকে ঘুরে আসতে হচ্ছে একমাত্র তার বাবার এই পেশার জন্য। না জানি সেও কবে হারিয়ে যায় তার বাবার মতো। আর আজ তার নিজের ছেলেই সেই পথে পা বারিয়ে হাঁটছে। সেও একই ভুল করছে।
__________________
—-” নাম কি?”
মুখ থেকে রক্ত গলগল করে ঝরে পড়ছে লোকটার। চোখের কোনে,কপালে,ঠোঁটে কোনো জায়গাতেই বাদ নেই কাটাছেঁড়া করার। সব জায়গা থেকেই রক্ত ঝরছে। সে আর কতক্ষণ বেঁচে থাকবে জানে না সে। তবে এটুকু জানে আর বেশিক্ষণ আয়ু নেই তার। সাবাবের দিকে তাকিয়ে রক্ত মুখেই বিকৃত হাসল লোকটা। অস্পষ্ট কন্ঠে বলতে লাগল,
—-” নামমম! মমনে নাই!”
লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে সাবাবও হাসল। লোকটার চোখে চোখ রেখে দাঁড়িতে হাত ঘষে বলল,
—-” হীরের উপর এট্যাক করার জন্য কতটাকা পেমেন্ট পেয়েছিলিস?”
লোকটা দুর্বল চাহনি দিলো।
—-” মমনে নাই!”
সাবাব উঠে গেলো। লোকটাকে জেরা করে কোনো লাভ নেই। এরা তেমন কিছুই জানেনা। আর এও জানে না এদের উপরের আসল মাথা কে! এই লোকটাই হলো সে যে আহমেদ ভিলার গার্ডেনের পাশ থেকে হীরকে সুট করতে চেয়েছিলো। হীরের হসপিটালের একটা বিশিষ্ট কেবিনেই ইভান তাকে দেখতে পায়। যার কারনে তখন দৌড়ে এসে সাবাবকে এই খবর দিয়ে তৎক্ষনাৎ তাকে গিয়ে এরেস্ট করে নেয় তারা। আর বাকিদের সাথে তাকেও এনে আঁটকে রাখে তাদের সিক্রেট রুমে। লোকটার পাশেই বাকিরাও মরা মরা অবস্থা হয়ে গোঙাচ্ছে কেবল।
পেছন থেকে ইভান,আভিক,মাহদী আর কিরন এসে দাঁড়ালো সাবাবের পাশে। তৈরি রাখা ফাইল গুলো সাবাবের দিকে এগিয়ে দিয়ে কিরন বলল,
—-” স্যার, এখানে এদের সবার ডিটেইলস দেওয়া আছে।”
সাবাব ফাইলগুলো চেক করতে লাগল। পাশ থেকে আভিক চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
—-” স্যার, হীরের উপর এট্যাক করা এই চ্যালারা বেশিদিন নির্দিষ্ট থাকেনা।”
সাবাব ভ্রু কুঁচকে বলল,
—-” মানে?”
মাহদী এগিয়ে এসে সাবাবকে ফাইল গুলো ধরে দেখাতে দেখাতে বলল,
—-” দেখুন স্যার, প্রথম পেজে আজকের এট্যাক কারীদের ডিটেইলস আছে। তার পরের পেজে গতকাল এট্যাক করা লোকটার ডিটেইলস এন্ড তার পরের পেজে তার আগের দিন হীরের রুমে যে এট্যাক করে তাদের ডিটেইল এন্ড তার পরের পেজ, সর্বশেষ ডিটেইলস হলো কফিশপে যারা বোম ফিট করে তার ডিটেইলস। প্রতিদিন সব নতুন নতুন এট্যাক কারীদের আগমন! একজন এট্যাক কারী কিন্তু সেকেন্ড টাইম এট্যাক করতে পারেনা। ইভেন পরবর্তীতে তাদের আর কোনো খোঁজই মেলেনা।”
ইভান ভাবুক কন্ঠে বলল,
—-” গত পরশু দিন হীরের রুমে যে এসেছিলো সে কিন্তু মাত্র কয়েক মিনিট বাদেই ডেড হয়ে গিয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম ও হয়তো গুলি খেয়ে মারা গেছে কিন্তু না! পরে রিপোর্ট এলো যে ওর শরীরে প্রথম থেকেই কোনো কেমিক্যাল পুশ করা হয়েছিলো। যার কারনে ঠিক সময় পরেই ওর মৃত্যু ঘটে।”
সাবাব কপাল কুঁচকে ফাইল গুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল,
—-” কিন্তু এই লোকটা কি করে বেঁচে আছে?”
সাবাবের প্রশ্নে সবারই কপালের ভাজ সুক্ষ হলো। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
—-” সেটাই ভাববার বিষয়। সবাই যদি মরে যায় তবে এই লোক এতো ঘন্টা পার হতেও কি করে বেঁচে আছে।”
সাবাব ফাইল গুলো আভিকের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
—-” ওদের রিপোর্ট এসেছে?”
কিরন হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,
—-” ইয়েস স্যার!”
মাহদী ভাবুক কন্ঠে বলল,
—-” স্যার ওদের রিপোর্টও একই এসেছে। ওদের শরীরেও একই কেমিক্যাল পাওয়া গিয়েছে। তাই ওদের আয়ুও আর বেশিক্ষণ নেই।”
সাবাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও ফাইল ঘাটায় মনোনিবেশ করল। শেষ পর্যায়ে এসে বলল,
—-” ওদের কাছে কোনো সেলফোন পাওয়া যায়নি?”
আভিক আর মাহদী না সূচক মাথা নেড়ে বলল,
—-” নো স্যার। আশ্চর্যজনক হলেও ওদের কারোর কাছেই কোনো সেলফোন পাওয়া যায়নি।”
সাবাব ফাইলটা পাশে রেখেই রাগান্বিত হয়ে দেয়ালে ঘুষি মারল। তার মাথায় কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। একদিকে হীর আর অন্যদিকে এট্যাককারীরা। কোনো রকম কোনো ক্লুই যদি না মিলে তবে মাস্টারমাইন্ড অব্দি পৌঁছাবে কি করে?
আচমকা ফোন বেজে উঠল সাবাবের। সাবাব তড়িঘড়ি করে ফোনটা বের করতেই দেখল সানিয়ার নাম্বার। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল সাবাবের। অস্থির মনটা বারবার বলে উঠছে, ঠিকাছে তো হীর?
—-” সানি? ঐদিকে সব ঠিকাছে তো?”
—-” ভাইয়া, হীরের সেন্স ফিরেছে! কোথায় তুই?”
“হীরের সেন্স ফিরেছে” কথাটা শুনতেই বুকের ভেতরটায় যেন ঠান্ড হাওয়া বয়ে গেলো! সাবাব বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
—-” আমি এক্ষনি আসছি।”
সাবাব ফোনটা পকেটে রেখে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই দেখা মিলল সবার অস্থির হয়ে থাকা মুখগুলোর। সাবাব সবার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
—-” হীরের সেন্স ফিরেছে।”
কথাটা শুনতেই সবাই একসাথে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিরন বলল,
—-” আপনি হসপিটালে চলে যান স্যার। এদিকটা আমরা সামলে নিবো।”
সাবাব ছোট্ট করে হাসল। মাথা নেড়ে বলল,
—-” আসলাম।”
#চলবে____________________