কাছে দূরে পর্ব ৯

#কাছে_দূরে ♥️🥀
#moumita_mehra
#পর্বঃ০৯

ডক্টর গম্ভীর মুখে তাকালেন আজিম সাহেবের দিকে। নাকের ডগায় ঝুলে থাকা চশমাটা কলমের ক্লিপ দিয়ে একটু পেছনের দিকে ঠেলে দিলেন। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

—-” ওকে এভাবে আর কতদিন বাঁচাবেন আপনারা? ভয় পেতে পেতে ওর মানসিক অবস্থা কতটা করুন তা যদি খাতা-কলমে ধরে আপনাদের বোঝাতে পারতাম। এই ভয়ের দ্বারা ওর শরীরে যে বড় কোনো রোগ বাসা বাঁধছেনা সেটাও সিওরিটি দিয়ে আমি বলতে পারছিনা আজিম সাহেব। আমি আর ওর লাইফ রিস্ক নিতে পারছিনা! আপনারা এর একটা ব্যাবস্থা করুন। হয় ওর বিরুদ্ধে হওয়া এসব ক্রাইম আটকান অন্যথা ওকে এমন কোনো জায়গায় পাঠিয়ে দিন যেখানে ও মানসিক শান্তি নিয়ে বাঁচতে পারে। আমার আর কিছু বলার নেই। এই যে প্রেসক্রিপশন। এখানে অল্প কিছু ঔষধ দেওয়া আছে। এতে ওর শারীরিক দুর্বলতা কেটে যাবে কয়েকদিনের মধ্যে। আজ বরং আসি। খেয়াল রাখবেন ওর প্রতি।”

ডাক্তার অরিত্র ঘোষ সাবাবের হাতে প্রেসক্রিপশনটা তুলে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেলেন। রুবি ডাক্তার বাবুর পেছন পেছন গেলো তাকে গাড়ি অব্দি ছাড়তে। হীর এখনও অচেতন। ঘন্টা তিনেক পেরিয়ে গেলো এখনও মেয়েটার জ্ঞান ফিরল না। নাজমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে প্রেশার হাই করে ফেলছেন। সানিয়া তাকে সামলাচ্ছে। আজিম সাহেবেরও একই দশা। সানিয়ার বিয়ের ডেট ফাইনাল হওয়ার আগেই বাঁধল এই বিপত্তি। ছাদ থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসতেই হার্ট অ্যাটাক করে ফেলার দশা হলো নেহালের বাবার। তারউপর তার ছোট ছেলেও হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে গেলো। কোথায়,কখন বের হলো কেউই জানে না। হীরকে রুমে নিয়ে এসে সাবাব দৌড়ে গেলো নীচে। ডাক্তারকে কল করার মাঝেই রুবিকে সাতপাঁচ বুঝ দিয়ে শিখিয়ে দিলো যেন তাদের বলে, রুবি তাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। রুবি এ’কথা বলতে তারা একটু শান্ত হলেন। ঐদিকে হীরের এই অবস্থা জেনে স্থীর থাকতে পারল না কেউই। ছুটে গেলো সবাই হীরের কাছে। ভেজা শরীরে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে আছে দেখতেই সবার আগে সানিয়া আর নাজমা বেগম মিলে হীরের জামাকাপড় পাল্টে দিলো। গরম কাপড় পরিয়ে শুইয়ে দিলো বিছানায়। জ্বরের আগাম আচ পেয়ে গায়ে ভালো করে চাদর পেঁচিয়ে দিলো। ততক্ষণে ডাক্তার বাবু এসে পড়েছিলন। আর নেহাল আর তার বাবা-মা বেশিক্ষণ না থেকে ঘরের পরিস্থিতি বুঝেও তারাও চলে গিয়েছেন। বিয়ের ডেট ফাইনাল করে ফোনেই জানাবেন বলে জানালেন আজিম সাহেব। আপাতত তারাও নিশ্চিন্ত। কেবল দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছে আহমেদ ভিলার মানুষ গুলো। হীরের ভবিষ্যত নিয়ে সবার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কি আছে মেয়েটার শেষ পরিনতিতে? কখনও কি সুখের দেখা মিলবে হীরের কপালে? নাকি কেবল দুঃখ দিয়েই ভরা মেয়েটার জীবন!

—-” আমার মেয়েটার জীবনটা এভাবে নরকেই কাটবে? কখনও কি সুখের মুখ দেখবে না ও?”

কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুছলেন নাজমা বেগম। সানিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদছে। আজিম সাহেব বউয়ের পাশে বসলেন। তারও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে হীরের এমন অবস্থায়। কিন্তু সে যে বউ আর মেয়ের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে পারছেন না। কারন সেটা তার ব্যাক্তিত্বের সাথে যায়না। একজন পুরুষ মানুষ কখনও এভাবে কাঁদতে পারেন না। সেই কঠিন নিয়মে পরে সেও পারছে না। তাই বউ আর মেয়েকে সামলানোর ভারটা কাঁধে তুলে নিলেন। হীর একদম ঠিক হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিলেন আজিম সাহেব। সাবাব হীরের মাথার কাছে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার কষ্ট হওয়ার চেয়েও রাগ হচ্ছে বেশি। বুকের ভেতরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দপদপ করছে আগুন। তারা হীরকে বারবার এভাবে আঘাত করেই যাবে, করেই যাবে আর সে শুধু চুপচাপ দেখে যাবে সেটা কি করে হয়? শুধু চুপচাপ দেখার জন্য তো সে এতোগুলা বছর হীরের থেকে আলাদা থাকেনি! হীরের থেকে আলাদা থাকার যে কারন সেটা তো এবার প্রয়োগ করতেই হবে। অনেক হয়েছে লুকোচুরি খেলা। আর নয়।

হঠাৎ বেজে উঠল সাবাবের ফোন। সঙ্গে সঙ্গে ঘোর কাটলো সাবাবের। চমকে উঠে পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল ‘private number’। সাবাব আর দাঁড়িয়ে না থেকে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। নিজের রুমে গিয়ে কলটা রিসিভ করে কানে তুলতে ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসল। মেয়েটা সাবাবকে স্যালুট করল! সাবাব এপাশ থেকেই আন্দাজ করে নিলো। সাবাব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—-” এনি আপডেটস্!”

ওপাশ থেকে মেয়েটার কোমল কন্ঠে জবাব এলো,

—-” নো স্যার। স্যার, আমরা আপনার কল পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঐ আগন্তুকের পিছু নেই। কিন্তু আমরা তার কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার একটা গাড়ি এসে তাকে সেফ করে নিয়ে যায়। যদিও সে পুরোটা সেফলি গাড়িতে উঠতে পারেনি। ইভানের পিস্তলের গুলি তার বাম পায়ে গিয়ে লেগেছে। আমাদের হাতে আর কয়েক মিনিট সময় থাকলেই আমরা তাকে ধরে ফেলেছিলাম প্রায় কিন্তু….”

—-” ড্যাম!”(রাগান্বিত স্বরে)

—-” স্যার রিল্যাক্স হন। আশাকরছি, আমরা বিভিন্ন হসপিটাল গুলোতে খোঁজ করলে ঐ লোকের সন্ধান পেলেও পেতে পারি। কারন স্যার, ওর পায়ের গুলিটা যে এঙ্গেলে বিঁধেছে তাতে কোনো অভিজ্ঞ ডক্টর ছাড়া তার ট্রিটমেন্ট করা পসিবল না। আর হলেও তার বাঁচার আশা শূন্য।”

—-” অলরাইট। তোমরা ওকে খুঁজে বের করো। মনে রেখো ওকে খুঁজে পেলে ওর উপরের কলকাঠি নাড়া মাথাগুলো কারা সেটা একটু হলেও আন্দাজ করা যাবে।”

—-” সিওর স্যার।”

—-” অলরাইট।”

—-” আর স্যার রাবিবের জন্য কি ব্যাবস্থা করা যায়?”

রাবিবের নামটা শুনতেই যেন মাথায় রক্ত উঠে গেলো সাবাবের। রাবিবকে এই মুহুর্তে হাতের কাছে পেলে সে নির্ঘাত সুট করে মেরে ফেলত। শুধু সানিয়ার দেবর বলেই তার জীবনটা হয়তো বাঁচিয়ে রাখা হবে। কিন্তু বাঁচার মতো নয়।

—-” ওকে থার্ড ডিগ্রি দাও।”

—-” স্যার সইতে পারবে তো?”

সাবাব বাঁকা হাসল। ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,

—-” হীরের দিকে হাত বাড়ানোর আগে ওর ভাবা উচিৎ ছিলো ওর সাথে ভবিষ্যতে কি কি ঘটবে সেটা ও সইতে পারবে কি না!”

—-” স্যার আরব বলছিলো ওর হাত পা ভেঙে গুরিয়ে দিলেই ও বাঁচার আশা ছেড়ে দিবে।”

সাবাব ভাবুক কন্ঠে বলল,

—-” ওকে ফাইন। তবে তাই করো। আমারও মনে হচ্ছে ও এতো টর্চার নিতে পারবে না। দেখা যাবে টর্চার করার নাম শুনলেই ও শেষ।”

মেয়েটা হাসল। বলল,

—-” ইয়েস স্যার। স্যার… আর একটা কথা…”

—-” হ্যাঁ বলো?”

—-” হীরপরি এখন কেমন আছে স্যার?”

সাবাব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাতে ধরে রাখা প্রেসক্রিপশনটার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” নাউ শি ইজ ফাইন। বাট কতক্ষণ ফাইন থাকবে আই ডোন্ট নো!”

—-” ডোন্ট ওয়ারি স্যার। শি উইল বি ফাইন। আর আমরা আছি তো তার জন্য।”

—-” হু!”

সাবাব কলের লাইন কেটে দিয়ে ফোনটা পকেটে পুরে আবারও একবার দৃষ্টি রাখল প্রেসক্রিপশনটার উপর। তার ভেতরটাতেও ভয় কাজ করছে। না জানি আরও কি কি বিপদ মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করছে।

পরক্ষণেই মনে পড়ল প্রেসক্রিপশনটা ধরে ধরে দেখে লাভ নেই। এই ঔষধ গুলো আনতে হবে হীরের জন্য। তাই আবারও ফোনটা বের করে কল করল কারোর নাম্বারে। ঔষধের নামগুলো চটপট বলে দশমিনিটের মধ্যে বাসায় পৌঁছে দিতে বলল।

____________________

গাল ফুলিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে হীর। একটু একটু রাগও হচ্ছে তার। বড়মার আদেশ আজও তার ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ। কিন্তু পরপর দু’দিন অযথাই বিনা কারনে ভার্সিটি যাবেনা সেটা যেন হীর মেনে নিতে পারছেনা। হীরের ধারনা বড়মা তার উপর এট্যাক হওয়া নিয়ে ভয় পাচ্ছে কিন্তু এট্যাক তো তার উপর বাড়িতে বসেও হচ্ছে। তাহলে ভার্সিটি কি দোষ করল? বরং এটা হতে পারে ভার্সিটিতে ঢুকলে সে অনেকটাই সেফ। কেননা, ভার্সিটির অসংখ্য মানুষের ভীড়ে তার উপর এট্যাক হওয়াটা একটু তো কষ্টসাধ্য।

—-” কি হলো? খাচ্ছো না কেন?”

নাজমা বেগম বকার সুরে কথাটা বলে উঠলেই কাঁদো কাঁদো মুখ করে ঠোঁট উল্টায় হীর। খাবারের থালাটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে আঁড়চোখে একবার তাকালো নাজমা বেগমের দিকে। নাজমা বেগমের মুখের ভঙ্গিমা কঠিন হয়ে আছে। যা দেখে আজিম সাহেবও কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু হীরের কাঁদো কাঁদো মুখটা দেখতেও যে কষ্ট হচ্ছে তার। তাই সাহস করে বউয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন তিনি,

—-” আহা বকছো কেনো মেয়েটাকে?”

—-” তুমি চুপ করো। ও খেয়ে এখন নিজের রুমে গিয়ে রেস্ট করবে। আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না!”

বড়মার কথা শুনে হীর অসহায় মুখ করে সানিয়ার দিকে তাকালো। সানিয়া তাকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,

—-” মা! হীর বলছিলো যে ওর আজ একটা ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে। সামনেই না ওর ফাইনাল? তাই কিছুদিন ইম্পরট্যান্ট ক্লাস চলবে। টিচার্সরা ওদের এক্সামের ব্যাপারেই অনেক নোটস দিবে। তাও খুব ইম্পরট্যান্ট মা। তাই বলছিলাম কি যেতে দাও না? দরকার পরলে ভাইয়া যাকনা ওর সাথে?”

নাজমা বেগম কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সানিয়ার দিকে। রুক্ষ স্বরে বললেন,

—-” ইম্পরট্যান্ট ক্লাস থাক আর যাই থাক আমি ওকে আজ কোথাও বের হতে দিবো না এটাই ফাইনাল। মেয়েটার উপর থেকে ফাঁড়া মোটে কমছেই না। আমি আর কোনো ঝুঁকি নিতে পারব না।”

হীর মাথা নীচু করে বসে রইল চুপচাপ। তার যে ঘরবন্দী হয়ে থাকতে মোটেই ভাল্লাগছে না! কিন্তু বড়মাকে মানানোও যে দুষ্কর! তবুও শেষ চেষ্টা একবার সেই করবে। হীর কাচুমাচু করে বড়মার দিকে তাকালো। নাজমা বেগম স্বামীর প্লেটে পরোটা দিচ্ছেন। আজিম সাহেব বউয়ের চোখের আড়ালে বারবার তাকাচ্ছে হীরের দিকে। বেচারিকে এই মুহুর্তে কোনো সাহায্য করতে পারছেনা বলে সেও পড়ে গেলো মহা ফ্যাসাদে। হীর আস্তেধীরে উঠে নাজমা বেগমের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। নাজমা বেগম পেছনে মুড়ে তাকাতেই হীর ঝাপটে ধরল তাকে। প্রথমে নাজমা বেগম আঁতকে উঠলেও পরক্ষণে আবার নিজেকে সামলে নিলো। হীর বাচ্চাসুলভ কন্ঠে বারবার করে বলে উঠতে লাগল তাকে,

—-” বড়মা প্লিজ আজকের জন্য যেতে দাও। প্লিজ বড় মা! আমি কথা দিচ্ছি আমার নোটস গুলো কালেক্ট করে এক্সামের আগে আর যাবো না ভার্সিটি। সবসময় তোমার চোখের সামনে বসে থাকব। প্লিজ প্লিজ প্লিজ বড় মা। প্লিজ রাজি হয়ে যাও না! প্লিজ বড় মা!”

নাজমা বেগম ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অসহায় মুখ করে স্বামীর দিকে তাকাতে সেও মাথা নেড়ে অনুমতি দিতে বললেন। সানিয়া মুচকি হেসে বলল,

—-” মা, দিয়ে দাও না পারমিশন। ও এতো করে যখন বলছে…”

নাজমা বেগম সানিয়ার কথার মাঝখান থেকে বলে উঠলেন,

—-” অনুমতি দিতেই পারি। কিন্তু তুমি বাইরে থাকলে তো আমি টেনশনে শেষ হয়ে যাবো মা।”

হীর নাজমা বেগমকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সাবাবের রুমের দিকে ইশারা করে বলল,

—-” তোমার ছেলেকে বলো আমার সাথে যেতে। তাহলে তো আর কোনো টেনশন থাকবে না।”

নাজমা বেগম আবারও কাজে হাত লাগিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন,

—-” সাবাব থাকলে তো আমি আর বাঁধ সাধতাম না। কিন্তু সে তো সকাল থেকে বাসায় নেই। বেরিয়েছে কোথাও একটা। বলেছে ফিরতে আজ একটু লেট হতে পারে।”

আজিম সাহেব কপাল কুঁচকে তাকালেন নাজমা বেগমের দিকে। ভারী কন্ঠে বললেন,

—-” কোথায় গেলো সাবাব?”

—-” জানিনা। বলল কাজ আছে।”

সবার মুখেই চিন্তার ছাপ। সেই ফাঁকে হীর আরও একবার পারমিশন করিয়ে নিলো বের হওয়ার জন্য। সবার নাস্তা শেষে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে হীরও বেরিয়ে যায় ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। হীরের গাড়ির ড্রাইভার ফিরোজ তিনদিনের ছুটি কাটিয়ে আবারও কাজে জয়েন করল। আগের মতোই নিয়ম নেমে হীরের গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে সুন্দর করে বলে উঠলো,

—-” গুড মর্নিং ছোট ম্যাডাম?”

হীর মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলল,

—-” গুড মর্নিং ফিরোজ ভাই।”

“ফিরোজ ভাই” কথাটা একদমই নতুন ড্রাইভার ফিরোজের কাছে। এর আগে কখনো হীর তাকে এভাবে করে গুড মর্নিং উইস করেনি। ফিরোজ ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টেনে আবারও বলল,

—-” ছোট ম্যাডাম, আমার একটা মেয়ে হয়েছে। মাশাআল্লাহ দেখতে না ঠিক আপনার মতো।”

হীর হেসে উঠলো। মাথা দুলিয়ে বলল,

—-” তাই নাকি? তা কি নাম রাখলে আমার জেরক্স কপির?”

ফিরোজ দাঁত কেলিয়ে হাসল। গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,

—-” আপনার নামের নামকরন করছি ম্যাডাম। আমার বিবি আপনারে ভীষণ পছন্দ করে কি না। তাই সে যখন প্রেগন্যান্ট ছিলো তখন সবসময় আপনার ছবি দেখতো। বলত যে, এই সময় তুমি যারে বেশি দেখবা বাচ্চার গঠন ঠিক তার মতোই হইবো।”

হীর বিস্মিত কন্ঠে বলল,

—-” সিরিয়াসলি?”

ফিরোজ তুমুল বেগে মাথা নেড়ে বলল,

—-” হ্যাঁ ম্যাডাম এমনটা হয় আমি অনেক দেখছি ছোট বেলায়। আমাদের মা,চাচিদের দিনে তো আর এই সব মোবাইল ফোন ছিলো না। আর তারা তখন বাড়িঘর ছেড়েও বেশি বের হতো না। তাই মনে করেন তাদের নিজেদের মতে দেখতেই সব হতো। কারন তারা তো আয়নায় নিজেদের ছাড়া বাইরের কাউরে দেখত না। তাই মাও যেমন হতো মেয়েও তেমন হতো।”

হীর খিলখিল করে হেসে উঠলো। ফিরোজের কথাটা তার বেশ মনে লেগেছে। হীরকে হাসতে দেখে ড্রাইভারও হাসতে লাগল। হীর হাসতে হাসতেই নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,

—-” তোমার বউকে আর আমার জেরক্স কপিকে নিয়ে একদিন আসবে কিন্তু আমাদের বাড়িতে। তাদের দু’জনকে দেখার লোভ নিয়ে আমি বেশিদিন থাকতে পারবনা কিন্তু।”

ফিরোজ হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,

—-” আপনার আদেশ শিরোধার্য ম্যাডাম। পরের বার ছুটি নিয়ে তাদের দু’জনকে সঙ্গে করে নিয়ে হাজির হয়ে যাবো।”

—-” হুম অবশ্যই আসবে।”

গাড়ি মেইন রোড পেরিয় অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। গাড়ির ভেতর হীর আর ড্রাইভারের টুকটাক কথা হওয়ার মাঝেই হীরের নজর পড়ল ড্রাইভারের মাথার কাছের ছোট্ট আয়নার উপর। আয়নার সচ্ছ কাচে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের গাড়িকেই ফলো করে ধেয়ে আসছে পাঁচটা কালো গাড়ি। প্রথমে খেয়াল না করলেও এবার বেশ সন্দেহ হচ্ছে হীরের। গাড়ি গুলো তাদের গাড়িকেই ফলো করছে। হীরের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ফিরোজকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—-” ঐ গাড়িগুলো কি আমাদের গাড়িকে ফলো করছে ফিরোজ ভাই?”

হীরের কথা শুনে ফিরোজ আয়নার দিকে দৃষ্টিপাত করল। সত্যিই তাদের গাড়িকে পেছনের গাড়ি গুলো ফলো করছে। ফিরোজ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পাশের আয়নায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শকুনের নজর নিয়ে ধেয়ে আসছে গাড়ি গুলো। হীরকে কি করে বাঁচাবে এখান থেকে? ফিরোজ নিজেও ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে। তবুও হীরকে বারবার অভয় দিয়ে বলতে লাগল,

—-” ছোট ম্যাডাম আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি আপনার গায়ে একটা ফুলের টোকাও আমি লাগতে দিবোনা। আপনাদের নুন খেয়েছি আমি। আমার জীবন দিয়ে হলেও আমি আপনাকে বাঁচাবো।”

এই বলেই গাড়ির স্পিড হাই করে দিলো ফিরোজ। হাওয়ার বেগে গাড়ি ছুটছে তাদের। কিন্তু এট্যাক কারীরাও কম যায় না। তারাও হাই-স্পিডে গাড়ি স্টার্ট দিলো। আর এমন ভাবে ছুটে আসছে যেন এই ধরে ফেললো বলে। হীর গাড়ির সীটের সাথে সিটিয়ে বসল। ভয়ে তার ভেতরটা কাঁপছে। কি হবে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে ভীষণ। পেছনের হিংস্র কুকুরগুলো আজ ওকে খুবলে খাবে নিশ্চিত। আজ তার বাঁচাও অসম্ভব।

আকস্মিক গাড়িতে ধাক্কা খেয়ে এক সীট থেকে অন্য সীটে হুমড়ি খেয়ে পড়ল হীর। গাড়িগুলো তাদের গাড়িকে ধরে ফেলেছে। দুইপাশ থেকে দুটো কালো গাড়ি বারবার ধাক্কা দিয়ে চলেছে তাদের গাড়িকে। হীর সীট থেকে নীচে নেমে পড়ল। এক কোনে গুটিশুটি মেরে বসে পড়তে আবারও স্ব জোরে ধাক্কা খেয়ে হেলেদুলে গেলো গাড়ি। ফিরোজ কাঁপা কাঁপা হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়েই যাচ্ছে। তার গলা শুঁকিয়ে কাঠে পরিনত হয়েছে। এখান থেকে কি করে মুক্তি মিলবে তাদের?

আকস্মিক পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে তাদের গাড়িকে স্ব জোরে ধাক্কা মারতেই ব্যালেন্স হারিয়ে গাড়ির সামনের কাচ ভেঙে বাইরে ছিটকে পড়ল ফিরোজ। হীর নীচে বসেই গাড়ির সীটের সাথে লাগানো শক্ত রডের সাথে বারি খেয়ে আবারও হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো নীচে। প্রচন্ড ব্যাথায় মাথা চেপে ধরে কুকিয়ে উঠল হীর। মাথায় হাত রাখতেই মনে হলো কপাল কেটে রক্ত ঝরছে। কাঁপা কাঁপা হাতটা চোখের সামনে তুলে ধরতেই রক্ত দেখে গা গুলিয়ে উঠল তার। এই মুহুর্তে সাবাবই পারে তাকে উদ্ধার করতে। পাশে পড়ে থাকা ফোনটা দ্রুত উঠিয়ে অন করতেই দেখলো নীচে পরে গিয়ে ফোনটার ডিসপ্লে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাখে দুঃখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল হীর। ফোনটা আবারও ছুঁড়ে মারল নীচে। আর ওমনি মনে হলো কারোর হাতে হেঁচকা টান খেয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। হেলতেদুলতে দাঁড়াতেই আবারও হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো পিচ ঢালা রাস্তায়। আচমকাই চোখের সামনে সবটা ঘোলাটে হয়ে উঠল। লোকটা তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করতেই কেউ পেছন থেকে মাথায় বারি বসিয়েছে। হয়তো মোটা কোনো রড ছিলো। হীরের কানের মধ্যে তীক্ষ্ণ সব আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি টুকু নেই তার। পাশ থেকেই কালো পোশাক পরিহিত এক লোক তার চুলের মুঠি ধরে টেনে দাঁড় করালো। হীর ব্যাথায় ছটফট করছে কেবল। কোনে শব্দ উচ্চারণ করা এই মুহুর্তে তার পক্ষে সম্ভব না। হীর দাঁড়াতে দাঁড়াতে খেয়াল করল শুধু একজন নয় বাকি সবাইও একই পোষাকে আছে। আলাদা বলে কাউকেই মনে হচ্ছে না। সবাই একজনেরই পোষা গুন্ডা।

যে লোকটা হীরকে ধরে দাঁড় করালো তার পাশ থেকেই একজন বন্দুক তাক করলো হীরের কপাল বরাবর। হীর ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকে দেখলে লাগল। লোকটা হীরের দিকে তাকিয়ে পৈশাচিক হাসতেই প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠলো প্রকৃতি।

#চলবে____________________

[ বিঃদ্রঃ গঠন মূলক মন্তব্য আশা করছি🙂 ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here