#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
||৫ম পর্ব ||
সকাল ছয়টা বাজে চল্লিশ মিনিট। পুরো ভার্সিটির রং আজ পাল্টে গিয়েছে। সারা ভার্সিটিতে ফুলের গন্ধে মো মো করছে। সাদা, লাল, নীল, সবুজ কাগজের কৃত্রিম ফুলে সজ্জিত হয়ে আছে বিভিন্ন স্থানে। ভির্সিটির সাজ থেকে নিয়ে মাইক পর্যন্ত সকলকিছুর দায়িত্ব জারিফদের উপর কেননা তাঁরা এই ভার্সিটির সিনিয়র। সকাল ছয়টায় জারিফরা এসে উপস্থিত হয় ভার্সিটিতে। আসার পর থেকেই কখনও স্টেজে কাজ করা লোকেদের ধমকাচ্ছে তো কখনও মাইকের লোকেদের চোখ রাঙাচ্ছে। চারপাশে আরেকবার চোখ ঘুরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে জারিফ। অবশেষে তার কাজ কমপ্লিট হয়েছে। চেয়ারে বসে একটু পর কি হবে তা ভেবে বাঁকা হাসি ফুটে উঠে জারিফের মুখে।
ভার্সিটির গেইট খুলে দেয়া হয়েছে। একে একে সকল ছাত্র-ছাত্রী প্রবেশ করছে ক্যাম্পাসে। চারদিকের নজরকাড়া সাজসজ্জা দেখে অনেকেই প্রশংসা করছে ক্যাম্পাসের। নতুনদের বরণ করতে রজনী গন্ধা ফুলের সাথে দুটো গোলাপ স্টিক আকারে করে নবীনদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সিনিয়ররা।
আয়না আর রাদিফ ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে জিনিয়ার। মেয়েটার এখনও আসার কোন নামগন্ধ নেই। নবীনরা প্রায় অর্ধ শতক ঢুকে পড়েছে ক্যাম্পাসে। তিন বন্ধুরা মিলে একসাথে মজা করবে আজ। কাল রাদিফ আর জিনিয়া মিলে আয়নাকে ওয়াদা করিয়েছে যে আজ কোন গোয়েন্দাগিরি না করতে। আয়নাও রাজি হয়ে যায় তাঁর জানের জিগারদের কথাতে। আয়না আজ শাড়ি পরে এসেছে জিনিয়ার কথায় নয়তো রোজকার পরিহিত থ্রি-পিস পরেই আসতো।
ভার্সিটির গেইটের বরাবর বসে আছে জারিফ অপেক্ষা করছে আয়নার। কেননা আয়নাকে দেখতে পেলে সে দৌঁড়ে যাবে ফুল দিয়ে স্বাগতম জানানোর জন্য। যথাসময়ে আয়না ও তাঁর বন্ধুরা ভার্সিটির গেইট দিয়ে প্রবেশ করে ঠিক তখনই জারিফ আয়নাকে ফুল দিতে চলে আসে। রজনী গন্ধার স্টিকের একদম নিচের অংশে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে জারিফ যেন মধ্যে অংশে আয়না হাত দেয়।
– স্বাগতম নবীনগণ।
আয়না মুচকি হেসে জারিফের হাত থেকে ফুলের স্টিক নেয়। আজকাল জারিফ তাঁর মনে থাকে সদা। জারিফের দিকে ধ্যান থাকায় গোলাপের কয়েকটা কাঁটা আয়নার হাতে ঢুকে যায়। আয়না জারিফের দিকে তাকিয়ে দেখে জারাফ মিটিমিটি হাসছে। জারিফের হাসি দেখে আরো শক্ত করে ফুলটাকে ধরে প্রসস্থ হাসি দিয়ে চলে গেল জারিফের থেকে। আয়নার এমন কান্ডে জারিফ থতমত খেয়ে যায়। জারিফ ভেবেছিল কাঁটার ঘা খেয়ে আয়না রীতিমতো চিল্লাবে কিন্তু জারিফ ভুলে গিয়েছিল যে সে আয়না ওরফে গুন্ডি বোম্বাইমরিচ এই সামান্য আঘাতে কিছুই হবে না।
আয়না এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করেছে কিন্তু আর কতো, সেও তো একজন মানুষ কোনো লোহা নয় যে ব্যথা পাবেনা। জিনিয়াকে কিছু একটা বলে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে আসে। শাড়ির আঁচলে লুকোনো হাতটা এবার সামনে এনে দেখে পুরো রক্তে লাল হয়ে আছে। গোলাপের দু একটা কাঁটা হাতে বিঁধে রয়েছে। ব্যথায়ে চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু বয়ে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা অপর হাত দিয়ে কাঁটা তুলতে গিয়েও হাত নামিয়ে নেয় আয়না। ঠিক তখনই কেউ ওয়াশরুমের দরজায় কড়াঘাত করে। আয়না চোখ মুছে নিজেকে পরিপাটি করে হাত আবারও আঁচলের নিচে লুকিয়ে নিয়ে দরজা খুলে দেয়। বাহিরে কাউকে দেখতে না পারায় আবারও দরজা আটকে নিতে গেলে একজোড়া হাত এসে বাঁধা দেয়। সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে আয়না এবার নরম হয়ে যায় চাইলেও কান্না আটকে রাখতে পারছে না ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মুহূর্তেই।
জারিফ খুবই মনোযোগ সহকারে আয়নাকে দেখছে। কয়েক মিনিটেই কেঁদে চেহারার অবস্থা পাল্টে ফেলেছে। নাক, মুখ, চোখ ফুলে টমেটো হয়ে আছে। আঁচলে লুকানো হাতটাকে একটানে সামনে এনে দেখে অবস্থা খুবই খারাপ। আয়নাকে টেনে এবার কলের নিচে হাত রেখে পানি চেড়ে দেয় বিধায় রক্তগুলো পানির সাথে ধুয়ে মুছে যায়। হাতে তিন থেকে চারটি কাঁটা বিঁধে আছে। জারিফ এক এক কলে সবগুলো কাঁটা উঠিয়ে পকেট থেকে একটা ইনটিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে দিরে দিতে বলে,
– আ’ম সরি বোম্বাইমরিচ। ভাবতে পারিনি এতোটা ব্যথা পাবে। আমি জাস্ট মজা করার জন্য গোলাপফুলে কাঁটা রেখেছিলাম কিন্তু তুমি জিদের বসে সবগুলো কাঁটা নিজের হাতে ঢুকিয়ে ফেললে।
আয়না জারিফকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে।
আয়নার কষ্টে ভানুষটা এমন রিয়েক্ট করছে যেন সেই ব্যথা পেয়েছে। কান্না থামিয়ে দিয়ে আয়না বলে,
– আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই। আমি কাউকে কখনও কৈফিয়ত দেই না। হয়েছে আপনার এবার ছাড়ুন।
– তোমার হাত সারাজীবনের জন্য ধরে রাখিনি। আমার কাজ শেষ হলে এমনিই চলে যাবো।
– সারাজীবনের জন্য ধরতে হলে কি ধরবেন?
আয়নার এমন প্রশ্নে জারিফ থেমে যায়। ভ্রূ যুগল কুঁচকে রুমাল দিয়ে হাত বাঁধতে বাঁধতে উওর দেয়,
– প্রশ্নই আসে না তোমাকে সারাজীবন নিজের করে নিতে। আরে, আমার এখনও এমন দিন আসেনি যে তোমার মতো ঝগড়াটে বোম্বাইমরিচকে পাত্তা দিবো।যেভাবে তুমি ছেলেদের পিটাও এমন মেয়েকে কোনদিনও পছন্দ নয় আমার। এই নাও বাঁধা শেষ। নেহাত আজ আমার জন্য তোমার ক্ষতি হয়েছে নয়তো এই তাযিন জারিফ স্ব ইচ্ছায় কারোর কাছে যায় না।
জারিফ চলে গেছে মিনিট পাঁচেক আগে কিন্তু আয়না এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাঁধা ব্যান্ডেজে নিজের অধর ছুঁয়ে বলতে শুরু করল,
– তাযিন জারিফ নিজেকে যাই মনে করো না কেন। এই আয়নার নজরে পড়েছো তুমি এত সহজে ছাড়া পাবে না। আজ থেকে তোমার মনে জায়গা করার মিশন শুরু।
——-
– কি রে আয়না কোথায় গিয়েছিলি আর তোর হাতে ঐটা কি?
রাদিফ আতংকিত হয়ে আয়নাকে জিজ্ঞেস করছে। যেন ব্যথাটা তাঁরই লেগেছে। আয়না রাদিফের এহেন আচরণে বিরক্ত মাখা কন্ঠস্বরে বলল,
-উফ রাদিফ তুই একটু বেশি বেশি করিস। একটু কেঁটে গিয়েছে আর কিছু না। আমি পছন্দ করি না আমাকে নিয়ে কেউ এত ভাবুক তা।
– আরে ইয়ার চেতস কেন। আমি আমার বন্ধুত্বকে অনেক গুরুত্ব দেই সবকিছু থেকে। তোদের দুজনকে আমি সমান সমান ভালোবাসি তোদের ক্ষতি আমি কখনোই দেখতে পারবোনা দোস্ত। আর আমার ময়নাপাখি আছে তোরা জানিসই।
– হয়েছে লেকচারের গোডাউন থাম এবার মাফ কর আর কখনোই কোনো প্রশ্ন করবোনা।
আয়নার কথায় এবার জিনিয়া চশমা ঠিক করতে করতে বলে,
– আয়না সত্যি করে বল না তোর হাতে কি হয়েছে?
জিনিয়ার প্রশ্নে আয়না মুচকি হেসে বলে,
– ভালোবাসার শুরুতেই কাটার ঘায়ে ব্যথিত হয়েছি তা একেবারে আমার অন্তরে বেঁধেছে যা মৃত্যু ছাড়া ছুটানো সম্ভব না।
আয়নার এমন কথায় রাদিফ জিনিয়া একসাথে বলে উঠে,
– তাযিন জারিফ দা চকলেট বয়?
আয়না দুজনের কথায় হেসে উওর দেয়,
– হ্যাঁ, তাযিন জারিফ। আমার ভালোবাসা।
নবীন বরণ অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের বক্তব্য শেষ করার পর এখন মূল অনুষ্ঠান মানে সংস্কৃতি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নাচ গান নাটক সবকিছুর পর এখন মূল কেন্দ্রবিন্দু মানে আয়নার দিকে সবার নজর।
রুমাল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় মাইক হাতে মঞ্চে উঠে আয়না। পরনে নীল শাড়ি সাথে মেচিং করে কানের দুল আর হাতে রেশমি চুড়ি। বাদ্যযন্ত্রের তালের সুরে মুখরিত হচ্ছে চারপাশ ঠিক তখনই পরিবেশকে আরেকটু মুখরিত করতে গান গাওয়া শুরু করল আয়না আর রাদিফ,
” নিজের ভাল বুঝিস রে তুই
পথে পথে ঘুরিস রে তুই
আমানতের খেয়ানত কইরা করস রে সর্বনাশ
আমি কান্দি তোর দুঃখে
তুই ঘুরস মনের সুখে
কার দিকে নজর দিয়ায় আমারে হাই কোর্ট দেখাস
দেই কাঠের চশমা চোখে
দেখি শইষ্য এখন শোকে
শুধু ডানে বামে ঘুইরা ঘুইরা হইছে ফাঁপর বাজ
বন্ধু তুই লোকাল বাস
বন্ধু তুই লোকাল বাস
আদর কইরা ঘরে তুলস
ঘাড় ধইরা নামাস
বন্ধু তুই লোকাল বাস
বন্ধু তুই লোকাল বাস
আদর কইরা ঘরে তুলস
ঘাড় ধইরা নামাস
তুই লোকাল বাস রে
বন্ধু তুই লোকাল বাস
আদর কইরা ঘরে তুলস
ঘাড় ধইরা নামাস
ক তুই কই যাবি, গাড়ী তোর আমার চাবী
মিটাইয়া মনের দাবী পরে কইচ হাবি যাবি
যেমনে চাচ অমনে পাবি কবি আমি কারিগর
খাবার দাবার শেষ বাড়ি ঘর খালি কর
জোর কত জানি তোর সবাই তো স্বার্থপর
মনে তে রং লাগাইয়া হইয়া ঘুরস যাযাবর
স্বার্থের পটি বাইন্ধা কানামাছি ভোঁ ভোঁ
পাগলেও বোঝে এখন টাকা পয়সার লোভ ও
পাঙ্খা ভাবে থাকি আগুনের গোলা বইলা
আইসা তুই খাবি খাবি মনে মনে মনা কোলা
চোরের মার বড় গলা লইয়া লবি যারে তারে
শারাফাতি ড্রাইভার এ, নরম পাইয়া বেরেক মারে
মুনাফা ছাড়া পরে না মাটিতে পারা
রক্ত চুইশা খাইয়া উপড়ে উঠছে যারা ওগো
দুনিয়ার ভোগে আছে দুনিয়ার শাস্তি
উস্তাদ বুইঝা হুইনা ডাইনে বামে প্লাস্টিক
ও তুই মনের কথা বুঝলি না
আমারেও গুনলি না
জনে জনে একই প্রেম তুই কতবার বিলাশ
কতবার বিলাশরে বন্ধু কতবার বিলাশ
ওহ তুই বুঝলি যখন ফাইদা রে
ডাকলি না সেই আদরে
ষোল আনা বুইঝা রে তুই অন্য দিকে চাস
দিল জ্বালা বাড়ায় বুকের দেখি না চেহারা সুখের
সে তো অলি গলি ধরা খাইয়া হইছে পাঙ্গা বাজ
বন্ধু তুই লোকাল বাস বন্ধু তুই লোকাল বাস
আদর কইরা ঘরে তুলস ঘাড় ধইরা নামাস
বন্ধু তুই লোকাল বাস বন্ধু তুই লোকাল বাস
আদর কইরা ঘরে তুলস ঘাড় ধইরা নামাস
তুই লোকাল বাস রে
বন্ধু তুই লোকাল বাস
আদর কইরা ঘরে তুলস
ঘাড় ধইরা নামাস
বন্ধু তুই লোকাল বাস
বন্ধু তুই লোকাল বাস
আদর কইরা ঘরে তুলস
ঘাড় ধইরা নামাস
তুই লোকাল বাস রে
বন্ধু তুই লোকাল বাস
আদর কইরা ঘরে তুলস
ঘাড় ধইরা নামাস”
গানের প্রতিটা কথায় আয়না জারিফের উদ্দেশ্যে বলেছে। কাল হলরুমে আয়নার হাতের কাগজে লিখা ছিলো ব্যান্ড সঙ্গীত হিসেবে সে গান গাইবে সবার শেষে সকলকে বিনোদন দেয়ার জন্য। যা একদিনে রিহার্সাল ছাড়া কারোর পক্ষে সম্ভব না। আর এই আসম্ভব কাজটাকে সম্ভব করেছে আয়না। সকল টিচারদের বিনোদন দিয়েছে আজ সে গানের তালে নেচে গেয়ে। জারিফ এদিকে রাগে ফুঁসছে আয়নাকে এই কয়েকদিনে অনেকবার এটাসেটা করে হারাতে চেয়েছে কিন্তু এই মেয়েকে হারানো যাচ্ছে না। জারিফ এবার আয়নাকে হারানোর জন্য জঘন্য প্যান করছে যা জারিফের জন্য হানি কারক ।
চলবে…..
[কপি করতে গিয়ে গতপর্বে দুইবার চলে এসেছে তার জন্য দুঃখিত।]