“প্রমত্ততা তুই পর্ব ৬

#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
||৬ষ্ট পর্ব ||

অন্ধকারে গিটারে টুংটাং আওয়াজ করছে আয়না। দশ থেকে বারোটার মতো আয়নার মধ্যে বসে এক ধ্যানে হাতের রুমালটার দিকে তাকিয়ে আছে কি মনে করে গিটারটা পাশে রেখে দাঁড়িয়ে যায় আয়নাগুলোর সামনে। গভীর মনোযোগ সহকারে নিজেকে দেখছে আয়না। ঠিক মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে থাকায় প্রতিটা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। আয়না এবার নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করছে,

– হ্যাঁরে আয়না, কি হলো তোর? এতো এলোমেলো লাগছে কেন তোকে? তুই না স্ট্রং গার্ল তোকে তো সবাই ভয় পায় তাহলে কেন তুই তোর আগের রুপে ফিরে যাচ্ছিস? তুই জানিস না এই পৃথিবী ভালো না। পৃথিবীর মানুষগণ খুবই নিকৃষ্ট বিশেষ করে ছেলেরা। তুই কি ভুলে গিয়েছিস তোর আদরের বড়ো বোনের কথা? সেই কালো রাতের কথা কিভাবে ভুললি? আজও তোর বোন যেখানে রাতের পর রাত বালিশে আশ্রু বিসর্জন করে তোর কি একটুও কলিজা কাঁপে না? নাকি সব ভুলে অন্যান্য মেয়েদের মতো নরম হতে যাচ্ছিস।
এমন হাজারো আবল তাবল বলে হাঁটু গেড়ে বসে পরে মাটিতে। হাত থেকে বাঁধা রুমাল এক টানে খুলে ফেলে।
– আমি আয়না। একজন শক্ত মনের মানুষ। আমার মধ্যে প্রেম ভালোবাসার কোন জায়গা নেই। কাল থেকে তাযিন জারিফের আশেপাশেও থাকবোনা যতই কষ্ট হোক না কেন।
——-
আজ শুক্রবার। ভার্সিটি বন্ধ। ছুটির দিনে সবাই রিলেক্সে প্রিয়জনদের সাথে ঘুরতে বের হয়। আয়না আজ সুন্দর করে সেজেছে। চোখে মোটা করে কাজল পড়েছে, ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক পরনে কালো চুড়িদাড়, কালো ওরনা, চুলগুলো বরাবরের মতো ছাড়া আর হাতে ছোট পার্স ব্যস রেডি আয়না। নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে বড়ো বোন ফারিয়ার কক্ষে গেল। ফারিয়া সবেমাত্র শাওয়ার নেয়ে এসেছে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলে,

-কি ব্যাপার, আজ আমার পরীটাকে একটু অন্যরকমই লাগছে। শরীর ঠিক আছে তো? না মানে আজ আমার গুন্ডি বোনটার এমন মেয়ে সাজতে ইচ্ছে হলো কেনো?

আয়না ফারিয়ার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে ফারিয়াকে নিচে বসিয়ে সে খাটে বসে পড়লো ফারিয়ার মাথার চুল মুছে দেয়ার জন্য। ফারিয়া আয়নার এমন কান্ডে মুচকি হাসে। ফারিয়া বুঝতে পেরেছে আজ আয়নার মন খারাপ।

– কোথায় নিয়ে যাবি বল। আজ না করবো না। তোর ভাইয়া তো শুনলে খুশিতে পাগল হয়ে যাবে তোর ভাইয়াকেও বল আসতে।

– আপাই, আজ মায়ের একটা শাড়ি পড়বে? মাকে খুব মনে পড়ছে।

ফারিয়া এবার বিছানায় বসে এক হাতে আয়নার গালে হাত রেকে বলল,
– মনটা কি খুবই খারাপ আমার পাখিটার? বল কি হয়েছে আপাই পারলে তোর কষ্ট দূর করে দিবে।

আয়না এবার অশ্রুশিক্ত নয়নে বলল,
– আর কত কষ্ট লাঘব করবে আমাদের বলো
তো? নিজের তো কম ক্ষতি করোনি আমাদের জন্য।

– ঐসব পুরোনো কথা বাদ দে আয়ু। যা দর্পণকে নিয়ে নিচে বস আমি আসছি।

ফারিয়া তাঁর মায়ের একটা সুতি শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলল। আয়না বুঝতে পেরেছে ফারিয়া কথাটি এড়িয়ে গেল। চাঁপা নিশ্বাস ফেলে নিচে চলে গেল আয়না।

———-
শহরের নামকরা রেস্টুরেন্টে বসে আছে আয়নার ভাই বোনেরা। বিভিন্ন আভিজাত্যে ভরপুর এই রেস্টুরেন্ট। দর্পণ বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলছে নিজের সাথে সাথে বোনদের।

– আহ আপাই তুমি কিছু বুঝোই না। কিভাবে যে এত বড়ো হলে তুমি আর ভার্সিটিতে উঠলে কে জানে। এখানে আসো। এই যে এই দোলনায় বসে একটুখানি হাসো দেখবে কত সুন্দর ভাবে ছবি তুলে দেই।

দর্পণের কথায় ফারিয়াও তাল মিলায়,

– হ্যাঁ রে পাখি যা তো, সবসময় গুন্ডি মুখ করে বসে থাকিস। জীবনটা উপভোগ কর দেখবি সব ভালো লাগবে।
আয়না কখনও ফারিয়ার কথা ফেলতে পারে না তাই দর্পণের বলা দোলনায় বসে কয়েকটা পোজ দিলো। দর্পণও তার প্রিয় আপাইয়ের ছবি তুলে মনটাকে ভালো করে নিলো।

আয়নাদের পাশের টেবিলে চারবন্ধু মিলে কি যেন খাচ্ছে। বড় রেস্টুরেন্ট বিধায় এখানে দেশী মাল দেকে শুরু করে বিদেশি ড্রিংক্স অসকার, বিয়ার, হুইস্কি ইত্যাদি জাতীয় তরল নেশাদ্রব্য পাওয়া যায়। আয়না আর দর্পণ একটু সামনে গিয়ে ছবি তুলছে বিধায় ফারিয়া টেবিলে একা। ঠিক তখনই চারজনের মধ্যে একজন বলে উঠে,
– ওহ্ দোস্ত, দেখ কি মাল। শাড়ি পরে এসেছে আমাদের আকৃষ্ট করার জন্য। তাও আবার লাল শাড়ি। লাল কিসের প্রতীক বলতো?
অপরজন ঐ ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে একটু ঝুঁকে বলে,

– লাল তো প্রোস্টি,,, থাক বলবোনা। আরে ইয়ার জিজ্ঞেস কর না কত রেট। রেস্টুরেন্টের কোয়াটার তো খালিই আছে।

– হ্যাঁ হ্যাঁ ওহে রূপসী, এক রাতের জন্য কত নিবে? সাথে তো দেখি ব্লাক চেরিও আছে। আজ আমাদের রাত রঙিন হয়ে যাবে।

ফারিয়া চুপচাপ কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। এখন যদি রিয়েক্ট করে তো আয়না কেয়ামত ঘটিয়ে ফেলবে।

– আরে বলোনা লতিকা। কত নিবে?

হঠাৎই চারজনের মাথায় এক এক করে বোতল ভাঙ্গতে শুরু করে আয়না। রাগে আয়নার শরীর রীতিমত কাঁপছে। দূরে লোহার কিছু দন্ড সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। আয়না সেখান থেকে একটা দন্ড নিয়ে এলোপাথাড়ি ছেলেদের মারতে থাকে। রেগে হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে চিল্লিয়ে বলতে থাকে,

– কু** বাচ্চা, জানোয়ার তোদের জন্য আজ মেয়েরা স্বাভাবিক ভাবে জীবন জাপন করতে পারে না। যেখানেই একা দেখবি সেখানেই খুবলে খেতে চাইবি। আজ তোদের প্রত্যেককে মেরেই ফেলবো।

আয়না পাগলের মতো ব্যবহার করছে। যেভাবে পারছে সেভাবেই পিটাচ্ছে ছেলেদের। আয়নার কবল থেকে রক্ষা পাওয়া কষ্টকরহয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে প্রথমে বলা ছেলেটা ছাড়া পেয়ে পাশ থেকে একটা চেয়ার মাথার উপর তুলে যেই না আয়নার মাথায় আঘাত করবে ঠিক তখনই একজোড়া বলিষ্ঠ হাত এসে ছেলেটাকে আটকিয়ে দেয়।

– না না ভাইজান পেছন থেকে আক্রমণ করে না। যদি নিজেকে পুরুষ ভাবো তো সামনে থেকে আক্রমণ করো কাপুরুষদের মতো পেছন থেকে না।
আয়না পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে। জারিফকে এই সময়ে এখানে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে। জারিফ ছেলেটির হাত খুব শক্ত করে ধরে আছে। হঠাৎ জারিফ ছেলেটির হাত ছেড়ে আয়না বলে চিল্লিয়ে উঠে। আয়না কিছু বলতে নিবে তাঁর আগেই জারিফ আয়নাকে জরিয়ে ধরে সরিয়ে নিলো।
খুব দ্রুত ডিপডিপ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে জারিফের হার্টের। কড়া পারফিউমের ঘ্রাণে নেশা ধরে যাচ্ছে আয়নার। জারিফ আয়নাকে এমনভাবে জরিয়ে ধরে আছে যেন ছেড়ে দিলেই কেউ নিয়ে চলে যাবে। আয়না জারিফের বুকে কয়েকবার নাক ঘসলো। এতে জারিফ আয়নাকে ছেড়ে দিয়ে একহাতে আগলে ধরে অপরপাশে তেড়ে আসা ছেলেটিকে এক ঘুষিতে জমিনে ফেলে দিল। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার সহ আরো কয়েকজন মিলে ছেলেগুলোকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে আয়নাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল।

জারিফ এখনও আয়নাকে এক হাত দিয়ে আগলিয়ে ধরে রেখেছে। আয়না এবার জারিফের কাছে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফারিয়ার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ফারিয়ার কোলে মাথা রেখে বলে,
– আমি খুব খারাপ আপাই, পৃথিবীর এই নোংরা অমানুষদের কবল থেকে না আগেও তোমাকে রক্ষা করতে পেরেছি না আজ। আমি খুব খারাপ আপাই আমি খুব খারাপ। কি হলো আমার দুনিয়ার চোখে খারাপ হয়ে যেখানে তোমাকেই প্রটেক্ট করোএ পারিনি। আমি কি করবো আপাই ওরা কিভাবে তোমার সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করেছে। আমি শান্ত হতে পারছি না আপাই পারছি না।

– শান্ত হো পাখি। আমি ঠিক আছি। যার তোর মতো শক্তিশালী বোন আছে তার আবার ভয় কিসের? কান্না করিস না লক্ষী বোন।

জারিফ রেস্টুরেন্টে এসেছিলো তাঁর বাবার অফিসের কিছু ক্লাইন্টদের সাথে মিটিংয়ে। দূরে টেবিলে মিটিং চলছিলো তাদের ঠিক তখনই চিল্লাচিল্লির শব্দ শুনে এখানে আসে। আর আয়নাদের এই অবস্থা দেখে ।
জারিফ মনে মনে ভাবছে,

– এই বোম্বাইমরিচ সত্যিই আপনজনদের জন্য জীবন। আপনজনদের জন্য সবকিছু করতে পারে। কিন্তু এই বোম্বাইমরিচের কি এমন কষ্ট যার জন্য গুন্ডিরুপটাকে বেছে নিয়েছে? আয়নার অতীত সম্পর্কে আমার জানতে হবে।

জারিফের এমন চিন্তা ভাবনার মাঝেই দর্পণ বলে উঠে,

– ধন্যবাদ ভাইয়া আমার আপাইকে রক্ষা করার জন্য।

– এই বোম্বাইমরিচ সত্যিই খুব ঝাল মরিচ যা আজ বুঝলাম। এই ছেলে এরে ভয় লাগে না?

জারিফ দর্পণের কাচে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করছে। জারিফের কথায় দর্পণ উচ্চস্বরে হাসা শুরু করে।
– আমি আপাইকে খুব ভালোবাসি। ভয় পাই না কারন আপাই আমাকেও খুব ভালোবাসে।
দর্পণের কথা শুনে জারিফ মিনমিন করে বলে,

– হ্যাঁ আমাকেও বাসতে হবে।
ছারিফের কথা স্পষ্টভাবেবুঝতে না পারায় দর্পণ জিজ্ঞেস করল,
– কিছু বললেন ভাইয়া।
প্রত্যুত্তরে জারিফ মেকি হাসি দিয়ে বলল,

– হে হে তেমন কিছু না। বলছি যে বোম্বাইমরিচ কোথায় লাগলে বেশি ঝাল লাগবে? পেছনে না সামনে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here