মেঘের পরে মেঘ-১১

মেঘের পরে মেঘ -১১

দুজনেই সিএনজিতে বসে আছে। নাবিল একহাতে শায়েরীর একহাত শক্ত করে ধরে আছে। যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে এমন।মাঝে মাঝে শায়েরীর কানে কানে কথা বলছে।শায়েরী হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
নাবিল তাকিয়ে আছে মুগ্ধ দৃষ্টিতে।একটাই তো জীবন। সে জীবন টা যদি ভালোবাসার মানুষ টাকে পাশে নিয়ে বাঁচা যায় তাহলে এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে?নাবিলের মনটা হঠাৎই অপার ভালোলাগায় ভরে যায়।সেই সাথে ভয়।এমনি সারাটা জীবন হেঁসেখেলে পাড় করে দিতে পারবে তো?না কি?
না না।কি হবে?কি ভাবছেে এসব নাবিল।শায়েরী ওকে ভালোবাসে।আর আজীবন বাসবে।আল্লাহ চায় তো নিশ্চয়ই ভালো থাকবে ওরা।

“এই তো এই বাড়িটাই তো।তাই না?”

শায়েরীর ডাকে ভাবনাগুলো বিলীন হয়ে যায়। তাকিয়ে দেখে ওরা চলে এসেছে তানজুদের এখানে।শায়েরী আজ খুব করে আসতে চাইছিলো তাই আসা।
নাবিল ছোট্ট করে উত্তর করলো।

“হ্যাঁ।”

সিএনজি ড্রাইভারকে থামতে বলে শায়েরীকে নামতে বলে নিজেও নামলো নাবিল।

“তুমি যাও।আমি দুপুর নাগাদ চলে আসবো।তারপর একসাথে সারাটা বিকেল কাটাবো। কেমন?”

“আচ্ছা। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।”

“আসবো।ফ্ল্যাট চিনবে তো?না আমি আসবো সাথে? ”

“না। আসতে হবে না।আমি চিনি।”

“আমি আসি তাহলে।”

“এসো।”

নাবিল চলে যেতেই শায়েরী তানজুর বিল্ডিংয়ের দিকে পা বাড়ালো।কিন্তু থামতে হলো। পেছন থেকে কেউ তাকে ডাকছে।শায়েরী পেছনে তাকালো।একটা অল্প বয়সী ছোকরা।বয়স খুব বেশি হলে বাইশ কি তেইশ হবে।রংচঙয়ে শার্ট গায়ে,চোখে নীল রঙের সানগ্লাস। বাইকে বসে ওকে ডাকছে।সাথে আর একজন হোমরাচোমরা ধরনের।
নিজের অজান্তেই ভ্রু টা একটু কুঁচকে গেলো ওর।এই ছেলে ওকে ডাকছে কেনো?কখনো দেখেছে বলেও মনে পড়ে না।শায়েরী ঘুরে দাঁড়ালো।

“আমাকে বলছেন?”

ছেলেটি৷ তার সঙ্গী কে নিয়ে ধীর পায়ে শায়েরীর৷ সামনে এসে দাঁড়ালো।

“হ।আপনেরেই ডাকতাছি।”

“কেন?আমি তো আপনাদের চিনি বলে মনে হয় না।”

“কেন,না চিনলে বুঝি কতা কওন যায় না।”

শায়েরী কথা বাড়ালো না।কথা বাড়িয়েও খুব লাভ হবে বলে মনে হয় না।

“বলুন।কি বলবেন।”

“তানজুগো হোনে যাইতাছেন বুঝি?”

“হ্যাঁ।কেনো? কোন সমস্যা? ”

“না সমস্যা কিয়ের।এমনেই জানবার চাইলাম।তা কি হন উনার?”

“উনি আমার হাসবেন্ডের কলিগ ছিলেন।ভালো বন্ধুত্ব ওনাদের।সেই সূত্রেই আসা যাওয়া।”
বলেই হাটতে নিলে বাঁধা পেলো শায়েরী।

” কেডা আপনের হাসবেন্ড? ”

“একটু আগে যিনি আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন, উনি।”

“ওই যে ফর্সামতো সুন্দর ছ্যাড়া ডা।ওইডা?”

“হ্যাঁ।”

“ওনি কেমনে আপনের সোয়ামী অয়?”

“কেনো?উনি আমার স্বামী হলে সমস্যা কোথায় আপনার।”

“সমস্যা আছে তো।হেয় আপনের সোয়ামী অইলো কেমতে?হেতো তানজুর সোয়ামী।”

চট করে মাথা গরম হলেও নিজেকে শান্ত রাখলো শায়েরী।কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“কে বলেছে এগুলো আপনাকে?”

“কে কইবো আবার?তানজুই তো কইলো।প্রথম সোয়ামী মইরা যাওনের তিন মাস পরই হেগো বিয়া অইছে।”

“এ কথাগুলো তানজু বলেছে আপনাকে?”

“হ।”

“ভাই এগুলো মিথ্যা কথা। নাবিল আমার হাসবেন্ড। ও কেনো এগুলো বললো আমি জানি না।আচ্ছা চলেন আপনি আমার সাথে আমি এখনি তানজুর সাথে কথা বলছি।দেখবেন ও নিজের মুখেই বলবে।আমার হাসবেন্ড ওনাকে মাঝে মাঝেই সাহায্য সহযোগিতা করেন এটা আমি জানি।এর মধ্যে খারাপ কিছু নেই।কিন্তু তানজু আপু আপনাদের কেনো এ কথা বললো আমায় জানতে হবে।আপনি প্লিজ আমার সাথে চলুন।”

“হ।লন।দেহি কে হাছা কয় আর কে মিছা।”

_______

দরজা খুলে শায়েরী কে দেখে হাসিমুখে ভেতরে আসতে বললো তানজু কিন্তু পর মুহূর্তেই পাড়ার ছেলে সজীব কে দেখে মুখটা কালো হয়ে গেলো।শায়েরী এসেছে তাও ওকে সাথে নিয়ে।কোন ঝামেলা নিশ্চয়ই হয়েছে। মনে মনে প্রস্তুতি নিলো তানজু।

শায়েরী হুরমুর করে ঘরে ঢুকলো।কোন দিকে না তাকিয়ে সরাসরি তানজুর মুখোমুখি হলো।

“তুমি এদের কি বলেছো আপু?”

“কি বলেছি?”

“তুমি নাকি বলেছো নাবিল তোমার হাসবেন্ড?তোমরা বিয়ে করেছো?”

মাথা নিচু করে রইলো তানজু।এটাই মোক্ষম সুযোগ ভেবে উত্তর করলো।

“যা সত্যি তাই বলেছি।”

তানজুর কথায় শায়েরীর কান ঝাঁঝাঁ করতে লাগলো।কি শুনলো ও?এগুলো কি সত্যি?নাবিল? না না নাবিল এটা কিছুতেই করতে পারেনা।কিন্তু তানজু?ওই বা কেনো মিথ্যে বলবে? এতোটা সময় সাহসের সাথে কথা বললেও তানজুর এ কথায় ওর সমস্ত শক্তি যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো।ধপ করে পাশের সোফায় বসে পরলো।
তানজু ওর পাশে বসে কপট কান্নার ভান করতে লাগলো।
“আমি জানি তোমার শুনতে খুব খারাপ লাগছে।কিন্তু এটাই সত্যি। ”

শায়েরী দিশেহারার মতো ওর দিকে তাকালো।সজীব নামের ছেলেটাও ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

“আমি কইছিলাম না আপা।আপনে তো বিশ্বাস করলেন না।উনি তো মাঝে সাঝেই এহনে আহে।”

শায়েরীর মুখে কোন কথা জোগালো না।ওর মাথা ঘুরছে।শরীর ঘামছে।কোন রকম শরীর টাকে টেনে উঠালো।দরজার কাছে যেতেই তানজু এগিয়ে আসলো।

“আমায় তুমি মাফ করো বোন।আমি নিরুপায় ছিলাম।আসলে ও এমন জোরাজোরি করলো। ”

শায়েরী বের হতে নিলেও থামলো।

“তুমি মাফ চাইছো কেন?তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই।যার প্রতি আছে তার কাছেই যাচ্ছি এর উত্তর জানতে।কেনো এ ধোঁকা? ”

শায়েরী টলতে টলতে চলে গেলো।তানজু বসে বসে বাকি প্ল্যান টুকু সজীবের সাহায্যে করে নিলো।ওর দৃঢ় বিশ্বাস খুব দ্রুতই নাবিল আসবে।আর তখন যেন ও কিছুতেই ফেরত যেতে না পারে সেই ব্যবস্থা করে রাখলো।এখন শুধু নাবিলের অপেক্ষা।

_________

নাবিল লাঞ্চের পর ছুটি নিয়ে নিচে নেমেছে একটু আগেই।কলিগ ফারহানকে কিছু কাজ বুঝিয়ে দিতে দিতে সামনের দিকে এগুচ্ছিলো।ফারহান হঠাৎ ওকে কনুই দিয়ে টোকা দেয় আর ফিসফিস করে বলেে,

“কি ভাই, ভাবি এখানে?”

ফারহানের কথায় নাবিল সামনের দিকে তাকালো। শায়েরী আসছে।কেমন যেন অগোছালো ভাব।কিন্তু এ অবস্থায় ও এখানে কেনো?ওর তো তানজুর ওখানে থাকার কথা।নাবিল এগিয়ে আসলো।

“কি হয়েছে শায়ু?তুমি এখানে? এ অবস্থায়?”

“কথা আছে।”

“কি কথা যার জন্য এখানে এভাবে চলে এসেছো?আচ্ছা ঠিক আছে সব শুনবো।আগে বাড়ি চলো।”

“না বাড়ি যাবো না।এখানেই বলবো।তার আগে বলো, তানজুর সাথে তোমার কি সম্পর্ক?”
দিকহারা হয়ে বললো শায়েরী

“তানজুর সাথে কি সম্পর্ক মানে?বুঝলাম না”

“না বোঝার কি আছে?যাকে বিয়ে করে বসে আছো তার সাথে কি সম্পর্ক তা বুঝি জানো না।”
প্রায় চিৎকার করে বললো শায়েরী।

নাবিল চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো অনেকেই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার দিক থেকে নজর সরিয়ে শায়েরীকে টেনে নিজের কাছে আনলো।মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।

“কি হয়েছে? এসব কি বলছো তুমি?আমি কেন তানজু কে বিয়ে করতে যাবো?”

“কেন করেছো তা তুমি জানো। ”
চিৎকার করে উঠলো শায়েরী।নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলো।

নাবিল বুঝতে পারলো তানজুদের ওখানে এমন কিছু হয়েছে যাতে শায়েরী এমন রেগে গিয়েছে। আর কি বলছে এসব?অশান্ত শায়েরীকে বুকে জড়িয়ে প্রবোধ দিতে থাকলো।

“আমি এমন কিছুই করিনি।বিশ্বাস করো।”

“আমি বিশ্বাস করি না।ও কেন মিথ্যে বলবে?”
কাঁদতে কাঁদতে বললো শায়েরী।

“কেন এমন কথা বললো আমিও তো জানি না।চলো আমার সাথে। আমি জানতে চাই তানজুর এমন কথার কারন কি।”
বেশ রাগের সাথে কথাগুলো বললো নাবিল।

“আমি যাবো না।তুমি যাবে। আর তুমি যদি সত্যি এসবে না জড়িত থাকো তবে এর যথাযথ প্রমান নিয়ে ফিরে আসবে।যদি আসতে পারো তবে মনে করবে আমি আছি।আর যদি না পারো তবে আমি মনে করবো তানজুর কথাই সত্য। এবং আজকেই হবে তোমার সংসারে আমার শেষ দিন।”
কঠিন গলায় বললো শায়েরী।

নাবিল তাকালো শায়েরীর দিকে।আর্দ্র চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি বাড়ি যাও। আমি আসছি।বহু কস্টে তোমাকে পেয়েছি ছেড়ে যাবার জন্য নয়।তোমাকে কাঁদানোর দাম তানজুকে দিতে হবে।আমার উপর বিশ্বাস রাখো।আমি শুধুই তোমার।”
বলেই নাবিল চলে গেলো হনহন করে।

চলবে…….

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here