মেঘের পরে মেঘ -১৮
সিগারেটে শেষ টান টুকু দিয়ে পায়ের নিচে পিষে নিলো প্রলয়।এরপর চায়ের কাপে বেশ আয়েশ নিয়ে চুমুক দিলো। মাথাটা পুরো ফাঁকা হয়ে আছে।ঝোঁকের বশে রুপসাকে ছুয়ে দিয়ে এখন খারাপ লাগছে।
এমনটা না করলেই হতো।রুপসা কি ভাবছে?নিশ্চয়ই খুব খারাপ ছেলে ভাবছে ওকে।
রুপসা কে ওভাবে কাঁদতে দেখে কি যে হলো,নিজেকে নিজের আয়ত্তে রাখতে পারলোনা।আর মেয়ে টাকেও বলে,বসে বসে কাঁদবে তাও বলবে না ভালোবাসে।
এমন আদুরে করে কাঁদলে কি করতে মন চায়?
প্রথমে ভেবেছিলো চোখের জলগুলো মুছিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে।কিন্তু রুপসা যখনি ওর ভেজা ভেজা চোখ তুলে তাকালো,তখনি কি যে হয়ে গেলো।মনে হলো ওর অধর ছুয়ে দিয়েই ওর মন ছুয়ে দেবে।
কিন্তু এখন কি হবে?ও যদি প্রলয় কে খারাপ ছেলে ভেবে আরো দুরে সরে যায় তখন?তখন কি হবে?
আর ভাবতে পারছে না প্রলয়।
সেই বিকেলে ঢাকা ফিরে এসে অবধি এখনো এক কাপড়েই আছে।কাজের খালাকে বলে এক কাপ চা নিয়েছে শুধু। পেটে আর কিছু পরেনি।পেট মহাশয় সে কথাই জানান দিচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে।
কি খাবে ভাবছে তখনি মোবাইলে ফোন এলো।নুর এর নাম ভেসে উঠেছে মোবাইল স্ক্রিনে।
প্রলয়ের সব থেকে কাছের বন্ধু।ওর ফোন পেয়ে ভীষণ খুশি হলো প্রলয়।মনের কথা খুলে বলার মানুষের হদিস পেয়ে বুক পাতলা হলো।
“হ্যালো।”
“কি রে,কি খবর তোর?সেই কখন থেকে কল করছি ধরছিস না।”
“আমি খেয়াল করিনি রে।সরি।”
“সেই সকালে বললি ঢাকা আসবি।আর খবর নেই। কোথায় আছিস?ঢাকায় না…… ”
বাকি কথা শেষ করার আগেই প্রলয় উত্তর দিলো।
“ঢাকায় চলে এসেছি।”
“তো একটা কল করবি না?”
“এসে এখনো কাপড় ও বদলাইনি।ভেবেছি ফ্রেশ হয়ে তোকে কল দেবো।তুই কি ফ্রি আছিস আজ রাতে?”
“কেন আজ রাতে কি?”
“কিছু না।ফ্রি থাকলে চলে আয়।দুজন মিলে আড্ডা দিতাম রাতভর।”
“ঠিক আছি আসছি।কিছু খাবি?মানে বাড়িতে কি খাওয়ার এরেঞ্জমেন্ট কিছু হয়েছে?”
“খালা করতে চেয়েছিলো।আমিই নিষেধ করেছি।ভেবেছিলাম বাইরে কোথাও খেয়ে নিবো।”
“বাইরে খেতে হবে না।আমি খাবার নিয়ে আসছি।কি আনবো?কি খাবি?”
“তোর যা খুশি।শুধু তাড়াতাড়ি আয়।”
“আসছি।রাখলাম।”
লাইন কেটে হাফ ছাড়লো প্রলয়।ভালোই হয়েছে নুর আসছে।নইলে একা একা এতোবড় ফ্ল্যাটে আজ ও দম
আটকে মরতো।নুরের আসতে ঘন্টা খানেক সময় লাগলো।সাথে বিরিয়ানি, রুটি, কলা,একটা বড় প্যাকেট নুডুলস আর সেভেনআপ নিয়ে এসেছে।রাতে যদি অনেকটা সময় জেগে থাকে তবে নিশ্চয়ই ক্ষুধা লাগবে।তাই এতো কিছু আনা।ঘরে ঢুকে ডিমের কথা মনে হয়েছে ওর।ডিম ছাড়া নুডলস ভালো লাগবে নাকি?
চু করে শব্দ করে উঠলো নুর।
“কি হয়েছে? এতো বিরক্ত কেনো?”
বললো প্রলয়।
“আর বলিস না,ডিম আনতে ভুলে গেছি।নুডলস টা রান্না হবে কি দিয়ে? ”
“আবার নুডলস রান্না করতে হবে কেনো?এই তো কতো কিছু এনেছিস।”
“রাত জাগলে খিদে পাবে না?তখন কি খাবো?”
“এতো রাত জেগে কি করবি?”
“কেন গল্প। তোর প্রেমের কাহিনী কতোটা এগোলো সেটা শুনবো না?”
“হবে হবে।এখন যা ফ্রেশ হয়ে আয়।একসাথে খাবো।আমার খুব খিদে পেয়েছে। ”
প্রলয় কথাতেই নুর জলদি ফ্রেশ হয়ে আসলো।হাসি ঠাট্টায় রাতের খাাবার শেষ করলো দুজনে।এরপর নিজের বেডরুমে টিভি ছেড়ে দিয়ে নুর কে নিয়ে ফ্লোরে বসে পরলো প্রলয়।প্রলয়কে একের পর এক টিভি চ্যানেল পাল্টাতে দেখে নুর বিরক্ত হয়ে রিমোট নিয়ে নিলো।
“তোর শালা কিছুই ভালো লাগবে না।যেটা ভালো লাগবে সেটা দেখতে পারবি না।একেবারে তোর প্রেম কাহিনীর মতো।জীবনে কোন মেয়ে পছন্দ হলো না উনার,এখন যাও পছন্দ হয়েছে তাও পটাতে পারছেন না।”
” টিটকারি দিচ্ছিস?”
“টিটকারির কি আছে?সত্যিই তো।বাচ্চা একটা মেয়েকে পটাতে পারছিস না এটা কোন কথা।”
“তুই থামবি।দেখ তুই, বেশি বেশি টিভি দেখ।যাও তোর সাথে সব শেয়ার করতে চাইছিলাম,তাও করবো না।”
প্রলয়কে রাগতে দেখে নুর হেসে দিলো।নরম কন্ঠে বললো,
“সরি রে।আচ্ছা বল কি অবস্থা? কাজ কতোদুর এগোলো?”
“এগিয়েছে না ছাই।আরো মনে হয় নিচে নামিয়ে দিয়ে এসেছি।”.
” বুঝলাম না।একটু খুলে বল।”
প্রলয় সবটা খুলে বললো ওকে।চুমুর অংশ টাও বাদ দিলো না।সবটা শোনার পর নুর জিজ্ঞেস করলো,
“কিস করার পর কি তোকে চড়টড় মেরেছে?”
“না তো।”
“তো কি করেছে?মানে এক্সপ্রেশন কেমন ছিলো?”
“ও কাঁপছিলো এতটুকু বুঝতে পেরেছি কিন্তু মুখভঙ্গি দেখিনি।”
“লেগে থাক হয়ে যাবে।”
“মানে?”
“মানে হলো মেয়ে টাও তোর প্রতি দুর্বল।হয়তো প্রকাশ করছে না।কিন্তু দুর্বল এটা নিশ্চিত।কারন পছন্দের মানুষ টা স্পর্শ করেছে বলেই ও চুপ ছিলো বা শিহরিত হয়ে উঠেছিলো।অপছন্দের মানুষ হলে কিন্তু এমনটা হতো না।কষিয়ে চড় লাগিয়ে দিতো এটাই সিওর।”
“তুই ঠিক বলছিস?”
“হিসেব তো তাই বলছে।”
“থ্যাংক ইউ দোস্ত।”
“এখন তোকে একটা কাজ করতে হবে।”
“কি কাজ?”
“কয়েকটা দিন ওর থেকে দুরে থাকতে হবে।যোগাযোগ বন্ধ রাখতে হবে।যাতে ও নিজেকে সময় দিতে পারে তোকে নিয়ে ভাবার।তোকে নিয়ে চিন্তা করার।”
“তাই করবো দোস্ত। তুই ভাবিস না।তবু যেন ও আমার হয়।”
নুর হাসলো।প্রেমে পরলে বয়স্ক মানুষ রাও বাচ্চাদের মতো করে।প্রলয়ই তার বড় প্রমান।বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে আনলো।হাসি মুখে বললো,
“আল্লাহ চায় তো নিশ্চয়ই হবে।আয় এই মুভি টা দেখি।বেশ ভালো।”
বাংলা ছবি তেমন পছন্দের না হলেও প্রলয় খুব আগ্রহ নিয়ে ছবিটা দেখলো।পুরনো দিনের বাংলা ছবি। নাম “টাকা আনা পাই”।রাজ্জাক ববিতার জুটি।ববিতাকে এখন ওর কাছে একদম রুপসার মতো মনে হচ্ছে। আহা,যদি এই সিনেমার মতো এতো সহজেই রুপসার সাথে ওর বিয়ে হয়ে যেতো।প্রলয় দিকদারি ভুলে ছবি দেখছে,যেন বাস্তবতা ছেড়ে অলীক দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে ও।সাথে আছে রুপসা।
_________
ক্লাস করার ফাঁকে ফাঁকেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলো রুপসা।ইদানিং এই হয়েছে এক রোগ।থেকে থেকেই অন্যমনস্ক হয়ে যায়।শুধু প্রলয়ের কথা ভাবে। কি করলো এটা প্রলয়?
শুধুমাত্র অধর স্পর্শ করেই যেন ওকে পুরো টা জয় করে নিয়েছে।থেকে থেকেই সে কথা মনে পরে আর সর্বাঙগ শিহরিত হয়ে উঠে রুপসার।প্রলয়েরও কি এরকমই অনুভূতি হয়?
যদি হয়েই থাকে তবে কোথায় উধাও হলো ও?
পনেরো দিন হয়ে গেলো কোন খবর নেই।সত্যিই কি কোথাও চলে গেলো? সত্যিই কি আর আসবে না প্রলয়?
যাবেই যদি তবে এ নাটকের কি দরকার ছিলো?
আর ভাবতে পারে না রুপসা। মনটা খুবই বিষন্ন থাকে।
মনে মনে প্রলয়কে খোঁজে।সবসময় ভেবে এসেছে নিজের স্বামী ব্যতীত অন্য কাউকে এ শরীর স্পর্শ করতে দেবে না।কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো।
প্রলয় ওকে ছুয়ে গেলো আর ও কিছুই করলো না?
নিজের শরীর যেন নিজের সাথেই বেঈমানী করেছিলো সেদিন।প্রতিবাদের বদলে অজানা শিহরণে শিহরিত হয়ে উঠেছিলো।
প্রলয় কি ভাবছে ওকে?নিশ্চয়ই খারাপ একটা মেয়ে ভাবছে।যাকে চাইলেই ছুয়ে দেয়া যায়।
যতই ভাবে এসব ভাবনা ভাববে না ততই যেন জেঁকে ধরে।রাতে এখন আর ঠিকঠাক মতো ঘুম আসে না।মটকা মেরে শুয়ে থাকে শুধু। নয়তো মা টের পেয়ে যাবে।
“রুপসা কোন সমস্যা? ”
প্রভাষকের গলার আওয়াজে ধ্যান ভঙ্গ হলো রুপসার।
ও যে ক্লাসে বসে আছে সেটাই ভুলে গিয়েছিল।
আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো,
“না স্যার।একটু মাথা ব্যথা করছিলো আর কি।”
“ঔষধ খাচ্ছো না এখন আর? ”
“দুটো চলছে।”
“ঠিক মতো চালাও ঠিক হয়ে যাবে। বসো এবার।”
“থ্যাংক ইউ স্যার।”
বসে পরলে মনিকা নিচু গলায় বলে উঠলো,
“ক্লাস শেষ হলে একটু বসবি আমার জন্য। কথা আছে। ”
“কি কথা?”
“তখনি শুনিস।”
বলেই ক্লাসে মনোযোগ দিলো মনিকা।ওর এই স্বভাব টা সম্পর্কে জানে রুপসা।বলেছে যখন পরে বলবে,তাহলে পরেই বলবে।এখন জোর করেও কোন লাভ হবে না।
ক্লাস শেষে শহীদ মিনারের সিড়িতে বসে মনিকার জন্য অপেক্ষা করছিলো রুপসা।পাঁচ মিনিটের মধ্যে মনিকা এলো।
“বল, কি বলবি?”
“বলবি তো তুই।”
“মানে?কি বলবো?”
“কি হয়েছে তোর?”
“কি হবে?”
“সেটা তো তুই জানিস।”
“আমার কিছুই হয় নি।শুধু শুধু জিজ্ঞেস করছিস।”
আমতা আমতা করে বললো রুপসা।
“তাহলে এমন মন খারাপ করে থাকিস কেনো?শুধু শুধু মুখ ভার করে থাকার মেয়ে তো তুই না।অন্য কোন ব্যাপার আছে।কেমন উদাস উদাস থাকিস।কি যেন ভাবিস।প্রেমে পরলে এমন হয়।প্রেমে পরেছিস প্রলয় ভাইয়ের?”
সরাসরিই বলে বসলো মনিকা।
“কে বললো তোকে?”
“কে বলবে?বোকা কোথাকার।তোর কথায়ই তো তুই ধরা খাস।বল সত্যি কি না?”
রুপসা নিজের মনের ভাব আর লুকালো না।ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।মনিকা ওকে দুহাতে জড়িয়ে নিলো।
“আরে বোকা কাঁদছিস কেনো?উনি তো ভালো একজন
ছেলে।উনাকে ভালো বাসাই যায়।”
“আসলেই ভালোবেসে ফেলেছি রে।যেখানেই যাই, যে কাজই করি শুধু উনার মুখটা চোখে ভাসে।কখন যে উনার প্রতি এমন দুর্বল হয়ে গেলাম বলতেই পারবো না।”
কাঁদতে কাঁদতেই বললো রুপসা।
“ভালোবাসা এমনি দোস্ত। কখন হয়ে যায় বলা যায় না।আর কাঁদিস না প্লিজ। ”
রুপসার কান্না থামছেই না।মনিকা নিজের মোবাইল বের করে কাকে যেন কল দিলো।রুপসার একটু বিরক্ত লাগলো।কোথায় মনিকা ওকে সময় দিবে। না, উনি মোবাইলে এখন কার সাথে কথা বলবেন।
বাঁকা চোখে মনিকার দিকে তাকিয়ে রইলো রুপসা।
“হ্যালো,আপনার হোয়াটসঅ্যাপ এ একটা অডিও ক্লিপ পাঠিয়েছি শুনুন।”
ওপাশের লোক কি বললো শোনা গেলো না।
এরপরই মনিকা কল কেটে দিলো।
“কে ছিলো?”
“তুই চিনবি না।চল বাড়ি যাই।তার আগে মুখ ধুয়ে নে।কেঁদে কেটে চেহারার হাল তো বেহাল করে ফেলেছিস। প্রলয় ভাই দেখলে কি হবে ভেবেছিস?”
“কি হবে?আমি কি উনাকে ভয় পাই নাকি?তাছাড়া উনি এখানে নেই।তোর এতো ভাবতে হবে না।”
ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলিয়ে মনিকা বললো,
“নেই, আসতে কতোক্ষন।”
রুপসা মনিকার কথা তেমন আমলে নিলো না।চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো কলেজ একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। মনিকার ওড়নায় টান দিয়ে বললো,
“চল, এখন বাসায় যাই।এম্নিতেই দেরি হয়ে গেছে। ”
চলবে…….
মুনিরা মেহজাবিন।