মেঘের পরে মেঘ -২৭
“শায়েরী,এমন করো না প্লিজ। একটু তো শুনবে আমাদের কথা।”
“কি শুনবো কবির ভাই? এখন আর কি শোনার আছে? আমার জীবন তছনছ করে দিয়ে আপনার বন্ধু এখন আমাকে কি শোনাতে চায়?আমি শুনবো না।কোন কথা শোনার নেই আমার।”
“শায়েরী তুমি ভুল বুঝেছো। একটু আমার কথা শোন। তানজুর সাথে আমার কোন সম্পর্ক ছিলো না।সব ওর ষড়যন্ত্র ছিলো তোমাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দেবার।ও ইচ্ছে করে এমন করেছিলো।”
শায়েরীর সামনে দাঁড়িয়ে বললো নাবিল।
শায়েরী হাসলো।
“ইচ্ছে করে কেন এমন করবে?শুধু শুধু নিশ্চয়ই করেনি?ও আপনার প্রতি দুর্বল ছিলো।”
“হ্যাঁ,ছিলো।কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি।”
কাতর গলায় বললো নাবিল।
“ঠিক বলেছেন।আপনি বুঝতে পারেন নি।আপনি তো দুধের শিশু ছিলেন কিভাবে বুঝবেন?একটা প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ না কি বুঝতে পারে না কোন মেয়ে টা তাকে কি চোখে দেখে?এটাও সম্ভব? আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?আমি আপনাকে যতোটুকু চিনি তাতে তো এতো বোকা আপনি নন।না কি ভান?”
“শায়েরী তুমি যা কিছু বলো কিন্তু আমাকে ফিরিয়ে দিও না।একবার তোমাকে হারিয়ে তোমাকে ফিরে পাওয়ার আশা নিয়ে বেঁচে ছিলাম। এবার যদি তুমি ফিরিয়ে দাও আমি আর বাঁচবো না।”
“ব্ল্যাকমেইল করছেন?ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল।আর আপনাকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা আসছে কেন?যখন আমি আপনার প্রতিক্ষায় বসে ছিলাম তখন তো আসেন নি।যখন সমস্ত দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল তখন তো আপনাকে পাশে পাইনি।তবে এখন কেন?”
“আমার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। বিশ্বাস করো।যখন ফিরে এলাম তখন তুমি ছিলে না।”
“একেবারে সময় মতোই হয়েছিল। তাই না?তাহলে তানজুর পাড়ার লোক মিথ্যে বলেছিল?”
“কি বলেছে?”
“আপনারা বিয়ে করে অন্য কোথাও শিফট হয়েছেন।”
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো নাবিল।
“এতোকিছু বলেছে আর এটা বলেনি আমি যে পালিয়ে এসেছিলাম?তুমি একটু বিশ্বাস আমাকে করো শায়েরী।ঐ ঘটনার পর আমি তানজুর নামে পুলিশ ওয়ারেন্ট বের করে ওর বাসায় গিয়েছিলাম।খুব রাগ হয়েছিল।ভেবেছিলাম ওকে জেলে পঁচিয়ে মারবো।কিন্তু ও ছিলো না।কার সাথে না কি বিয়ে হয়েছিল ওর।ও কোথায় থাকে জানি না।জানলে খুব ভালো হতো।অন্তত তোমার সামনে ওকে দাঁড় করালে সত্য মিথ্যার যাচাই হয়ে যেতো।”
শায়েরীর খুব ইচ্ছে করছে নাবিলকে বিশ্বাস করতে। সেই পুরোনো দিনের মতো।কিন্তু কেন যেন আসছে না।মন বলছে এটা হয়তো সত্যি না।
“তোমাকে কতো খুঁজেছি।কতো জায়গায় যে খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি।তোমার বাপের বাড়ি,তোমার সমস্ত আত্নীয়ের বাড়ি। কোথাও পাই নি।তোমাকে হারিয়ে আমি ভালো ছিলাম না শায়েরী। একটুও ভালো ছিলাম না।কতোরাত যে একটু শান্তিতে ঘুমোই না বলতে পারবো না।আমি জ্ঞানত কোন অন্যায় করিনি
কিন্তু তবুুও তোমার কাছে আমি অপরাধী। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।আর কস্ট দিও না।”
“হু।কস্টের কথা বলছেন?কস্ট কাকে বলে, কতো প্রকার ও কি কি তাতো আমি জেনেছি এতো গুলো দিনে।একটা প্রেগন্যান্ট মহিলার স্বামী ছাড়া,কোন আশ্রয় ছাড়া কিভাবে দিনাতিপাত করতে পারে তার কোন ধারণা আছে আপনার?”
“আমি জানি তোমার খুব কস্ট হয়েছে।অনেক কস্ট করেছো।এ কস্টের কোন সীমা হয় না তাও জানি।তবু তুমি আমাকে মাফ করে দাও।ফিরে চলো।”
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পরলো নাবিল।ভাঙা গলায় বললো,
“তুমি বলো তো তোমার পায়েও ধরছি।”
বলেই দু’হাতে শায়েরী পা ধরতে উদ্যত হলে শায়েরী সরে গেলো।নাবিল দুহাত জড়ো করে সেখানেই কাঁদতে লাগলো।
“কি করছেন আপনি?” পা ধরছেন কেন?”
কান্না কান্না গলায় বললো শায়েরী।
“আর কি করবো জানি না।শুধু তুমি মাফ করে দাও। ”
এবার কবির, হিমেলও এগিয়ে এলো।
“শায়েরী, তোমার জীবনটা খুব কস্টে কেটেছে আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি।কিন্তু এখানে নাবিলের কোন দোষ নেই।ও তো উপকার করতে গিয়ে ফেঁসে গেছে।তুমি ছাড়া ওই বা কি ভালো ছিলো বলো?একজন মানুষের সব থাকতেও যখন তার পাশে কেউ থাকে না তখন সেই মানুষটির মতো হতভাগ্য আর কেউ হয় না।আর রাগ রেখো না শায়েরী। ওকে মাফ করে দাও।অনেক তো বললে।এখন সব ঠিক হোক।”
শায়েরী কথা বলতে পারলো না।সামনের একটি সোফায় বসে অঝোরে কাঁদছে।চোখের পানি যেন বাঁধা মানছে না।এই মানুষ টাকে কি করে ফিরিয়ে দেবে?এতোদিনের এতো কস্ট কি এতো সহজেই ভুলে যাওয়া যায়?আর রুপসা?ওই বা কিভাবে নিবে সবকিছু?
নাবিল একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে শায়েরীর দু হাত
শক্ত করে ধরলো।
“কেঁদো না, প্লিজ। সারাজীবন তো কম কস্ট করলে না।সব আমার জন্য হলো।আগে যদি জানতাম,পৃথিবীর সব সুখ দিতে গিয়ে, সমস্ত দুঃখ গুলোকে তোমার ঝুলিতে দিয়ে দেবো,, তবে কখনো তোমাকে বিয়ে করতাম না।মাফ করে দাও।প্লিজ। ”
“বাবা কে মাফ করে দাও মা।বাবাও তো অনেক কস্ট পেয়েছে। ”
শায়েরী ঝট করে সামনে তাকালো।এতো ঝামেলার মধ্যে কখন থেকে রুপসা দাঁড়িয়ে আছে তা জানেই না শায়েরী। অবাক হয় নাবিলও।ওর সামনে ওর মেয়ে দাঁড়িয়ে। যাকে কি না জন্মের পর একটা বারের জন্য দেখতে পারেনি,একটু ছুঁতে পারেনি।একটু আদর করতে পারে নি।সেই আজ ওর সামনে দাঁড়িয়ে।নাবিল ধীর পায়ে রুপসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
নিজের প্রতিবিম্বের সামনে দাঁড়িয়ে যেন।কখন দু হাত রুপসার মুখে চলে গেছে জানতেই পারলো না যেন।
রুপসাও তাকিয়ে আছে ওর আজন্ম না দেখা বাবার দিকে।
দুচোখে অশ্রুর বন্যা নাবিলের।মেয়ের মাথায় এলোপাতাড়ি চুমো খেয়ে নিয়ে বুকে টেনে নিলো।
“মাফ করে দে মা।আমি যে তোর প্রতি কোন দায়িত্বই পালন করতে পারলাম না।মাফ কর মা,মাফ কর।”তারপরই চিৎকার করে উঠে, ”ও আল্লাহ তুমি আমাকে এতো শাস্তি কেন দিলে,আমার মেয়ে এতো বড় হয়ে গেছে, জন্মদাতা হিসেবে আমাকে একবার দেখার সুযোগও দিলে না।একটু আদর করতেও দিলে না আল্লাহ।সন্তান থাকতেও বাপ ডাক শুনতে দিলে না আল্লাহ। কি দোষ করেছিলাম তোমার কাছে আল্লাহ ?এতো শাস্তি কেন দিলে আমার পরিবারকে আল্লাহ? কেন দিলে?”
নাবিলের বুকভাঙা আহাজারিতে রাতজাগা পাখিরাও ডানা ঝাপটাতে থাকে।
রুপসা নাবিলকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো।
“থামো বাবা।শান্ত হও।আমি সবটা শুনেছি। তোমার কোন দোষ নেই বাবা।সব আমাদের নিয়তি।আল্লাহ চেয়েছেন তাই আমাদের পরীক্ষা নিয়েছেন।”
“মা রে,আমার বুকটা চিড়ে যদি দেখাতে পারতাম কতো কস্ট এখানে।”
বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো নাবিল।রুপসার চোখের ও বাঁধ ভেঙেছে। শায়েরীও হেঁচকি তুলে কাঁদছে।কাঁদছে বাকি সবাই।
জীবন সিনেমার থেকেও বড়ো সিনেমা যার চিত্রনাট্য তৈরি করেন স্বয়ং উপরওয়ালা।তাই কার জীবন কখন কোন খাতে প্রবাহিত হবে তা কেউ জানে না।
রুপসা কে একহাতে জড়িয়ে শায়েরীর কাছে গেলো নাবিল।একহাতে শায়েরী হাত জড়িয়ে ধরলো।এবার শায়েরী আর হাত ছাড়িয়ে নিলো না।
অশ্রুসিক্ত কন্ঠে নাবিল শুধু এটুকুই বলতে পারলো,
“প্লিজ। ”
এরপরই ঢলে পরলো শায়েরীর কোলে।শায়েরী হতভম্ব হয়ে গেলো। রুপসা ধরতে গেলেও তা আগেই নিচে লুটিয়ে পরলো নাবিল।
রুপসা প্রায় চিৎকার করে উঠলো,
“বাবা।”
_________
নাবিলের জ্ঞান ফিরে হসপিটালের বেডে।পুরো বারো ঘন্টা পর।ছোটখাটো একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে।উত্তেজিত হতে পুরোপুরি বারন করে গেছে ডাক্তার। কমপ্লিট বেড রেস্টে থাকতে বলেছে অন্তত সাতদিন।
নাবিল চোখ মেলেই শায়েরীকে দেখতে পেলো।ওর বালিশের পাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।ক্লান্ত চেহারা।যেন কতোদিন ঘুমোয় নি।
নাবিল ধীরে ধীরে শায়েরী চুলে আঙুল চালাতে লাগলো।সেই বহু বছর আগের মতো।
কিছুক্ষনের মধ্যেই শায়েরীর ঘুম ভেঙে গেলো।বুঝতে পারলো নাবিলই ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।
শায়েরী উঠে বসলো।তারপর নাবিলের কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন লাগছে এখন?একটু ভালো লাগছে?”
“হুম।”
“কিছু খাবেন? খিদে লেগেছে? ”
“না।মেয়ে কোথায়?”
“ওকে হোটেলে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
“আসবে না?”
“আসবে।পরে আসবে।সারারাত জেগে ছিলো।তাই পাঠিয়ে দিলাম।যেতে চাইছিলো না অবশ্য। ”
“একা হোটেলে থাকাটা কি সেইফ হবে?”
“একা না।ওর এক বান্ধবী আছে সাথে। ”
“শায়ু?”
অধীর হয়ে ডাকলো নাবিল।শায়েরী একটু কেঁপে উঠলো যেনো।কতোদিন পর এ ডাকটা শুনতে পেলো। এ নামে কেউ ওকে ডাকতো তাই ভুলে গিয়েছিল।নিজেকে সামলে নিলো শায়েরী।
“বলুন।”
“মাফ কি পেয়েছি? ”
একটু যেন ভাবলো শায়েরী। তারপর হেসে দিয়ে বললো,
“মাফ তো সারাজীবনেও পাবেন না।আসল শাস্তি তো এবার থেকে পাবেন।এতোদিন তো খুব আরামে ছিলেন।এখন বুঝবেন বৌ আর মেয়ের যন্ত্রনা কি জিনিস।”
“তুমি পাশে থাকলে যে কোন যন্ত্রনা,যে কোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো।”
কথা বলার সময় দুজনের চোখই অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।
এতোক্ষনে রুপসার ঠোঁটেও হাসি ফুটলো।সেই কখন৷ থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মা বাবার কথোপকথন হচ্ছিলো তাই ইচ্ছে করেই সামনে যায় নি।ওনাদের নিজেদের মধ্যে কথা হওয়া প্রয়োজন।অবশ্য মা যে রেগে নেই সেটা বাবা অসুস্থ হওয়ার পর ওনার ছটফটানি দেখেই বুঝতে পেরেছিল রুপসা।বাবা লুকিয়ে পরার পর সবচেয়ে বেশি মা ই চিৎকার করছিলো দ্রুত হসপিটালে নেয়ার জন্য। দুজনই দুজনকে কতো ভালোবাসে অথচ নিয়তি কতোদুরে সরিয়ে দিয়েছিলো এদেরকে।
চলবে……
মুনিরা মেহজাবিন।