হৈমন্তীকা
৩১.
দু’টো মাসে নিজের হিংস্রতা দিয়ে অতিষ্ঠ করে দেওয়া নিষ্ঠুর, পাষাণ গ্রীষ্ম বিদায় নিয়েছে আজ প্রায় অনেকদিন। পৃথিবীতে আষাঢ় নেমেছে। নেমেছে বর্ষা। ঘন কালো মেঘের ভেলায় ঢেকে আছে বিশাল নভস্থল। এ সময় ফাঁকফোঁকর দিয়ে সোনালী রোদ্দুরের দেখা পাওয়া যে বড্ড কষ্টকর। বাজ পরছে। হুটহাট বৃষ্টিতে অপ্রস্তুত হচ্ছে মানুষ। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ কানে বাজছে। ব্যাঙেদের ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘ্যাঙরঘ্যাঙ, ঘ্যাঙরঘ্যাঙ। তুষার বাইক সাইড করে হৈমন্তীকে নিয়ে বাসস্টপের ছাউনিতে দাঁড়ালো। একহাতে নিজের ভেঁজা চুল ঝারতে লাগলো। পকেট থেকে মানিব্যাগ আর মোবাইল বের করে বললো, “এগুলো আপনার ব্যাগে রাখুন হৈমন্তীকা। পানিতে নষ্ট হয়ে যাবে।”
হৈমন্তী মাথা দুলালো। মানিব্যাগ আর মোবাইল রাখতে গিয়ে হঠাৎ-ই মানিব্যাগের ক্ষীণ ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট মেয়েলি ছবির অস্তিত্ব টের পেল। কৌতুহল বশত পুরো মানিব্যাগ খুললো সে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাসোজ্জল ছবি ভেসে উঠল আঁখিজোড়ার সামনে। হৈমন্তী একহাত গালে ঠেকিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে তাকিয়ে হাসছে। পরনে হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি।
তার মনে পরে গেল, নবীন বরণের দিন ঠিক এই শাড়িটি পরেই এভাবে অনমনা হয়ে বসে ছিল সে। মাঝে মাঝে পারুর কথায় হাসছিল। তারপর তো এ শাড়ি পরার আর সুযোগই পায় নি সে। তুষার কখন তার এ ছবি তুললো? হৈমন্তী বুঝলো না কেন?
হঠাৎ তুষারের গম্ভীর গলায় ঘোর কাটলো তার, “আমি আমার বউ ছাড়া ব্যক্তিগত জিনিস কাউকে ধরার অধিকার দেই নি, হৈমন্তীকা। ওগুলো ব্যাগে রাখুন।”
শুনে ভ্রু কুঁচকাল হৈমন্তী। ব্যাগের চেন আটকালো। বিমূঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
— “আমি আপনার বউ নই?”
— “হ্যাঁ। তবে পঞ্চাশ ভাগ। শতভাগ বউ করে নেই, তারপর এই আমিকেই দিয়ে দেবো আপনাকে।”
হৈমন্তী পিটপিট নয়নে এদিক-ওদিক তাকালো। নিশ্বাসের গতি অল্প কমলো। ইদানিং তুষার আশেপাশে থাকলে হৈমন্তীর লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতি অনুভূত হয়। উপরন্তু তুষারের এহেন কথায় লজ্জা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। নাকের দু’পাশ সামান্য কেঁপে উঠে। তুষার আপাদমস্তক দেখলো তাকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। আলতো করে নাক টেনে বললো,
— “মুখ তো লাল হয়ে টমেটো দেখাচ্ছে। এত লজ্জা কোথা থেকে পান হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী জবাব দেয় না। মনে ভয়াবহ জোড় লাগিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাফল শুণ্যই রয়ে যায়। তুষার দু’কদম এগিয়ে আসে। মাথার ঘোমটা-টি সাবধানে ফেলে দেয়। ওড়নার কোণাংশের বেশ খানিকটা হাতে পেঁচিয়ে স্বস্নেহে হৈমন্তীর কালো ঘন কেশ মুছে দিতে থাকে। হৈমন্তী নিশ্চুপ, চুপচাপ হতজানু হয়ে আছে। প্রখর অনুভূতিতে নিজেকে কেমন অনুভূতি শূণ্য মনে হচ্ছে। মৃদু, মৃদু কেঁপে উঠছে শরীর।
মাথায় আবারও ঘোমটা টেনে সরে এলো তুষার। পরনের ভেঁজা শার্ট-টা গায়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। কলারটা একটু টেনে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে সটান হয়ে দাঁড়ালো সে। অবিরাম বৃষ্টিধারার দিকে তাকিয়ে একমনে বলতে লাগলো,
— “বৃষ্টি বেড়ে যাক, আপনি থেকে যান আরেকটু সময়।”
_____
সন্ধ্যার দিকে নাওয়াজ আর তার পরিবার এলো আসরাফ সাহেবের বাসায়। সঙ্গে করে চার-পাঁচেক মিষ্টির প্যাকেট, ফল-মূল আর কেকও এনেছেন। হৈমন্তী জানতো না ওরা এসেছে। নিজ রুমে মনোযোগ সহকারে বই পড়ছিল সে। হঠাৎ রাবেয়ার আগমন ঘটলো সেখানে। কোনোরুপ কথা না বলে তিনি আলমারির কাছে এগোলেন। একে একে গোছানো কাপড়গুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন। সর্বশেষে তুষারের দেওয়া সেই নীল রঙা শাড়িটি হাতে নিয়ে হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে এলেন। চিন্তিত সুরে বললেন,
— “শাড়িটা পড়ে দ্রুত রেডি হয়ে নেয় হৈমন্তী। দেড়ি করিস না। উঠ!”
হৈমন্তী উঠে দাঁড়ালো। শাড়ি হাতে নিলো। প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “হঠাৎ রেডি কেন? কোথাও যাবে?”
— “হ্যাঁ।”
— “কিন্তু তাই বলে শাড়ি পড়তে হবে কেন? একটা কামিজ বের করে দাও।”
রাবেয়া চোখ রাঙালেন,
— “এত কথা বলিস কেন? এক কথায় হয় না? যা তাড়াতাড়ি রেডি হ!”
বলে চলে গেলেন রাবেয়া। হৈমন্তী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল মায়ের যাওয়ার পানে। অতঃপর বাধ্য মেয়ের মতো তৈরি হয়ে নিলো।
কিছুক্ষণ পর রাবেয়া আবার এলেন। মেয়ের অল্প সাজসজ্জা দেখে রেগে গেলেও পরক্ষণে কি ভেবে মন গলে গেল উনার। এগিয়ে এসে হৈমন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পরম মমতাময় কণ্ঠে বললেন,
— “আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে! মাশাল্লাহ।”
তারপর একটু থেমে হেমন্তকে বললেন,
— “রুম থেকে বের হবি না। চুপচাপ পড়ালেখা কর।”
মায়ের ব্যবহার কেমন অস্বাভাবিক ঠেকলো হৈমন্তীর কাছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারলো না সে। তার কিছু মুহুর্ত পর ড্রইংরুমে পা রাখতেই সবকিছু ঠাওর হলো মস্তিষ্কে। শরীর অবশ হয়ে গেল। নাওয়াজের পরিবার দেখতে এসেছে তাকে। আসরাফ সাহেব কি দারুণ প্রফুল্লতার সঙ্গে নাওয়াজের বাবার সঙ্গে কথা বলছেন! হাসি যেন সরতেই চাইছে না ঠোঁট হতে। হৈমন্তীর গলা শুকিয়ে গেল। পা এগাতে চাইলো না। রাবেয়া জোড় করে টেনে নিয়ে গেলেন তাকে। নাওয়াজের সামনা-সামনি বসানোর পূর্বে মৃদু স্বরে কানে ফিসফিসিয়ে বললেন, “উলটাপালটা কিছু করবি না হৈমন্তী। তোর বাবার এই হাসিটা আবারও হারাতে দিস না।”
এই এইটুকু বাক্যে আর কোনো মতবাদ প্রকাশের ইচ্ছেটুকু তৎক্ষণাৎ মিইয়ে গেল হৈমন্তীর। সে চুপচাপ সব হজম করে নিলো। নাওয়াজ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ণ হাসি লেগে আছে। বড়দের আলোচনায় একবারও চোখ তুলে তাকালো না হৈমন্তী। তুষারের দেওয়া শাড়ি পরে যেখানে তার তুষারের সঙ্গে থাকার কথা ছিল, সেখানে নাওয়াজের দেওয়া আংটি অনামিকা আঙুলে পরিধান করতে হলো তাকে। সে সময়টা ছিল হৈমন্তীর জন্য সবচেয়ে করুণ, মর্মান্তিক মুহুর্ত। নেত্রকোণে জমা হয়েছিল ক্ষীণ বিন্দু কণার জল।
আংটি পড়ানো শেষে নাওয়াজ আর হৈমন্তীকে আলাদা কথা বলতে পাঠানো হয় তার রুমের বারান্দায়। হৈমন্তী কথা বলছে না। নাওয়াজ বরাবরই নিষ্পলক চেয়ে আছে তার মুখপানে। অস্বস্থিতে, ঘৃণায় আর রাগে শক্ত হয়ে আছে হৈমন্তী। নাওয়াজ কিছু বলছে না দেখে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠে,
— “আপনি এমন কেন করেছেন, নাওয়াজ ভাইয়া?”
নাওয়াজ যেন বুঝলো না,
— “কি করেছি?”
হৈমন্তী অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো,
— “কি করেছেন জানেন না? আপনাকে বলেছিলাম আমার আর তুষারের বিয়ে হয়ে গেছে। তবুও কোন মনমানসিকতায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন আপনি?”
নাওয়াজ অবুজ চোখে তাকালো। হেসে বললো, “তুমি মিথ্যা বলছো। এমন কখনোই হতে পারে না। দেখ হৈমন্তী, আমি জানি তুমি আমাকে তেমন পছন্দ করো না। তাই বলে যে একদম অপছন্দ করো তা কিন্তু না। একটু বোঝার চেষ্টা করো আমাকে। আমি তোমাকে সুখে রাখবো।”
হৈমন্তীর অধৈর্য গলা,
— “আপনি কি বাংলা কথা বুঝেন না? কোনো কালেই আপনাকে পছন্দ নয় আমার। বিরক্তিকর লাগে আপনাকে। আমি শুধু তুষারকে ভালোবাসি। আর ওর সাথে আমার আইনত বিয়েও হয়েছে।”
নাওয়াজের মুখশ্রী করুণতায় ভরে গেল। হাসার চেষ্টা করে বললো,
— “আমি বিশ্বাস করি না। তুমি মিথ্যে বলছো।”
— “আপনাকে মিথ্যে বলে আমার কি লাভ? তবুও আপনার বিশ্বাস না হলে আপনাকে রেজেস্ট্রি পেপারের ছবি দেখাতে পারি। দেখতে চান?”
নাওয়াজের চোয়াল শক্ত। চোখে জলের স্বতঃস্ফূর্ত আভাস। কাঁপা স্বরে সে বললো,
— “তুমি সত্যিই তৈমুরকে ভালোবাসো?”
— “হ্যাঁ।”
— “আঙ্কেলকে কিছু জানিয়েছ এ ব্যাপারে? আঙ্কেলকে কিভাবে মানাবে?”
হৈমন্তীর কঠিন গলার উত্তর,
— “তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু বিয়েটা ভেঙ্গে দিন। আমি উপকৃত হবো।”
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলল নাওয়াজ। নিদারুণ কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে উঠলো,
— “আমার ভালোবাসা একপাক্ষিক রয়ে গেল, হৈমন্তী। আমি তোমায় আমার করে পেলাম না।”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা