#দূর_আলাপন
পর্ব-৪
অদ্রিজা আহসান
___________________
শ্রাবণের আরও একটি বিষন্ন দুপুর। আকাশ জুড়ে ভেসে থাকা ছিন্ন কিছু সাদা মেঘ আর সোনালী রোদ। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দুপুরের মিষ্টি সে রোদের লুকোচুরি খেলা। কখনো বা ছাদের এককোণে, কখনো আবার গাছের ডালে, পাতায় পাতায় একফালি রোদ্দুর। তিতিক্ষাদের বাড়ির উঠোন এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। সকালের ঝুম বৃষ্টির রেশ এখনো রয়ে গেছে ভিজে মাটিতে। অতিবৃষ্টির ফলে এই অসময়েও কামিনী ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। এই মধ্যদুপুরে বাড়ির আর সকলে যখন ভাতঘুম দিচ্ছে নিশ্চিন্তে , তিতিক্ষা তখন একখানা ইংরেজি কবিতার বই হাতে তাদের সোঁদা গন্ধ ওঠা ভেজা মাটির উঠোনে ধীর পায়ে হাটছে। চোখ বুজে মাঝে মাঝে আওড়াচ্ছে কবিতার দু একটা লাইন ।
As I looked into his eyes
And found his longing stare
I stopped myself from saying words
That would show how much I care…
লোকে ভাবে, যে ধর্ম নিজেকে আড়াল করতে শেখায়, অট্টহাসিতেও নিষেধ দেখায় সে ধর্ম তো সন্ন্যাসেরই নামান্তর! যে নামায পড়ে, কোরআন পড়ে, সে হাতে তবে কেন আবার ইংরেজি নভেল উঠবে! তিতিক্ষা চোখ বুজে কথাটা ভেবে আনমনে হেসে ওঠে। এই ধারার কথা জীবনে সে কম বার তো শোনেনি! স্কুলের দিনগুলোতে টিফিন টাইমে বাকিরা যখন কানামাছি খেলতে ছুটে মাঠে যেত, তিতিক্ষা তখন সেই ফাঁকা ক্লাসে বসে ফরজ সালাতটুকু শেষ করে উপন্যাসের পাতা ওল্টাতো। মেয়েরা তখন মুখ ভেঙচিয়ে বলত,’দেখ কান্ড! দিনরাত হাদিসের বুলি ঝেড়ে এখন আবার প্রেমের উপন্যাস পড়া হচ্ছে! আর কি কি যে দেখবো! ‘
কথাগুলো ভেবে তিতিক্ষার এখন দুঃখ হয়না আর। সবাই ত্যাগ করেছে তাকে । সমাজ, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব। ছাড়তে পারেনি শুধু সে নিজে। অথচ সমাজের কাছে তার ভুলের কোনো অবধি নেই। সে দাম্ভিক, হিংসুক, পরশ্রীকাতর, অমিত্রোচিত, গেয়ো ভূত আরো কত কি! অতএব সমাজে তার স্থান অতি ন্যূন!
সেই নিস্তব্ধ দুপুরে বিষন্ন মনের অনুকূল আবহাওয়ায় তিতিক্ষা আরো অনেক কথা ভাবে। নানান ভাবনার মাঝে একটা অপ্রিয় ভাবনাও উঁকি মেরে যায় থেকে থেকে। তিতিক্ষা ভাবতে চায় না। আবার এই অভেদ্য রহস্য ভেদ করতে না পেরে শান্তিও পায় না। কি ভীষণ জ্বালা!
ওড়না প্রান্তে হেচঁকা টান পড়তেই তিতিক্ষা ঘুরে তাকায়। ছোটন দাঁড়িয়ে আছে। তার ঘুম ভাঙা ফোলা ফোলা চোখ মুখ, এলোমেলো হয়ে থাকা মাথার চুলে তাকিয়ে তিতিক্ষার হাসি পায়। সে আঙুল দিয়ে আঁচড়িয়ে চুলগুলো ঠিক করে দেয় তারপর ছোটনকে কোলে তুলে নিয়ে আচমকা তার গাল চেপে ধরে চুমু খায়। বলে,’ছোট মিয়ার ঘুম এতো জলদি শেষ? মা জানলে পিঠে যে দুরুম দুরুম পড়বে। জানা আছে তো? ‘
ছোটন ভেংচি কাটে। ভাবটা এমন দেখায় যেন মা জেনে গেলে কি ছাই করবে সে তার জানা!
তিতিক্ষা ফের মুচকি হাসে। বলে, ‘ তা এই ভরদুপুরে এখানে তোমার কি চাই? এর চেয়ে কি মায়ের সাথে ঘুমটাই ভালো ছিল না? ‘
ছোটন ডানে-বামে মাথা নাড়ে। বলে, ‘আম্মো তো ঘুমায় না। আম্মোর মন খারাপ। তাই রাগে শুধু আমাকে মারে । সেজন্যই চলে এসেছি আমি। আর যাবোই না।’
মারের কথা শুনে তিতিক্ষার ভুরু কুঁচকে যায়। বুবুর এই স্বভাব টা সে ভয়ানক অপছন্দ করে। কিছু হলেই ছেলেটার গায়ে হাত তোলে। তিতিক্ষা ছোটনের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘ফের মেরেছে তোমাকে? দাঁড়াও আজ তোমার মায়ের নামে বিচার বসাবো আমি।’
ছোটন সায় পেয়ে খালার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
তিতিক্ষা বই রেখে এবার তাকে কোলে নিয়েই উঠোন জুড়ে হাটতে থাকে। অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে, ‘ছোট মিয়া?’
-‘হু’
-‘তোমার আম্মোর আজ হঠাৎ মন খারাপ কেন হলো? ‘ তিতিক্ষা উত্তরের অপেক্ষা করে না।মনের বেখেয়ালে আনমনেই প্রশ্নটা সে করেছিল।
ছোটন এতো কিছু জানে না। তবে সেদিন রাতে তার ভবিতব্য শ্বশুর নিনাদ ওরফে তার বেস্টু ফোন রাখার পর থেকেই সে দেখছে মায়ের মন খারাপ। সেটাই সে তিতিক্ষাকে বোঝাতে লাগলো। এর আগেও কয়েকবার নানান কথা দিয়ে ব্যাপার টা সে তিতিক্ষা কে বোঝাতে চেয়েছে। তবে ছাত্রীটি নিতান্ত অমনোযোগী হওয়ায় বারবারই সে ব্যার্থ হয়েছে। তিতিক্ষা কিছুই বোঝেনি। শুধু এটুকু বুঝেছে, আড়ালে কিছু একটা চলছে। গভীর কিছু। তবে সে যাই হোক আনন্দদায়ক কিছু যে নয় এটা সে নিশ্চিত! গত দুদিনে সে দেখেছে বুবুর হাবভাব ভালো নয়। ভেবেছিল রওশান ভাই চলে গেছে তাই হয়তো মন খারাপ। কিন্তু রওশান ভাই তো কিছুদিন পর পর আসে, আবার চলেও যায়। আর সময় তো বুবু এমন গুম মেরে বসে থাকে না কখনো। তারপর বুঝলো ব্যাপার যাই হোক, সেখানে নিনাদ জড়িত। এরমাঝে থাকা তার চলে না । অতএব তিতিক্ষা আগ্রহ হারালো। তাই সে এখন নিশ্চুপ বুবুর এই অতর্কিত গুমরে যাওয়া দেখেও।
ক্রমে ক্রমেই বেলা পেরিয়ে অপরাহ্ন হয়ে এলো। তিতিক্ষা সোফায় হেলান দিয়ে বসে একটা বাচ্চাদের গল্পের বই হাতে জোরে জোরে পড়ে শোনাচ্ছে। ছোটন তার পাশে গা এলিয়ে দিয়ে আধশোয়া হয়ে বই পড়া শুনছে। তখন শেষ মধ্যাহ্নে উঠোনে হাটাহাটির পর আসরের আযান পড়তেই তারা দুজন ঘরে ফিরে এসেছিলো। তারপর তিতিক্ষা ছোটনকে পাশে নিয়েই সালাত আদায় করেছে। এরপর থেকেই এখানে বসে এরূপে তাদের বইপড়া চলছে। মারুফ সাহেব এখনো মসজিদ থেকে ফেরেননি। তিহা রান্নাঘরে আলুর চিপস ভাজছে। ক্রিংক্রিং করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। তারপর অনবরত বাজতেই থাকলো। ছোটন গভীর মনোযোগে শুনছিল রাজকন্যার রাক্ষসপুরীতে বন্দী হওয়ার কাহিনি। তাই হঠাৎ এভাবে বাঁধা পরায় সে যেন একটু বেশিই বিরক্ত হলো। তার ছোট ছোট গাঢ় কালো ভ্রু জোড়া কুঁচকে সে টেলিফোনের দিকে তাকাল। টেলিফোন তখনো বেজে চলেছে। তিতিক্ষা বই উল্টে রেখে টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফোন কানে তুলে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম। কাকে চাই?’
ওপাশে নিরবতা।
‘হ্যালো, কে বলছেন? ‘
আবারো নিরবতা।
তিতিক্ষা ভুরু কুঁচকে নাম্বার টা দেখে নিয়ে হাতের ইশারায় ছোটনকে কাছে ডাকলো। মাঝে মাঝেই বাজে ছেলে ছোকরারা এভাবে রং নাম্বার থেকে কল করে ডিস্টার্ব করে। ছোটন কাছে এলে টেলিফোনে হাত চেপে সে ফিসফিস স্বরে বললো, ‘দেখো তো ছোট মিয়া কি বলে।’
এতবড় দায়িত্ব পেয়ে আত্ম অহামিকায় ছোট মিয়ার বুক ফুলে উঠল। টেলিফোন হাতে নিয়ে সে যতটা সম্ভব গলার স্বর কঠিন করে বলল, ‘হ্যালো। ‘
এবারেও ওপাশে স্থির নিরবতা।
ছোট মিয়া ফের ‘হ্যালো’ বলল। এবারেও উত্তর নেই। অতএব ছোট মিয়ার রক্ত গরম হতে বেশি সময় লাগলো না। সে এবার তার ছোট্ট শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,’হ্যালোওওওওও।’ এবার ঠিক কাজ হলো। ওপাশ থেকে একজন বৃদ্ধার খড়খড়ে গলায় আওয়াজ পাওয়া গেল। তিনি বিষম বিরক্ত কণ্ঠে বলছেন, ‘ও মারে মা….আমার কান শ্যাষ। ওই নিনাইদ্দা। তুই এইডা কারে ফোন করলি? চিককুর পাইরা তো আমার কানের পুক লারায়ালছে! ওরে আল্লাহ!’
নিনাদ লাফিয়ে ফের ফোন হাতে নিল। কল করে প্রথমে তিতিক্ষার কণ্ঠ শুনেই সে চুপ করে ছিল। তারপর বৃদ্ধার হাতে ফোন দিতে যতটা সময় লাগে। এর মাঝেই আবার কি হলো! নিনাদ বলল,’ হ্যালো। ‘
তিতিক্ষা ছোটনের দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে ছিল। এবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কে ছোট মিয়া?’
ওপাশে বৃদ্ধার খড়খড়ে গলার কথা শুনে ছোট মিয়ার ততক্ষণে মুখ শুকিয়ে এসেছে। সে টেলিফোনে কান থেকে নামিয়ে নিয়েছিল তৎক্ষনাৎ। বললো, ‘জানি না। ‘ বলেই টেলিফোন তার হাতে ছেড়ে ভোঁ দৌড় দিল। তিতিক্ষা মস্ত বিপদে পড়লো। ছোটন কেন এভাবে হঠাৎ ভয় পেয়ে পালালো? ওপাশে কে আছে? না জেনে তার একদম কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ওদিকে তার হাতে থাকা টেলিফোন তখনো ভাইব্রেট হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ওপাশে নিশ্চয়ই কেউ কিছু বলছে। তিতিক্ষা সংকোচ নিয়ে ফোন কানে তুললো। বলল, ‘হ্যালো।’
এই স্বর চিনতে নিনাদের দেরি হলো না। সে তৎক্ষনাৎ পাশে থাকা বৃদ্ধার হাতে ফোন দিয়ে বললো, ‘ নাও, কথা বল।’
বৃদ্ধা ফোন নিলেন। হেসে বললেন,’তিহা নাকি তুমি? কেমুন আছো? কউ তো আমি কেডা?’
তিতিক্ষা হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কে এই বৃদ্ধা, এভাবে পরিচিতের মতো কথা বলছেন। সে বুঝতে পারলো না। মিনমিনে স্বরে বলল, ‘জ্বি……আসলে। আপু তো এখানে নেই। আমি ওর ছোট বোন। দাঁড়ান, এক্ষুনি আমি আপুকে ডেকে দিচ্ছি। ‘
এই বলে কান থেকে ফোন নামানোর আগেই তিতিক্ষা শুনল ভদ্র মহিলা বেশ উৎসুক কণ্ঠে বলছেন, ‘ও তুমি তিতিক্ষা! তোমারেও তো আমি চিনি। কেমুন আছো তুমি? ‘
-‘জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো আছেন? ‘
-‘আল্লায় রাখছে কোনো রকম। তোমার আপায় কই? তারে ডাকো। বল শিউলি ফুআম্মা ফোন দিসে। ‘
-‘জ্বি….জ্বি। এক্ষুনি ডাকছি।’ বলে ফোন নামিয়ে রেখে তিতিক্ষা যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলো। দৌড়ে গেল রান্নাঘরে তিহাকে ডাকতে। তিহাকে বাইরের ঘরে টেলিফোনের ওখানে পাঠিয়ে দিয়ে এবার সে নিজেই চিপস ভাজায় হাত দিল। এরপর অনেক সময় কেটে গেলেও তিহার আর দেখা নেই। সে এলো বিস্তর সময় পর মুখে একরাশ হাসি নিয়ে।
-‘কে ছিলো বুবু? এতো সময় ধরে যে কথা বললে? ‘ তিতিক্ষা চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল।
-‘ শিউলি ফুআম্মা কে মনে আছে তোর? একবার কলেজে থাকতে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম নিনাদের বাসায়। তখন যে এসেছিল? ‘
নিনাদের নাম শুনেই তিতিক্ষার সমস্ত উৎসাহ মুহুর্তে উড়ে গিয়ে সেখানে রাশি রাশি বিরক্তি এসে জমা হলো। সে বিরস মুখে বলল, ‘নাহ মনে নেই।’
নিজের খুশিটুকু যেভাবেই হোক প্রকাশ করতে তিহা উতলা তখন। সে তাই চুপসে না গিয়ে দিগুণ উৎসাহে বলল,’ ফুআম্মা যে কি ভালো মানুষ! কি ভালো টাই না বাসতেন আমাদের সে সময় । একদম নিজের ফুফু-চাচির মতো।
তোর মাথায় যে কি! কিছু মনে রাখতে পারিস না। তোকে নিয়ে যাওয়ায় কতো যত্নআত্তি করল সেবার। সব ভুলে গেলি?’
-‘তোমার কলেজে পড়ার সময়। সে অনেকদিন আগের কথা বুবু। মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। ‘
-‘ছাই! আচ্ছা শোন, আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। ফুআম্মা কেন ফোন করেছিল। নিনাদ তো চলেই যাচ্ছে তাই ফুআম্মা কে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে বুঝলি? নিনাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবেন ফুআম্মা । নিনাদ চলে যাবার আগে নিনাদের সাথে সাথে আমাদের কেও তিনি একবার দেখতে চান। তাই নিজেই দাওয়াত দিলেন। সামনের শুক্রবার নিনাদের বাড়িতে। আমি, ছোটন আর তুই। ইশশ দারুণ হবে। ফুআম্মার হাতের রান্না কি যে ভালো! খাওয়ার এই বড় সুযোগ।’
এসব কোন কথাই তখন আর তিতিক্ষার কানে যাচ্ছে না। সে তখনো বুবুর বলা ওই একটা কথাতে আটকে রইল। বুবু বলল নিনাদ চলে যাচ্ছে। হঠাৎ সে কোথায় যাচ্ছে? কেনই বা যাচ্ছে? এজন্যই বুঝি বুবুর এ’ কদিন এতো মন খারাপ ছিল! নিনাদ তো ছেলেমানুষ নয়। যদি দিন কয়েকের জন্য কোথাও যায়ই বা, তবে বুবুর এতো বাজছে কেন? আর সেই সুদূর গ্রাম থেকে নিজের ফুফুকে আনিয়ে তার এত আয়োজনই বা কেন? এই অভদ্র, বেহায়া লোকটা হঠাৎ যাচ্ছেই বা কোথায়!
তিহা তখন দারুণ খুশিতে হড়বড় করে একের পর এক কথা বলেই চলেছে। তিতিক্ষা চিন্তান্বিত। তার বুবুর ওই বেহায়া বন্ধুর হঠাৎ চলে যাওয়া নিয়ে সে চিন্তিত নয়। ওই লোক যেখানে খুশি যাক! তার তাতে কি! তবে সে চিন্তিত হচ্ছে যাওয়ার এই আয়োজন দেখে। বুবু, দুলাভাই আর সেই ফুআম্মা। সবার ব্যাস্ততা দেখে মনে হচ্ছে নিনাদ বহুদূর যাচ্ছে, বহুদিনের জন্য। একটা সুখস্বপ্ন নিয়ে। যেকারণে এই বিচ্ছেদও সবার কাছে এতটা আনন্দের!
________________________
সেদিন রাত্রিবেলা তিহা, রওশানের জোরের কাছে হেরে বাধ্য হয়ে নিনাদকে সব বলতে হল। নিনাদ মুখ ভয়ানক গম্ভীর করে জানালো মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই সে দেশের বাইরে যাচ্ছে। বাইরে মানে আমেরিকা। ঢাবিতে অনার্স-মাস্টার্স শেষে একমাত্র যে লক্ষ্যটার পেছনে দিনরাত সে মরিয়া হয়ে ছুটেছিল। এখন সেই লক্ষ্যপূরনের দোর গোরায় সে দাঁড়িয়ে। জিআরই আর আয়েল্টস এর রেজাল্টের পর আমেরিকার তিনটা ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিল সে। এরমধ্যে টলেডো থেকেই শুধু গ্রীন সিগনাল আসে। তার প্রোফাইলও তাদের পছন্দ হয়। ভিসা আবেদনও শেষ। এবার শুধু ভিসা ইন্টারভিউ টা বাকি। আর দিন পনেরোর মধ্যে বোধহয় সেটাও হয়ে যাবে। তারপর সামনের মাসেই কোন একটা দিন আকাশে উড়াল দিতে হবে।
তার কথা শেষ হতেই ফোনের এপাশে তিহা রওশান সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। ফোন লাউড স্পিকারে ছিল। তিহা চেচিয়ে বলল,’তুই সত্যি বলছিস? সত্যি তোর স্কলারশিপ টা হয়ে গেছে? আমি একটুও বিশ্বাস করি না। তুই এক্ষুনি কসম কাট তো।’
নিনাদ অস্ফুট স্বরে হাসলো। বলল,’কসম কাটতে পারবো না। ভয় লাগে আমার।’
-‘যদি সত্যি যেতে পারিস তাহলে একটা কসমে তোর কি সমস্যা? আমি কিছু শুনবো না। তুই কসম কাট জলদি।’
-‘আচ্ছা, যা বইন কসম। সত্যি যাবো। ওরা যদি শেষ সময়ে আমাকে নিতে না চায় তবুও ওদের পা ধরে হলেও আমি যাবো। এখন ঠিক আছে তো?’
তিহা হাসলো। আর কিছু বলতে পারলো না। খুশিতে তার চোখে জল আসছে। কারণ সে যে জানে, তার এই বন্ধু রূপী ভাইটার পুরো জীবন কেমন শূন্যতায় মোরানো। মা, বাবা, ভাই, বোন কাছের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। সবাই তাকে রেখে বহু আগেই ওপারে নৌকা ভিরিয়েছে। শুধু রয়ে গেছে সে একা। জীবনের লড়াইটা সে তাই একাই লড়ে গেছে সবসময়। নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে। আজকের এই অর্জন তো সে সত্যিই ডিজার্ভ করে। তিহা চোখ মুছতে লাগলো। সে কাঁদলে নিনাদ কষ্ট পাবে ভীষণ।
নিনাদের কথা শুনে রওশান তখন থেকে হা হয়েই ছিল কিছুক্ষণ। এবার বলল, ‘নিনাদ, শালাবাবু, মাথা টাথা ঠিক আছে তো তোমার? ‘
নিনাদ কিছু বুঝতে না পেরে বলল, ‘কেন ভাই?’
-‘নাহয় এমন একটা খবর কি আর কেউ এমন মুখ গম্ভীর করে দেয়! মনে হচ্ছে স্কলারশিপ পেয়ে নয়। তুমি নিতান্ত অনিচ্ছায় আমেরিকার কোনো এক কারাগারে দাসত্ব বরণে যাচ্ছো!
একথার উত্তর নিনাদ মুখে দিল না। তার গগনবিদারী হাসি মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে চূড়ে খানখান করে দিল।
তিহার ধ্যান তখন এখানে আর নেই। সেই অন্ধকার রাত্রিতে, সবার মাঝে থেকেও যেন সে খুব একা অনুভব করলো। দু’হাত একত্রে তুলি আকাশের দিকে তাকিয়ে বারবার শুকরিয়া জানাতে লাগলো আরশের মালিকের দুয়ারে।
বহুদূরের কোনো এক অন্ধকার ছাদে ঠিক এভাবেই একা বসে নিনাদের হঠাৎ করা গগনবিদারী হাসির শব্দ কি আর কারো কানেও এসে পৌঁছেছিল? সেও কি কেঁপে উঠেছিল অজানা অনুভূতির শিহরণে। কে সে? তিতিক্ষা নয়তো? কে জানে!
চলবে……
আগের পর্বের লিংক-