#প্রিয়দর্শিনী🍂
#সুমাইয়া_যোহা
পর্ব-২৪
তিথি চোখজোড়া খুলে দেখে সেখানে কন্সট্রাক্টশন স্পটে অনেক শ্রমিকের ভিড়। মুহূর্তের মধ্যেই তিথি ভেতরটা ধক করে উঠে। এক অজানা ভয় যেন ওর ভিতর জেকে বসেছে। সে পাথরের ন্যায় ধীর পায়ে সেই ভিড়ের দিকে এগিয়ে যায়। ভিড় ঠেলে ভিতরে যেতেই সে মাহিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। উপস্থিত সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এমনকি মাহিমও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। সাময়িকের জন্য হলেও সে বুঝতে পারে ওর সাথে কি ঘটল। সে আশেপাশে লক্ষ করে সবাইকে সেখান থেকে চলে যেতে বলে। তারপর তিথির মাথায় হাত দিতেই তিথি ডুকরে কেদে উঠে। সে হেচকি তুলে বলে-
: জানেন আমি কতোটা ভয় পেয়েছিলাম! এই বুঝি আমি আপনাকে আবার হারিয়ে ফেললাম! আপনি আমাকে ছেড়ে প্লিজ কোথাও যাবেন না। বলুন যাবেন না কোথাও!!
তিথিকে মাহিম নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে নরম সুরে বলে-
: অবশেষে অভিমান ভেঙেছে। আমি আমার চ্যালেঞ্জের জিতে গেলাম তাই না? যদি আগে জানতাম এই একটা ইট মহাশয় তোমার অভিমান ভাঙাতে পারবে তাহলে অনেক আগেই এই ইটকে হায়ার করতাম তোমার ভাঙানো জন্য।
তিথির মাহিমের এমন বেখাপ্পা কথাবার্তা শুনে হাত ঝাড়া দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। মাহিম তিথির পেছন পেছন গিয়ে তিথি সামনে গিয়ে দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দাঁড়ায়। তিথি অশ্রু ভেজা কন্ঠে চেঁচিয়ে বলে-
: কি হলো এখানে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে গেলেন কেন? কি যেন বলছিলেন ইট হায়ার করবেন! করুন গিয়ে! কারো ফিলিংস এর কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে। খুব সহজে বলে দিলেন যে ইট হায়ার করবেন! ইট হায়ার করে নিজের মাথা ফাটাবেন? ফাটান! একজনকে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসে যে আপনার সামান্য কিছুতেই আতকে উঠে তার তো কোনো মূল্য নেই। যান গিয়ে মাথা ফাটান আপনার! এখানে এভাবে কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে যান!!
মাহিম লক্ষ্য করে দেখে তিথির গাল বেয়ে সমানে জল গড়িয়ে পড়ছে। মাহিম তিথির কাছে যেয়ে ওর চোখের জল গুলো মুছতেই তিথি চোখ বন্ধ করে হাটু ভেঙে ধপ করে বসে কাদতে কাদতে বলে-
: আমি আর পারছি না মাহিম। আমি পারছি না। নিজের সাথে আর যুদ্ধ করতে পারছি না। বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগছে আমার এতোগুলো বছর আমি কিভাবে কাটিয়েছি তা শুধু আমি জানি। আমাকে প্লিজ এবার মুক্তি দিন এসব থেকে। বাবা যখন আমাকে অন্যকারো সাথে বিয়ে আমি সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি। নিজের পরিবারকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু যদি আমি সেই মানুষটাকে বিয়ে করতাম তাহলে কখনোই না নিজে সুখী হতে পারতাম না পারতাম তাকে সুখী করতে। আমি আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি মাহিম। অন্যকাউকে আমি আমার ভালোবাসার ভাগ কিছুতেই দিতে রাজি নই।
তিথির কথাগুলো মাহিমকে আজ প্রশান্তি দিচ্ছে। অবশেষে যেই কারনে মাহিম এই শহরে এসেছিল আজকে তার সমাপ্তি ঘটল। মাহিম নিজেও হাটু ভাজ করে তিথি সামনে বসতেই তিথি ওর দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। তিথি চেহারায় যেন আজকে কোনো রুক্ষতা নেই। মাহিম মৃদু হেসে আশেপাশে লক্ষ্য না করে তিথিকে শক্ত জড়িয়ে ধরে বলে-
: আমিও ভালোবাসি আমার এই মায়াবিনীকে। যার চাহনিতে আমি পেয়েছিলাম শুধুই মায়া। ভালোবাসি, ভালোবাসি এবং ভালোবাসি!
তিথির এতোদিনের নিজের সাথে নিজের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল। মাহিমের বাহুতে সে যেন রাজ্যের শান্তি খুঁজে পায়। নিজের কান্না থামিয়ে এবার সে শীতল এবং নরম সুরে বলে উঠে-
: ভালোবাসা কখনোই অপূর্ণ থাকে না। শুধু ভালোবাসার মানুষগুলো চাইলেই সবার ভালোবাসাই পূর্ণতা পাওয়া সম্ভব।
————————————————————
অফিস টাইম হলে নিজেই এসে দেখে যেতাম। আজকে ছুটির দিন বিধায় অন্তুও আমার সাথে এসেছে। যদিও উনি এখন আগের চেয়ে অনেকটাই সুস্থ। আর দুদিন পরই উনাকে ডিসচার্জ করে দিবেন। বাবার জোরাজুরিতেই আজকে আরো আসা। মাঝে মাঝে মনে হয় অন্তু আর আমি উনার সন্তান না পান্থই যেন উনার একমাত্র সন্তান। পান্থর জন্য বাবার এতো কনসার্ন মাঝে মাঝে আমাকে অনেক হতবাক করে। তিনতলায় হওয়াতে লিফটের জন্য নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। লিফটের দরজা খুলার পর রুবিনা আন্টিকে সেখানে আবিষ্কার করি। তিনি আমাকে থামিয়ে অন্তুকে উপরে চলে যেতে বলেন। উনি আমাকে হসপিটালের দরজা থেকে কিছুটা দূরে এনে আমার গালে হাত রেখে চিকন সুরে বলেন-
: তরুনিমা আমার ছেলেটা বড্ড অন্যরকম। ও মানুষকে হাসানোর জন্য মানসিক ভাবে সবাইকে চিল মুডে রাখার জন্য সব করতে পারে।
: আন্টি আমি উনাকে যতোটুকু চিনেছি উনি যথেষ্ট ভালো মানুষ। এমনকি অনেক শান্ত শিষ্ট এবং হাসি খুশি মানুষ। যদিও উনার মাথার একটু তার ছিঁড়ে গেছে তাও আমি এইটা বিশ্বাস করি উনার লাইফে যে আসবে সি ইজ ভেরি লাকি!
আমি কথাগুলো খুবই সরল এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলি। রুবিনা আন্টি আমার কথাগুলো শুনে মৃদু হেসে বলেন-
: আমি জানি তরুনিমা। আর আমি এটাও জানি যে ও তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছে। কিন্তু বিলিভ মি ও এমনটি করেছে যাতে তুমি ভালো থাকো। তুমি তোমার আগের ফর্মে ব্যাক করতে পারো সেইজন্য এমনটা করেছে। পান্থ আমাকে তোমার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানায়নি। কিন্তু আমি তো ওর মা আমি সবই বুঝি। অফিসিয়াল পার্টিতে তোমাকে আমি দেখার পরই বুঝেছিলাম যে তুমিই সে তরুনিমা যার জন্য পান্থ বিদেশ থেকে সোজা সিলেটে চলে এসেছিল। ওর মাঝে তোমাকে হারানোর ভয় আমি লক্ষ্য করেছি। তাই হয়তো সেদিন আমাকে বলেছিল যাতে ওর বাবাকে বলে তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই। জানি না আহসান শাহরিয়ার তোমার বাবার সাথে কথা বলেছিলেন কিনা? তুমি সব জানার পর তোমার ডিসিশন কি হবে তা আমি জানি না। তবে আমি এতোটুকু জানি আমার ছেলে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আর ও কখনোই তোমাকে ছেড়ে দেয়ার কথা ভাববে না। পরিস্থিতি যাই থাকুক সে তোমাকে আঁকড়ে ধরে রাখা চেষ্টা করবে।
রুবিনা আন্টি কথাগুলো শেষ করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যান। আমি সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রুবিনা আন্টির কথাগুলো যেন আমাড়র মস্তিষ্কে বারবার নাড়া দিচ্ছে।
: পান্থ আমাকে ভালোবাসেন? উনি আমাকে বিয়ে করতে চান? বিদেশ থেকে ছুটে এসেছেন? উনি আদৌ সব জানেন আমার ব্যাপারে? মাথায় কোনো কিছু কাজ করছে না। সব প্রশ্নের উত্তর আমাকে জানতে হবে।
তাড়াহুড়ো করে লিফটে গিয়ে তিন তলায় উঠে পান্থর কেবিনে যেতেই দেখি পান্থকে ডাক্তার চেকআপ করছেন। অন্তু রিন্তা সবাই সেখানে আছে। ডক্টর আমাকে দেখে একটা মেকি হাসি দিয়ে বলেন-
: পেশেন্ট ঠিক আছে। চিন্তার কিছু নেই। এক্সকিউজ মি..
ডক্টর পান্থর কেবিন থেকে তাড়াতাড়ি করে কেটে পড়তেই অন্তু অট্টহাসি দেয়। পান্থ অন্তুর দিকে হ্যাবলার মতো তাকাতেই অন্তু হাসতে হাসতে বলে-
: আরে পান্থ ভাইয়া আপনি জানেন না, ওইদিন তরু আপু ডক্টরের উপর কিভাবে ক্ষেপে গিয়েছিল! ডক্টরের পরে নিজের বিপি কন্ট্রোল করার জন্য মেডিসিন নিতে হয়েছে।
অন্তু গড়গড় করে ওইদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো বলে দেয়। আমি অন্তুর দিকে চোখ রাঙালে অন্তু চুপ হয়ে যায় কিন্তু পান্থ আমার দিকে তাকিয়ে হুট করে হেসে দেয়। আমি পান্থর চেহারায় উনার সেই হাসিটা আবার দেখতে পেয়ে নিজের ভেতর যেন এক স্বস্তি খুঁজে পাই। উনি আমার দিকে তাকাতেই আমি সেখানে আর এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে আসি।
: উনাকে এখন আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবো না এমনকি কোনো কিছুর জন্য ফোর্স করা ঠিক হবে না। পান্থকে আমি এখন কিছু জিজ্ঞেস করতে না পারলেও একজনের কাছে আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর পেতে পারি। হুমম… তার কাছেই যাবো।
#প্রিয়দর্শিনী🍂
#সুমাইয়া_যোহা
পর্ব-২৫
রিন্তা পান্থর কেবিন থেকে বেরিয়ে সোজা হাটা শুরু করে। পিছন থেকে অন্তু ডাক দিতেই রিন্তা পেছন ঘুরে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে তাকাতে অন্তু স্মিত হেসে বলে-
: আপনি কোনো কারনে আমার বোনের উপর বিরক্ত?
: কেন বলুন তো?
রিন্তা অন্তুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিতে অন্তু সাবলীল ভঙ্গিতে বলে-
: না মানে বেশ কয়েকদিন যাবত লক্ষ্য করছি, আপনি তরু আপুকে পান্থ ভাইয়ার কেবিনে দেখলেই আপনার চেহারায় অমাবস্যার চাঁদ নেমে আসে। আমার জানা মতে তরু আপুর সাথে আপনার তেমন শত্রুতা নেই যার জন্য আপনি এমন বিরক্ত হবেন। তাই নয় কি?
: তা একদম ঠিক বলেছেন। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন বন্ধু হতে যেমন বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না, ঠিক একইভাবে শত্রু হতে বেশি সময় লাগে না। সময় হলেই জানতে পারবেন আমি তরু আপুর উপর সন্তুষ্ট নাকি বিরক্ত! আমার ক্লাস আছে। গুড বাই।
রিন্তা অন্তুকে অনেগুলো কড়া কথা শুনিয়ে চলে যায়। অন্তু হতবাক হয় সেখানে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে। অন্তু বুঝতে পারল না, ও এমন কি কথা বলল যার ফলশ্রুতিতে রিন্তা ওকে এতো কথা শুনিয়ে চলে যায়।
এদিকে মিসেস রুবিনা বাসায় এসে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দেখেন মাহিমের অনেক মিসড কল পরে। মিসেস রুবিনা কল ব্যাক করতেই মাহিম রাগান্বিত সুরে বলে উঠে-
: মামনি পান্থ যে হসপিটালে সেইটা কি একবারও মনে হলো না যে আমাকে জানানো দরকার? তোমরা আমাকে কিছুই জানাও নি। বাবাও আমাকে কিছুই বলেনি।
: আমরা চাইনি তুমি চিন্তা করো। তাই তোমাকে জানায় নি। আর তুমি জানলে তুমি সবকিছু ছেড়ে চলে আসতে।
: আর এক ঘন্টা পর আমার ফ্লাইট। আমি আসছি। আর হ্যাঁ তিথিও আমার সাথে আছে।
মিসেস রুবিনা মাহিমের কন্ঠে তিথি না শুনে তার চেহারায় মুহূর্তে উজ্জ্বল আভা ধারন করেছে। তিনি হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বলেন-
: তার মানে মাহিম তুমি তিথিকে খুঁজে পেয়েছো?
: হুমম.. মামনি পেয়েছি। আর তাকে সাথে নিয়েই ফিরছি।
: ঠিকাছে আসো তুমি! আমি তোমার বাবাকে খরব দিচ্ছি। আর শুনো পান্থকে কিছু জানিও না এখন। ওকে সারপ্রাইজ দিও। তাড়াতাড়ি আসো বেটা। আই এম ওয়েটিং।
রুবিনা কল কেটে আহসান শাহরিয়ারকে ফোন দিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বলেন-
: কনগ্রাচুলেশন মি: আহসান শাহরিয়ার। দুই ছেলের বিয়ের সব এরাজমেন্ট শুরু করুন! আমি আজ খুশি। আমার ছেলেরা তাদের ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে।
মিসেস রুবিনা নিজের কথাগুলো শেষ করে কট করে ফোনটা কেটে দেন। ওইদিকে আহসান শাহরিয়ার তার সহধর্মিনীর কথাবার্তার আগাগোড়া কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি তার সেক্রেটারীর দিকে হ্যাবলার মতো ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বলেন-
: আপনার ম্যাডামের জন্য মেইবি পাবনার হাসপাতালের টিকিট বুক করা লাগবে। উনি পাগল হয়ে গেছেন।
: কি বলছেন স্যার আপনি এগুলো? ম্যাডাম পাগল হবে কিভাবে?
সেক্রেটারী প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো প্রতিউত্তর করলেন না। পরক্ষণেই মিসেসে রুবিনার কথাগুলোর অর্ধেক মানে বুঝতে পেরে তিনি নিজেই হু হা করে হেসে দেন।
———————————————————–
দরজায় সমানে কলিং বেল বাজিয়ে চলেছি। প্রায় দশ মিনিট পর দরজা খুলতে মেহু ভাবি আমাকে দেখে চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। আমাকে সকাল সকাল এইভাবে দেখবে সেইটা হয়তো ভাবির বোধগম্য হয় নি। আমি ভাবির মুখের সামনে আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজাতেই তিনি ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে অন্যমনা হয়ে চমকের সুরে জিজ্ঞেস করে-
: তুমি এখানে তরু? তাও এতো সকালে! তোমার তো আগামী মাসে আসার কথা ছিল! মেইবি কাজ শেষ হয়ে গেছে।
: ভেতরে ঢুকতে দিবে না?
: অবশ্যই কেন নয়?
বাসার ভেতর ঢুকতেই কাউকে না দেখতে পেয়ে ভাবির থেকে জানলাম সবাই ঘুমোচ্ছে। একদিকে ভালোই হয়েছে কারন হুট করে সিলেট চলে আসাতে সবাই মেহু ভাবির মতো চমকে উঠত। আর এতো মানুষের প্রশ্ন সম্মুখে পড়ার মতো পর্যাপ্ত সময়ও আমার হাতে নেই। আমি ভাবিকে নিয়ে আমার রুমে যেতেই দেখি ঘরটা আগের মতোই গুছিয়ে রেখেছে ভাবি। ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে দরজা লক করতেই ভাবি আমাকে উদগ্রীব হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আমিই বলি-
: পান্থ কি আমাকে ভালোবাসেন ভাবি?
তরুনিমার থেকে এমন প্রশ্ন মেহু আশা করতে না পারায় সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তরুনিমা মেহুর দুই বাহু চেপে জোরে ঝাকিয়ে উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করে-
: কি হলো ভাবি! বলো! পান্থ কি আমাকে ভালোবাসেন?
: সেইটা তুমি পান্থকেই জিজ্ঞেস কর। এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার জন্য তুমি ঢাকা থেকে সিলেটে আসোনি?
: ভাবি আমাকে প্লিজ তুমি সত্যিটা বলো। রুবিনা আন্টি বলেছেন যে পান্থ আমাকে ভালোবাসেন। আর…
তরুনিমা মেহুকে মিসেস রুবিনার সাথে ওর কথোপকথনের সব কথা বললে মেহু স্মিত হেসে সাবলীল কন্ঠে বলে-
: রুবিনা আন্টি কোনো কিছু মিথ্যে বলেনি। হ্যাঁ! পান্থ তোমাকে ভালোবাসে। পান্থ তোমাকে অনেক আগে থেকেই চিনে। কিন্তু কখনো আমাকে বলেনি। আমি তখন জানতাম না আমার ফ্রেন্ড পান্থ যেই মেয়েকে ভালোবাসে সেই মেয়ে আমার হাসবেন্ডের ছোট বোন তরুনিমা।
তরুনিমা বাকহীন দৃষ্টিতে মেহুর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহু একটা ছোট শ্বাস ফেলে আবার বলে-
: বিয়ের সময় পান্থ দেশের বাইরে ছিল। আমি আমাদের বিয়ের কিছু পিকচার ওকে পাঠাই সেখান থেকেই পরে জানতে পারি যে তুমি তার প্রিয়দর্শিনী।
প্রিয়দর্শিনী শব্দটা শুনে তরুনিমা চমকে উঠে। সে অস্ফুট কন্ঠে বলে-
: প্রিয়দর্শিনী?
: হুমম.. প্রিয়দর্শিনী। তবে তোমাকে প্রিয়দর্শিনী ডাকার কারনটা আমার অজানা। এর উত্তর একমাত্র সেই দিতে পারবে। তবে এতোটুকু জানি যে তুমি সত্যিই ওর প্রয়দর্শিনী হবার যোগ্য।
তরুনিমা মাথা যেন পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। মেহু তরুনিমার পাশে বসে ওর কাধে হাত রেখে বলে-
: তরুনিমা তুমি খুব লাকি যে পান্থর মতো একটা মানুষ তোমার লাইফে এসেছে। তোমার হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে যাওয়া, যেই তরুনিমার প্রতিচ্ছবি আমি মিনহাজে মুখে শুনে নিজের কল্পনায় তৈরি করে রেখেছিলাম সেই তরুনিমাকে বাস্তবে যে পুরোই সেই প্রতিচ্ছবির বিপরীত মেরুর মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করবো ভাবতে পারিনি। হয়তো কোনো এক কারনে তোআর পরিবর্তন হয়েছিল। কিন্তু যেদিন পান্থর সাথে তুমি ওকে শহর ঘুরালে তারপর বাসায় আসার পর তোআর আচরনে আগের তরুনিভা প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করে কবির আঙ্কেলের চাহনিতে সামান্য হাসি ফুটে উঠতে দেখেছিলাম সেদিনই বুঝতে পেরেছি যে পান্থর চেয়ে বেটার কেউ আমাদের আগের তরুনিমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
তরুনিমা আয়নার সামনে থেকে সরে এসে জোরালো কন্ঠে চেচিয়ে বলে–
: ভাবি প্লিজ! অনেক হয়েছে! আগের তরুনিমা আর বর্তমানের তরুনিমা দুজনই একই মানুষ ছিল। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে!
মেহু তরুনিমার হাত ধরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সাভনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে নিজের তর্জনী আঙুলটাকে আয়নায় প্রতিফলিত সেই মানুষটার দিকে উদ্দেশ্য করে বলে-
: আয়নার নিজের প্রতিবিম্বটাকে লক্ষ্য করে বলতে পারবে যে আগের তরুনিমা আর বর্তমানের তরুনিমার মাঝে এক চুল পরিমাণও কোনো ফারাক নেই! পারবে বলতে তরু! যদি পারো তাহলে আমি মেনে নিব!
তরুনিমার আয়নার দিকে নিজের প্রতিবিম্বটা দেখে কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তার চোখের কোটর থেকে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মেহু সেইটা লক্ষ্য করে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে-
: সবার থেকে মিথ্যে বললেও নিজের থেকে নিজের সত্যটাকে কিভাবে লুকিয়ে রাখবে?
: কি করবো আমি ভাবি! কি করবো! যাকে পাঁচটা বছর ভালোবেসে এসেছিলাম, যার নিজের পায়ের মাটি যেন শক্ত করে দাঁড়ানোর জন্য অপেক্ষা করছি সেই আমার পায়ের মাটি সরিয়ে নিয়ে চলে গেল! নামমাত্র অজুহাত দিয়েছিল তার নাকি পরিবার মেনে নিবে না! হাহ..! আর যেই বেস্ট ফ্রেন্ডকে নিজের বেস্টি না নিজের আপন বোনের চেয়েও বেশি মর্যাদা, বেশি বিশ্বাস করেছি, যার জন্য পারলে নিজের সবকিছু উৎসর্গ করে দিতাম সেই মানুষটাও শেষ পর্যন্ত ঠকালো! কিভাবে বিশ্বাস করবো বলো আবার! কিভাবে!
তরুনিমা মেঝেতে ধপ করে বসে মৃদু শব্দে কাদতে কাদতে থাকে। মেহু তরুনিমার সামনে বসে নিজের দুই হাতে তালুতে তরুনিমার গাল রেখে আশ্বস্ত কন্ঠে বলে-
: আরো একবার বিশ্বাস করে দেখো। আমি বলছি এইবার তুমি ঠকবে না।
তরুনিমা চোখ ছলছল করে তাকিয়ে আছে মেহুর দিকে। মেহু ওর চোখের জল গুলো মুছে দিয়ে স্মিত হেসে বলে-
: তরু একটা কথা মনে রেখো, প্রথমবার ভুল মানুষকে ভালোবেসে ঠকে যাওয়াতে ব্যর্থতা নেই। বরং সঠিক মানুষটাকে দ্বিতীয়বার ভালোবাসতে না পারাটাই হবে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। তাই বলছি দ্বিতীয়বার নিজেকে সুযোগ দিয়ে দেখো। সমাপ্তিটা অন্যরকম হলেও হতে পারে।
#চলবে____
(।)