ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ১৯

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব -১৯

“দেখছো আম্মু বলছিলাম না মনে কস্ট নিবা না। জামাই কি সুন্দর চলে আসছে শশুরবাড়িতে তোমাকে নিতে। বোকা মেয়ে একটা, জামাই আসবে আগে বলবে না আমাকে!!! কিছুই তো আপ্যায়ন করতে পারিনি ভালো ভাবে। জামাই তো মাশাল্লাহ।
প্রিমা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আন্টির কথা শুনে। আমার রিয়াকশন বোঝার চেষ্টা করছে।

আন্টির হাসিমাখা মুখ দেখে অন্তর থেকে চাইছিলাম আরও অসংখবার উনাদের বাড়িতে সাব্বির কে নিয়ে আসি। এই বাসার ছাদে আমার আর প্রিমার বানানো মিনি উদ্যানে সাব্বিরকে জরিয়ে ধরে জোছনাবিলস করি।
একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাম। জানালার বাইরে দিয়ে আসা হালকা রোদে সাব্বির থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছি না। আমি ভয়ংকর ভাবে সাব্বিরের প্রেমে পড়ে গিয়েছি!!! বুকের ভেতর কেমন চাপা একটা কস্ট তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। কারণ এখন অক্টোবর মাস, জানুয়ারি থেকে আমার মার্স্টারস শুরু হবে।

কোনো ফ্রেন্ডের বাড়িতে এইভাবে কেউ জামাই আদর পেয়েছে বলে মনে হয়না। আমার সাথে কি কি দিয়ে দিবে শশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে সেটা নিয়ে দুই মা মেয়ে ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে আছে!!! একটু পর পর এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন আমার শশুর শাশুড়ী কি কি খেতে পছন্দ করেন!!!! আঙ্কেল বাজারে গিয়েছেন মৌসুমি সব ফ্রুটস কিনবেন বলে!! গতকালকের জন্য মন খারাপ করবো নাকি আজকের জন্যে খুশি হবো বুঝতে পারছি না।

ঝামেলার ব্যাপার হলো সাব্বির আমাকে এক মিনিটের জন্যেও ওর চোখের সামনে থেকে যেতে দিচ্ছে না। বিরক্ত চোখমুখ নিয়ে গেস্টরুমে ওর সামনে বসে আছি। কোনো কথাও বলছে না আমার সাথে। মিটিমিটি করে হাসছে শুধু। এই হাসি আর কিছুক্ষণ দেখলে নির্ঘাত উল্টো পালটা কিছু করে ফেলবো!!
ছি! কেমন হয়ে গিয়েছি আমি!! পাচ বছরের রিলেশনের কথা সব ভুলে গিয়েছি আমি!! বাট হোয়াই??
নাহ এইভাবে ভাবলে চলবে না। এই মায়ায় পরে গেলে ওকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবো না। মায়া বড্ড খারাপ জিনিস। একবার এই বাধনে জড়িয়ে গেলে পা পিছলে আবার পিছনে পড়ে যাবো!!

“আম্মু,এখন থেকে আমার দুই মেয়ে। এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, আর একটা বাকি। এই বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ে যেনো তার বুড়ো বাবা মাকে দেখতে না ভুলে। পরের বার এসে এক সপ্তাহ জামাইকে নিয়ে থাকা চাই। এর কম হলে কথা বলবো না আমি। কেউ যেনো এই কথা মনে রাখে।” বিদায়বেলায় কান্নাভেজা চোখে আন্টির এমন কথায় উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আবার আসবো ওকে নিয়ে, ইনশাআল্লাহ।
হাসি মুখে উনাদের বিদায় দিলাম। শুধু প্রিমার মুখে হাসি নেই। আমার মনে মনে করা টেনশন করা গুলো ওর চোখেমুখে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে ।

সাব্বির নিজেই ড্রাইভ করছে। গাড়িতে উঠেই আমি ঘুম। সাব্বির আর ফয়সালকে নিয়ে কয়েকটা সপ্নও দেখে ফেলছি!!!! কিন্তু কি দেখেছি ভুলে গিয়েছি।
চোখে লাইটের আলোতে ঘুম ভাঙতেই দেখি তিনশো স্কয়ার ফিটের আর একটু সামনে কোথাও খুব সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা নরমালি ঢাকায় কাচপুর দিয়ে ঢুকি। এদিক দিয়ে কেনো আসলাম কে জানে!!
সাব্বির চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
-কিছু বলবা?
-নামো।
– আমি হিজাব পরিনি। নামতে পারবো না। মাগরিবের নামাজ মিস করে ফেলেছি, ডাকো নাই কেনো?
-তুমি কখন আমাকে ডাকতে বললে?
-ও বলি নাই!
এই প্রথম সাব্বির নরমালি কথা বলছে আমার সাথে!! খুশিতে কি কথা বলবো ওর সাথে বুঝতে পারছি না!!
-হিজাব লাগবে না। ওড়না ভালোভাবে পেচিয়ে বের হও।
নামাজ পরার মতো করে ওড়না দিয়ে বের হলাম। রেস্টুরেন্টটা সত্যিই অনেক সুন্দর। খুশি হওয়ার বদলে ভয় হচ্ছে কেনো জানি। সাব্বিরের সাথে একা কোথাও যাইনি এর আগে। কেমন কেমন জানি লাগছে।
একজন ওয়েটার এসে সাব্বিরকে স্যার স্যার করে টেবিল পর্যন্ত নিয়ে গেলো। আজব তো!!!
সন্দিহান চোখে কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছি। হালকা পিংক কালারের সাথে হলুদ রঙের মিশ্রণের অসাধারণ এক কম্বিনেশনের আলোতে সাব্বিরকে ভয়ংকর রকম সুন্দর লাগছে!!
মাথা কেমন ঝিম ঝিম করছে!! সাব্বির তো আমাকে আমার মতো করে ফিল করে না এই ভেবে দুচোখ হঠাৎ পানিতে ভরে গেলো। কতটা কস্ট হচ্ছে বলে বোঝানো যাবে না। হৃদয় কাঁপানো প্রেমটা তাহলে আমার হয়েই গেলো!!! ফয়সালের জন্যে কখনো আমার এই অনুভূতি হয়নি।
অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি লুকোনোর চেষ্টা করছি।

“কি দোস্তো, ভাবিকে নিয়ে এতো সুন্দর রেস্টুরেন্টে তো ভালোই মজাই আছো”। অপরিচিত কারো গলার স্বর শুনে তাকালাম কিন্তু কে চিনতে পারলাম না। হয়তো সাব্বিরের কোনো ফ্রেন্ড হবে।
-ভাবি…….. আপনার থুতনির খাজে মরে গিয়েছি। আর ঠোঁটের নিচে তিল, ঠোঁটে তিল, ইশ!! ভাবি ইশশশ,,,!! হাসলে দেখি গালে ডিম্পলও পড়ে!!!!! সব প্রেমে পড়ার সাইন একসাথে!!! সাব্বির তো মনে হয় আপনার প্রেমে মরে ডুবে বঙ্গপোসাগরের তলায় চলে গিয়েছে।
কেনো যে আপনার সাথে সাব্বিরের আগে আমার দেখা হয়নি!!! ধুর, কি করলাম জীবনে!!
আপনি যতগুলো কথা এখন বলেছেন তার সিকিভাগও যদি সাব্বির আমাকে বলতো, হাসিমুখে সারাজীবন ওর মেন্টাল টর্চার গুলো সহ্য করতাম আমি। মনে মনে কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে মুচকি হেসে বললাম ভালো আছেন ভাইয়া?
-ধুর, খেলা শুরুর আগেই আপনি আমাকে ডিস্কোয়ালিফাইড আর সাব্বিরকে উইনার বানাই দিলেন। এটা ঠিক না ভাবি।
“কাজের কথায় আসি। তারাতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।” সাব্বিরের কথায় রাগের আভাস পেয়ে প্রচন্ড ভয় পেলাম আমি।
-বন্ধু তোমার বউ নিয়ে কেউ ভেগে যাবে না আর সেই চিন্তা করার সাহসও কেউ করবে না।
ওয়েটার খাবারের অর্ডার নিয়ে চলে গেলো।
“খাবার আসার আগেই কাজের কথা শেষ করি। শুভ আমরা দুজন ডিভোর্স চাই। যত তারাতাড়ি সম্ভব।”
ওর ফ্রেন্ড অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
আর আমার কথা না হয় নাইবা বললাম। অবচেতন মন হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছিলো এমন কিছু একটা হবে, তাইতো আরও বেশি কস্ট পাওয়ার জন্যে এই ধোয়াশাময় গভীর প্রেমে ক্রমান্বয়ে অতলে তলিয়ে যাচ্ছি!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here