ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ১৭

#ঝরা পাতার দিন গুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব -১৭

কেউ দেখে ফেলার আগেই বাড়ির পিছন দিয়ে বের হয়ে গেলাম। গন্তব্য প্রিমার বাসা। একমাত্র এই একটা জায়গায় আছে যেখানে আমি বিনা সংকোচে যেতে পারি।
দরজা খুলে অানটি আমাকে দেখে জরিয়ে ধরে সেকি কান্না!!! আর বিলাপ করে কতো কিছু বলছেন!! ইশ পুরো মায়ের মতো করে আদর করছেন উনি।।

-আমার বাড়িতে যখন খুশি তখন আইবা আম্মু। আইজকা থেকে এইটা তোমারও বাড়ি। জামাইকে শশুর শাশুড়ী নাই বলে মন খারাপ করতে মানা করবা। জামাইকে নিয়ে এইখানে আসবা। আজকে এইখানে আসছো, থাকবা আর কালকে জামাইকে আইসা নিয়ে যাইতে বলবা, ঠিক আছে আম্মু?
আমি স্মিত হেসে মাথা ঝাকিয়ে আচ্ছা বললাম।
-আম্মু তুমি কি খাইবা বলো আমারে। কত শুকাই গেছো তুমি জানো সেইটা? চেহারাটা কেমন কালো হয়ে গেছে। গতকালকে সারাদিন কিছু খাও নাই তাই না আম্মু? চোখের নিচে কালি কেনো পড়ছে আম্মু? রাতে ঘুমায়তে পারো না শান্তিতে তাই না?

এই ভদ্রমহিলা আর কিছুখন থাকলে আমি হাউ মাউ করে কান্না শুরু করে দিবো। আম্মু মারা যাওয়ার পর এই প্রথম কেউ এইভাবে আমার খোজ খবর নিলো!!!!

উনি রান্না ঘরে যেতেই প্রিমাকে দরজা আটকাতে বললাম। সিগারেট ধরালাম একটা। আমাকে সিগারেট ধরাতে দেখেই প্রিমা বুঝে গেলো আমার লাইফে আবার সিরিয়াস কিছু হয়েছে। তিনটা সিগারেট খাওয়ার পর চার নাম্বারটা ধরাতেই অানটি দরজায় নক করলেই নাস্তা করার জন্য। নাস্তা করে রুমে এসে প্রিমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলাম।

-কি হয়েছে মেহের বলবি না আমাকে?
-জানিস প্রিমা, আমি তখন ক্লাস ফোরে প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। মেহনাজ আপু সবে এসএসসি পরীক্ষা দিলো। মুবাশশিরা আপু কলেজে আর মিরা আপুর বিয়ে হয়ে একটা বাচ্চাও হয়ে গিয়েছে। বড় ভাইয়া নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। মেজো ভাইয়া জাহাঙ্গীরগর বিশ্বব্বিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রিতে পড়ে। আর ছোট ভাইয়া গ্রামের হাই স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়তো। কি সুন্দর ছিলো আমাদের ফ্যামিলি!!!! খুব বেশি টাকা পয়সা আমাদের ছিলো না হয়তো। কিন্তু কোনো কিছুর অভাব ছিলো না।কেমন করে জানি সব ভাইবোন আমরা সব সিচুয়েশনে মানিয়ে নিতে পারতাম।
বাবা নিজেও একজন স্কুল শিক্ষক তাই তার খুব ইচ্ছে যেমন করেই হোক সবাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন। কিন্তু জানিস, এই চিন্তাটায় মনে হয় আমাদের জন্যে কাল হলো!!

আব্বু ছোট ফুপি আর মেজো ফুপির কথা খুব শুনতেন। আপুরা যখন একটু বড় হলো ফুপিরা যখনই বাড়ি আসতো বার বার শুধু মুবাশশিরা আর মেহনাজ আপুর বিয়ের কথা বলতো। বলতো গ্রামের মেয়ে এতো পড়ে কি হবে। তারাতাড়ি বিয়ে দিয়ে দাও, আরো কতকিছু বলতো। মজার ব্যাপার কি জানিস, এই দুই ফুপিকে নিয়ে আব্বু আম্মুকে বিয়ে করে অন্য জায়গায় থাকতো শুধু উনাদের পড়াশোনা করানোর জন্য।

আমার সব ভাইবোনরাই অনেক ফরসা। শুধু আমার গায়ের রঙটাই শ্যামলা। এমনকি ছোট ভাইয়াও আমার থেকে ফরসা।
সব থেকে সুন্দরি ছিলো মুবাশশিরা আর মেহনাজ আপু। গ্রামের কতো ছেলে চিঠি পাঠাতো আপুদের। কিন্তু ওরা কেউ সেগুলো গোনায়ও ধরতো না।
ছোট ফুপি আব্বুকে অনেক হাবিজাবি বুঝিয়ে মুবাশশিরা আপুর থেকে বয়সে সতেরো বছর বড় এক বিদেশি লোকের সাথে বিয়ে দিলো।
ঠিক এর দুই মাসের মাথায় তেমন কোনো কারণ ছাড়াই আপুর ডিভোর্স করিয়ে দিলো। ব্যস, আমার সবথেকে রুপে গুনে গুনবতি বোনটার কপালে কলংকের দাগ লেগে গেলো।

এরপর আবার আপু পড়াশোনা শুরু করলো। কলেজের রেকর্ড করা রেজাল্ট টা এখনো মুবাশশিরা আপুর দখলে।

রিশাদ ভাইয়া ছিলো মেহনাজ আপু থেকে চার বছরের বড়। সেই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। মেজো ফুপির সেকি গর্ব ছেলেকে নিয়ে। তার ছেলে এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডে থার্ড হয়েছে,নটরডেমে পড়ছে,শিউর বুয়েটে চান্স পাবে।

মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসলে জোর করে সাব্বিরের কাছে আমাকে পড়তে বসাতো। গ্রামের মেয়ে কি না। একটু পড়ালে পরিক্ষায় যদি পাশ করতে পারি!! কিন্তু পড়ানোর সময় সাব্বিরের বেশিরভাগ কথায় আমার মাথার উপর দিয়ে যেতো। কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগতো।
পাশের বাড়ির এক ফ্রেন্ডকে বলতেই বললো আমি নাকি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। এবং এখন যদি এই কথা না বলি তাহলে আর ভালোবাসা হবে না। এই ভালোবাসা মানে কি সেটাই তখন জানতাম না আমি!!!

পরের দিন ঐ ফ্রেন্ডের জোরাজুরিতে সাব্বিরকে পুকুরপাড়ে ডেকে নিয়ে এসে বললাম
-“ভাইয়া তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।”
-“কি কথা?”
-“তোমাকে দেখলেই বুকের ভেতর কেমন কেমন জানি করে”
একসাথে অনেকগুলো কথা বলে থামলাম কিছুক্ষন। অন্য সময় হলে হয়তো প্রিমা বলতো, তুই তো ছোট থেকেই এমন ছিলি। কুত্তি একটা। এর জন্যই তো তোর কোনো বোন প্রেম করে নাই আর তুই প্রেমের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে আছিস!
ওর কোল থেকে মাথা উঠিয়ে রকিং চেয়ারটায় বসে একটা সিগারেট ধরালাম।
আবার বলতে শুরু করলাম।
এরপর সাব্বির সবার সামনে অনেক বেইজ্জতি করলো আমাকে। কি বলেছি সেটা না বলে নাকি দয়া দেখিয়েছিলো সেদিন!!
আব্বু কি মারটাই না মারলো আমাকে!! ভিষণ জেদ চেপে গিয়েছিলো। পরের বার পুরো উপজেলায় প্রথম হয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। আর ছোট ফুপি কি বলেছিলো জানিস? বলেছিলো গ্রামের স্কুলতো তাই বৃত্তি পাওয়া খুব সহজ।

মেহনাজ আপু তখন কলেজে ভর্তি হলো। আর রিশাদ ভাইয়ার আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া বেড়ে গেলো। বিষয়টা নিয়ে প্রথমে কেউ মাথা না ঘামালেও যখন রোজার ঈদে সবাইকে ড্রেস কিনে দিলো তখন আম্মু খুব টেনশনে পরে গেলো।
আম্মু খুব ভদ্রভাবে ভাইয়াকে বুঝিয়ে বললো যেনো এই বাড়িতে আর না আসে। কিন্তু ভাইয়া কারো কথায় শুনতো না।
মেজো ফুপি ব্যাপারটা জানতো না সেটা না, কিন্তু উনি সবটাই আমাদের উপর চাপিয়ে দিতো আর আম্মুকে কথা শুনাতো।
এতো কিছুর মাঝেও যখন ভাইয়া বুয়েটে ভর্তি পরিক্ষায় প্রথম হলো তখন ফুপির কথা বলার লিমিটা টাও ক্রস হয়ে গেলো।

দিন দিন রিশাদ ভাইয়ার এই বাড়িতে আসা যাওয়া বাড়তেই থাকলো। ভাইয়া বাড়িতে আসলে আপু এখন ঘর ছেড়েই বের হয়ে অন্য কোথাও চলে যায়।
তারপর একদিন ছোট ফুপি আর মেজো ফুপি আমাদের বাড়িতে এলো।
বড়দের কথার মাঝে থাকতে নেই এই বলে আম্মু আমাদের ছোট দুই ভাইবোনকে বের করে দিয়েছিলো ঘর থেকে।
সেদিন কি হয়েছিলো বাসায় জানি না কিন্তু বাসায় এসে দেখেছিলাম মেহনাজ আপু চোখে মুখে প্রচন্ড রাগ নিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে। আর আম্মু আঁচলেে বার বার চোখ মুছতেছিলো।
এর পর থেকে আব্বু বাদে আমাদের কোনো ভাই বোন অনেক বছর যাবত ফুপিদের বাসায় যাইনি।

ক্লাস এইটে পড়ার সময় সেদিনকার ফুপিদের বলা কথাগুলোর মধ্যে দুইটা কথা শুনেছিলাম তার মধ্যে একটা ছিলো আমার বাবা সব কুকুর বেড়ালের ছাও নাকি পয়দা করছে, সে জন্য আমদেরকে পালতে নাকি ফুপিদের কাছে বার বার হাত পাতা লাগে!!! আর একটা ছিলো আমাদের নিজেদের শহরে যাওয়ার সামর্থ নেই তাই বড়লোক ফুপির ছেলের পিছনে আপুকে লাগিয়ে দিয়ে দিয়েছে!!!!!
বাকি কথা গুলো শোনার ইচ্ছেটা তখন মরে গিয়েছিলো।

সেদিনের পর রিশাদ ভাইয়া একবার এসেছিলো। ততোদিনে ভাইয়ার উল্টো পালটা কাজ কর্ম শুরু হয়েছে। আমার আম্মু আপুরা অনেক ধার্মিক ছিলো। স্কুলে পড়া সত্তেও খুব স্ট্রিক্টলি পর্দা করতো।
ভাইয়া এসেছিলো আম্মুকে জিজ্ঞেস করতে ভাইয়া যদি আরবি নিয়ে পড়াশোনা করে তাহলে আম্মু ভাইয়ার কাছে আপুকে বিয়ে দিবে কিনা!!!!

আম্মু সেদিন ভাইয়াকে কি বলেছিলো জানি না কারণ সেদিনের পর ভাইয়া এই বাড়িতে আসেনি। আর ভাইয়া পরের বছর বুয়েট ছেড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ডবার এডমিশন টেষ্ট দিয়ে আরবিতে ভর্তি হয়েছে!!!
প্রতি ইয়ারে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ভাইয়া ফাইনাল ইয়ারে এসে যখন বুঝতে পারলো যে আপুর সাথে ভাইয়ার বিয়েটা হবে না আর সেটার জন্যে দায়ি তার ফ্যামিলি তখন থেকেই ভাইয়া পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি বিগড়ে গেল!!!!

আর আপু অনার্সে সকল জাতীয় বিশ্বাব্বিদ্যালয়ের সম্মিলিত মেধা তালিকায় সেকেন্ড হলো!!!
মাস্টার্সেও সেইম রেজাল্ট!!
আর এর পরের বছর লন্ডনের এক নামকরা বিশ্বাব্বিদ্যালয়ের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসররের সাথে আপুর বিয়ে হয়ে আপু লন্ডন পাড়ি জমালো।
আমি যখন ক্লাস নাইনে উঠি মেজো ভাইয়া আমাকে সাইন্সে ভর্তি করালো সেটা নিয়ে ছোট ফুপির কি হাসাহাসি!! কি টিটকারি মার্কা কথা!!

মেজো ফুপি ততোদিনে নিজের করা ভুল বুঝতে পেরে গিয়েছে। বার বার আমাদের বাড়ি আসে যেনো আম্মু আব্বুর মন গলে আপুকে ভাইয়ার সাথে বিয়ে দেয়। কিন্তু আব্বু অনেক কস্ট পেয়েছিলো ফুপিদের সেদিনের কথায়। তাই এই বিয়ে আর হয়নি আর রিশাদ ভাইয়ার অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছিলো।
ফুপির সাথে যখন সাব্বির ভাইয়া আসতো, তখন ভাইয়ার হাব ভাব দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম একি কাহিনির পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে!!!!

সেদিন ছোট ফুপি আমাকে সাব্বিরের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে বলেছিলো এক মেয়ে দিয়ে পারে নাই তাই আর এক মেয়েকে পিছে লাগাই দিছে!!!!!!!
তাও আবার মেজো ফুপির সামনে আর ফুপি কিছুই বলেনি এর বিরুদ্ধে!!!!!

ভেবেছিলো হয়তো আমি কথাটা শুনতে পাইনি, কিন্তু সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য ক্রমে আমার কানেই কথাটা চলে এসেছে!!!
সাব্বিরের সাথে এর পর থেকে আর একটা কথাও বলিনি। যখন চিটাগং এ দুজনেই ভর্তি হলাম তখনও না। ওকে মাথা আর লাইফ থেকে দূরে রাখার জন্য ফয়সালের সাথে রিলেশনে জড়াই।
এর মাঝখানে অনেক বার ফুপিকে দিয়ে সাব্বির বাসায় বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছে। কিন্তু আম্মু আব্বু কেউ রাজি হয়নি।
প্রিমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম,
বলতো প্রিমা আমার সাব্বিরকে বিয়ে কিংবা প্রেম করতে না চাওয়াটা কি অনেক বড় কোন দোষ ছিলো???
প্রিমা চুপ করে চোখে পানি নিয়ে অপরাধির মতো তাকিয়ে আছে।
তাহলে তুই এই কাজটা কিভাবে কর‍তে পারলি রে!!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here