প্রীতিকাহন পর্ব ৩৮

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩৮

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

হেসে উঠল মিষ্টি আর ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করল, “হলুদ মিষ্টি?”

“হুম, এই হলুদ শাড়ি আর গাজরা ফুলে তোমাকে হলুদ মিষ্টির মতো লাগছে।”

“হলুদ রঙের কোনো মিষ্টি হয় কিনা জানি না। তবে আমি অন্তত এমন মিষ্টির নাম শুনিনি কখনো।”

মৃদু হেসে নবাব বলল, “শুনবে কী করে বলো? তুমি তো একজনই। তুমি ছাড়া আর কোনো হলুদ মিষ্টি নেই।… এখন সব আলাপচারিতা বাদ৷ এসো, তোমাকে হলুদ ছুঁয়ে দিই।” মিষ্টি কোনও উত্তর দিলো না। অশ্রু ভেজা চোখে মুগ্ধ হয়ে নবাবের দিকে তাকিয়ে রইল৷

নবাব সামান্য কাঁচা হলুদ আঙুলে নিয়ে আলতো করে মিষ্টির কপোল ছুঁয়ে দিলো। এরপর একটুখানি মিষ্টি মুখের সামান্য এগিয়ে দিয়ে বলল, “খাও।” নবাব হালকা হাসল আর মিষ্টিও হেসে মুখে মিষ্টি নিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নবাব, আমি তোমাকে হলুদ ছুঁয়ে দিবো?”

“দাও।” বলেই মুখ এগিয়ে বসল নবাব। মিষ্টির মাথায় হঠাৎ কী চাপল কে জানে? মিষ্টি একগাদা হলুদ নিয়ে নবাবের পুরো মুখে হলুদ লেপ্টে হো-হো করে হেসে উঠল। এদিকে নবাব অবাক হওয়ার পাশাপাশি রেগে গেল, “এই, কী করলে তুমি? এভাবে কে হলুদ লাগায়?”

মিষ্টি এখনও হাসছে, শরীর দুলিয়ে হাসছে। নবাব বাঁ হাতে মুখের বাড়তি হলুদ মুছে নিয়ে বলতে লাগল, “হলুদে গোসল করিয়ে হাসছ কেন? কী করেছ দেখো তো? চোখে-মুখে হলুদ ঢুকিয়ে দিলে।”

“ভালো করেই তো দিলাম তাও রাগ করছ?”

“না, রাগ করব কেন? খুশিতে ধেইধেই করে নাচব। কারণ এত ভালো করে হলুদ ছোঁয়ালে যে এখন নিজের বিয়েতেও হলুদ সন্ধ্যা অনুষ্ঠান করার বিষয় বাতিল করলাম।”

“কেন, কেন?” অবাক হলো মিষ্টি।

“কারণ তোমার সাথে আজকে আমারও হলুদ সন্ধ্যা অনুষ্ঠান হয়ে গেছে।”

“এই মিষ্টি, আমাদের প্লেন এসেছে। চলো জলদি।” নবাবের ডাকে চৈতন্য হলো মিষ্টির, কিন্তু জবাব না দিয়ে মিষ্টি নবাবের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আর তাই দেখে নবাব স্মিত হেসে মুখে মাস্ক লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল, “যাবে না?” প্রতিত্তোরে মিষ্টি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ভাবনার ঘোর এখনও কাটেনি মিষ্টির তাই সে ভুলে গেছে কিছুক্ষণ আগে নবাবের সাথে তার রাগারাগি হয়েছে। এখন কেবল মিষ্টির মনে হচ্ছে, “নবাব, সেদিন তোমাকে হলুদ ছুঁয়ে দেওয়ার অনুমতি আমায় দিয়েছিলে তুমি, সেটা সত্যিই তোমার বিয়ের জন্য ছিল। কিন্তু দেখো, এই নির্বোধ আমি সেটা তখন বুঝতেও পারিনি।”

.

“হাসছ কেন এভাবে? আমার অবস্থা দেখে তোমার হাসি পাচ্ছে?” সব শক্তি দিয়ে চেয়ারের হাতল ধরে রেখেছে মিষ্টি। ভয়ে সমস্ত শরীর কাঁপছে তার আর ওর অবস্থা দেখে উচ্চৈঃস্বরে হাসছে নবাব। তাই দাঁতে দাঁত চেপে কোনোমতে নবাবকে জিজ্ঞেস করেছে সে।

“তোমার এমন কাণ্ড দেখলে যে কেউ হাসবে মিষ্টি। এত বড় হয়েও প্লেনে ভয় পাচ্ছো। এতে হাসব না?” হাসিতে ফেটে পড়ে নবাব মিষ্টিকে বলল।

প্লেন এখন ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে আসছে কিন্তু মিষ্টির ভয় যেন তরতর করে বাড়ছে। অসহ্য রকমের ভয়ের মাঝেও সে নবাবের ওপর তীব্র রাগ অনুভব করছে, “নবাব, খুব বেশি কিন্তু বলছ। আমি তোমার মতো প্লেনে উঠে অভ্যস্ত নই। তাছাড়া প্লেন যদি থামার আগেই কিছু একটা…” এই বলতেই মিষ্টি তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করল বিধায় চোখ-মুখ খিঁচে বিড়বিড় করে আল্লাহকে ডাকতে শুরু করল। এদিকে নবাব এখনও হেসেই চলেছে।

“এই মিষ্টি, এবার শান্ত হও। আমরা ঢাকা পৌঁছে গিয়েছি।”

ভয়ে ভয়ে মিষ্টি চোখ খুলে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”

“হ্যাঁ, সত্যি। মিনিট পাঁচেক লাগবে প্লেন সম্পূর্ণ স্থির হতে। তুমি এবার শান্ত হও। ভয়ে তো প্লেনে কথা বলবে দূর কিছু খেলেও না।” বলে আবারও হাসতে লাগল নবাব আর মিষ্টি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নবাবকে দেখে বলে উঠলো, “ফাজিল কোথাকার।”

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই নবাব দেখতে পেল নিলয় আর জিসান দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সাথে চোখাচোখি হতেই হাসি মুখে ছুটে এসে নবাবকে একসাথে জড়িয়ে ধরলো দু-জনে। কয়েক সেকেন্ড বন্ধুদের আলিঙ্গন করে নবাবের বুকে জমা কষ্ট যেন অনেকটাই দূর হয়ে গেল। এই দুই বন্ধুর জন্যই আজ সে তার ভালোবাসাকে পেয়েছে। তাই কৃতজ্ঞতা আজ হৃদয় গহীন থেকে উগলে দিচ্ছে নবাব চুপিসারে।

“কেমন আছিস তোরা?” জিজ্ঞেস করেই সোজা হয়ে দাঁড়াল নবাব।

“ফাস্ট ক্লাস। তোদের কী খবর?” নিলয় জিজ্ঞেস করলো। নবাব উত্তর দিতে যাবে কিন্তু তার আগে জিসান জিজ্ঞেস করে বসল, “দোস্ত, হানিমুন কেমন হলো রে?” আচমকা এমন প্রশ্নে মিষ্টি লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলো, নবাব রাগে দাঁতে দাঁত চাপল আর নিলয় জিসানের মাথায় চাটি মেরে বলল, “শালা, তোর মাথায় কি গোবর ছাড়া কিছু নাই? কখন আর কার সামনে কোন কথা জিজ্ঞেস করা লাগে জানিস না?”

মাথা চুলকে জিসান বলল, “না মানে…” জিসানকে থামিয়ে দিলো নিলয়, “চুপ থাক।” এরপর নবাবকে উদ্দেশ্য করে বললো, “দোস্ত চল।”

“হুম।” জবাব দিয়ে মিষ্টিকে বললো নবাব, “এসো।”

গাড়ির কাছাকাছি এসে খানিকটা চমকে গেল মিষ্টি। খুব একটা চিনতে না পারলেও মিষ্টি বুঝতে পারছে এই জিপ গাড়িতেই নবাব তাকে তুলে এনেছিল। আজকে সেই জিপ গাড়িতে উঠবে মিষ্টি– এটা ভাবতে গিয়ে মিষ্টি নিজের মাঝে হঠাৎ-ই কত-শত ভয় অনুভব করছে, “হে আল্লাহ, জানি না আমার জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে।”

“লামিয়া, বাইরে হৈচৈ হচ্ছে কেন রে?” বধূ সাজে সজ্জিত মিষ্টি নাকের নোলক ঠিক করতে গিয়ে প্রশ্ন করল লামিয়াকে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিজের ঘরের বাইরে সে শোরগোল শুনতে পাচ্ছে। একটু আগেও বিয়েবাড়িতে সাধারণ শব্দের আনাগোনা ছিল কিন্তু এখন হুট করেই অস্বাভাবিক শব্দের স্রোতে ভাসছে যেন মিষ্টির ঘরের বাইরে পরিবেশ।

দুপুর হলেও বিয়েবাড়ি বলে মিষ্টির ঘর ভর্তি মানুষ ছিল কিন্তু লামিয়া এসে সবাইকে বলেছিল, “এই তোমরা সবাই এখন বাইরে যাও।” মিষ্টির বিয়ে বলে আজ লামিয়া আচমকা যেন মুরুব্বি হয়ে উঠেছে। সবাইকে বেশ হুকুমের সুরে কথা বলছে আবার সবাই লামিয়া কথা মুখবন্ধ করে তামিলও করছে।

ফাঁকা ঘরের বিছানার এককোণে বসে বেশ নির্বিকায় গলায় লামিয়া জবাব দিলো, “আরে, বিয়ে বাড়িতে এমন একটু-আধটু হৈচৈ হয়েই থাকে। তুমি বউ মানুষ। তুমি ঘোমটা দিয়ে চুপ থাকবা, লজ্জা-টজ্জা পাইবা আর মাঝে মাঝে হুদাই কান্না করে বোঝাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছো; এসব না করে টেনশন কেন করছ আপু?” লামিয়ার কথা শুনে মিষ্টি হতভম্ব হয়ে গেল।

“পুঁচকে ছেমড়ি বলে কী?” একই সাথে বিস্ময় আর রাগ তার মাঝে উদয় হলেও অস্থির মনে নিয়ে মুখে কিছু বলতে পারছেন না।

গতকাল রাতে শেষবারের মতো মিষ্টি নবাবকে দেখেছিল। হলুদ ছুঁয়ে দিয়ে নবাব যে কোথায় মিলিয়ে গেল মিষ্টি বুঝতে পারছে না কারণ কালকের পর থেকে নবাবের কোনো পাত্তা নেই।

সকাল থেকে মিষ্টি ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও নবাবকে অনেকবার কল করেছিল, কিন্তু নবাব কল রিসিভ করেনি। ফুপ্পিকে জিজ্ঞেস করে যখন নবাবের খোঁজ নিয়েছিল, তখন মিষ্টির ফুপি জবাব দিয়েছিল, “ওই ছেলের খবর আমি জানি না রে মা। সেই ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছে। কোথায় গেছে তা নিয়ে আমাকে কিচ্ছু বলেনি। এখানে আসবে কিনা সেটাও জানি না।” এসব শুনে মিষ্টির খুব মন খারাপ হয়েছিল। এখন বাসায় এত হৈচৈ হচ্ছে তবুও নবাবের চিন্তায় মিষ্টির মন উচাটন হচ্ছে।

“ওই আপু, কী ভাবছ এত?” মিষ্টিকে ভাবনাগ্রস্ত দেখে লামিয়া প্রশ্ন করল। মিষ্টি লামিয়ার দিকে তাকিয়ে উত্তর তৈরি করছে কিন্তু হঠাৎ সমস্ত বাড়ি কেঁপে উঠল কোনো একটা শব্দে। আঁতকে উঠে মিষ্টি যখন দরজার দিকে তাকাল, তখন পুরো বাড়িতে হৈচৈ আরও বেড়ে গেল। অস্থির হয়ে মিষ্টি লামিয়াকে জিজ্ঞেস করল, “লামিয়া, গুলির শব্দ কেন হলো?” এই বলে মিষ্টি বসা থেকে উঠতে যাবে তার আগে লামিয়া তড়াক করে দাঁড়িয়ে বলল, “ওই আপু, করছ কী তুমি? তোমার বাইরে যাওয়া চলবে না। তুমি চুপচাপ ঘরে বসে থাকো। আমি গিয়ে দেখছি। তুমি অস্থির হইও বাইরে পুলিশরা আছে।”

“কিন্তু…” মিষ্টির কথা শুনবার আগ্রহ লামিয়ার নেই, “কিন্তু-ফিন্তু বাদ দাও আপু। আমি গেলাম।” এই বলে লামিয়া পালাল। এদিকে ব্যাকুল মিষ্টি লামিয়াকে ডাকতে শুরু করল, “এই লামিয়া, লামিয়া?”

“আল্লাহ, হঠাৎ এই গুলির শব্দ কেন? কারো কি কোনো ক্ষতি হলো?” একা একা বিড়বিড় করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল মিষ্টি। বাইরের শোরগোল এখন তীব্র হচ্ছে।

একটা পরিচিত গলা হঠাৎ মিষ্টির কানে এসে ধরা দিলো, “আমাকে আটকানোর চেষ্টা করলে খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম। কেউ আমার সামনে আসবে না।” কথাগুলো শুনতে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল মিষ্টি, “নবাব এসব বলছে? নবাব কেন বলবে এসব?” মিষ্টি নিজের ভাবনা জিইয়ে রেখে শাড়ির কুচি ধরে দরজার দিকে এক পা বাড়াল। কিন্তু ঠাসা করে দরজা লাগানোর শব্দ শুনতে পেয়ে মিষ্টি বোধ হলো কেউ মেইন দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। এসব ভাবনার মাঝে কেউ জুতোয় প্রচণ্ড শব্দ করে দরজা আঁকড়ে দাঁড়াল।

ঝাঁকড়া চুল আর খসখসে মুখে ঘামের রাজত্ব নিয়ে নবাব দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টির রুমের দরজায়। গোটানো শার্টের হাতায় মুখের ঘাম মুছে নবাব মিষ্টিকে বলল, “মিষ্টি, চলো আমার সাথে।”

মিষ্টি বাকরূদ্ধ হয়ে গেছে কারণ নবাবের ডান হাতে চকচক করছে কালো পিস্তল। এমন ভয়ংকরী নবাবকে মিষ্টি আগে দেখেনি। ভয়ে মিষ্টির শ্বাস খুব দ্রুত উঠানামা করছে তবুও শুকনো ঢোক গিলে মিষ্টি নবাবকে বলল, “এই নবাব,কী… কী করছ তু… তুমি এসব? তো… তোমার হা… হাতে পি… পিস্তল কে… কেন?”

“ওহ মিষ্টি, ডোন্ট ওয়েস্ট মাই টাইম। শিগগির চলো।” ব্যস্ত ভঙ্গিতে নবাব বললো কিন্তু মিষ্টি ভয়ে পিছিয়ে যেতে শুরু করল, “নবাব, এমন পা… পাগলামি করো না। তু… তুমি প্লিজ শান্ত হও।”

গর্জে উঠল নবাব, “আমার শান্ত হওয়া লাগবে না। তুমি চলো আমার সাথে।” নবাবের গর্জনে মিষ্টি কেঁপে উঠল, কিন্তু বাক্য ব্যয় না করে অশ্রু ঝরাতে শুরু করলো।

“আমি শেষবারের মতো বলছি মিষ্টি, এসো আমার সাথে।”

মিষ্টি প্রায় কেঁদে দিবে এমন ভঙ্গিতে বলল, “আমি যাব না নবাব।”

“যাবে না? ঠিক আছে, তোমায় যেতে হবে না। যা করার আমিই করছি।” এই বলে উত্তেজিত হওয়া নবাব দরজা থেকে সরে গেল, কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই একটা রুমাল হাতে ঘরে প্রবেশ করল।

নবাবের একহাতে পিস্তল আর অন্য হাতে সাদা রুমাল। চেহারায় ভাসছে ভিন্ন রূপ যে রূপ মিষ্টিকে ভয়ে কাঁপিয়ে তুলছে। নবাব মিষ্টির কাছাকাছি হচ্ছে সেটা দেখে মিষ্টি আরও ঘাবড়ে গেল, “নবাব, কী করছ তুমি?”

ঘর্মাক্ত নবাব তার থমথমে গলায় জবাব দিলো, “তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি মিষ্টি। আমার তোমাকে চাই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমাকে চাই আর তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারি, মিষ্টি। আমার সাথে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে ছাড়ছি না আমি, একমুহূর্তের জন্যও না।”

“মানে?” চিৎকার করে উঠল মিষ্টি, কিন্তু সেই চিৎকারের তোয়াক্কা না করে নবাব মিষ্টির মুখে রুমাল চেপে ধরল। মিষ্টি হাত-পা ছোড়াছুড়ি করল কিন্তু নবাবের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারল না বরং ধীরে ধীরে যখন চোখের পাতা এক হতে লাগল, তখন ঢলে গিয়ে বিছানার শক্ত কাঠে মাথায় আঘাত পেল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here