#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্বিংশ_পর্ব
হঠাৎ এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ায় কোনো কূল কিনারা খুঁজে পায় না সিরাত। আতংকিত হয়ে ফাইয়াজের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ড্রেসের সাইডের অংশ আঁকড়ে ধরে। এদিকে সিরাত হুট করে সরে যাওয়াতে হালকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ফাইয়াজ। কিন্তু পরমুহূর্তেই সিরাতের উন্মুক্ত কোমড় সংলগ্ন ড্রেস ভেদ করে বেরিয়ে আসতে দেখে বিস্মিত হয় সে। মৃদু আলোতে ফর্সা শরীরের একাংশ বের হয়ে যাওয়ার মতো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে তড়িঘড়ি করে নিজের গায়ে থাকা কোট খুলে সিরাতের গায়ে জড়িয়ে দেয় ফাইয়াজ। হুট করে ডান্স বন্ধ হয়ে যাওয়াতে সব মিউজিক বন্ধ হয়ে যায়, সাথে করে লাইট গুলোও জ্বলে ওঠে। হলরুমে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি সিরাত এবং ফাইয়াজের দিকে স্থির।
সিরাত চুপসে এক কর্নারে ফাইয়াজের কোট গায়ে জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে এমনটা হওয়াতে মিসেস সাবিনা বেগম এগিয়ে আসেন। বিচলিত হয়ে সিরাত আর ফাইয়াজকে জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
– “কি ব্যাপার সিরাত? কি হয়েছে? ফাইয়াজ?”
সিরাত কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ড্রেস হাতে গুটিয়ে নিয়ে উপরের দিকে হাঁটা শুরু করে।
– “মা, আই উইল এক্সপ্লেইন ইউ লেটার।”
বলেই ফাইয়াজ ও সিরাতের পিছু পিছু হাঁটা দেয়। উপস্থিত সকলের কাছে ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হয় না। অনেকেই কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। রিয়াও এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটা দেখে আনমনেই হেসে উঠে। ধ্রুব সবার নীরবতা ভাঙিয়ে দিতে বলে উঠে জনসমক্ষে,
– “সরি ফর এভরিথিং গাইস। বাট ইটস্ এ ফ্যামিলি ম্যাটার। আপনাদের সকলকে পার্টি এটেনড্ করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।”
ধ্রুবের কথায় সকলে একে একে আহমেদ ম্যানশন থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। চন্দ্রিকা আর রূপ দুজনেই একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। দৃষ্টিতে দুজনেরই দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
রুমের মধ্যে কোনোমতে প্রবেশ করে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয় সিরাত। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে নিশ্চুপ হয়ে বসে পড়ে। সবকিছু যেন অবিশ্বাস্য আর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। একটু আগের ঘটনা মনে পড়তেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আতংকে। শরীর থেকে সরিয়ে নিয়ে আলমারি থেকে একটা ড্রেস নিয়ে চেঞ্জ করে নেয় অতিদ্রুত। খাটের উপর ভাবলেশহীন দেহ নিয়ে বসে পড়তেই গত সময়ের ঘটনায় ফাইয়াজ সঠিক সময়ে গায়ে কোট জড়িয়ে না দিলে কি পরিণাম হতে পারত তা নিয়েই ভাবনার জগতে মগ্ন হয়ে যায় খুব গভীর ভাবে। তার ভাবনার সুতো কাটে দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ পেয়ে।
– “সিরাত? আর ইউ ওকে? দরজা খোলো! আমি সত্যিই ভাবিনি হুট করে এমনটা হয়ে যাবে। প্লিজ লেট মি এক্সপ্লেইন। সিরাত?”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রলাপ বকে ফাইয়াজ। কিন্তু অপর পাশ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না পেতেই চিন্তা আরো এক ধাপ এগিয়ে যায় ফাইয়াজের। দরজায় দ্রুত কড়া নাড়তে থাকে। মিনিট দুয়েক পর দরজা খুলতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। দ্রুত রুমের ভেতর প্রবেশ করে সিরাতের দিকে এগিয়ে যায় সে।
– “আর ইউ ফাইন? লিসেন আ’ম সো সরি, আমি কখনো কল্পনাও করিনি এমন একটা উইয়ার্ড পরিস্থিতি হয়ে যেতে পারে। আমি ইচ্ছে করে করি নি, ট্রাস্ট মি।”
সিরাতের দু গাল নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অস্থির হয়ে প্রলাপ বকে চলে ফাইয়াজ। ফাইয়াজের অস্থিরতায় সমাপ্তি ঘটিয়ে নিঃশব্দে ফাইয়াজকে জড়িয়ে ধরে সিরাত। এতেই মুখ থেকে সমস্ত বাক্যালাপ হারিয়ে যায় ফাইয়াজের।
– “আমি জানি আপনি কিছু করেননি। আমার উল্টো আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। আপনি ঐ সময় না থাকলে কি হয়ে যেতে পারত! প্লিজ নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে আমাকে ছোট করবেন না।”
নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে সিরাত। ফাইয়াজ ও সিরাতের কথায় মুচকি হেসে তার দু হাত প্রসারিত করে সিরাতকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নেয়।
রাতের ডিনার শেষে,,
ব্যালকনিতে এক ধ্যানে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল ফাইয়াজ। পাশেই ঝুলন্ত চেয়ারটাতে কয়েকটা সায়েন্স ফিকশনের বই আর কয়েকটা রোমান্টিক উপন্যাস সহ গিটার টা রাখা। বস্তুত বই পড়ার অভ্যাস খুব একটা তীব্র না হলেও বই পড়লেই প্রশান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু আজকালকার এই দুশ্চিন্তা আর নানা ব্যস্ততায় বইগুলোকে তেমন ভাবে ছুঁয়ে দেখা হয় নি।
– “ভেতরে আসতে পারি, মিস্টার ফাইয়াজ?”
পেছন থেকে কোনো পুরুষালী কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই ফিরে তাকায় ফাইয়াজ।
– “আরে ডক্টর রূপ, চন্দ্রিকা আপু আপনি? বাহিরে দাঁড়িয়ে পারমিশন নেয়ার কি আছে? ভেতরে আসুন।”
ফাইয়াজের অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে চন্দ্রিকা আর রূপ। ফাইয়াজ ও ব্যালকনি থেকে রুমে এসে পড়ে।
– “আসলে সিরাতকে নিয়ে কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কথা ছিল। যেটার বিষয়ে আমরা দুজন ঢাকায় এসেছি সেটার মেইন পয়েন্ট নিয়ে কিছু কথা আছে।”
সোজাসাপ্টা গলায় বলে উঠে চন্দ্রিকা। ফাইয়াজ গভীর কন্ঠে বলে উঠে,
– “হুম বলুন।”
চন্দ্রিকা তার চোখের ইশারা দিতেই রূপ ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করে বক্তব্য আর ফাইয়াজ ও সেগুলো মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে।
বেশ খানিকটা রাত হওয়া সত্ত্বেও ঘুম নেই চোখে সিরাতের। নিশাত বেশ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম না ধরার ফলস্বরূপ আকাশের স্বল্প আলোয় ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে বসে আছে সিরাত। জীবনের সব অধ্যায়ের হিসেব মিলানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে চলেছে তার মস্তিষ্ক। তবুও তার মাঝে এক টুকরো প্রশান্তি যেন ডানায় ভর করে চলে আসে মুহূর্তেই। ফাইয়াজ নামক মানুষটা তার জীবনের সাথে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে রয়েছে চাইলেও যেন দুঃখ, কষ্ট সব কর্পূরের মতো মিলিয়ে যায়। এই মানুষটাই তো এত ফ্যাকাশে রংহীন জীবনকে রঙিন করায় প্রচেষ্টা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। ফাইয়াজের ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকতে থাকতে এক সময় চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে।
রূপ আর চন্দ্রিকার কথা শোনার পর চেহারায় বেশ গাম্ভীর্য ভাব চলে এসেছে ফাইয়াজের মধ্যে।
– “আর এতকিছুর পরও অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার চান্স মাত্র ১০%। এতটুকুই ছিল ইম্পর্ট্যান্ট কথা। যা কিছু করতে হবে খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ফাইয়াজ। আর তুমি যদি চাও আমি সিরাতের অপারেশন খুব ইমিডিয়েটলি শুরু করব। আর আই হোপ অপারেশন টা যেন সাকসেসফুল হয়!”
রূপের কথায় মেঝে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা তুলে তাকায় ফাইয়াজ। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। লাইফের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট একটা ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেয়া যেন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে তার কাছে। মাথার চুল গুলো আঙুলে আবদ্ধ করে দু তিনটে নিঃশ্বাস ফেলে সে।
– “ঠিক আছে। সব কন্ডিশনে আমি রাজী। ১০% পসিবিলিটি থাকলেও আমি এ অপারেশন করাতে চাই।”
– “আর ইউ শিওর?”
– “ইয়েস, ডক্টর রূপ! আ’ম শিওর।”
ফাইয়াজের সাথে কথা শেষ হতেই উঠে দাঁড়ায় চন্দ্রিকা আর রূপ। পা বাড়ায় রুমের বাইরের দিকে।
তীব্র রোদের প্রখরতা চোখে সরাসরি পড়তেই নড়েচড়ে উঠে সিরাত। টেবিল থেকে মাথা তুলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। হাই তুলে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ওয়াশরুমের দিকে। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চন্দ্রিকার কন্ঠ স্পষ্ট শুনতে পায় সে। নিশাতের সঙ্গে খোশগল্প করতে ব্যস্ত চন্দ্রিকা। হুট করে ফোনে কল আসায় থেমে যায় সে। ফোনের উপর ইয়াসিন আঙ্কেল নামটা জ্বলজ্বল করছে। ঠিক কি উদ্দেশ্যে ইয়াসিন সাহেবের কল এসেছে তা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয় না চন্দ্রিকাকে।
– “আমি একটু আসছি!”
বলেই উঠে পড়ে চন্দ্রিকা।
– “………………..”
– “কিন্তু আঙ্কেল আমি তো আগেই বলেছি আমার পক্ষে ডক্টর রূপ কে বিয়ে করা পসিবল না। তুমি তো সব জানো তবুও কেন? আর আমি ডিসাইড করেছি আমি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ব্যাক করলেই ডক্টর রূপ কে সরাসরি না করে দিব।”
– “………………..”
– “ঠিক আছে আমি রাখছি এখন।”
বলেই কল কেটে দেয় চন্দ্রিকা। ছোট একটা শ্বাস ফেলে পেছনে ফিরতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে যায় তার।
– “প্,পূ্,পূরবী তুই?”
– “তুমি রূপ ভাইয়াকে ভালোবাসো তাই না?”
গম্ভীর গলায় বলে উঠে সিরাত। এতে আরো এক দফা অবাক হয় চন্দ্রিকা।
– “কি সব বলছিস তুই? নিশ্চয়ই তোর কোথাও ভুল হয়েছে। আমি ডক্টর রূপকে ভালোবাসতে যাব কেন?”
– “শুধু শুধু মিথ্যে কথা বলছ কেন? আমি খুব ভালো করেই জানি তুমি রূপ ভাইয়াকে ভালোবাসো, তবুও তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ কেন যেখানে রূপ ভাইয়া নিজেই তোমাকে ভালোবাসে?”
– “হ্যাঁ আমি জানি ডক্টর রূপ আমাকে ভালোবাসেন আর আমি এটাও স্বীকার করছি যে ডক্টর রূপের প্রতি আমিও দুর্বল হয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি দ্বিতীয়বার কারো ভালোবাসার মায়াজালে নিজেকে জড়াতে চাই না। আমি তো আরমানকে ও ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু দিনশেষে সে ঠিকই অন্যের সাথে চলে গিয়েছে। তাই আবারো ভয় হয় ডক্টর রূপকে নিয়ে। যদি সেও চলে,,,,”
– “যাবে না, আমার বিশ্বাস। আহামরি তেমন ভাবে আমি রূপ ভাইয়াকে চিনি না তবে এটা জানি তোমার প্রতি তার ভালোবাসা কোনো সাজানো মিথ্যে নয়। আর একটা মানুষের জন্য আর কতদিন নিজেকে কষ্ট দিতে থাকবে চন্দ্রিকা আপু? আরো একবার না হয় নিজের জীবনকে সুযোগ দিয়ে দেখ। দিনশেষে সব কালপ্রহর কেটে গিয়ে ভালোবাসার সফলতা নিশ্চয়ই আসবে।”
সিরাতের কথা শুনে থমকে যায় চন্দ্রিকা। আসলেই কি তাই? তার কি উচিত নিজের জীবনকে নতুন করে আর একটিবার সুযোগ দেয়া?……………
#চলবে 🍂
(