দ্বিতীয় বাসর পর্ব ১৪+১৫

দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-১৪
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

(অনেকে আমার গল্পের শহর চ্যানেল থেকে গল্প পড়ে না বিষয়টা আমাকে খুব কস্ট দেয় তাই গল্পের শহর থেকে নিয়মিত গল্প পড়তে ভিজিট করুন গল্পের শহর চ্যানেলের ।community আর চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে রাখুন যাতে পোস্ট হওয়ার সাথে সাথেই আপনি নোটিফিকেশন পান)

মিতু টেবিলে ভর দিয়ে মাথা নুইয়ে চোখ বুজে ফেলে।এমনি লো প্রেশারের সমস্যা তার আগে থেকেই।বাবা তাকে জোর করে ভিটামিন আর আয়রন টেবলেট খাওয়াতেন।রক্তশূন্যতা বা এনিমিয়ার রোগী সে।বুয়া ডাইনিং রুম মুছতে এসে দেখলো মিতু মূর্ছা যাচ্ছে।আঙুল কেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।তাড়াতাড়ি মিতুকে ধরে ফেল্ল বুয়া।ঘরে নানু ছাড়াও কেউ নেই।নীবিড় বাইরে বের হয়ে গেছে।নানুকে ডাক দিতে লাগল বুয়া।মিতু চোখ মুখ উল্টাচ্ছে।সেদিকে তার খেয়াল নেই।মিতু ঐ অবস্থায়,বুয়াকে বল্ল রুই মাছের মাথাটা ভাল করে ধুয়ে দিতে আর মুগ ডালটা হালকা আঁচে ভেজে দিতে।বাঁধনের এদুটা ফেভরেট ডিশ,বড়বড় ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ির দোপেয়াজা আর মুগডাল,রুই মাছের মুড়িঘন্ট।বুয়া কি করবে বুঝতে পারছিল না। মিতুকে সে আগে এভাবে মূর্ছা যেতে দেখেনি।এর আগে শুনেছিল যে গাড়ির সাথে ব্যাথা পেয়ে অজ্ঞান হয়েগিয়েছিল।মিতুর আঙুল টা চেপে ধরে বুয়া বলতে লাগল,
“আফামনি কি হইসে?এমন করতেসেন ক্যান?আর সালাদ আফনেরে কে কাঁটতে কইসে।আমারে কইলেই তো কাইটা দিতাম।’
বুয়ার চিৎকারে নানুও ছুটে এলো।কানে শোনার যন্ত্র বা হেয়ারিং এইড না লাগিয়েও মোটামুটি ভালো শুনতে পান আল্লাহর রহমতে।
নানু মিতুর কাছে এসেই বকতে লাগল,
“মাথাখান ঘুইরা পড়ে যাইতেসিস এখন আবার মুড়িঘন্ট রাঁধতে চাচ্ছিস?’
বুয়া আর নানু দুজন ধরাধরি করে মিতুকে শুইয়ে দিয়ে আসলো বিছানায়।নানু তার শাড়ীর আঁচল ছিঁড়ে মিতুর আঙুলে বেঁধে দিল।ফাস্ট এইড বক্সটা খুঁজতে বল্ল বুয়াকে।
“ও বুবু চোখ খোল,কি হইসে এই অাঙুল কাঁটোনে কেউ ঘুইরা পড়ে?বাচ্চা পেটে আসলে কি করবি তখন?’
লো প্রেশারের সমস্যার কারনে মিতুর মাথা ঘুরে পড়ার সমস্যাটা অনেক আগে থেকে।বিশেষ করে তার মা মারা যাবার পর থেকেই ছিল।মাঝখানে একেবারেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু হীমেলের সাথে সম্পর্কের অবনতি,পারিবারিক কিছু কারন আর তার শরীর খারাপ বা মাসিকের সময়টাও তার আবার দেখা দিচ্ছে এ সমস্যাটা।বিয়ের আগেও ডাক্তার দেখিয়েছে।তার বড় চাচাই ডাক্তার।পরীক্ষাও করিয়েছে।এটা ওর তেমন কোন সমস্যা নয়।মিতু অনেক নরম স্বভাবের।টেনশন, এংজাইটি বা মানসিক বিষন্নতা থেকে এটা ওর হয়।তাছাড়া রক্তশূন্যতা প্রচুর।
নানু যেন ঘাবড়ে যায়।বন্ধনকে ফোন করে নানু।নানুর কাছে ডায়েরীতে প্রয়োজনীয় সব নাম্বার দেয়া আছে।কিন্তু বন্ধনও তো ফোন ধরছে না।
মিতুর হাতের আঙুল কাঁটার পর থেকেই চেষ্টা করছিল যেন ঘুরে পড়ে না যায়।শুধু শুধু বাসায় তাকে নিয়ে টেনশন করবে এটা সে চায়না কোনমতে।বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকে।কতক্ষণ বাদেই চোখ মেলে। তাকিয়ে দেখে বুয়া তার পা মালিশ করছে তেল পানি দিয়ে।মাথাতে তেল দিয়ে দিচ্ছে নানু যত্ন করে।
“আরে নানু কি করছো ছাড়ো তো আমি ঠিক আছি।’
বলেই বিছানা ছেড়ে উঠতে চায় মিতু।বুয়া আর নানুর সেই একই কথা কেন মাথা ঘোরালো এভাবে।নানু,বুয়া একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন জানতে চায় অনুমান করে মিতু।নানু এবার ভারী কন্ঠ করে বলে,
“হ্যারে বুবু বমিটমী হইসিল তোর?
“না বমি হবে কেন?’
“ঐ দেখো আবার জিগায় বমি হইবো ক্যান?’
তারপর বুড়ী বড়বড় চোখ করে মিতুর দিকে তাকিয়ে বল্ল,
“তোর কি হইসে মিতু? আঙুল কাইটা ঘুইরা পড়লি কেন?’
“ও কিছুনা নানু।আঙুলটা বোধহয় একটু বেশী কেটে গেছে।এখন ঠিক আছি।’
“আঙুল কাঁটসে তো হাতে মুখেও তো দেখি কাটঁসে?’
ফের ফিঁক করে হেসে মিতুকে শুধায়,
“তোর শরীরের দাগগুলা যে বানাইসে তার কারন জিগাইতেসি।বাবু সোনা কিসু করসে কিনা হেইডা বল?ছোটবাবুর ভাই বোন কেউ আইতাসে?’
মিতু লজ্জায় লাল হয়ে যায়,
“বলে কি বুড়ী? বাবুসোনা তোমার খালি দাগ বানানো পর্যন্তই করতে পেরেছে।কিন্তু এখনো আমি কুমারীই আছি।’মনে মনে বিড়বিড় করে লাজুক হাসে মিতু।
মিতু এবার বিছানা ছেড়ে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।একদিকে ভালই হলো নানুর কাছে আর লুকোচুরি খেলা খেলতে হবে না তাকে।
“কি রে কই যাস মিতু?’
“নানু তোমার বাবু সোনার আরেকটা প্রিয় খাবার রান্না বাকি।সেটা এখন করি গিয়ে….’
“ঐ সেরি মাত্র ঘুইরা পড়লি,ওহন তোরে পাকঘরে কে যাইতে কইসে?আঙুলে ওষুধ লাগা।আর তোরে আমি কি জিগাইসি হেইডার জবাব না দিয়া কই যাস?’
মিতু কোমড়ে আঁচল গুজে একেবারে পাক্কা গৃহিনীর মতো ফের রান্নাঘরে যায়।বুয়াকে ডেকে নেয় সাথে।যেতে যেতে হেসে বলে,
“শোনো নানু,এরকম মাথা ঘুরে আরো কত পড়বো সবে তো শুরু…..’
ফের দুষ্টু হাসি দিয়ে বল্ল,”আর শোনো তোমার এত কথার জবাব আমি দিতে পারবো না তোমার বাবুসোনার কাছ থেকেই জেনে নিও।’
দিব্যি মুড়িঘন্ট রাঁধতে আবার মনোযোগী হয়।অথচ একটু আগে সে ঘুরে পড়েছিল ভাবখানা এমন যে কিছুই হয়নি।
মনোযোগ দিয়ে লংকা, পেঁয়াজ কুচি,সামাণ্য রশুনকুচি আর ধনে পাতা দিয়ে রুই মাছের মুড়োটা চুলোয় চাপিয়েছে মিতু।তার হাতের মুগডালের,রুই মাছের মুড়িঘন্ট অসাধারণ হয়।একটা তেজপাতাও দিয়েও নাড়তে থাকে মুগডালের তরকারী।ছোট ভাই মুহিনের কাছে তো অমৃত মনে হয় মিতুর রান্না করা এই খাবার।
“আচ্ছা ছোট ভাইকে ফোন করে একটু আসতে বলবো নাকি?বাবাকেও একটু পাঠিয়ে দেয়া যাবে।’
“না না মুহিন আবার এতদিন পর মুখের এই দাগগুলি দেখে কি না কি ভেবে বসবে?’পরে মিতুই কিছু বলতে পারবে না।
বাইরে আজ আবার বৃষ্টি পড়ছে।সেপ্টেম্বর মাসে এই অসময়ে বৃষ্টি কেন?বাংলাদেশের আবহাওয়াও এখন ভীষনরকম গরমিল।আর বৃষ্টির পর সোঁদা মাটির একটা গন্ধ আসে মিতুর কাছে খুব ভালো লাগে সেটা।
সকাল থেকেই টপটপ ঝরছিল।এখন বেশ জোরে এসে পড়েছে।মিতু জানলা গুলি খুলে দেয়।আহ্ প্রাণ জুড়ানো শীতল বাতাস।বন্ধন,বাবাই তিনজনে মিলে বৃষ্টিতে ভিজলে মন্দ হতোনা।ছেলেটার পড়ার এত চাপ বিনোদন বলতে স্কুলের মাঠ,আর বাসায় টিভিতে কার্টুন আর ট্যাবে গেমস।মাঝে মাঝে ছোট চাচুর ল্যাপটোপেও খেলে, গান শোনে।নীবিড় গিটার বাজানো শেখায় তার ভাতিজাকে।
মুড়িঘন্টটা প্রায় হয়ে গেছে, লবন দেখে নেয়,নামানোর আগে পিঁয়াজ বেরেস্তা আর ধনে পাতা ছড়িয়ে দেয়।সামাণ্য জিরার ফাকি।বাশমতি চালের ভাতের সাথে চিংড়ির দোপেয়াজা আর মুড়িঘন্ট,আর এই ঝুম বৃষ্টিতে খিচুড়ি, মাংস না হলেও এই খাবার গুলিও কম জমজমাট নয় বৈকি।ঘিয়ে সিদ্ধ আলু ভেজে ভর্তা করতে পারলেও বেশ হতো।তবে বুয়া কচুশাখ রান্না করে দিয়ে গেছে।মুড়িঘন্টটা এর আগে খানসামা করে দিতো।তার কাছেই জেনেছে মিতু বন্ধন খুব পছন্দ করে।
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে তার,ওপাশ থেকে ভারী কন্ঠে বন্ধন প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে,”কি হয়েছে মিতু তোমার?এতবার ফোন করছি ফোন ধরছো না কেন?আজ আবার মাথা ঘুরে পড়েছো?’
ফোনটা চার্জে ছিল, তাই খেয়াল করেনি মিতু।
“ও আচ্ছা তেমন কিছু না। একটু আঙুল কেঁটে গিয়েছিল তো তাই।’
“আঙুল কাঁটলো কি করে?ধ্যান কোথায় থাকে?’
“বুঝেন না ধ্যান কোথায় থাকে?কাল রাতের ঘটনা ভুলবো কেমন করে?তার উপর নীবিড় যা বল্ল,মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ঐ কথাটা?’ফের বিড়বিড় মিতু।
“কি হলো চুপ করে আছো কেন?কি ভাবো হ্যা?’
আচমকা মিতু বলে ওঠে
“আমার নূপুরটা খুঁজে পাচ্ছিনা,আপনি দেখেছেন?’
“ও এই ব্যাপার ভালো করে খুঁজেছো?’
“খুঁজে দেখেছিতো সব জায়গায় কোত্থাও নেই।’
“ঠিক আছে হারিয়েছে,হারিয়েছে আর একটা বানিয়ে দিব এই নিয়ে টেনশন এর কি আছে?’
“টেনশন করবো না আমার নানীর বানিয়ে দেয়া নূপুর এত সুন্দর ডিজাইন আর পুরো দশ আনার ভারী নূপুর,খাটি সোনার এখন এইসব পাওয়া যায় না সহজে?’
“বুঝেছি যত খাঁটিই হোক নূপুরের ছবি আছে?ইই ঐটা আমাকে ভাইবারে পাঠাও।ওরকম আরেকটা বানিয়ে দেয়া যাবে, সেজন্য টেনশন করে মাথা ঘুরে পড়তে হবে কেন?’
বাঁধনের কথায় মনে হচ্ছিল,পাঁচ মাস পরে সে যেন উৎকৃষ্ট স্বামীর মতো বউকে শাসন করছে।
“ইশ এতদিন এই ঝাড়ি কই ছিল?আজ যে বড় ঝাড়ছেন?’
মিতুও যেন একটু রেগে যায়,
“কি বল্লে?’
“কিছু না।’
“ঘুম তাহলে ভালোই দিলা আমাকে ছাড়া?’
“কই? আমি তো ঐ ঘরেই ছিলাম?নানুর ঘরে সেও তো কত পড়ে গেলাম?আপনি বুঝি ঘুমাননি?’
“আমাকে ঘুমাতে দিসো তুমি?’
“আমি আবার কি করলাম?’
“বুঝো না কি করসো?এত আদর-সোহাগের পরও মন ভরে তোমাকে আদর করতে পারিনি?আমার অবস্থা তুমি বুঝতেসো?’
“ইশ কি যে বলেন? এতটা দিন চলে গেল,আপনার এখন মনে হলো আমাকে আপনার বুঝতে হবে? কত যে ঢং জানেন?’
“তাই বুঝি?প্রতিশোধ নিচ্ছো হুম?’
“প্রতিশোধ নিব কেন?পাঁচমাস দেরী করলে এমনই হয়?’
বলেই সশব্দে হেসে ওঠে মিতু।
হঠাৎ ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস শোনে মিতু বন্ধনের।
“কি হলো চুপ করে আছেন কেন?’
“শুনছিলাম’
“কি?’
“তোমার হাসি।তোমার হাসির দাম এককোটি টাকা!’
“সত্যি?’
“হুম জান।কালকে রাতের পর বুঝলাম পাঁচ মাস দেরী করেছি এখন পাঁচটা দিনই আমি ওয়েট করতে পারছি না কবে তোমাকে কাছে পাবো…..’
মিতু মন্ত্রমুগ্ধের মতো বন্ধনের কথাগুলো শুনছে।
“এই কি হয়েছে আপনার?’
“জানি না মিতু।আজ অফিসে যাবার সময় খুব মিস করেছি তোমাকে।নানুর রুমে গিয়ে তোমাকে দেখে এসেছিলাম।কি শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলে?একটা জিনিস করতে খুব ইচ্ছে করছিল।কিন্তু দুষ্টু বুড়ীর চাহনী দেখে চলে এসেছি।’
“তাই?’মিতুর মুগ্ধতা।
“হুম আর শোন নীবিড়কে বলে দিয়েছি আজ ডাক্তার দেখিয়ে আসবে।’
“না না আজ কিছুতেই পারবো না।’
“আজ আবার কি হলো?’
“আমার সারা মুখে কি করেছেন মনে নাই?ডাক্তার জিজ্ঞেস করলে কি বলবো?’
“বলবে স্বামী মাইর দিসে এখন ওষুধ দেন হাহাঃ হাঃ’
“না প্লিজ আমি পারবো না আমার বুঝি লজ্জা করে না?দাগ চলে গেলে আমি বরং বড় চাচাকে দেখিয়ে আসবো।’
“দাগ চলে গেলে মানে?দাগের দেখসো কি সবে তো শুরু?আর এত কথা শুনতে চাই না আজি যাবে ডাক্তারের কাছে।’
ফোনটা রেখে দেয় বন্ধন।গাড়ীর আওয়াজ শুনতে পায়।বুয়া টেবিলে ভাত,তরকারী সুন্দর করে বেড়ে দিয়ে গেছে।বাবাই আর নীবিড় চলে এসেছে।
মিতু দরজা খুলে তো অবাক।মুহিনও এসেছে তাদের সাথে।
নীবিড় বল্ল সুপারসপে গিয়েছিল বাবাই এর স্কুলের কিছু জিনিস কিনতে ওখানেই মুহিনের সাথে দেখা।
“ধরে এনেছি ভাবী তোমার আদরের ছোট ভাইকে, ভালো করেছি না?’
“হুম, খুব ভালো করেছো?’
কিন্তু যা হবার তাতো হলোই।হাবার মতো মুহিনও সেই একই কথা।ও যেন আঁতকে উঠলো আরো বেশী।
“আপু তোমার মুখে কি এগুলা?দেখে মনে হচ্ছে কেউ মেরেছে তোমাকে?’
মিতু এবার মনে মনে বেজায় ক্ষেপে যায়।
“নাও এখন এই আহাম্মককে ব্যাখা দাও আবার নতুন করে।’আর মুহিনের তো এসব জানার কথা না। মাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে।এসব ব্যাপার আসলেই ওর কাছে নতুন।
যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই রাত হয়।যে ভয়টার কারনে মিতু একটু আগেও ইচ্ছে করেই তার ভাইকে আজ মুড়িঘন্ট খেতে আসার জন্য বলতে চায়নি।কিন্তু হয়ে গেল তাই।বাবাই চেয়ে আছে মিতুর দিকে,কিন্তু কিছু বুঝতে পারছে না।
নীবিড় এবার মুহিনের কাঁধে হাত রেখে,সহাস্যে বল্ল,
“ভাই সেরকম মাইর হয়েছে।’
ছোট ভাইয়ের সামনে লজ্জায় ওর মাথা কাটা যাচ্ছে যেন।নীবিড়ের কথায় রেগে যায় মিতু চোখের ইশারায় তা বুঝিয়ে দেয় নীবিড়কে।
নীবিড় ঠান্ডা গলায় বলে,
“আরে ছোট ভাইয়া ওসব মাইর টাইর কিছু না, তোমার আপু মানে আমার প্রিয় ভাবী আরো সুন্দর হতে চায়,আটা ময়দা মেখে এই অবস্থা…..’
মুহিন কি বুঝলো কে জানে?কিন্তু বোনের চেহারার এই অবস্থা দেখে তাকে সত্যি চিন্তিত মনে হলো। (চলবে)দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-১৫
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

অবশেষে মিতুর প্রস্তাবই ঠিক হলো।সে এই মুখ নিয়ে কিছুতেই নীবিড়ের সাথে ডাক্তারের কাছে যাবে না।বন্ধনকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করালো।যে দু এক দিনের ভিতর তার বড় চাচার বাসায় যাবে।চাচা সরকারি চিকিৎসক ছিলেন জামালপুর হাসপাতালে।রিটায়ার করার পরও প্রাইভেট মেডিকেল এ চাকরী করছেন।মেডিসিন বিভাগের অভিজ্ঞ ডাক্তার।কিছুদিন অবশ্য আর্মি ক্যান্টনমেন্ট এও চিকিৎসক ছিলেন।
আজ দুপুরে হঠাৎ করে খেতে চলে এল বন্ধন।সচরাচর দুপুরবেলা সে আসে না তবে মাঝে মাঝে আসে।বিয়ের পর খুব কমই দেখেছে মিতু।নানু অবশ্য বন্ধনের মাথায় ঢোকায় অনেক কিছু।
“শোন নতুন বিয়া করসো এইবার ঘরে জলদি জলদি ফিরবি।জুয়ান বউ,আবার নীবু ও ঘরে থাকে।বুঝোস না’
নীবিড়কে নীবু ডাকে নানু।
“কি বুঝবো বুড়ী?’হেসে জিজ্ঞেস করে বন্ধন
“কি আবার নীবুও ব্যাটা পোলা,এহনো বিয়া করে নাই, ভাবীরে কয় মিঠা না মিষ্টি ভাবী।’
“ডাকুক না?ভাবীকে তো মিষ্ঠি ভাবী বলতেই পারে?অসুবিধা কি?’
“না আমার কোন অসুবিধা নাই।জুয়ান বউ,সুন্দরী বউ বিয়া করসো,তারে সময় দিবা না আর সে ভালো থাকব তাই মনে করো?বেকুব পোলা সোজা কথা বুঝে না?’
বন্ধন এবার নেড়েচেড়ে বসে বুড়ীর কথায়,
“হঠাৎ এসব কথা কেন বলছো নানু?মিতুকে কি তোমার সেরকম মেয়ে মনে হয়?নীবিড় কিছু করেছে? দেখেছো কিছু?’
“না তয় দেখতে কতক্ষণ।মাইয়াটা বিয়ার পর থন একলা একলা উদাস হইয়া বইয়া থাকে।ঘরের কাম কাইজ করে ছোটবাবুরে নিজের পোলার মতোন আদর করে।কিন্তু নীবু যহনতহন মিতুর হাত ধরে।এইডা ভালা লাগে না।’
“তাই নাকি?’
“হো তাইলে আর কি কই?’
বন্ধন এর এয়ারফোর্সে দায়িত্ব আজকাল বেশী। আর তাদের ইদানীং র‍্যাংকিং যত বাড়ে তাদের দায়িত্বও বেড়ে যায়।কাজ না থাকলেও সেনাবিভাগ এ যাওয়া তার দায়িত্ব। মিতুকে সে আসলেই ঠিকমতো সময় দিতে পারে না।শুধু মিতু কেন বাবাইকেও পারেনা।বিয়ের আগে মিতুর সাথে দেখা করে,যে কথা তাকে বলেছে এই কারনে এবং এই সময় না দেয়ার কারনেও আজ পর্যন্ত মিতু, মুখ ফুটে কোন অনুযোগ নিজ থেকে করেনি।সেদিন রাতে আদর করার সময়ই শুধু অভিমান করেছে।কিন্তু অনেক লক্ষী মিতু।তবে নীবিড়ের ব্যাপারটা তার কাছে মোটেও ভাল লাগছে না।
বন্ধন তার শোবার ঘরের ওয়াশরুমে হাত মুখ ধুতে চলে যায়।অপেক্ষায় থাকে মিতু তোয়ালেটা তাকে আগিয়ে দিবে।মিতু অবশ্য বন্ধনের সব কিছু আগে থেকেই গুছিয়ে রাখে বন্ধন অফিস যাওয়ার আগে বা পড়ে।কখনো বিছানায় ওর কাপড় রেখে দিয়ে যায়।কখনোবা হাতে টাওয়ালটা দেয়।বন্ধনের খুব ইচ্ছে করছে মিতু এখন এসে তোয়ালেটা ওর হাতে দিবে।মিতু বেশীরভাগ শাড়ী পড়ে।আজও পড়েছে হালকা ঘিয়া,গোলাপী শেডের শাড়ী।
“ইশ গোলাপী শাড়ীতে মেয়েদেরকে সেইরকম আবেদনময়ী মনে হয়! কেয়াকেও লাগতো আর মিতুকে প্রথম হালকা গোলাপী শাড়ীতে দেখেছিলাম যেদিন প্রথম বিয়ের আগে আমরা কথা বলেছিলাম।ওকে আরো বেশী বেশী এইসব সফট কালার শাড়ী কিনে দিতে হবে।’
‘শাড়ীর ফাঁকে ওর ফরসা পেট সেভাবে দেখা না গেলেও বোঝা যায়।মিতুকে বারণ করতে হবে ঘরে নীবিড় আছে ঢেকে ঢুকে রাখতে।’
” কই ও এদিকে আসছে না কেন?তাহলে ওকে একটু কাছে পেয়ে আদর করা যেতো।কি নরম স্পঞ্জের মতো মিতুর শরীর!আমি ধরলেই কেমন কেঁপে ওঠে মেয়েটা।আর আদর করলে চোখদুটো বন্ধ করে যে কই হারায় যায়,কি যে ভালো লাগে ওকে দেখতে ….!’
বন্ধন মনে মনে ভাবছে আর এদিক-ওদিক মিতুকে খুঁজছে।বন্ধন খেতে বসবে কি খুশী মেয়েটা যত্ন সহকারে খাবারগুলি নিজ হাতে বাড়ছে তার স্বামীর জন্যে।বুয়া চলে গেছে ততক্ষণে।মিতু আবারো সালাদ কাটতে ব্যস্ত।
বন্ধন ঘরে ঢোকার সময় খেয়াল করে ব্যাপারটা।মিতুকে সাবধান হতে বল্ল,”দেখো আজ আবার হাত কেটে ফেলোনা।’
“আরে ধাৎ খাবার একটু পরে বাড়লেই তো হতো।আমি তো খেয়েই চলে যাবো।ততক্ষণে ও আসতে পারে না স্বামীর কাছে?মেয়েটা কি বুঝে না?’
বন্ধন মুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে ডাইনিং রুমে যায় ফের।টেবিলে সব বেড়ে রেখেছে মিতু।করল্লা ভাজি,মুরগী দিয়ে আলু,লাউশাখ দিয়ে ছোট চিংড়ি,মশুর ডাল চর্চরী।
“বাহ্ দারুন’সন্তুষ্ট চিত্তে ভাবে বন্ধন।সালাদটা দেয়া হয়নি এখনো।বন্ধন এবার নীবিড়ের কন্ঠ শুনতে পেল।
“ভাবী ও মিষ্টি ভাবী…টাকা দাও টাকা লাগবে।’
মিতু বেশ বিরক্ত।বন্ধন চেয়ার ছেড়ে উঠে রান্নাঘরে উঁকি দেয়।বন্ধন দেখলো নীবিড় মিতুর হাত থেকে সালাদ কাটার ছুড়ি সরিয়ে হাত ধরে টানাটানি করছে।
মিতু বারণ করছে,”আহ্ নীবিড় আমার হাত ছাড়ো,ব্যাথা পাচ্ছি আমি।’
“না ছাড়বো না আগে বলো টাকা কখন দিবা?’
বন্ধন এবার প্রচন্ড রেগে যায়,
“মিতু…এই মিতু সালাদ কাটতে এতক্ষণ লাগে?’
মিতু তাড়াতাড়ি সালাদ নিয়ে ডায়নিং টেবিলে যায়।
বন্ধন এর প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে থাকে।
বন্ধন হাত দিয়ে বাঁধা দেয়।
“থাক লাগবে না ক্ষিধে নেই।’
“ক্ষিধে নেই?কিন্তু কেন?কি হয়েছে?’অবাক হয়ে মিতু জিজ্ঞেস করে।
থমথমে মেজাজে বন্ধন কয়েকটা কথা বলে ওঠে।নীবিড় ও আসে ডাইনিং রুমে।
“এতো অবাক হচ্ছো কেন মিতু?ভালোই তো আছো আমাকে ছাড়া।আমি রুমে গেলাম তুমি টাওয়ালটা এগিয়ে দিতে পারলে না? সালাদ কাটতে এতক্ষণ লাগবে কেন?’
“আমি তো আপনার টাওয়াল ওয়ার্ডরবের মাথায় রেখে দিয়েছি আপনি খুঁজে পান নি?’
“থাক এত চিন্তা করতে হবে না তোমাকে।’
এরপর নীবিড়কে একটা ঝাড়ি দেয় বন্ধন।
“এই সারাদিন ঘরে থাকিস কেন তুই?কাজ নেই তোর?রান্নাঘরে কি এত?’
নীবিড় ভাইয়ের ঝাড়ি খেয়ে থতমত খেয়ে যায়।
বন্ধন এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে নেয়।
মিতু বেশ ঘাবড়ে যায়,
“প্লিজ এমন করবেন না,আমার ভুল হয়ে গেছে।প্লিজ এভাবে না খেয়ে যাবেন না?’
বন্ধন হাতঘড়িতে সময় দেখে।
“না আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে,এখন সময় নেই।’
বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে হাঁঠা দেয়।
মিতু এর আগে কখনো বন্ধনকে এত রাগতে দেখেনি।
যাবার সময় শুধু বলে যায়,
“তুমি রেডী থেকো,তোমার চাচার বাসা থেকে ঘুরে এসো,আমি যেয়েই গাড়ী পাঠিয়ে দিচ্ছি।’বলেই ক্ষিপ্ত ভঙ্গীতে না খেয়েই চলে যায়।
মিতু অসহায় চাহনীতে বন্ধনের চলে যাওয়া দেখতে থাকে।
নীবিড় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কানে হাত দিয়ে সরি বলতে থাকে ভাবীকে।বন্ধনের ঠান্ডা মেজাজ।সহজে রেগে যায় না।কিন্তু যখন রেগে যায়, সবাই ভীষন ভয় পায়,চুপ করে থাকে।আজ অনেক দিন পর ভাইকে রাগতে দেখে সেও ভয় পেয়ে গেল।
মিতু এবার প্রচন্ড রেগে যায়,কটমট করে সেও তাকায় তার নির্বোধ দেবরের দিকে।
ছলোছলো হয়ে ওঠে মিতুর চোখ।দাঁতে দাঁত লাগিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে নীবিড়কে গালাগাল দেয় সে,
“আহাম্মক কোথাকার তুই দেখিস নাই তোর ভাইয়া এসেছে আমার হাত ধরে টানাটানি করছিস।শুধু গায়ে গোতরেই বড় হয়েছিস বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হয় নাই?
“তুই আমার হাত ধরে টানাটানি করিস কেন?এটা কি কানাডা যে যখনতখন তুই আমার হাত ধরবি?’
“সরি বলেছি তো…….’
ভীষন রেগে যায় মিতু।বেশী রেগে গেলে ও কথা গুলিয়ে ফেলে, কিছুই বলতে পারে না তখন।
ফের মনে মনে বিড়বিড় করে,
“এখন সরি বলে কি হবে?আমার যা ক্ষতি করার তা তো করেই ফেল্লা …… ‘
ফের তার শোবার ঘরে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মিতু…..
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here