#রঙধনুর_রঙ_কালো(২)
*********************
রেস্টুরেন্টে এসে মিলা’র মনটা কেমন কেমন করতে লাগলো। ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় পুড়তে লাগলো মামুনের সাথে মিথ্যে বলার কারণে। নিজের ওপর ভীষন রাগও হলো তার । এক কাপ কফি খেয়েই কাজের ব্যস্ততার কথা বলে সাইফকে বিদায় জানালো সে । ব্যাংকে ফিরে দিনের বাকী কাজগুলো গুছিয়ে নিতে থাকলো মিলা ।
ওর পাশের ডেস্কেই রিমা বসে । গতবছর অফিসে সবার আগে রিমা তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলো । বিকেলে সবাইকে ট্রিট দিয়েছিলো মিলা । আজ এই পর্যন্ত কেউই কোনো শুভেচ্ছা জানালো না । রিমা যেন অন্যদিনের চেয়ে বেশী ব্যস্ত, কথা বলার ফুরসতই মিলছে না তার। অথচ গতমাসে রিমার জন্মদিনে সে কী সুন্দর একটা আয়োজন করেছিলো ।
কাজ শেষে বেরোবে এমন সময় বস একটা জরুরী ফাইল ধরিয়ে দিলেন । মেজাজটা পুরোই খারাপ হয়ে গেলো মিলা’র । সে বলতে চেষ্টা করলো –
স্যার, আমি কাল ফার্স্ট আওয়ারে কাজটা রেডি করে আপনার টেবিলে দিয়ে দেবো ।
না, না, কাল হবে না মিলা । আজই লাগবে । মাত্র দশ মিনিটের কাজ । এটুকু করে দেন প্লিজ । চিঠিটা আমি সাথে নিয়েই বের হবো।
স্যার রিমাকে দিয়ে যাই?
মিলা’পু, সরি। ভীষন কাজ আছে আমার । তোমারটায় এখন হাত দিতেই পারব না ।
অল্প কাজ রিমা ।
উহু, আপু একটু কষ্ট করে তুমি নিজেই করে দাও ।
মামুন অপেক্ষা করবে রিমা ।
ভাইয়াকে চলে আসতে বলো । এক কাপ চা খেতে খেতেই তোমার কাজ হয়ে যাবে ।
রিমার ওপর ভীষন রাগ হয় মিলা’র । এভাবে মুখের ওপর না করতে পারলো মেয়েটা! আর কথা না বাড়িয়ে মিলা ফাইলটা খুলে বসলো ।
ঠিক পাঁচ মিনিট বাদেই সবাই জড়ো হলো ওর টেবিলে । এমনকি মামুনও চলে এলো । মামুন তো অন্যদিন ভেতরে আসে না । মামুনকে আসতে দেখেই রিমা দৌড়ে চলে গেলো মামুনের কাছে । কী সব বলতে বলতে দুজন এগিয়ে আসছে মিলার টেবিলের দিকে। তখনই মিলা বুঝলো, তাকে আটকে রাখার জন্যই এত নাটক ! নিমিষেই রিমার ওপর জমে থাকা রাগ মুছে গেলো । কেট কাটা, খাওয়াদাওয়া শেষে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা ।
গাড়িতে উঠেই মামুন বললো –
ভীষন মন খারাপ হয়েছিলো বুঝলে । দুপুরে তোমার সাথে দেখা হলো না । পরে ভাবলাম, তোমার তো আসলে কিছু করার ছিলো না । তোমারও নিশ্চয়ই অনেক খারাপ লেগেছে? অবশ্য রিমা’র এই আয়োজন মনটা ভালো করে দিলো, কী বলো ।
মিলা যেন মামুনের চোখের দিকে তাকাতেই পারছে না । মনে হচ্ছে তাকালেই তার মিথ্যে ধরা পরে যাবে।
কী হলো? মন খারাপ?
না, কিছু না ।
তাহলে এমন করে আছো কেন?
আজ দুপুরের জন্য সরি মামুন ।
আহা,,, বাদ দাও তো । দেখো তো সবাই কতো আনন্দ করলাম একটু আগে । বাড়িতে তোমার ছেলে মেয়ে অপেক্ষা করে আছে । একটু পরে আরো আনন্দ হবে ।
মিলা কিছু বলে না, চুপ করে থাকে ।
রাতে সত্যিই সবাই মিলে অনেক আনন্দ করলো । ছেলেমেয়ে দু’টো ও ভীষন খুশী।
এরপর যে দিন সাইফ এলো, একটু সচেতন ভাবেই কথা বললো মিলা । কাজের বাইরে তেমন কোনো কথা বললো না দেখে সাইফ নিজে থেকেই কথা তুলল-
কোনো কারণে মন খারাপ মিলা?
জ্বী না । চা দিতে বলবো সাইফ ভাই?
মনে হচ্ছে মন খারাপ । সুন্দর মানুষের মন খারাপ হলে সেটা চেহারায় প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। যেটা আমি এখন তোমার চেহারায় দেখতে পাচ্ছি ।
না, না, তেমন কিছু না । কাজের চাপ একটু বেশী, এই আর কী ।
কাজ তো সারাক্ষণই করো । কাজ তো তোমাকে কাবু করতে পারে না । আমার ধারণা অন্য কিছু । অবশ্য আমি বাইরের মানুষ, আমাকে কেন সব কথা বলবে তুমি?
না, সত্যিই কাজের চাপেই একটু হাঁপিয়ে উঠেছি ।
আর আমি এর মাঝে এসে বিরক্ত করে যাচ্ছি । ঠিক আছে উঠি । বিরক্ত করার জন্য সরি।
সাইফ ভাই আপনি অন্যভাবে নিয়েন না প্লিজ । সত্যি অন্য কিছু না ।
সাইফ বিদায় নিয়ে চলে গেলো । যেতে যেতে ভাবলো, জালটা আরো নিবিড় করে বেছাতে হবে যেন মিলা একদম টের না পায় । তাড়াহুড়োয় সব কিছু নষ্ট হয়ে যায় ।
সাইফ চলে যাওয়ার পর মিলা’র মন খারাপ হয়ে গেলো । সত্যি তো লোকটা তো কোনো খারাপ আচরণ বা ইঙ্গিত করেনি তার সাথে তাহলে সে কেন শুধু শুধু অমন ব্যবহার করতে গেলো? দুর ছাই, কী সব উল্টা পাল্টা হয় বার বার । কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করলো মিলা ।
এরমধ্যে সাইফ আর ওমুখো হলো না । প্রয়োজনীয় কিছু ডকুমেন্টস সে মিলা’র কাছে পৌঁছে দিলো অফিস সহকারীর মাধ্যমে। মিলা একটু অবাক হলো । কারণে অকারণে যখন তখন এক কাপ চা খাওয়ার জন্যে যে লোক চলে আসতো সেই মানুষটার কোনো খোঁজই নেই । কী ভেবে ফোনটা হাতে নিলো মিলা । রিং হয়ে থেমে গেলো একসময় । মিলা একটা ম্যাসেজ দিয়ে রাখলো –
“সাইফ ভাই, রাগ করে আছেন নাকি? চায়ের দাওয়াত রইল”।
মিলা বুঝতেও পারলো না যে সে আসলে তার খারাপ দিনকে দাওয়াত দিয়ে আনলো ।
ম্যাসেজ পড়ে সাইফ মনে মনে হাসলো । তার প্ল্যান কাজ করতে শুরু করেছে ।
দু’দিন পর সাইফের কাছ থেকে একটা গিফ্ট বক্স এলো । মিলা খুলে দেখলো, তার পছন্দের গানের সিডি আর রবীন্দ্রনাথের “সঞ্চয়িতা”। সাথে ছোট একটা চিরকুট – সব সময়ের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং ভালো বন্ধু হতে চাই । মিলা খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো । সে তো তার পছন্দ সাইফের সাথে শেয়ার করেনি তাহলে তিনি জানলেন কীকরে! অবাক ভাব নিয়েই সে ফোন করলো সাইফকে –
হ্যালো, সাইফ ভাই….
হ্যা, মিলা কেমন আছো তুমি?
জ্বী, ভালো আছি, আচ্ছা সাইফ ভাই এগুলো পাঠানোর মানে কী? আপনি তো ভাই আমাকে ঋনী করে দিচ্ছেন ।
আরে এগুলো কিছু না। ভাবলাম তোমার হয়ত ভালো লাগবে।
এসবই আমার অসম্ভব প্রিয় কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে বলেন তো?
তুমি কী ভুলে গেছো মিলা তোমার একাউন্ট জুড়ে রবীন্দ্রনাথ?
একাউন্টে রবীন্দ্রনাথ আসে কীভাবে টাকা পয়সার মধ্যে?
আরে, ব্যাংকে কাজ করতে করতে একাউন্ট বলতে শুধু ব্যাংক ব্যালান্সই বুঝলে ম্যাডাম । ফেসবুক বলে তো একটা জিনিষ আছে নাকি?
মিলা লজ্জা পেয়ে যায় । কী আকাশ – পাতাল ভাবছিলো সে এতক্ষণ। তার সব ভালো লাগা, আনন্দ-দুঃখ তো ফেসবুকে শেয়ার করেই । সাইফ ভাই তাহলে ওখান থেকেই জেনেছে সবকিছু ।
তুমি বোধহয় গান খুব ভালবাসতে তাই না মিলা? তোমার অনেক পোষ্ট আছে গান নিয়ে । স্কুল, কলেজের দিনে পুরস্কার হাতে কতো ছবি । কই তুমি তো বলোনি একবারও যে তুমি এতো ভালো গান করো ।
করি নাতো, করতাম একসময় ।
কী বলো! তোমার কতোগুলো ছবি দেখলাম পুরস্কার হাতে নিয়ে । সেই তুমি আর গান করো না! এটা সম্ভব?
এখন আর পারিনা সাইফ ভাই । চাকরি, সংসার সব কিছু নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকি যে গানে আর সময় দিতে পারিনি ।
এটা খুব খারাপ । তোমার মতো প্রতিভা এভাবে আঁধারে ডুবে যাবে, মানা যায় বলো?
না, মানে এখন আর ইচ্ছেও করে না তেমন ।
নিজের মনের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখো । দেখতে পাবে সেখানে ইচ্ছেরা মুখ গোমড়া করে বসে আছে ।
কী যে বলেন না আপনি?
আমি সত্যি বলছি মিলা । নিজেকে আবার ভালবাসতে শেখো। অনেক ভালো লাগবে ।
ফোনটা রেখে মিলা চিন্তা করে, সত্যি তো কতোদিন হলো গান ছেড়েছে কিন্তু গানের মোহে সে এখনো পড়ে আছে । গানটা তার ভালবাসা ছিলো । কী করে সে গান থেকে এতো দুরে সরে গেলো ? আজই মামুনকে বলবে সে ।
রাতে খাওয়ার টেবিলে প্রতিদিন আড্ডা হয় ওদের চারজনের । সবার সারাদিনের জমে থাকা সব কথা তখন ডালপালা মেলে বসে । অপূর্ব আজ স্টুডেন্ট অফ দা মান্থ এর এওয়ার্ড পেয়েছে । সেটা নিয়ে কতক্ষন গল্প চলে । পূর্বা’র ছবি আঁকা, গানের ক্লাসের মজার ঘটনা শোনে সবাই । এটা ওটার ফাঁকে মিলা হঠাৎ বলে –
আমি গানটা আবার শুরু করবো ।
সত্যি মা, আবার গান গাইবে তুমি? তাহলে কাল আমার সাথে গানের ক্লাসে চলো না মা । খুব মজা হবে ।
আরে তুমি আবার এখন কী গান শুরু করবে? এসো গান শিখি? হেসে বলে মামুন ।
একটু রাগ হয় মিলা’র । বলে, আগে কিন্তু আমার গানের ভক্ত ছিলে তুমি। মনে আছে?
আমি তো দুষ্টুমি করলাম । তুমি সিরিয়াস হয়ে গেলে নাকি? আমি এখনো তোমার গানের ভক্ত আছি ।
চল না মা কালকে আমার সাথে, পূর্বা বলে ।
আরে মা কী আর সত্যি গান করবে এখন? কী মিলা তুমি শুরু করবে আবার? ভালোই হবে কিন্তু ।
মিলা ভাবে মামুন তার সাথে ঠাট্টা করছে । গান নিয়ে আর কথা বলে না সে । প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। শুধু ভাবতে থাকে, মামুন তার কথায় কোনো আগ্রহই দেখালো না অথচ সাইফ ভাই কী দারুণভাবে তাকে উৎসাহ দিলেন গানটা আবার করার জন্যে ।
কোনো একটা সেমিনারে অংশ নিতে মামুন জাপান গেছে সাত দিনের জন্য । অফিস শেষে মিলা একাই বাড়ি ফেরে । ছুটির ঠিক আগে আগে সাইফের ফোন এলো –
হ্যালো, মিলা ব্যস্ত তুমি?
না, এই তো বের হবো একটু পরে । আপনি ভালো আছেন?
আছিতো । আচ্ছা শোনো, বিখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে গানের ফেস্টিভ্যাল চলছে জানো তো?
হুম, খুব ইচ্ছে ছিলো একদিন যাবো । দেখি যদি এর মধ্যে সময় করতে…
আরে শোনো, শোনো, সময় বের করে নিতে হয় । সময় এমনি ধরা দেয় না । আমি তো জানি এমন একটা শো তুমি ভীষন মিস করবে । তাই টিকেট আনিয়ে রেখেছি । আজ সন্ধ্যার শো’র। যাবে তুমি?
আজ? আমার তো কোনো প্রিপারেশনই নেই ।
আমি অফিসের কাছেই আছি । যদি তুমি বলো, আসতে পারি । আমারও তো ভীষন পছন্দ রবীন্দ্র সংগীত । ভাবলাম তোমার সাথে গান শুনতে ভালোই লাগবে । সবাই তো গান বোঝে না । অবশ্য তুমি যদি চাও তবেই…
এক মুহূর্ত ভেবে মিলা বলে, আমি ঠিক পাঁচ মিনিট পরে বের হয়ে রাস্তার মোড়ে আসছি । আপনি থাকেন ।
মোড়ে এসে মিলা দেখলো সাইফ ওর জন্য অপেক্ষা করছে । মিলা গাড়িতে উঠে বসলো । গাড়ি চললো ধানমন্ডির পথে ।
অনেক দিন পর ভীষন ভালো লাগলো মিলা’র । এতো চমৎকার একটা অনুষ্ঠানে কতোদিন পরে যে এলো । বিয়ের আগে সে আর মামুন কতো ঘোরাঘুরি করতো । কোনো অনুষ্ঠান, কোনো মঞ্চ নাটক বাদ দিয়েছে ওরা? কী সুন্দর ছিলো দিনগুলো । বিয়ের পর থেকে বিশেষ করে বাচ্চারা হওয়ার পর থেকে এধরনের অনুষ্ঠান গুলোতে তার আর যাওয়াই হয়নি । মামুন তাকে যেতে নিষেধ করেনি কিন্তু নিজে থেকে যাওয়ার কথাও বলেনি । সাইফ ভাইয়ের কাছে সে আজ কৃতজ্ঞ, তার হারানো ভালোবাসাকে জাগিয়ে তোলার জন্যে । মামুনের প্রতি একটু অভিমান জমা হলো তার মনে ।
গানের আবেশে কাটলো পরের কয়েকটা দিন । মিলা ভাবছে, গানটা সে আবার সিরিয়াসলি শুরু করবে । সাইফ ভাই তাকে না জাগালে তো জানাই হতো না যে তার মনের ইচ্ছেগুলো এখনো উড়াল দিতে চায় ।
মামুন না থাকলে বাড়িটা অনেক নিরব থাকে । মামুন সারাক্ষণ ছেলেমেয়ে নিয়ে হৈচৈ করতে থাকে । মামুন বাইরে থাকলে ওরা বিনুর কাছেই বেশী থাকে । এমনিতেও ওরা বিনুর কাছেই তো থাকে সারাক্ষণ । টিচার পড়িয়ে যাওয়ার পর ভাইবোন দুজন মা’র রুমে এসে ঢুকলো –
মা, চলো না কোথাও যাই । বাবা ছাড়া ভালো লাগছে না । বাবাকে বলো তাড়াতাড়ি চলে আসতে ।
কালকে ক্লাস আছে তো তোমাদের । এতো রাতে বাইরে গেলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে । বাবা আসুক তারপর একসাথে যাবো । বিনুকে বলো তোমার সাথে খেলতে ।
মন খারাপ করে বিনুর কাছে চলে যায় পূর্বা ।
মা আমার প্রজেক্টে একটু হেল্প করবে? কাল জমা দিতে হবে ।
মা, ছেলে প্রজেক্টের কাজ নিয়ে বসে । মিলা মনে মনে ভাবতে থাকে, ছেলেমেয়ে দুটো ওদের বাবাকে খুব মিস করে অথচ তার কাছে ঠিক সেভাবে ঘেঁষে না । এর জন্য তো আসলে সে ই দায়ী । সে কখনো বাচ্চাদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি । ওদের সবকিছুতেই ওদের বাবা । মামুনের যেন পুরো দুনিয়া একদিকে আর বাচ্চা দুটো একদিকে……….
চলবে..