#হৃদ_মাঝারে_তুমি
#পর্ব_০৫
#Written_by_Mehebin_Nira (ছদ্মনামী)
চারদিকে আদ্রাজ আর নিরা কে খুঁজতে গিয়ে হয়রান আশা। মেয়েটার জন্য খুব টেনশন হচ্ছে। একটু আগে তাও আদ্রাজ ছিলো এখন সেও উধাও হয়ে গেলো। এসব হচ্ছে টা কি? রাতুল কে দেখে আশা তার দিকে এগিয়ে যায়। রাতুল আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। তার ভাবনার জগতে বিচর শুধু আশার। একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছে সে আশা কে কিন্তু কখনো বলার সাহস হয়ে উঠে নি। দারুণ লাগে মেয়েটাকে তার কাছে। আশা পেছন থেকে বলল,
‘বলছি যে আপনি কি নিরা কে বা আমার ভাইয়া কে এখানে কোথাও দেখছেন!’
যাকে প্রশ্ন টা করলো সে একেবারে নিশ্চুপ।
‘কি হলো কথা বলছেন না কেন?’
রাতুল এবার পিছন ফিরলো। চোখ জোড়া ছোট ছোট করে আশা কে দেখছিলো। কিছু সময়ের জন্য মনে হচ্ছে আশা তার কল্পনা। আর সে কল্পনায় এতোটাই বিভোর যে তার সামনে আশা কেও বাস্তব মনে হচ্ছে। এদিকে আশা উত্তর না পেয়ে খুব বিরক্ত হলো। চিল্লিয়ে বলল,
‘বয়রা হয়ে গেছেন নাকি? কিছু জিঙ্গেস করছি আমি আপনাকে!’
থতমত খেয়ে যায় রাতুল। আতঙ্কিত হয়ে কানে দু হাতের দুইটা আঙ্গুল চেপে ধরে। কপাল কিঞ্চিত বাঁকা করে বলল,
‘কানের পর্দা ফাটিয়ে দিবে নাকি?’
‘ফাটে নি এখনো? আমি তো ভাবছিলাম আপনি অলরেডি বয়রা হয়ে গেছেন!’
‘তোমার মনে আর কি কি হয় ভূত… না মানে..
আশা রাতুলের অর্ধেক কথাটার ফুল মিনিং বুঝতে পেরে নাক ফুলিয়ে নেয়।
‘আপনার সাথে ঝগড়া করার কোনো মুড নাই আমার। আদ্রাজ ভাইয়া আর নিরা কে দেখেছেন?’
‘বললে কি দিবে?’
‘উষ্ঠা কিল ঘুসি [বিড়বিড় করে]’
‘কি বললে?’
‘উফ্ আমার মাথা! আপনার সাথে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে!’
আশা চলে যেতে নেয় রাতুল বলল,
‘আদ্রাজ কে দেখেছিলাম কোথাও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে। নিরা কে দেখেনি!’
আশা হা হুতাশ করে বলল,
‘কেন যে মরতে নিরা কে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। মেয়েটা কে আমার জন্য বারবার বিপদে পড়তে হচ্ছে। না জানি এখন আবার কোথায় গেলো! কোনো খারাপ কিছু হয়ে গেলে কি করবো আমি? আর ভাইয়া এতো রাতে গাড়ি নিয়ে কোথায় গেছে?’
‘রিল্যাক্স আশা। এতো হতাশ হচ্ছো কেন?’
‘তো কি ডান্স করবো?'[রেগে]
‘করবে? মন্দ হয় না কিন্তু![ডেভিল স্মাইল দিয়ে]
আশা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে রাতুলের দিকে তাকায়। রাতুল হাসতে হাসতে বলল,
‘ওকে ওকে সরি। আমি যদি ভুল না বলি তাহলে নিরা আদ্রাজের সাথেই আছে। কল দিয়ে দেখো!’
‘আপনার কি মনে হয় আমি চেষ্টা করিনি? কল ঢুকছে না কারো ফোনে!’
‘নিরার বিপদে আদ্রাজ আছে ওকে সেইফ রাখার জন্য চিন্তা করো না!’
রাতুল যতটা সম্ভব চেষ্টা করলো আশা কে সান্ত্বনা দেওয়ার। রাতুল ও নিজের ফোন টা বের করে কল দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সত্যি ই কল যাচ্ছে না।
‘কাম অন আদ্রাজ! কোথায় তুই? ফোন টা তো অন্তত খোলা রাখবি নাকি?’
_______________________
আদ্রাজ নিরা কে নিয়ে সোজা হসপিটালে চলে আসে। ভাগ্যিস পাশেই একটা হসপিটাল ছিলো! নাহলে কি করতো এতোক্ষণে সে? মনে পড়ে গেলো তখনকার ঘটনা…….
আদ্রাজ নিরার কাছে এসে দেখে নিস্তেজ হয়ে নিচে পড়ে আছে নিরা। টোটালি সেন্সলেস সে। ভয় পেয়ে যায় আদ্রাজ। এই এক্ষুনি তো ভালো ছিলো হঠাৎ কি এমন হলো যে সরাসরি সেন্সলেস হয়ে গেছে? আদ্রাজ হাটু গেড়ে বসে নিরার গালে হাত রেখে বলল,
‘নিরা চোখ খোলো! প্লিজ!’
অনেক ডাকাডাকির পর ও কোনো রেসপন্স পেলো না সে। পেছন থেকে কারো গলা শুনে হকচকিয়ে যায় আদ্রাজ। কতগুলো লোক দাঁড়ানো। তারা ব্যাপার টা লক্ষ্য করে বলল,
‘কে তুই? আর মেয়েটাকে নিয়ে এতো রাত রাস্তায় কি করছিস?’
‘কি আর করবে বুঝো না মিয়া! নিশ্চয়ই বড়লোকের নবাবজাদা মেয়েটাকে একা পাইয়া তার সর্বনাশ করার চেষ্টা করতেছে!’
‘সত্যি ই কইছিস ছোট। আমরা থাকতে মাইয়াডার সর্বনাশ হইতে দিমু না ধর ছেলেটারে! আজকে আরেকটা লাশ পড়বে এইহানে!’
আদ্রাজ সব শুনে খুব অবাক। এমন কোনো ভাবনার ছিটে ফোঁটাও তার মনে নেই। কি যাতা বলছে এই লোক গুলো? ছিহ..
লোকগুলো আদ্রাজ কে ধরতে এলে আদ্রাজ নিরা কে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পেছনের দিকে তাকায়। তিন জন লোক। তাকে উঠতে দেখে ঐ লোকগুলো বলে,
‘কিরে ভয় পাইয়া গেলি নাকি?’
‘কি সব বলছেন আপনারা?’
‘কেন শুনতে পাস নি? মাইয়া ডারে একা পাইয়া রাস্তায় সর্বনাশ করতে চাচ্ছিস?’
একজন চিল্লিয়ে বলে,
‘ওস্তাদ মাইয়া ডা তো অজ্ঞান হইয়া পইড়া আছে! এই পোলায় ওরে অজ্ঞান কইরা দিসে!’
‘কিহহহ..!’
লোক গুলো উল্টা পাল্টা বলতে শুরু করে। যা শুনে আদ্রাজ রেগে যায়। সে কিছু বলতে নিবে আরো দুটো লোক আসে। অলরেডি তারা আদ্রাজ কে মারার প্রিপারেশন নিচ্ছে। অবস্থা বেগতিক। আদ্রাজ তার আম্মুকে কথা দিয়েছিলো আর কখনো মারামারি তে জড়াবে না তাই আদ্রাজ নিজেকে দমিয়ে রাখলো। নাহলে এরকম আট দশটা মানুষ কে শায়েস্তা করা তার বা হাতের খেল মাত্র! মারামারি তে না গিয়ে বরং সুন্দর করে কিভাবে মানুষ গুলো কে মানানো যায় তাই ভাবছে সে। শেষমেশ উপায়ান্তর না পেয়ে বলল,
‘দেখুন আপনারা যা ভাবছেন তা ভুল! ও আসলে আমার স্ত্রী!’
‘তোর বউ হইলে এমনে বেহুঁশ হয়ে গেছে ক্যামনে রে বেটা?’
‘রাগারাগি হয়েছিলো তাই গাড়ি থেকে নেমে গেছে। ঐ যে দেখুন গাড়ি। আমি ওকে মানাতে আসছিলাম হুট করে অজ্ঞান হয়ে গেছে!’
‘সত্যি বলছিস?’
‘জ্বি!’
লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কি যেনো বিড়বিড় করলো তারপর বলল,
‘বেটা বউয়ের সাথে কেউ রাগারাগি করে রে? বউ হলো ঘরের লক্ষী! দেখ মেয়েটা কেমন নিষ্পাপ! যা বাড়ি নিয়ে যা ওকে!’
‘আচ্ছা!’
‘আর শুন..
‘জ্বি!’
‘স্বামী স্ত্রীর মাঝে রাগ কে বেশি প্রশ্রয় দিতে নাই। রাগ হচ্ছে সয়তান প্রদত্ত। দিনে রাগ হলে রাত পর্যন্ত আসতে দিস না। স্বামী স্ত্রীর বন্ধন হলো পবিত্র। যার মধ্যে সয়তান আসতে পারে না। নিজ থেকে সয়তান কে আসতে দিস না। বুঝলি কি বলতে চাইছি?’
‘বুঝছি!’
সেই লোকটা এবার গলা টা ছোট করে মায়াময় কন্ঠে বলল,
‘বাজান কিছু মনে করিস না। আমার ও একটা মাইয়া আছিলো! [নিরার দিকে ইশারা করে[ ঐ মাইয়াডার মতো! আমার সেই মাইয়াডারে রাতের আঁধারে নড়পশুদের হাতে পড়ে ধর্ষিত হয়। পরে ওরা আমার মাইয়াডার ক্ষত বিক্ষত লাশ এখানেই ফেলে গেছে! সেই থেকে বাবা হিসেবে পন করেছি আর কোনো বাবা মায়ের বুক খালি হতে দিবো না! আর কোনো মাইয়ার সর্বনাশ করতে দিবো না! তোকে দেখে আমরা প্রথমে তাই ভাবছিলাম! ভুল হয়ে গেছে রে!’
কথা টা বলতে বলতে লোকটার গলা ধরে আসছিলো। সম্ভবত উনি কাঁদছে। ইশ মেয়েটার জন্য আফসোস হচ্ছে! প্রথমে যতটা রাগ হয়েছিলো এক মুহুর্তে সব উবে গেলো। মন টা খারাপ হয়ে গেছে! সঙ্গে সঙ্গে রোহানের কথাটা মাথায় আসতেই বেঁকে বসলো। রোহানের মতো জানোয়ার গুলোর জন্য মেয়েরা আজ এতো অসহায়!
‘মিস্টার আদ্রাজ আপনার ওয়াইফের জ্ঞান ফিরেছে!’
পেছন থেকে একজন সিস্টারের কন্ঠে উক্ত কথাটা শুনে চমকে উঠে বাস্তবে ফিরে আসে আদ্রাজ। ‘আপনার ওয়াইফ’ কথাটা দ্বিতীয় বারের মতো সিস্টারের কাছ থেকে শুনতে কেমন একটা লাগলো! লোকগুলো কে মিথ্যা বলেছিলো তাদের ভুল ধারণা ঠেকাতে। কারণ এছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিলো না। হসপিটালে এসে পরিচয় দিতে হয় নি তাকে। তাহলে কি সিস্টার টাও ভাবছে তারা স্বামী স্ত্রী?
সিস্টার আদ্রাজের অদ্ভুত চাহনি দেখে হতভম্ব হয়ে বলল,
‘এতো রাতে উনাকে নিয়ে এসেছেন! অবশ্য আপনার স্ত্রী ই হবে তাই না?’
‘ইট্স ওকে! আমি যাচ্ছি দেখতে!’
আদ্রাজ তেমন কিছু বললো না। সিস্টার ও চলে গেলো। কেবিনের ভেতরে ঢুকতেই দেখলো নিরা বেডে বসে আছে। আদ্রাজ কে দেখে চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়। আদ্রাজ তা খুব ভালো করে খেয়াল করলো। দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে নিরার সাথে কথা বলতে! যেই কাজ করলে দ্বিতীয় বার ঐ মানুষটির সাথে কথা বলতে দ্বিধা হবে সেই কাজ করা মোটেও কারো উচিত নয়! আদ্রাজ কে ক্রমশ তার দিকে আসতে দেখে নিরা বেড থেকে নেমে যায়। মাথা টা এখনো ঘুরঘুর করছে। নিজের ব্যালেন্স হারাতে নিবে ওমনি আদ্রাজ এসে তাকে ধরে ফেললো। নিরা শক্ত কন্ঠে বলল,
‘আ-প-নি এখানে কি করছেন?’
‘দেখতেই তো পাচ্ছো!’
‘ডোন্ট টাচ্ মি!’
‘নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারছো না কিন্তু কথার ব্যালেন্স তো দেখি ঠিক ই আছে!’
নিরা রাগি চোখ বলল,
‘আপনি এখানে কেন এসেছেন?’
‘তো কি অন্য কারো আসার কথা ছিলো?’
‘ছাড়ুন আমাকে!’
‘ওকে ওয়েট!’
আদ্রাজ নিরা কে বেডে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো।
‘এখানেই বসো এক চুল ও নড়বে না। আমি এক্ষুনি আসছি!’
আদ্রাজ কেবিন থেকে বের হয়ে হসপিটালের বিল চুকিয়ে দিতে যেতে নেয় তখনি ফোনে টুং করে একটা শব্দ হয়। আদ্রাজ ফোন টা বের করে দেখলো সেখানে লিখা,
‘দোস্ত কই তুই? নিরা কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আশা বেশ টেনশনে আছে! তোর ফোন ও বন্ধ নিরার ও। বুঝছি না কি হচ্ছে এসব? তুই কি নিরার সাথে আছিস? থাকলে একটু কুয়িকলি জানাস!’
মেসেজ টা আর কেউ নয় রাতুল পাঠিয়েছে। এতোক্ষণ আদ্রাজ অনেক চেষ্টা করেও নেটওয়ার্ক সংযোগ নিয়ে আসতে পারে নি। নো সার্ভিস দেখাচ্ছিলো। এই এখন মেবি একটু নেটওয়ার্ক পেয়েছে সাথে সাথে মেসেজ টা এসেছে। আদ্রাজ দেরি না করে মেসেজ লিখলো,
‘নিরা আমার সঙ্গেই আছে! আশা কে টেনশন করতে নিষেধ কর! আসছি আমরা!’
আদ্রাজ বুঝ উঠতে পারে নি। এই কয়েক টা বাক্য তাকে পঁচানোর জন্য ঠিক কতটা যথেষ্ট ছিলো!
______________
নিরা আদ্রাজ কে বেরিয়ে যেতে নিজে উঠে দাঁড়ায়। হসপিটালে নিজেকে আবিষ্কার করে ভালোই বুঝতে পেরেছিল কি হয়েছে। তার পেছনে তখন গাড়ি নিয়ে আদ্রাজ আসছিলো। আর সে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। অপমান করে এখন এটাকে স্রেফ আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে নিরার কাছে! সহ্য হচ্ছে না আদ্রাজ কে! তাই আদ্রাজ আসুক তার আগে নিজেই এখান থেকে প্রস্থান করবে! এমনিতেই অনেক করেছে! নাহয় এর জন্য ও খোটা শুনতে হবে। তার থেকে নিজেই চলে যাওয়া ভালো।
নিরা বের হয়ে যেতে নিবে তখনি সিস্টার টা কেবিনে ঢুকে বলল,
‘আপনার হাজব্যান্ড হসপিটালের বিল চুকিয়ে আসতে গিয়েছেন। এই টাইমে আপনি এই স্যুপ টুকু খেয়ে নিন। শরীর খুব দুর্বল আপনার! আপনি তো বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন। আপনার হাজব্যান্ড আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে! মুখ দেখেই বুঝেছি খুব ভালোবাসে উনি আপনাকে! আপনি খুব লাকি যে এমন একটা হাজব্যান্ড পেয়েছেন!’
চলবে———————