ময়ূখ পর্ব -১৪+১৫

#ময়ূখ
#পর্ব-১৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৪০.
জুলেখা কাজে ব্যস্ত। তাই মিরার হাঁক শুনে মৌন চা, ফুলকপি বড়া আর মাল্টা কেটে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলো। নিভৃত সিঁড়িতে দাঁড়ানো অবস্থায় কপাল কুঁচকে মৌনর দিকে তাকিয়ে আছে। বাড়িতে কি কোনো কাজের লোক নেই নাকি! এই মেয়ে খাবার নিয়ে এলো কেনো!

মৌন ড্রয়িং রুমে এসে টি-টেবিলে খাবার রেখে চলে যেতে চেয়েছিলো। মহিন তার মাকে ইশারা করতেই তিনি পিছু ডাকেন,
‘শুনো মেয়ে।’

মৌন পিছু ফিরে বলে,
‘আমায় কিছু বলছেন আন্টি?’
‘হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। এদিকে এসো। একটু মহিনের পাশে বসোতো।’

মিরা অনেকটা অবাক হলেন। এটা আবার কেমন কথা তাদের বাড়ির বউ পরপুরুষের সাথে বসবে কেন? মৌন কিছু না বুঝেই মিরার দিকে তাকালো। মিরা দাঁড়িয়ে বললো,
‘মানে ভাবি আপনি কি বলতে চাইছেন?’
‘দেখুন ভাবি যে কারণে আপনার বাড়িতে আসা। জুলেখাকে আমার মহিন পছন্দ করেছে। যদিও আমার মত ছিলোনা। তবে একমাত্র ছেলে বুঝেনই তো। জুলেখাকে আমি পুত্রবধূ করতে চাই।’

মিরা যারপরনাই অবাক হচ্ছেন। হচ্ছে কি এসব! তিনি আবার হাঁক ছাড়লেন।
‘জুলেখা!’

এবার জুলেখা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। হাতে তার আটা লেগে আছে।
‘জ্বি, বড়আফা।’

মিরা রেগে বললেন,
‘এই আমি তোর আফা লাগি! আমার ছেলের বউও আফা আবার আমিও আফা! গর্দভ।’
‘সিলিপিং অপ টেং বড়আফা ছরি খালাম্মা।’
‘ভাবি ও জুলেখা।’

মহিন দাঁড়িয়ে বললো,
‘না, আন্টি।’
অতঃপর মৌনকে দেখিয়ে বললো,
‘ও জুলেখা। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।’

মিরা দপ করে সোফায় বসে পড়লেন। এমন কান্ড ইহ জনমেও তিনি দেখেননি। তার ছেলের বউয়ের জন্য তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়েছে! এদিকে মৌনর লজ্জা, রাগে হলুদ চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মিরা মহিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তোমাদের সাহস দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। আমার বাড়িতে এসে আমার পুত্রবধূর জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছো!’

রুনা দাঁড়িয়ে গেলেন। মৌনর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আপনার পুত্রবধূ মানে ও তো আপনাদের নতুন কাজের লোক।’
‘আপনাকে এই অদ্ভুত কথা কে বললো?’

মিরার রাগে শরীর জ্বলে উঠেছে। নাটক শুরু করেছে নাকি! মহিন হঠাৎ নিভৃতের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ঐতো নিভৃত। এই নিভৃত তুই না বলেছিলি এই মেয়েটা তোদের নতুন কাজের লোক।’

মিরা রাগী দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। রুনা, জিল্লুর সাহেব আর মহিনের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘মৌন নিভৃতের বিয়ে করা বউ। আশাকরি আপনাদের আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই। আপনারা এখন আসতে পারেন।’

মহিন খুবই মর্মাহত হলো। রুনা রাগে গজগজ করতে করতে স্বামী, সন্তান নিয়ে প্রস্থান করলেন। মৌনর চোখের কোণা বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। এতোটা লজ্জা সে কখনো পায়নি। মিরা নিভৃতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘নিভৃত এসবের মানে কি! বিয়ে করা বউকে তুমি মানুষের কাছে কাজের লোক বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছো কোন সাহসে?’

নিভৃত নিচে নেমে এসেছে। মায়ের গলা শুনেই বুঝলো মা রেগে আছেন। আর রাগলেই কেবল তাকে বাবুই না ডেকে নিভৃত ডাকে।
‘মা, আমি…..
‘কোনো কথা শুনতে চাচ্ছিনা। এসব যেন দ্বিতীয়বার না শুনি।’

৪১.
পড়ন্ত বিকেলের হালকা আলো ঘরে প্রবেশ করছে। বারান্দায় ঢুকার দরজার পাশে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে মৌন। তার পাশেই মিটির খাঁচা রাখা। মিটিকে খাঁচা মুক্ত করলো মৌন। ছেড়ে দিলো বারান্দায়। মিটি উড়ছে আর খুশিতে বাকবাকুম করছে। তাকে মুক্ত করায় সে ভিষণ খুশি। মৌনর মিটির খুশি দেখে ভালোলাগছে। নিজে সুখী না হলেও অন্যের সুখে সে মন খুলে হাসতে জানে। উদাস ভাব কাটিয়ে মনে নেমে এলো স্নিগ্ধতা। যে রাগটুকু লোকটার জন্য ছিল তা কোথায় গেলো কে জানে! মৌন অনেক চেষ্টা করে রেগে থাকতে। তবে সে পারেনা। মিটি ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখা ঝাপটিয়ে নিজের স্বাধীনতা উপভোগ করছে।

তখনই ঘরে প্রবেশ করলো নিভৃত। সে আজ নিজের প্রিয় কালো রঙের পোলো টি-শার্ট পরেছে। ঘরে ঢুকেই নজর গেলো বারান্দায় দরজায় দ আকারে বসে থাকা উদাস মেয়েটার দিকে। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের টি-শার্টে কিছু পড়তে দেখে উপরে তাকালো সে। একটা কবুতর তার উপর বিষ্ঠা ত্যাগ করছে।

নিভৃত একচিৎকার দিলো।
‘স্টুপিড!’

মৌন হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘরের ভিতর প্রবেশ করতেই মিটি তার কাঁধে উড়ে এসে বসলো।
‘এই মেয়ে এটা তোমার?’
‘হ্যাঁ।’
‘এটারে যেন আর ঘরে না দেখি।’
‘কেনো?’
‘কেনো তোমার মাথা স্টুপিড।’

নিভৃত রাগে গজগজ করতে করতে বাথরুমে ঢুকে গেলো। মৌন হা করে তাকিয়ে মিটিকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই কিছু করেছিসরে, মিটি?’

মিটির চেহারাটা বড়ই অসহায় দেখালো। অর্থাৎ সে কিছুই করেনি। মৌন নিশ্চিত বদলোকটা নিজের দোষ ঢাকতে ঢং করছে।

____________________

কেটে গিয়েছে ছয়মাস। মৌন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন জীবনে মৌন অনেকটা ডুবে গিয়েছে। দুই-তিনজন নতুন বান্ধবী হয়েছে তার। টিএসসিতে বসে আড্ডা দেওয়া, চা খাওয়া, ফুচকা খাওয়া। ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ানো। রবীন্দ্র সরোবরে বান্ধবীদের সাথে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ানো। ভালোই সময় কাটছে তার। শশুর-শ্বাশুড়ি কখনো তাকে কোনো কাজেই বাঁধা দেয়না। তবে নিভৃতের সাথে সম্পর্কটা রয়ে গেছে ঠিক আগের মতো।

বিগত ছয়টা মাসের ঘটনাগুলো ছাদের দোলনায় বসে পর্যবেক্ষণ করছে মৌন। এতো আনন্দের মাঝেও কি যেন নেই। প্রিয় মানুষটার ভালোবাসা নেই। তার আদর সোহাগ নেই। তার অবহেলা পূর্ণ আচরণগুলো তীরের মতো বুকটাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। লোকটা কেন বুঝেনা! মাঝেমাঝে মৌনর রুহানির উপর হিংসা হয়। রুহানির ভাগের একভাগ ভালোবাসা যদি সে পেতো! কিংবা প্রিয় মানুষের বুকে রুহানির পাশে একটু জায়গা!

৪৩.

দিলারা বিছানায় শুয়ে আছেন। তিনি হুইলচেয়ার ছাড়া চলাচল করতে পারেন না। মৌন প্রবেশ করে দিলারার ঘরে। বিছানায় বসে বলে,
‘দাদুমনি, শরীর কেমন তোমার?’

দিলারা মিষ্টি হেসে বললেন,
‘ভালো আছি। তোমার দেখাই তো পাইনা নাতবউ। কই থাকো তুমি?’
‘পরীক্ষার ঝামেলায় আসতে পারিনা দাদুমনি। এবার যে হজ্জে যাবে কেমন লাগছে তোমার?’
‘আমি অনেক খুশি নাতবউ। ভাগ্য করে এমন ছেলে আর ছেলের বউ পেয়েছি। নয়তো আজকালকার যুগে এমন পঙ্গু মায়ের খেয়াল কে রাখে।’
‘এভাবে বলোনা। তুমিও অনেক ভালো।’

মৌনর অবাক লাগে। এই দিলারাই এককালে তার শাশুড়ী মিরাকে অত্যাচার করতো। অথচ এখন বৌমা বলতে অজ্ঞান। সত্যিই সময় পাল্টায়, মানুষ পাল্টায়। কেবল ধৈর্য ধরতে হয়।

_____________________

আজ মিরা, নাজমুল আর দিলারাকে এয়ারপোর্টে প্লেনে তুলে দিয়ে এসেছে নিভৃত। একমাস পর একেবারে ঈদুল আজহার পরে ফিরবে তারা। মিরা বারবার বলে দিয়েছেন নিভৃতকে সে যেন মৌনর সাথে খারাপ ব্যবহার না করে, সে যেন মৌনকে কষ্ট না দেয়।

বাড়িতে জুলেখা, শরীফা কেউই নেই। তারা ইদের পর আসবে। মৌন, নিভৃতই কেবল আছে। আর আছে মিটি। নিভৃত এই মিটি নামক অদ্ভুত পায়রাটাকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনা। তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। এই বজ্জাত পায়রা প্রথম কয়েকমাস তার উপর বিষ্ঠা ত্যাগ করতো। রেগে তাকালে এমন ব্যবহার করতো যেন সে কিছুই করেনি। এখন সে স্বভাব গেলেও তাকে দেখেই উড়ে এসে তার কাঁধে বসবে।

নিভৃত মাত্রই সোফায় এসে বসেছে। মিটি উড়ে এসে বসলো তার কাঁধে। নিভৃত বিরক্ত হয়ে বললো,
‘এই বজ্জাত পায়রা! তুমি আবার আমার কাঁধে বসেছো! যাও বলছি!’

কে শুনে কার কথা। হাল ছেড়ে দেয় নিভৃত। মৌন একগ্লাস শরবত নিয়ে আসতেই নিভৃত বলে,
‘এই মেয়ে!’
‘এই মেয়ে না। আমার নাম মৌনতা সুবহা মৌন।’
‘তাতে আমার কি?’
‘আমার নাম নিয়ে ডাকবেন।’
‘দেখো ফালতু কথা বাড়াতে পারবোনা। বাবা-মা তো এখন বাসায় নেই। তুমি আমার রুমে থাকবেনা। গেস্ট রুমে থাকবে।’
‘কেন?
‘কারণ আমি বলেছি তাই।’
‘আপনার ঘরে কি আমার একটুও অধিকার নেই?’
‘না, নেই।’

মৌন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘আচ্ছা, তাহলে তাই হবে।’

পিছু ঘুরে নিজের চোখের কোণের পানিটা মুছে নিলো মৌন। এই যে সে লাল রঙা শাড়ি পরেছে, গাঢ় করে চোখে কাজল এঁকেছে। চুল গুলোকে এলোমেলো খোঁপা করেছে এসব কার জন্য!

‘এই মেয়ে শুনো।’
‘আরো কিছু বলবেন?’
‘তোমার বজ্জাত পায়রাটাকে নিয়ে যাও।’
#ময়ূখ
#পর্ব-১৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৪৩.
রাতে খাবার খেতে বসেছে নিভৃত, মৌন। নিভৃত খুবই আয়েশ করে টক ডাল দিয়ে পোলাও খাচ্ছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে অমৃত খাচ্ছে যেন। মৌন নিভৃতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
‘সেই তো আমার রান্নাই খাচ্ছে। আর প্রথমদিন কি ঢং দেখিয়েছিলো! বদলোক!’

নিভৃত কপাল কুঁচকে তাকালো মৌনের দিকে।
‘এই মেয়ে কি বলছো?’
‘কিছুনা।’
‘না, তুমি কিছু বলেছো। একমিনিট তুমি কিছু খাচ্ছোনা কেন? খাবারে কিছু মিশাও নি তো!’

মৌন এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। এই লোক নিশ্চিত তার সাথে ঝগড়া করার পায়তারা করছে।
‘হ্যাঁ, একটু বিছুটির রস মিশিয়েছি। মজা হয়েছে না?’
‘হোয়াট!’

মৌন আর কথা বাড়ালোনা। এই লোক একটা আস্ত পাগল। এখানে থাকলে নির্ঘাত ঝগড়া করবে। সে প্লেট নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এলো। থাকুক একা।

নিভৃতের রাগে গাঁ জ্বলছে। এটুকু একটা মেয়ে তাকে ইগনোর করে। একে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে সে।

_________________

দশদিনে তাদের ঝগড়া হয়েছে একশবার। মৌনর সাথে একটা না একটা নিয়ে নিভৃতের কথা কাটাকাটি হবেই। মৌন তো একদিন বলেই বসলো,
‘আপনি স্বামী হয়ে আমার সাথে যতটা ঝগড়া করেন আমার সতীন থাকলেও এতোটা করতোনা।’

নিভৃত বজ্জাত পায়রাটার উপরেও বিরক্ত। বিকেলবেলা সোফায় বসে ইতিহাসের একটি বই পড়ছে মৌন। নিভৃত তার সামনে দিয়েই ঘুরঘুর করছে। নিভৃতের সাথে মিটিও ঘুরঘুর করছে। নিভৃতের উদ্দেশ্যটা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি মৌন। হঠাৎ পাশের সোফায় ধপ করে বসলো নিভৃত। মিটিও টি-টেবিলে বসেছে। নিভৃত সেদিকে তাকিয়ে বললো,
‘এই বজ্জাত পায়রা এখানে বসেছো কেন? তুমি কতোটা অস্বাস্থ্যকর তুমি জানো?’

মিটি কোনো জবাব দেয়না। তার নিভৃতের বকা শুনতে বেশ লাগে। নিভৃত কপাল কুঁচকায়। এতক্ষণ বাকবাকুম করে মাথা খাচ্ছিলো। অথচ এখন জবাব দিচ্ছেনা। বজ্জাত পায়রা!
মৌন কেবল এসব নাটক দেখে যাচ্ছে। লোকটা কি পাগল হয়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত তাকে পাগলের সংসার করতে হচ্ছে! মিটির থেকে নজর সরিয়ে নিভৃত মৌনর দিকে তাকালো। উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘এই মেয়ে কি পড়ো?’
‘মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস পড়ছি।’

নিভৃত বিরক্তিতে চো শব্দ করলো। অতঃপর মুখটা বিকৃত করে বললো,
‘এসব কোনো পড়ার বিষয় হলো। এসব রাখো আজ আমি তোমাকে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বুঝাবো।’
‘মানে কি! আমি তো আর্টসের স্টুডেন্ট।’
‘সমস্যা নেই। আমি তোমাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিবো। একেবারে বেসিক ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’
‘না, আমি এসব পড়বোনা।’

নিভৃত হাল ছেড়ে দেয়নি। এই মেয়েকে আজ সে জব্দ করেই ছাড়বে। খুব শখ না পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার।

৪৪.
‘জানো মেয়ে আমার অনেক ইচ্ছা ছিলো প্রফেসর হবো। তবে বাবার ব্যবসা সামলাতে গিয়ে তা আর হয়ে উঠেনি। মাঝেমাঝে আমার প্রফেসর সত্তা জেগে উঠে। রুহানি প্রতিদিন বিকালে আমার একটা ক্লাস করতো। এখন তো আর কাউকেই পড়াতে পারিনা!’

অসহায় দেখালো নিভৃতের মুখ। মৌনর খুবই মায়া হলো। লোকটা এতো করে চাচ্ছে। একটু শুনলেই তো হবে।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

নিভৃত মনে মনে বাঁকা হাসছে। আজকে একটা মোক্ষম সুযোগ হয়েছে তার। মিটিকে সরিয়ে টেবিলে রাখা খাতা কলমটা হাতে নিলো সে।
‘নিউটন মধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে একটা পড়ন্ত আপেল থেকে।’
‘হ্যাঁ, এটা জানি। পরে বলুন।’
‘পড়ার মাঝে কথা বলবেনা। এটা আমার পছন্দ না।’
‘আচ্ছা, বুঝেছি।’
‘মহাকর্ষ, অভিকর্ষ বল সম্পর্কে জানো?’
‘এসব কি পড়াচ্ছেন আপনি। সবই পড়েছি আমি সপ্তম, অষ্টম শ্রেণিতে থাকতে।’
‘বাহ্, বেশ ভালো। তাহলে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রটাও বলো দেখি।’
‘মনে নেই।’
‘কেন মনে নেই! মনে রাখতে হবে।’

মৌন যারপরনাই বিরক্ত হচ্ছে। এই লোক এসব কি শুরু করেছে।
‘এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণ বলের মান বস্তু কণাদ্বয়ের ভরের গুণ ফলের সমানুপাতিক, এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক এবং এই বল বস্তুদ্বয়ের কেন্দ্র সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে।’

নিভৃত হেসে বললো,
‘বুঝেছো?’
‘না।’
‘ঠিক আছে ব্যাখা করছি।’

দীর্ঘ দু’ঘন্টা নিভৃত মৌনকে মহাকর্ষ সূত্র, কেপলারের সূত্র, মহাকর্ষ সূত্র থেকে কেপলারের সূত্র প্রতিপাদন বুঝালো। মৌনর অবস্থা এমন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। বেচারির মাথাটাও গ্রহের মতো ঘুরছে।

‘এই হলো কেপলারের তৃতীয় সূত্র।’

নিভৃত মৌনর অবস্থা দেখে এমন একটা হাসি দিয়েছে যেনো সে বিশ্ব জয় করেছে।

বসা থেকে উঠে শিস্ বাজাতে বাজাতে উপরে চলে গেলো সে। আজ সে ভিষণ খুশি।

________________

মৌন সবে মাত্র বাড়ি ফিরেছে। নিভৃত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বললো,
‘তুমি এসেছো?’

মৌনর খটকা লাগছে হঠাৎ এতো ভালো ব্যবহার!
‘এসো খেতে এসো।’

মৌনকে টেনে ডাইনিং টেবিলে বসালো নিভৃত। রান্নাঘর থেকে একে একে সব খাবার ঢেকে নিয়ে এলো সে। মৌন কেবল অবাকই হচ্ছে।

খাবারগুলো মৌনর সামনে দিয়ে বললো,
‘নেও খেয়ে বলোতো কেমন হয়েছে।’
মৌন ঢাকনা সরাইতেই আকাশ ভেঙে মাথায় পড়লো তার। কবুতরের মাংস আর রুটি! সে আশেপাশে তাকিয়ে মিটিকে খুঁজে যাচ্ছে। তবে মিটি নেই। নিভৃত মিটিমিটি হাসছে । মৌন অদ্ভুত এককাণ্ড করে বসলো। নিভৃতের টি-শার্টের কলার ধরে বললো,
‘আমার মিটি কই?’
‘রেঁধে ফেলেছি।’
‘মানে কি! আমার মিটিকে ফেরত দিন।’

নিচে বসে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে মৌন। নিভৃত যদিও ভয় দেখাতে চেয়েছিলো তবে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মিটিকে এনে দিলো শেষ পর্যন্ত। ঘরেই খাঁচায় ভরে রেখেছিলো।

ভালোবাসা মানুষ বিভিন্নভাবে প্রকাশ করে। এই যে মৌনর প্রতি তার আচরণ এগুলো কি নির্দেশ করে! নিভৃত নিজের কাজ, নিজের মন, নিজের মস্তিষ্ক কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেনা। হয়তো রাখতে চাচ্ছেনা!

৪৫.

ইদের কেবল বাকি পাঁচদিন। মিরা, নাজমুল, দিলারার সাথে রোজ কথা হয় মৌন, নিভৃতের। মিরা অনেক ভয় পেয়েছিলেন। তারা চলে গেলে নিভৃত যদি মৌনের উপর অত্যাচার করে তবে সবকিছু স্বাভাবিক দেখে তিনি খুশি।

বিগতদিনগুলো ভালোভাবেই কেটেছে মৌনর। তবে হঠাৎ করে এই দুইদিন যাবত নিভৃত চুপচাপ থাকে। কোনো কথা বলেনা, ঝগড়া করেনা। সেদিন পাঁচহাজার টাকা হাতে দিয়ে বলেছিল ইদের জন্য কেনাকাটা করে নিতে। তার হাসোজ্জল চেহারাটা আবার যেন কোনো অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে। মৌন গেস্ট রুমেই থাকছে। একটা পাঞ্জাবি কিনেছে নিভৃতের জন্য তাও দেওয়া হয়নি। ঝগড়ায় মেতে থাকা বাড়িটা হঠাৎই যেন বিরান হয়ে পড়েছে।

______________________

আজ ইদ। চারপাশে খুশির আমেজ। এবার মৌনদের কুরবানি দেওয়া হয়েছে গ্রামে। যেহেতু ঢাকার বাড়িতে মৌন একা এতসব সামলাতে পারবেনা। নিভৃত সারাদিন চুপ ছিল। কোনো কথা বলেনি। রাতের খাবার খেয়েও সোজা ঘরে চলে গিয়েছে। মৌন খুবই কষ্ট পেয়েছে নিভৃতের কাজে। ইদের শুভেচ্ছাটা কি অন্তত জানানো যেতোনা? এতো রান্না-বান্না, এতো সাজগোছ কার জন্য!

সময়টা এভাবেই কাটছে। দুইদিন বাদে বাড়ি ফিরবেন মিরা, দিলারা, নাজমুল। নাজমুল একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

সারাটাদিন নিভৃত বাড়ি ফিরেনি। সকালেও রাগ দেখিয়ে গেছে। মৌনর খুবই চিন্তা হচ্ছে। কাউকে সে চিনেনা। ফোন দিয়ে খোঁজ নিবে সে উপায় নেই। মিরা দুবার ফোন করেছে। তবে সে মিথ্যে বলেছে। নিভৃতের বাড়ি না ফেরার কথা বলেনি।

ঘড়িতে এগারোটা বাজে। অথচ নিভৃতের বাড়ি ফেরার খবর নেই। এমন তো সে কখনো করেনা। কোথায় গেলো নিভৃত!

হঠাৎ দরজায় আওয়াজ হতেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় মৌন। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে। নিভৃত এদিক ওদিক ঢলছে। গাঁ থেকে মদের বাজে গন্ধ ভেসে আসছে। শার্টটা এলোমেলো কুঁচকে আছে, টাইটা গলায় ঝুলছে। চেহারায় ছন্ন ছাড়া ভাব। ঠিকমতো হাঁটতেও পারছেনা সে। মৌন এগিয়ে গিয়ে ধরলো নিভৃতকে। নিভৃতও সুন্দরভাবে তাকে ধরে ঘরে এলো। নিভৃত মৌনর হাতটা এমনভাবে ধরেছে যেন হাত ছাড়লেই পালিয়ে যাবে সে। মাঝেমাঝে বলেও যাচ্ছে,
‘রুহানি শুভ জন্মদিন। আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ।’
‘তোমাকে কোথাও যেতে দিবোনা।’

মৌন এবার নিভৃতের উদাসীনতা আর মন খারাপের কারণটা বুঝতে পারলো।

(চলবে)…..
(চলবে)…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here