ময়ূখ পর্ব -১৬+১৭

#ময়ূখ
#পর্ব-১৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৪৬.
মৌনকে নিজের কাছে টেনে নিলো নিভৃত। মৌনেরও কষ্ট লাগছে। একটা মানুষ অপর একটা মানুষকে ঠিক কতোটা ভালোবাসলে এমন পাগলামি করতে পারে! মৌন নিভৃতের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিভৃত হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো মৌনের চিবুকের লাল তিলটা। কেঁপে উঠলো মৌন । অতঃপর মৌনকে কোলে তুলে নিলো সে। এলোমেলো পায়ে ঢুলতে ঢুলতে অগ্রসর হলো সামনে। নিভৃতের চোখের চাহনী অন্যরকম লাগছে। মৌন ভেবেছে হয়তো প্রতিদিনের মতো আজো তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে চাচ্ছে নিভৃত। তবে নিয়তি হয়তো তা চায়নি।
‘আমার তোমাকে চাই রুহানি।’
‘তোমাকে কোথাও যেতে দিবোনা আমি।’

মৌনর হাজার চিৎকার, আর্তনাদ শুনলোনা নিভৃত। মৌন একধ্যানে তাকিয়ে রইলো কেবল রুহানির হাসোজ্জল ছবিটার দিকে। মনে মনে বললো,
‘আমাকে ক্ষমা করো আপু। আমি অপারগ ছিলাম। আমি চাইনি আমাদের শুরুটা এভাবে হোক। তোমার ভাগের ভালোবাসাটা আমি নিতে চাইনি আপু।’

চোখের কোণা বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। সকালে হয়তো তাকেই শুনতে হবে সে সুযোগ সন্ধানী, বিশ্বাসঘাতক!

______________________

ঘুম থেকে উঠে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে রইলো নিভৃত। আশেপাশে অবলোকন করে বুঝতে পারলো কোনো অঘটন ঘটে গেছে। নিজেকে ধাতস্থ করে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো সে। মৌন রান্নাঘরে। মিটি মৌনর পাশে ঘুরঘুর করছে। তবে আজ মৌন মিটিকে আদর করছেনা, কথা বলছেনা। একধ্যানে সবজি ভাজি করছে কেবল।
‘এই মেয়ে!’

চিৎকার করে বললো নিভৃত। মৌন কোনো প্রতিক্রিয়া করেনি।
‘এই কথা কানে যায়নি?’
‘কি?’

সাদা পোশাক পরিহিত মৌন। কোমর সমান চুলগুলো হালকা ভেজা। মুখের সামনে কয়েকটা এলোমেলো চুলের বিচরণ। শরীরের হলদে ফর্সা রঙটা যেন গাঢ় লাগছে খানিকটা। মাথায় উড়না দেওয়া তার। চোখ দুটো লাল। বোধহয় কেঁদেছে মেয়েটা। এতো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে কেন! নিভৃত কথা খুঁজে পায়না। আমতা আমতা করে বলে,
‘তুমি আমার সুযোগ নিয়োছো কেন?’

মৌন কোনো জবাব না দিয়েই আবার সামনে ফিরে সবজি ভাজিতে মন দিলো। জোর করবে নিজে। কাছে টানবে নিজে। কৈফিয়ত দিতে হবে তার! সে কি এতো সস্তা!

নিভৃত উত্তর না পেয়ে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। মিটি উড়ে মৌনর কাঁধে বসলো। মৌন আজ তার সাথে আহ্লাদ করছেনা কেন! মিটিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে পাশে রাখলো মৌন। চিৎকার করে বললো,
‘মিটি একদম আহ্লাদ করবিনা। এই পৃথিবীতে সবাই আমাকে ব্যবহার করে তুইও করতে চাস! আমি কি খেলনা? আমি কি ভোগ্যবস্তু! মন চাইলো খেললাম আবার ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আবার আমাকে ব্যবহার করে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে আসছে!’
‘মিটির উপর রাগ দেখিও না। আমি তো মদ্যপ ছিলাম। তুমি তো বাঁধা দিতে পারতে?’
‘আপনার সাথে কোনো কথা আমি বলতে চাচ্ছিনা নিভৃত। আপনি আমার সাথে কোনো কথা বলবেন না দয়াকরে।’
চলে গেলো নিভৃত। ফুঁপিয়ে কাঁদছে মৌন। তার জীবনটা এতো অদ্ভুত কেন! কেন আর পাঁচটা মেয়ের মতো না! কেন স্ত্রী হয়েও এসব কথা শুনতে হচ্ছে তার!

৪৭.

মিরা, নাজমুল আর দিলারা বাড়ি ফিরেছেন আজ তিনদিন। মৌন গেস্টরুম ছেড়ে বাধ্য হয়ে নিভৃতের রুমে থাকছে। নাজমুল অসুস্থ। তাই কোনো ঝামেলায় যেতে চায়নি সে। যদিও নিভৃত দুইবার চেষ্টা করেছিলো তার সাথে কথা বলতে। তবে সে এড়িয়ে গেছে। কি দরকার! এতো ছন্নছাড়া সম্পর্কের!

বারান্দায় বসে নিজের ডায়েরিতে হাত বুলাচ্ছে মৌন। কালো মোটা একটা ডায়েরি। সেই দশম শ্রেণীতে থাকতে কিনেছিলো সে। এই ডায়েরিতে তার প্রিয়ের বসবাস। তার একতরফা ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে অজস্র কল্পনার অনুভূতি লিখা। আচ্ছা, খুবই কি খারাপ হয়ে যেতো ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পেলে। একটা সুন্দর সংসার হতো তাদের। প্রেমময় ছন্দে মেতে উঠতো প্রতিটা সময়। খুব কি খারাপ হতো? মৌনর চোখ ভিজে উঠে। বেহায়া চোখ বারণ মানে না। অশ্রুতে লেপ্টে দেয় কাজলাক্ষী চোখ। লেপ্টে কালো করে দেয় চোখের আশেপাশে! চোখের পানিটা মুছে কিছু লাইন ডায়েরিতে লেখে মৌন,

‘তোমাকে পাওয়ার যন্ত্রণায় আজো ছটফট করি আমি। আমার কিশোরী বয়সের আবেগ তুমি প্রিয়। তোমার সাথে ভালোবাসার সংসার সাজানোর স্বপ্ন যে অপূর্ণ রয়ে গেলো আমার! এই যে শুনছো তুমি! মনে রেখ তোমার একটা পাগলাটে প্রেয়সী ছিলো, আছে আর চিরজীবন থাকবে প্রিয়।’

দেয়ালে মাথাটা ঠেকায় মৌন। একতরফা ভালোবাসায় ভিষণ কষ্ট। ভিষণ!

________________

‘মৌন, নিভৃত।’

নাজমুল সাহেবের ঘরে দাঁড়িয়ে দুজন। নাজমুল সাহেব আগের থেকে সুস্থ অনেকটা। তাদের ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি। মিরা পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। নিভৃত জিজ্ঞেস করলো,
‘কিছু বলবে বাবা?’
‘হ্যাঁ। তোমাদের বিয়ের একবছর পূর্ণ হয়েছে। তা নিশ্চিত জানো।’
‘হয়েছে। তো?’

নাজমুল সাহেব বালিশের নিচ থেকে একটা খাম বের করে নিভৃতের হাতে দিলেন।
‘এটা কি বাবা?’
‘দেখ।’

মৌনও তাকিয়ে আছে কাগজটার দিকে। সিলেটের নাজিমগড় রিসোর্টের বুকিং কাগজ।

৪৮.
‘বাবা, তুমি অসুস্থ। আর আমরা ঘুরতে যাবো!’

নাজমুল হাসলেন। শক্ত কন্ঠে বললেন,
‘তুমি তো তোমার সুস্থ বাবাকেও অসুস্থ বানিয়ে দিবে দেখছি। আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। প্রেশার নিয়ন্ত্রণে আছে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে। তোমরা ঘুরে এসো।’

মৌন বললো,
‘বাবা-মা তোমরাও চলো।’

মিরা জবাবে বললেন,
‘এবার তোরা যা। পরেরবার আমরা সবাই মিলে যাবো।’

নিভৃতের ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারলোনা মৌন। নিভৃতের নিরবতা বলছে সে যেতে রাজি। কোনো প্রতিক্রিয়া, রাগারাগি ও করলোনা!

________________

‘এই মেয়ে?’

চুলে বেণী করছিলো মৌন। নিভৃতের ডাকে ডিভানের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘কিছু বলবেন?’
‘দেখো আমি যেতে রাজি হতাম না। তবে ডাক্তার বলে দিয়েছেন বাবাকে কোনো স্ট্রেস না দিতে। তাই তোমার সাথে যেতে রাজি হয়েছি। এতে খুশি হওয়ার দরকার নেই।’
‘আপনার কেন মনে হলো আমি খুশি হয়েছি?’
‘মিথ্যে বলবেনা। তুমি মুচকি মুচকি হাসছিলে কেন?’
‘অদ্ভুত তো! আমার মুখ আমি হেসেছি! তাতে আপনার কি? অদ্ভুত!’
‘সবই বুঝি। তোমাকে কিন্তু আমি পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারি। তাই এতো খুশি হয়ে লাভ নেই।’
‘কচু বুঝেন। আমাকে ধাক্কা দিলে আপনাকে নিয়ে পড়বো আমি।’
‘আচ্ছা, আমার কথার প্রেক্ষিতে তোমার সব উত্তর কি আগে থেকেই রেডি থাকে?’
‘আসলে আপনি আমার জাত শত্রু। তাই আপনাকে সঠিক প্রতিত্তোর না করতে পারলে শরীর নিশপিশ করে। উত্তর অটোমেটিক মুখে এসে যায়।’
‘স্টুপিড।’
‘আমি জানি। নতুন কিছু বলুন।’

নিভৃত অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকালো। এই মেয়ে তো পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে। একে নাজিমগড়ের টিলা থেকে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে বলে মনস্থির করলো নিভৃত। কিন্তু তাতে তো আরেক সমস্যা এই মেয়ে নাকি তাকে নিয়েই পড়বে!

_________________

‘সাবধানে যাস।’
‘ঠিক আছে মা। দোয়া করো। আর মিটির খেয়াল রেখো মা।’
‘আমার দোয়া সবসময় তোদের সাথে আছে পাগলী। তোর মিটির কোনো অযত্ন হবেনা।’

সবার থেকে বিদায় নিয়ে মৌন, নিভৃত বেরিয়ে পড়লো সিলেটের উদ্দেশ্যে। নিভৃতের খয়রী রঙা টয়োটা প্রিমিউ এফ ই এক্স আপনমনে ছুটে চলেছে রাস্তায়। মৌনর বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। এই প্রথম নিভৃতের সাথে কোথাও যাচ্ছে সে। নীল রঙের উড়নাটা মাথায় টেনে দিলো সে। আড়চোখে তাকালো নিভৃতের দিকে। কালো জ্যাকেট, জিন্স প্যান্ট পরনে তাকে অনেক সুদর্শন লাগছে। ফর্সা হাতে ঘড়িটাও মানিয়েছে খুব। অদ্ভুত লোকটা গাড়ির ভিতরও সানগ্লাস পরে ড্রাইভ করছে। একটা ভেংচি কাটলো মৌন। এসব উদ্ভট স্টাইল দেখলে তার গাঁ জ্বলে যায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো সে। শো শো বাতাস বইছে। ঢাকার রাস্তায় মানুষের হিড়িক। সূর্যের দাপটে বিস্তার চলছে। শুষে নিচ্ছে মানুষের পরিশ্রমী মনোভাব। ক্লান্ত, অবসাদে ভরে দিচ্ছে যেন। ভ্যাপসা গরম চারদিকে। বৃষ্টি হওয়ার লক্ষন হয়তো! আর কিছুক্ষণ পরেই ঝপঝপিয়ে বৃষ্টির তালে নেচে উঠবে ধারা। ক্লান্ত, অবসাদে ছন্দহীন মানুষগুলোও একটু ছন্দের সন্ধান পাবে। সিলেটের নাজিমগড় রিসোর্টে কি অপেক্ষা করছে মৌন, নিভৃতের জন্য!
#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-১৭

৪৯.
টয়োটা প্রিমিউ গাড়িটি শাহজালাল উপশহর মেইনরোডে প্রবেশ করেছে। নিভৃত একধ্যানে ড্রাইভ করছে। যদিও রাস্তায় দুইবার মৌনর সাথে তার ঝগড়া হয়েছে।
‘এই একটু গাড়ি থামান?’

ব্রেক কষে নিভৃত বললো,
‘এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন তুমি?’
‘আমার ইচ্ছে।’
‘এক ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বের করে দিবো।’
‘আপনার বের করতে হবেনা। আমিই যাচ্ছি।’
‘এই মেয়ে মাথা নষ্ট তোমার? সিলেট চিনো তুমি?’

কথা না বলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো মৌন। নিভৃত হা করে তাকিয়ে আছে। একটা মানুষ এতোটা ঘাড়ত্যাড়া কিভাবে হতে পারে! কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নিভৃত বের হবে তার আগেই গাড়ির ভিতর উঠে বসলো মৌন। হাতে একটা নীল পলিথিন।
‘কি এনেছো?’
‘আপনাকে কেন বলবো?’
‘স্টুপিড।’

আবারো গাড়ি স্টার্ট করলো নিভৃত। মৌন একটু পরপর একটা টুথপিক দিয়ে আনারসের টুকরো পলিথিনের ভিতর থেকে বের করে খাচ্ছে।লবণ,মরিচ মাখানো ছিল। তাই ট্টা ট্টা শব্দ করছে। নিভৃত গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে দেখছে কেবল।

‘খাবেন?’

বলে একটা আনারসের টুকরো নিভৃতের মুখের সামনে ধরলো মৌন। হলুদ রঙের আনারসের টুকরোটায় লাল গুঁড়ো মরিচ আর লবণ মাখানো।

‘আমি এসব খাইনা। তুমিই খাও।’
‘আপনার ইচ্ছা।’

নিজেই খেয়ে নিলো মৌন। নিভৃত একটু বিরক্ত হলো। আরেকবার কি খাওয়ার জন্য বলা যেত না?

ঢাকা-সিলেট তামাবিল রোডের ডানদিকে প্রবেশ করেছে গাড়ি। পাহাড়ি রাস্তা উঁচু-নিচু। দুইপাশে বন্যতরুর দল। সবুজের সমারোহে এক অভাবনীয় মায়া। কানে ভেসে আসছে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ। ঐ তো দূরে চূড়ার মতো দেখা যায় জয়ন্তপুরের পাহাড়। মৌন গাড়ির জানালা দিয়ে মুখটা বের করলো। স্নিগ্ধ, শুদ্ধ, নির্মল বাতাসে ছেয়ে যাচ্ছে তার মন, মস্তিষ্ক। প্রাণহীন, ছন্দহীন, সুরকাটা, তালকাটা জীবনে যেন ফিরে আসছে নতুন প্রাণ, নতুন ছন্দ, নতুন সুর আর নতুন তাল। বিকেল হয়ে এসেছে। অজানা, অদেখা পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের নীড়ে।

৫০.
অবশেষে দীর্ঘ ছয়ঘন্টা পর তারা পৌঁছালো সিলেটের নাজিমগড় রিসোর্ট। গাড়ি রিসোর্টের ভিতরে প্রবেশ করেছে। গাছগাছালি ঘেরা অনন্য সুন্দর একটা জায়গা নাজিমগড় রিসোর্ট। ডানপাশে গাড়ি রাখার গ্যারেজ। তবে রিসোর্ট আরো উপরে। মাটির উপর কৃত্রিম রাস্তা। আধার ঘনিয়ে আসছে চারপাশে। বাঁশগাছগুলো দেখে মৌনের মনে পড়ে তার নিজের বাড়ির কথা। ফরিদপুরের বাঁশবাগানের কথা। গাড়ি ক্রমশ উপরে উঠছে। উৎকন্ঠা বাড়ছে মৌনের। টিলার উপরে থাকার অভিজ্ঞতাটা কেমন হতে পারে?

রিসোর্টের সামনে গাড়ি থামলো। নিভৃত নেমে গেলো। মৌনের জন্য অপেক্ষা না করেই লাগেজ নিয়ে ভিতরের দিকে হাঁটা দিয়েছে সে। মৌন অবশ্য চারপাশ দেখছে। পাশে একটা দেয়াল। সেই দেয়ালের ভিতরে চারকোনা আকারের বক্স করে রাখা। সেখানে জ্বলছে হারিকেন। লাল রঙের দেয়ালে হলুদ রঙা আলোগুলো যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। পাশ ফিরে বিশাল বড় রিসোর্টার দিকে ক্ষানিকটা সময় তাকিয়ে রইলো মৌন। খয়রী আর লাল মিশেলে বিশাল আকৃতির বাড়ি। জায়গায় জায়গায় কৃত্রিম আলোয় ঘেরা। পাশে একটা বাগান বিলাস গাছ। গোলাপি ফুলগুলো চিকচিক করছে যেন। চোখ সরিয়ে কিছুটা ভিতরে ঢুকলো মৌন। পাশে একটা সুইমিংপুল। নীল রঙা পানি। সুইমিংপুলের ডানপাশে গাছগাছালি ঘেরা। বামপাশে বিশাল বড় লবি। লবিতে টেবিল, চেয়ার সাজিয়ে রাখা। মুগ্ধতার ভীড়ে মনে পড়লো তারপাশে নিভৃত নেই। দিকবিদিকশুন্য শূন্য হয়ে পড়লো মৌন। মানুষজন একেবারেই কম। কোথায় যাবে? কি করবে ভেবে পেলোনা মৌন। লবিতে রাখা একটা চেয়ারে বসে রইলো কেবল। নিভৃত তাকে একা ফেলে চলে গেল!

_________________

‘এই মেয়ে।’

পরিচিত কণ্ঠে জানে পানি এলো মৌনর। সে ভয় পেয়েছিল প্রচুর। নিভৃতের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘আপনি আমায় রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?’
‘রিসিভশনে চাবি আনতে গিয়েছিলাম মেয়ে। চলো এবার। আমাদের ঘর দুতালায়।’

নিভৃতের পিছুপিছু হেঁটে যাচ্ছে মৌন। খুবই ইচ্ছে করছিলো একটু ঝাপটে ধরতে। তবে কিসের যেন একটা বাঁধা।

সারি সারি ঘরের সামনে কাঠের বারান্দা। পাশে দুতালায় উঠার প্যাঁচানো সিঁড়ি। তা দিয়েই উপরে উঠছে তারা। বিশাল লম্বা বারান্দা দুতালায়। এককোনায় রুম পড়েছে তাদের। টিলার উপর রিসোর্ট হওয়ায় বারান্দা দিয়ে নিচে তাকালে ভয় লাগে প্রচুর। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারপাশে। বিভিন্ন পোকার আওয়াজ ভেসে আসছে। অদ্ভুত! খুবই অদ্ভুত সে ডাক। 3204 রুমের দরজাটা চাবি দিয়ে খুলে নিলো নিভৃত।

মৌন অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। অভাবনীয় সুন্দর ঘরটা। সুসজ্জিত করে রাখা সবকিছু। কাঁচের টানা দেয়াল। দেয়াল না ঠিক এটা বারান্দায় যাওয়ার দরজা। দরজা সরাতেই বিস্তৃত বারান্দা। কাঠের চেয়ার, টেবিল রাখা এককোণে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গাছগাছালির মিষ্টি স্যাঁতস্যাতে গন্ধ নিচ্ছে মৌন। অন্ধকারে জোনাকি পোকাগুলো টিমটিমে আলো ছড়াচ্ছে। কানে ভেসে আসছে হরেক রকম ডাক। শরীরে লাগছে শুদ্ধতার বায়ু।

‘এই মেয়ে?’

নিভৃতের ডাকে ধ্যান ভাঙে মৌনর। পিছু ফিরে বলে,
‘কি?’
‘বারান্দায় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমার প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। তুমি তো রাস্তায় গো গ্রাসে গিলেছো।’

মৌন তেড়ে এলো সামনে। কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
‘আপনি নজর লাগিয়েছেন। তাই না? আমার যদি পেট খারাপ করে?’
‘একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেনা!’
‘আপনি বলবেন না উল্টাপাল্টা কথা। আপনাকে খেতে বলি নাই আমি?’
‘যাও তো মেয়ে। ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমার সাথে ঝগড়া করার মুডে নেই আমি।’
‘ইস্। আপনার সাথে ঝগড়া করার জন্য আমি কি মরে যাচ্ছি?’
‘দেখো মেয়ে, কথা বাড়িয়োনা। বারান্দা থেকে ফেলে দিবো।’
‘আপনি বললেই হলো? পড়লে আপনাকে নিয়ে পড়বো।’
‘স্টুপিড। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। ফ্রেশ হয়ে এসো। নয়তো একাই খেতে চলে যাবো।’

৫১.

নিচে নেমে লবিতে হেঁটে গেলো তারা। লবির পাশ দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তার পাশ দিয়ে দু’তালায় উঠার সিঁড়ি। দুতালায় উঠলে রেস্টুরেন্ট। মানুষজন খুবই কম। একটা টেবিলে বসলো তারা। মেনুকার্ড হাতে নিয়ে মাথায় বাজ পড়লো মৌনের। এতো দাম!
‘এতো দাম খাবারের!’

আশেপাশের সবাই ফিরে তাকালো তাদের টেবিলে। নিভৃত কপাল কুঁচকে মৌনের হাত থেকে মেনুকার্ড টেনে নিয়ে চোখ রাঙালো। ফিসফিসিয়ে বললো,
‘সারা সিলেটেই খাবারের দাম বেশি,স্টুপিড। এতো জোরে চেঁচাতে হয়!’
‘না, মানে…..
‘চুপ। আর কোনো কথা না।’

মুখটা চুপসে গেলো মৌনের। সে কি ভুল কিছু বলেছে? এক গ্লাস লেমন জুসই নাকি আড়াইশ টাকা! ভাবা যায়! তাদের গ্রামে এই আড়াইশ টাকায় কতকিছু পাওয়া যায়!

নিভৃত বিরিয়ানি অর্ডার করেছে। একটা মাটির পাতিলে আটার প্রলেপ দিয়ে ঢাকা বিফ বিরিয়ানি। ওয়েটার এসে খাবার সার্ভ করে দিয়ে গেলো। নিভৃত চাকু দিয়ে মাটির হাড়ির উপরের আটার প্রলেপটা কেটে নিলো। খাবারটা ভালোই খেতে। তবে দামটা তুলনামূলক অনেক বেশি।

_________________

ঘরে ঢুকে নিভৃত ধপাস করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। মৌন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে কোথায় ঘুমাবে? এ ঘরে কোনো ডিভান কিংবা সোফা নেই। নিচে থাকাও সম্ভব না। কোনো চেয়ারও নেই। কেবল বারান্দায় দুইটা চেয়ার আছে। তবে অন্ধকার বাড়ছে ক্রমশ। পোকার ডাক ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। গাছগাছালি যেগুলো বিকেলে চিত্তাকর্ষক লাগছিলো তা এখন ভুতুড়ে লাগছে। এদিকে ক্লান্তিতে, অবসাদেও শরীর নেতিয়ে আসছে। মৌনকে বারান্দার দিকে তাকিয়ে গভীর মনোযোগী হতে দেখে নিভৃত বললো,
‘এই মেয়ে আবারো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে কি ভাবছো?’

মৌন নিভৃতের গলাটা বোধহয় শুনেনি। নিভৃত বিরক্তি নিয়ে আবার বললো,
‘এই মেয়ে?’
‘জ্বি।’
‘এভাবে দাঁড়িয়ে কেন?’
‘কোথায় ঘুমাবো বুঝতে পারছিনা।’
‘বেডটা তো বড় তুমি ঐপাশে ঘুমিয়ে পড়ো।’
‘কি!’
‘এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। একদম যেন আমার কাছে যেন ঘেষতে না দেখি। একদম বেড থেকে ফেলে দিবো তবে।’

মৌন বিছানার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে বিরবির করে বললো,
‘দেখা যাবে কে কার কাছ ঘেঁষে।’
‘কি বললে?’
‘কিছুনা।’

মধ্যরাতে ঘুমের ঘোরে ঠিকই মৌনকে জড়িয়ে ধরলো নিভৃত। মৌন মুচকি হাসলো কেবল। নিভৃতের চুলগুলোতে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে বললো,
‘আপনি এমন কেন নিভৃত? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায়না? আপনার রুহানির জায়গা তো আমি চাইনি। কেবল আপনার বুকের বাঁ পাশটায় ধুকপুক ধুকপুক করা যন্ত্রটার অদৃশ্য অংশে একটু ঠাঁই চেয়েছি কেবল।’

নিভৃত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মৌনকে। ঘুমের ঘুরে বললো,
‘হুম।’

মৌন শব্দহীন হেসে বললো,
‘কি হুম? নিভৃত মশাই?’

কোনো জবাব আসেনা। একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসে সে। ছোট করে ভালোবাসার পরশ দেয় নিভৃতের কপালে। অতঃপর একধ্যানে তাকিয়ে থাকে নিভৃতের মুখটার দিকে। হয়তো তার বাকীটা সময় এভাবে তাকিয়েই কেটে যাবে। কে বলবে এই নিষ্পাপ মুখের অধিকারী লোকটা তার সাথে সারাদিন ঝগড়া করে!

(চলবে)……
(চলবে)…….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here