#হয়ত
পর্ব:- ১৩ ও ১৪
.
তাপৌষির ফালুদা সাবাড় করে শারমিন আহমেদ একটা লম্বা ঢেকুর তুললেন।
-‘ তো তোমার আম্মায় গলায় দড়ি দিসে? তুমি এখানে কী করো? ঘুরতে আইসো? বাপেরে বাসায় একলা থুইয়া ঘুরতে আসছো। ছি ছি। এ ভারী নীতি বিরুদ্ধ কাজ। তোমার বাপে একলা থাকতে পারবো?’
মহিলার কথাবার্তায় মিষ্টতার অভাব। যেভাবে কথা বলছে মনে হচ্ছে খোঁটা দিচ্ছে। তাপৌষির চোখ ভিজে যাচ্ছে।
-‘ কথা কও না কেন। বাপ একা ক্যামনে খাবে? রান্না কেডা করে?’
তাপৌষির বলতে ইচ্ছে করছে বাবার রান্নার মানুষ আছে, ভালোবাসার মানুষ আছে, যত্ন আত্মির মানুষ আছে। “শুভ্রা”…
-‘ এই মেয়ের তো দেখি এখন মুখ দিয়ে কথায় বের হয় না।’
এবার রাবেয়া বানু হুংকার ছাড়লেন।
-‘ দেখছিস তোরা দেখছিস। এই মেয়ের ব্যবহার দেখছিস? বড় একটা মানুষ কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। মায়ের স্বভাব চরিত্র পাইসে একদম।’
তাপৌষি আর সহ্য করতে পারলো না। এঁটো হাত নিয়ে ছুটে আসলো নিচতলা থেকে দুতলায়। তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমটাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর প্রবেশ করলো ঘরের সাথে লাগোয়া বিশাল বারান্দাটায়। অর্ধ খোলা ছাদের বারান্দায় জ্বলছে নীল আলোর ড্রিম লাইট। আজকে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। অঝোরে বর্ষণ হচ্ছে। তাপৌষি দুই হাটু ভাজ করে সামনে এনে তাতে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। জোরে জোরে কাঁদছে সে। হয়তো বৃষ্টির শব্দে তার কান্নার আওয়াজ কারও কান অবধি পৌঁছাবে না এই নিশ্চতায়।
.
তাপৌষি নিচে যাওয়ার পরপরই বর্ষণ নিজের ঘরে চলে আসে। কালকে খুব জরুরি কাজে ঢাকা যেতে হবে। এরপর এক সপ্তাহ আর নাড়িশ্যা আসবেনা সে। তাপৌষির সাথে লুকোচুরিও করতে হবে না তাইলে।
হঠাৎ ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় কারো আওয়াজ পাওয়া গেল। দরজা খুলে যখন ঘর থেকে বারান্দায় প্রবেশ করলো এক ছায়ামূর্তি মানবীকে বসে থাকতে দেখলো। একটু সামনে এগিয়ে ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হলো। ঈশৎ নীল আলোয় দারুণ লাগছে মেয়েটিকে। বৃষ্টির ঝাপটা গায়ে এসে পড়ছে মেয়েটির। সাদা জামার অনেকটাই ভিজে গেছে। মেয়েটি আর কেউ নয় তাপৌষি।
.
“জানালায় একা বসে আছি
আকাশে তখন রোদ পাখির মতো উড়ছে
কিন্তু আমার ছিল মন খারাপ
হঠাৎ কালো উরদি পরা গুটিকয় মেঘ
গটগট শব্দ করে, প্যারেদ করতে করতে
ঘিরে ফেলল আকাশ
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই, মাঠঘাট গাছপালা ভেঙে
ঝাঁকড়া চুলের ঘোড়ার মতো ছুটে
জানালায় এল বৃষ্টি
বলল, ‘কি ভাবছিস? তোর মন খারাপ?
আয় আমার সাথে খেলবি।’
এক তো মন খারাপ, বললেই কি আর যাই?
বললাম কেন যাব? তুই বিচ্ছিরি, ভিজিয়ে দিবি
বৃষ্টি বলল, ‘এই দ্যাখ জলের পোশাক,
আমি কান্নাকে লুকিয়ে ফেলতে জানি।’
তখন আর না গিয়ে কি পারি?
সেই থেকে বৃষ্টিই আমার সব চে’ ভালো বন্ধু।”
… …. …. … ….
বর্ষণের কবিতা আবৃত্তি শুনে তাপৌষির কান্না অনেক আগেই থেমে গেছিল। ও তো ভুলেই গেছিল এই বারান্দায় বর্ষণের ঘর দিয়েও ঢুকা যায়।
তাপৌষির পাশে বসতে বসতে বর্ষণ জিজ্ঞেস করলো,
-‘ কাঁদছিলে তাপৌষি?’
এই কান্নাকাটি প্রশ্নের উত্তর দিতে তাপৌষির মোটেও ইচ্ছে করছিল না। কথা ঘুরাতে ফিরতি প্রশ্ন করলো ও।
-‘ কবিতাটিকে আপনার লিখা?’
-‘ না রুদ্র গোস্বামীর স্যারের। এপার ও ওপার বাংলার জনপ্রিয় কবিদের একজন।’
-‘ ওহ। সুন্দর কবিতা।’
-‘ বললে না তো কাঁদছিলে কেন?’
-‘ কাঁদছিলাম না তো। শীতকালে বৃষ্টিবিলাস করছিলাম। আপনাদের বারান্দাটা খুব বড় আর ভীষণ সুন্দরও।’
-‘ ধন্যবাদ।’
বর্ষণ বুঝতে পেরেছে তাপৌষি ওকে এত সহজে কিছু বলবে না। আর তাপৌষিকে তো জোরও করা যায় না। মেয়েটার সাথে এতটাও ফ্রি নয় ও। হালকা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো বর্ষণ। বৃষ্টির ঝাপটায় ওর নিজের জামা কাপড়ও ভিজে গেছে। এখন না পাল্টালে ঠাণ্ডা লাগবে। এই মেয়ে হয়তো পাগল। নইলে এমন করে কেউ?
-‘ জানেন আমার মা-বাবার না প্রেমের বিয়ে ছিল। আই মিন লাভ ম্যারেজ। খুব ভালোবাসতো দুজন দুজনকে। বাবার জন্য মা নিজের পরিবার ছেড়ে চলে আসে।’
বর্ষণ তাপৌষির কথা শুনে ওর দিকে তাকায়। মেয়েটা এক দৃষ্টিতে বাইরের বৃষ্টি দেখছে। বারান্দার ঈশৎ নীল রঙের ড্রীম লাইটের আভা ওর মুখে পড়ছে। চোখের কোণঘেঁষা এক বিন্দু জল সেই আভায় হীরার ন্যায় ঝলমল করছে। আবার তাপৌষির পাশে বসলো ও।
-‘ রাজশাহীতে ছোট একটা বাসা ছিল আমাদের। দুই রুমের সেই সাতশো স্কয়ার ফিটের বাসাটায় আমরা তিনজন মিলে নিজেদের ভালোবাসার রাজ্য সাজিয়ে ছিলাম। বাবার পনেরো হাজার টাকার চাকরিটা আমাদের জন্য ছিল আশীর্বাদ। হঠাৎ বাবা চাকরিটা ছেড়ে দেয়। নতুন চাকরি পেয়েছিল নাকি। পনেরো হাজারের বেতনের জায়গায় জয়নিং করেই বেতন পেয়ে গেলো পঞ্চাশ হাজার। সম্পদ -সমৃদ্ধি বাড়তে লাগলো। বাবা টাকার পেছনে ছুটতে লাগলো। পরিবারকে সময় দিচ্ছিল না। রোজ ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি লেগেই থাকতো। মা অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলো দিন দিন। মা’র মনটা অনেক আগেই মরে গেছিল জানেন তো? দেহের মৃত্যুর আগে মনের মৃত্যু ঘটেছিল। সে দিন ছিল আমার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। সকাল আট টায় বাসা থেকে বের হই। আমি একাই হলে যাই। আশ্চর্যের বিষয় না? অবাক হয়েছেন?’
একবার বর্ষণের দিকে তাকিয়ে তাপৌষি আবার বলতে থাকে,
-‘ মা অসুস্থ ছিল আর বাবা তখন নিজের কাজে ব্যস্ত। নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। এমনিকি ঢাকায় পরীক্ষা দিতে আসি এক বান্ধবীর পরিবারের সাথে। ওই দিন পরীক্ষা দিয়ে যখন বাসায় ফিরি সাতশো স্কয়ার ফিটের বাড়িতে তখন পা রাখার জায়গা নেই। আশেপাশের বাড়ির সব মানুষ তখন আমাদের ছোট বাসাতে। সামনে এগিয়ে দেখতে পাই সাদা কাফনে মোড়ানো হয়েছে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে। বাড়িতে বাবা নেই। যারা উপস্থিত ছিল সব পাড়ার মানুষ। এদের কারও সাথে মা খুব একটা মিশতো না। আমরা ছিলাম প্রচুর ইন্ট্রোভার্ট একটা পরিবার। তখন মনে হচ্ছিল আমি মাঝ সমুদ্রে পড়ে গেছি। সাঁতার না জানায় অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছি। বাবা-মা’য়ের পালিয়ে বিয়ের কারনে আত্মীয়স্বজন কাউকে চিনতাম না। তনয়া খালামনিকে ফোন দেই।তবে ব্যস্ত দেখাচ্ছিল বারবার। আমার তখন শেষ ভরসা সেই অচেনা পাড়ার মানুষজন। দাফন কোন কবরস্থানে করবে জানতে যখন বাবাকে ফোন দেওয়া হয় বাবা তখন ফোন ধরে নি। একবার কলব্যাকও করে নি। মা’র দাফন কার্য শেষ হলে আমাদের মানুষে ভরা বাড়িটা আস্তে আস্তে খালি হয়ে যায়। পাড়ার মানুষ আর কত করবে বলেন? সারাদিন ওরাই তো আমাকে দেখে রেখেছিল। এমনকি পুলিশ জানাজানি হতে দেয়নি ওরা।
মায়ের নিথর দেহটা যখন নিজের চোখের সামনে দেখেছিলাম তখন চোখ দিয়ে পানি বের হয়নি একফোঁটা। আমাকে ধরে থাকা মহিলা গুলো শুধু বলছিল কাঁদো মা কাঁদো। কান্না পাচ্ছিল না তখন। আমি তাকিয়ে ছিলাম মায়ের গলার দিকে। সূক্ষ্ম দড়ির ছাপ পড়েছিল মা’য়ের ফর্সা গলায়। আমার এত সুন্দর মা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছিল। জনমানবহীন ফাঁকা বাসায় তখন নিজের মৃত্যু চাচ্ছিলাম। আটকে থাকা কান্না তখন এক নিমিষে বের হয়ে আসলো। চিল্লিয়ে গলা ফাটিয়ে কেঁদেছিলাম সেদিন।’
বর্ষণ তাপৌষির দিকে তাকিয়ে আছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটি।
তাপৌষি ডান হাতের পীঠ দিয়ে চোখের পানি মুছল। বর্ষণের দিক তাকিয়ে এক আশ্বস্তের হাসি হাসলো। যার অর্থ “আমি ঠিক আছি।” তারপর আবার রাতের অন্ধকারে বাইরের প্রকৃতি দেখতে লাগলো। শীতকালীন বৃষ্টি এটা। তবুও থামছেই না। ঝমঝমিয়ে ধরণির বুকে পড়েই চলেছে। তাপৌষি একটা বড় দম ফেলল।
-‘ বাবা এলো মা মারা যাওয়ার দুইদিন পর। এসেই মিলাদের আয়োজনে লেগে গেল। যেই মানুষটা আমি খেয়েছি কিনা না যানা অবধি নিজে মুখে খাবার তুলতো না সেই মানুষটা এসে একবারও আমার খোঁজ নিলো না। দুইদিন পর প্রথম আমার মাথায় যে হাত রাখে তার নাম “শুভ্রা”। বাবার অফিসের কলিগ। আন্টি আমাকে বুকে টেনে নেয়। আমি কাঁদি খুব কাঁদি। একসময় ঘুমিয়েও পড়ি। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার মা’য়ের রান্না ঘরে মা’য়ের শাড়ি গয়না পরহিতা শুভ্রা আন্টিকে কাজ করতে দেখতে পাই। পিছিন থেকে মা মা লাগছিল। আমি রেগে যাই। আমার মা’য়ের শাড়ি তাকে পড়তে মানা করি। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বাবা নিজের ঘর থেকে এসে আমার গালে চড় মেরে দেয়। শুভ্রা আন্টিকে কাছে টেনে চোখের জল মুছে দেয়। আমার চোখের সামনে বাবা উনাকে জড়িয়ে ধরে বুঝাতে থাকে, কাঁদতে মানা করে, কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দেয়। আর আমি অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে। বোকা আমি মা’য়ের শাড়ির জন্য লড়াই করছিলাম। অথচ মায়ের সবচেয়ে বড় অলঙ্কার তো শুভ্রা আন্টি অনেক আগেই নিয়ে নিয়েছে।’
তাপৌষি জানেনা এসব কথা ও বর্ষণকে কেন বলছে। তবে মন হালকা লাগছে। মস্তিষ্ক শান্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। এখন আর কান্না পাচ্ছে না। বুকের মাঝে চিড়চিড় ব্যাথাও করছে না।
বর্ষণ আস্তে করে বলল,
-‘ তাপৌষি..’
-‘ কালকে বাবা আর শুভ্রা আন্টির বিয়ে। আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল। তবে ঢাকায় থাকায় আমি সেখানে যেতে অপারগ। আপনাকে বলতে তো ভুলেই গেছি বাবা একটা ফ্লাট কিনেছে। নতুন বউ নিয়ে কালকে সেখানেই উঠবে। ফ্লাটটা তেরশো স্কয়ার ফিটের। অনেক বড়। ঢাকা থেকে ফিরে আমরা বাবার নতুন কেনা গাড়িতে লং ড্রাইভে যাব। দারুণ না?’
তাপৌষি হাসছে। শব্দ করে হাসছে। কষ্টের হাসি। কেমন যেন রহস্যময়ী লাগছে ওকে!
বর্ষন কিছুক্ষণ পর বলল,
-‘ জানো তাপৌষি দুইদিন আগে আমার একটা চাকরির ইন্টার্ভিউ ছিল। ভালোই ইন্টার্ভিউ দিয়েছিলাম। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, “ইন ইন্টার্ভিউ, হাও ইউ রিসপন্ড ইস প্রবাবোলি মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান ওয়াট ইউ সে”। তবে চাকরিটা আমার হয় নি। ওরা এক্সপিরিয়েন্সড লোক চায়। আমার সাথে আমার এক বন্ধু ইন্টার্ভিউ দিয়েছিল। একটু আগে জানলাম ওর চাকরিটা হয়ে গেছে।’
তাপৌষি অবাক চোখে বর্ষণের দিকে তাকায়।
-‘ অবাক হচ্ছো? আর অবাক হবে না। শুনো, ছেলেটার নাম নাহিদ। হিরোদের মতো চেহারা। আমার সাথে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। ভার্সিটিতে ভর্তির পর আমরা তখন খাঁচা ছাড়া মুক্ত পাখি। নাহিদ, আমি আর বাকী বন্ধুবান্ধবরা খুব আড্ডা দিতাম। প্রথম বর্ষ তাই উড়াউড়া মন আমাদের। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষের শুরুর দিকে ওর বাবা মারা যায়। ঢাকায় তিন কাঠায় নিজেদের একতলা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিল না ওদের। বাড়িতে চারবোন আর মা। বাবা সরকারি চাকরিজীবী নয় বলে কোন পেনশনও পেতো না। ফলে পুরো পরিবার তখন পথে বসে যায়। চারটা বোনই ওর চেয়ে ছোট। ছেলেটা নিজে তখন পরিবারে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। সারাদিন টিউশনি আর একটা পার্টটাইম জব- এই ছিল ওর প্রাত্যহিক রুটিন। যখন ক্লাস করতে আসতো মাঝে মাঝে তখন আমাদের দেখে মুচকি হাসতো। সুন্দর ছেলেটির চেহারা ভেঙে পড়েছিল। ক্লাস শেষে আমরা আড্ডা দিতাম আর ও ছুটত নিজ কাজে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ওকে সবাই মজা করে “ফ্যামিলি ম্যান” বলে ডাকতো। অবাক হতাম ছেলেটার ধৈর্য দেখে। গতকালকে ওর মা মারা গেছে। রিমির বিয়েতে না থেকে ওর পাশে থাকাটা তখন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। যখন ওর বাসায় যাই, দেখতে পাই ওরা পাঁচ ভাইবোন ওদের বাসায় আসা আত্মীয়দের দেখে রাখছে। ওদের আত্মীয়রা কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ওর ছোট বোন ক্লাস সেভেনে পড়ে। মেয়েটা আত্মীয়স্বজন কে সরবত এগিয়ে দিচ্ছে। নাহিদ সবার দুপুরের খাবারে তদারকি করছে। অথচ ঘটনা উল্টো হওয়ার কথা ছিল।’
তাপৌষি আজ খুব মনোযোগী শ্রোতা। বর্ষণের বন্ধুর জন্য ওর খুব খারাপ লাগছে। চারটা বোন লোকটার। বোনদের পড়াশোনা, বিয়ে এখন লোকটাকে একা সামলাতে হবে। বর্ষণ বলেই চলেছে,
-‘ আমি অবাক হয়ে নাহিদ আর ওর বোনদের দেখছিলাম। নাহিদ আমার অবাক দৃষ্টি দেখে কী বলেছিল জানো?
ও বলেছিল, ” বর্ষণ আম্মার কাছে আমরা শক্ত থাকতে শিখেছে। এই চারটা মেয়েকে দেখেছিস? এই চারটা মেয়ে আম্মার মৃত্যুতে খুব কষ্ট পেয়েছে। আশেপাশে যখন কেউ থাকে না এরা প্রত্যেকে তখন কাঁদে। আমি নিজেও কেঁদেছি। তবে আমরা কেউ চোখের জল অপরকে দেখিয়ে হালকা সান্ত্বনা পেতে চাইনা। আমরা জানি আমরা যে মহামূল্যবান সম্পদ হারিয়েছি তা নিছক সান্ত্বনা দিয়ে কেউ ফিরিয়ে আনতে পারবে না। বর্ষন বাবার মৃত্যুর পর আম্মা আমাদের শিখিয়েছে এই পৃথিবীতে কেউ চিরদিনের জন্য আসে নি। সবাইকেই একসময় যেতে হবে। প্রিয় মানুষটি চলে গেলেও জীবন থেমে থাকে না। জীবন আপন গতিতে চলতে থাকে। আমরা একা এসেছি এই পৃথিবীতে। আর যেতেও হবে একা। কেউ কারও সঙ্গে যেতে পারে না রে। আমাদের জন্য এত চিন্তা করিস না।”
আমি তখন মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম ছেলেটা যেন খুব বড় হয়। এই ভাই বোনদের যেন কখনো আর কাঁদতে না হয়। যখন শুনলাম ওর চাকরি হয়েছে তখন কী যে আনন্দ হচ্ছিল তোমাকে বলে বোঝানো যাবেনা। কিছু বুঝলা তাপৌষি?’
বর্ষন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,
-‘ বৃষ্টি পড়ছে এখনো। ঘরে যেয়ে জামা কাপড় পাল্টে ঘুমিয়ে পড়ো। আমিও ঘরে যাই কেমন?’
তাপৌষি বর্ষণের চলে যাওয়া দেখছে। এই মানুষ টার সাথে থাকলে ওর কষ্ট গুলো কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে যায়। তাপৌষি মাথা নিচু করে আপন মনেই বলে উঠলো,
” কে বলল
ভালোবাসতে কয়েক বছর, কয়েক মাস লেগে যায়?
কিছুক্ষণ, কিছু মুহূর্ত, প্রথম দর্শনেও
ভালোবাসা হয়ে যায়।”
.
.
চলবে…