হয়ত পর্ব ১২

#হয়ত
পর্ব:- ১২
.
বর্ষণ ঘর থেকে যাওয়ার পর তাপৌষি দারুণ উদ্ভূত এক কাজ করে ফেলল। ওয়্যারড্রেবের উপরে রাখা বর্ষণের ক্যাস্টেল ব্লাক ফারফিউমটা ও সারা গায়ে মেখে ফেলল। একটু কড়া ঘ্রাণ। তবে তাপৌষির ভালো লাগছে। বুকের মধ্যে সাঁইসাঁই করে এক মিষ্টি বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
দিশাকে আস্তে করে ডাকলো।
-‘ ভাইয়া চলে গেছে তাপৌষি?’
-‘ হ্যাঁ। আমাদের এই ঘরে ঘুমাতে বলে গেছে। তুমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলে তাই আমি ডেকে দিলাম।’
তাপৌষি সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করার আগেই দিশা খাটে ঠিক ভাবে শুয়ে আবার ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। হালকা হেসে দেয়ালে টাঙানো বেতের আয়নাটার সামনে দাঁড়ালো তাপৌষি। গতকালকে হলুদে পড়া বর্ষণের লাল পাঞ্জাবিটা টেবিলে এখনো রাখা। লোকটা বড্ড অগোছালো।
পাঞ্জাবিটা হাতে তুলে নিয়ে গায়ে চাপালো তাপৌষি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলো নিজেকে। শেষে মিহি কণ্ঠে গান ধরলো পাছে দিশা শুনে ফেলবে এই ভয়ে।
“বাবরি কাটা তার চুলের বাহার
মুচকি হাসি হাসি মুখটা যে তার
বাবরি চুল ওয়ালা ঐ লাল কুরতা ওয়ালা
দিলি বড় জ্বালারে পাঞ্জাবি ওয়ালা
রসিক তেলকাজ্বালা, ঐ লাল কুরতাওয়ালা
দিলি বড় জ্বালারে পাঞ্জাবী ওয়ালা..”
এক অন্তরা গেয়ে নিজেই নিজের মাথায় ঠুয়া মারলো। তারপর বিরিবির করে বলল,” কী হলো রে তোর তাপৌষি। মাত্র দুই দিনেই মন দিয়ে দিলি। এ ভীষণ অন্যায়। শুধরে যা। ”
.
আজকের সকালটা তাপৌষির জন্য গুড মর্নিং নয় বরং ব্যাড মর্নিং বয়ে আনলো। মাইগ্রেনের ব্যথা চিড়িক দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। মাথা চেপে ধরে শুয়ে ছিল সে। দিশা বেশ ক্ষানিক্ষণ আগে উঠে গেছে। ঘরিতে এখন বেলা বারোটা ছুঁই ছুঁই। নিজের ঘরে যেয়ে ব্যাগ থেকে একটা নাপা বের করে খেল সে। তাড়াহুড়োতে ঔষধ ঢুকাতে ভুলে গেলে এই ধরনের মসিবতেই পড়তে হয়। গত রাতে মাথা ব্যাথায় মাঝ রাতে উঠে তাপৌষি তনয়া বেগমের ঘরে যেয়ে নাপা চায়। এটা সেই নাপার পাতা। তনয়া বেগম অবশ্য বলেছেন আজকে কাউকে পাঠিয়ে তাপৌষিকে ঔষধ এনে দিবেন।
ডাইনিং টেবিল আজকে লোকে লোকারণ্য। আগের চেয়ারগুলোর সাথে আরও ছয়টি চেয়ার যোগ করা হয়েছে। দিশা আর তনয়া বেগম খাবার পরিবেশন করছে। তাপৌষি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো,” আচ্ছা এখানে সকালের খাবার পরিবেশিত হচ্ছে না কি দুপুরের? একটা বাজতেও তো আর বেশি সময় নেই।” তাপৌষিকে আসতে দেখে দিশা বলল,
-‘ কিছুক্ষণ দাড়াও তাপৌষি। বড়দের খাওয়া হলে আমরা সবাই একসাথে বসবো।’
-‘ খেতে ইচ্ছে করছে না আপু। এমনি নেমে আসলাম। ঘুম দরকার আমার। রাতে ঘুম হয়নি।’
-‘ আচ্ছা দুপুরবেলা যেয়ে ঘুমিয়ে নিও।’
হঠাৎ খাবার টেবিলে উপস্থিত এক মহিলা ‘দিশা বলে’ চেঁচিয়ে উঠলো। ঘটনার আকস্মিকতায় তাপৌষি অবাক হয়ে মহিলাটির দিকে তাকায়। অতি ফর্সা মহিলাটির মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে। মহিলাটি বেশ মোটাও। দিশা জি ফুপু বলার সাথে সাথে মহিলাটি এক ধমক দেয় ওকে। মহিলাটির কথার সারমর্ম এই যে, দিশা তার বাড়িতে আসা অতিথিদের যত্ন নিচ্ছে না। খালি টুকুর টুকুর করে গল্প করে বেড়াচ্ছে সবার সাথে। আর যে টুকু যত্ন নিচ্ছে তা নিতান্ত লোক দেখানো।

তাপৌষিকে দেখে মহিলাটি বলল
-‘ কেন খাবা না কেন?’
-‘ জি আন্টি রাতে ঘুম হয়নি। না ঘুমালে আমি খেতে পাড়ি না।’
-‘ বুঝেছি। তোমার গ্যাসের ব্যামো হয়েছে। বাংলাদেশে আজকাল খাবারে যে পরিমাণ ফরমালিন মিশানো হয় তাতে গ্যাস হওয়া অস্বাভাবিক না।’
মহিলাটি নিজের পাশে দাঁড়ানো এক কিশোরী মেয়েকে কিছু একটা আনতে বলল। মেয়েটি দৌঁড়ে এই বাড়ি পেরিয়ে সেই মাটির বাড়িতে চলে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই হাতে একটা বক্স নিয়ে ফিরল।
-‘ খালাম্মা ধরেন।’
-‘ এই মেয়ে এই ঔষধটা এখন খাবা। এটা লোসেকটিল। আসো খেয়ে নাও।’
দিশা হাসি আটকাতে পারছে না। ওর ছোট ফুপু একটা মজার মানুষ। উনার কাছে সব রোগ হলো গ্যাসের রোগ, আর সব রোগী হলো গ্যাসের রোগী। তাও তাপৌষির চুপসে যাওয়া মুখের দিক তাকিয়ে বহু কষ্টে বলল,
-‘ ফুপু আসলে ওর রাতে ঘুমাতে অনেক দেরী হয়ে গেছিল। তার উপর মাথা ব্যাথা সকাল থেকে। গ্যাসের সমস্যা না এটা।’
-‘ তুই চুপ। বেশি জানোস? এই গ্যাসের ঔষধ খাইলে মাথা ব্যাথাও বাপ বাপ বলে পালাবে।’
টেবিলে বসা অনেকেই মিটিমিটি হাসছে। দিশা ওর ফুপুর কথাবার্তা শুনে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। একজন শিক্ষিত মহিলা এসব কী বলে? ইনি নিজেই সবার কাছে বলে বেড়ান, ” আমি নব্বইয়ের বি এ পাশ। এত পড়ালেখা করেও আমার অহংকার নেই। ঘর সামলাই, বাচ্চাকাচ্চা সামলাই। ইচ্ছা হইলে যে কোন সময় চাকরি পেয়ে যাবো।” অথচ গ্যাসের সাথে মাথা ব্যাথার কোন যোগ সূত্র নেই, এই স্বাভাবিক কথা উনি জানেন না?
তাপৌষি এই এলিট শ্রেণির মহিলাটিকে দেখে থতমত খেয়ে গেছে। বলে কী। গ্যাসের সমস্যা হলো কবে ওর? পেটে গ্যাস নিয়ে ঘুরছে অথচ নিজেই জানে না!
-‘ এই মেয়ে তোমাকে না আমি ঔষধ খেতে বললাম? খাও। নইলে দেখবা সারাদিন ভুসভাস বের হচ্ছে। ভুসভাস থেকে মনে পড়লো। তোমাদের একটা হাসির ঘটনা শুনাই। আমাদের পাশের ফ্লাটে এজাজ নামের এক নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে বুঝছো। তো ভদ্রলোককে প্রথম দিন দেখেই আমি বুঝে গেছি উনার গ্যাসের সমস্যা। পেটটা অনেক বড়। আমি বাবা লোকটার ভালোর জন্য জিজ্ঞেস করসিলাম গ্যাসের সমস্যা আছে নাকি। যা বাবা আমাকে রাগ দেখিয়ে চলে গেল। এই লোক সিঁড়ি দিয়ে উঠার আর নামার সময় মনে হয় সিঁড়িতে উত্তর কোরিয়া লাগাতার কয়েকটা এটম বোম্ব ফেলছে। ঘরে ঢুকার আগ অবধি চলতে থাকে এই ভুসভাস আওয়াজ। সারা বি ব্লকে উনার নাম হয়ে গেল ‘পাদ ম্যান’।
তো সেদিন উনার বউ আসছিলো। আমাকে অনুনয় করে জিজ্ঞেস করে আমি কোন গ্যাস্ট্রোলজিস্টের নাম জানি কী না। আমি বললাম এত টাকা খরচ করে কী হবে? হাই পাওয়ারের ঔষধ দেয় এসকল ডাক্তার। তাই আমি এই লোসেকটিল আর উলট কমলের ডালের পানি খাইতে বলসিলাম। এখন সে পুরোপুরি সুস্থ।’
মহিলা নিজের গল্প বলা শেষ করে হো হো করে হাসতে লাগলো। তারপর উপস্থিত সকলের দিকে তাকালো। কিন্তু দেখা গেল ভদ্র মহিলা ছাড়া আর কারও মুখে হাসি নেই। সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে আছে।
দিশা এবার তাপৌষির দিকে তাকালো। তাপৌষি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ লজ্জা পেয়েছে মেয়েটা। সে আস্তে করে তাপৌষির কানে কানে বলল,
-‘ ঘরে যাও তাপৌষি। ছোট ফুপু সাংঘাতিক মহিলা। কথায় কোন ব্যালেন্স নেই। আমরা যখন খেতে বসবো তোমাকে ডেকে দিব।’
.
তাপৌষি দুপুরে খায়নি। সেই যে দিশার কথা শুনে ঘরে আসলো আর ঘর থেকে বের হয়নি। বিরাট ঘুম দিয়ে উঠলো সে। তাপৌষিকে ডাকতে এসে দিশা যখন দেখলো তাপৌষি ঘুমাচ্ছে তখন আর ডাকেনি। ভেবেছিল পরে যখন উঠবে খাবার বেড়ে দিবে। কিন্তু তাপৌষির ঘুম ভাঙলো রাত আটটায়। দুপুরের গোসলটাও হয়নি তার। গতকালকের রাতে পড়া সাদা সালোয়ার-কামিজ এখনও পরনে রয়েছে। ঘরির দিক তাকিয়ে চমকে উঠে তাপৌষি। পেটটা খিদায় চোঁ চোঁ করছে। ঘর থেকে বের হয়ে দেখল দুই তলা সম্পূর্ণ ফাঁকা। নিচতলায় যাওয়ার সময় নিজের পাশের ঘরে একবার উঁকি মারলো। না ভিতরে বর্ষণ নেই।
নিচতলায় ড্রয়িংরুম থেকে অনেক মানুষের কণ্ঠস্বরের আওয়াজ ভেসে আসছে। দিশা, অথৈ, রৌদ ডাইনিং টেবিলে বসে কিছু একটা খাচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে ছোট গোল বাটি আর একটা চামচ।
তাপৌষিকে দেখে রৌদ বলে উঠলো
-‘ কেমন ঘুম হলো তাপৌষি? আসো ফালুদা খাই। দিশা ওকে বেড়ে দে।’
-‘ না ভাইয়া। ও দুপুরে কিছু খায় নি। সকালেও খায় নি। সারাদিন পেট খালি ছিল। মাথা ব্যাথার জন্য ডাক দেই নি। তাপৌষি ভাত বেড়ে দিব?’
তাপৌষি শুধু উপর নিচ মাথা নাড়াল।
-‘ আচ্ছা তুমি বসো।’
ওভেনে গরুর মাংসের তরকারি গরম করতে দিয়ে দিশা আবার টেবিলে এসে বসলো। বিয়েতে অনেক খাবার বেঁচে গেছিল। ওগুলোই খেতে হচ্ছে সবাইকে এখন।

তাপৌষি চুপচাপ টেবিলে বসে আছে মাথা নিচু করে। অথৈ আর রৌদ মজার কোন একটা ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছে আর তাপৌষি তা শুনে মুচকি মুচকি হাসছে।
খাবার প্লেটে নিবার পর মনে হচ্ছিল আর শবুর করা যাবেনা। এখন শুধু খাওয়া আর খাওয়া। তবে এরা কেউ ওর মতো ভাত খাচ্ছে না। ও কী ভাবে এদের সামনে খাবে? ওর জড়তা দেখে দিশা বলল,
-‘ আমরা খেয়েছি তাপৌষি। তুমি খাও এখন।’
কয়েক লোকমা ভাত গোগ্রাসে গিললো তাপৌষি। সত্যি বড্ড খিদা পেয়েছিল তার। আরেক প্লেট ভাত নেওয়ার সময় রাবেয়া বানু কে ঘরে ঢুকতে দেখল তাপৌষি। ভদ্র মহিলা ওকে দেখেই নাক সিটকাল। পিছে দিশার ছোট ফুপু আছে। সে এসেই ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল। তারপর আপনমনেই তাপৌষির জন্য রাখা ফালুদার বাটিটা তুলে নিয়ে খেতে লাগল। দিশা, রৌদ, অথৈ এই মহিলার স্বভাব সম্পর্কে জানলেও তাপৌষি জানে না। তাপৌষির সামনে ওরা বেশ বিব্রত হলো। এত বড় একজন মানুষের নির্বুদ্ধিতা ঢাকতে দিশা বলল,
-‘ তাপৌষি তুমি খেয়ে নাও। আমি তোমার জন্য ফালুদা নিয়ে আসছি।’
শারমিন আহমেদ রাবেয়া বানুর ছোট মেয়ে। বিয়ে হয়েছে পনেরো বছর। দুই সন্তানের জননী। একটাও কাজ নিজে করতে চান না। বাড়িতে কাজের লোক দুটো। পানিটাও তাকে কখনো ঢেলে খেতে হয়না তাই। ফলে ওজন দাঁড়িয়েছে একশত দশ কেজিতে। সারাদিন খাওয়া ছাড়া তিনি কিছুই বুঝেন না। তবে তার রান্নাবান্নার হাত বেশ পাকাপোক্ত। শারমিন দিশার কথায় খেক করে উঠলো।
-‘ এহ। ও ভাত খেল না এখন? এত জিনিস একসাথে পেটে ঢুকে নাকি? বস চুপচাপ।’
দিশার রাগ লাগছে ফুপুর উপর। নিজে চারবারের বেশি ফালুদা খেয়েছে। সকাল থেকে এই পর্যন্ত তিনবার ভাত খাওয়া হয়ে গেছে তার। কিছু বলাও যায় না। বললেই দাদী চিল্লানি দেয়।
.
.
চলবে…
.

[যারা পড়ছেন দয়া করে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। ভুল গুলো ধরিয়ে দিলে খুব উপকৃত হবো।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here