হয়ত পর্ব ১১

#হয়ত
পর্ব:-১১
.
-‘ এরেঞ্জ ম্যারেজ ভালো নাকি লাভ ম্যারেজ?’
-‘ এটাই তোমার প্রশ্ন? হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
-‘ গতকালকে থেকে প্রশ্নটার উত্তর জানার চেষ্টা করছি। কিন্তু উত্তর পাচ্ছি না।’
দিশা বেশ মজা পাচ্ছে। তাপৌষি বর্ষণকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। বর্ষণ ভেবে পাচ্ছে না সে এই পিচ্চিকে কী উত্তর দিবে! বাম হাত দিয়ে ডান হাতের আঙুলগুলো ফুটিয়ে নিল। কিছু একটা ভাবলো। তারপর তাপৌষির দিকে সরাসরি চাইলো।
-‘ দুটোই ভালো আবার দুটোই খারাপ। তবে বিবাহিত জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করবে জীবন সঙ্গী বাছাই এর উপর।’
-‘ মানে?’
-‘ শুনো তাপৌষি এরেঞ্জ ম্যারেজ লাভ ম্যারেজ বলতে কিছু নেই। আসল কথা হলো ভালোবাসা। এরেঞ্জ ম্যারেজে ভালোবাসা বিয়ের পর হয় আর লাভ ম্যারেজে বিয়ের আগে। কিন্তু ওই যে বললাম ভাগ্যে যদি নিষ্ঠুর জীবনসঙ্গী লিখা থাকে তাহলে উভয় বিয়েই খারাপ।’
“জীবনসঙ্গী” শব্দটা আসলে খুব বড় অর্থ বহন করে। মানুষের জীবনে নির্দিষ্ট সময়ে কেউ একজন তার জীবনসঙ্গী হয়ে আসে। স্বপ্ন দেখায় নতুনত্বের। তাপৌষির বাবা-মায়েরও তো লাভ ম্যারেজ। ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিল তারা। অথচ এত ভালোবাসা সব কর্পুরের মতো উড়ে গেলো। দুইমাসের মাথায় ভালোবাসার মানুষটিকে ভুলে আরেক জনের হাত ধরতে দ্বিধা হয় না। একটা গভীর নিশ্বাস তাপৌষির বুক চিড়ে বের হয়ে আসলো। হয়তো ” জীবনসঙ্গী” বাছাই উঁহু “সঠিক জীবনসঙ্গী ” বাছাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
-‘ হঠাৎ বিয়ের পর যদি কেউ জানতে পারে ভুল মানুষ তার জীবনসঙ্গী তাহলে? আবার এমন ও তো হতে পারে বিয়ের অনেক বছর পর জানতে পারলো তার চলার পথের সাথী তাকে ঠকাচ্ছে! মেয়েটার তো আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন পথই ফাঁকা থাকলো না তখন।’
বর্ষণ চমকে উঠে তাপৌষির কথায়। তাপৌষির গলা ভাঙা ভাঙা। মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে দিবে। অনেক কষ্টে কান্না আটকে রেখেছে। তাপৌষি হঠাৎ এমন সব প্রশ্ন করছে কেন? বর্ষণের এবার চিন্তা হচ্ছে। দুইমাস আগে তাপৌষির মা আত্মহত্যা করে। সবাই বলেছিল উনি নাকি মৃত্যুর কয়েকমাস আগেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তাপৌষির কথাগুলো কীরকম একটা যোগসূত্র তৈরি করছে। বর্ষণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাপৌষিকে পর্যবেক্ষণ করলো।
-‘ মৃতু কখনো একটা মানুষের শেষ সিদ্ধান্ত হতে পারেনা তাপৌষি। যদি কয়েক বছর সাথে চলা সঙ্গীকে অপরিচিত মনে হয় তাহলে সঙ্গীকে একবার শুধরে নেওয়ার সুযোগ দিতে হয়।
-‘ যদি সুযোগ দেওয়ার পরও কাজ না হয়?’
-‘ যদি সুযোগে কাজ না হয় তাহলে নিজের জীবনকে নিয়ে আবার ভাবতে হবে। নিজের পথ নিজে চলতে হবে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে হবে। জীবনটা অনেক বড় তাপৌষি। একটা জীবন আমাদের বারবার সুযোগ দেয় নিজেকে প্রমাণ করার। এখন আমাদের ইচ্ছা আমরা সেই সুযোগটা নিবো কি না। তবে বিষয়টা হলো নিজের পরিচয়ের। তুমি ভাবছো একটা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে। জীবনসাথী কে ছাড়ার পর মেয়েটা কী করবে এই ভেবে যদি অন্যায় মেনে নেওয়া হয় তাহলে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করা হবে।’
-‘ তাহলে মেয়েটা কী করবে? ধরেন আপনার কথা মতো ছেড়ে দিলো। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটা তালাক প্রাপ্ত মেয়েকে তার পরিবারও স্থান দেয় না। এমনকি মেয়েটার সিদ্ধান্তকে তার পরিবারও সার্পোট করে না। তখন পরিবার থেকে মেয়েদের শুনতে হয়, ” আমাদের পরিবারে এর আগে কেউ বরের থেকে তালাক নেয়নি। মুখে চুনকালি মাখালি। মেয়ে মানুষকে একটু মানিয়ে চলতেই হয়।’ আবার প্রেম করে বিয়ে করলে তো আরও সমস্যা। তখন শুনতে ” নিজে বিয়ে করসো, আমরা কেউ এর দায় নিবো না। নিজের রাস্তা নিজে মাপ।” এবার মেয়েটা কোথায় যাবে?’
তাপৌষির কথাগুলো বর্ষণের টিপিক্যাল মেয়েলোকের কথার মতো লাগছে। গ্রাম আর শহর কত উন্নত হিয়েছে এই মেয়ে কী তা দেখেনি? তাও একটু দম নিয়ে বললো,
-‘এখনকার মেয়েরা যথেষ্ট স্বাবলম্বী তাপৌষি। জানো,প্রথম হওয়া খারাপ নয় বরং ভালো। ছোটবেলায় আমরা যখন পড়াশুনা, খেলাধুলায় প্রথম হতাম সবাই খুব খুশি হতো ,তাইনা? সব থেকে বেশি খুশি হতাম আমরা নিজেরা। কারন আমাদের আগে আর কেউ নেই। সেই রকমই ডিভোর্স নিলে যদি পরিবারের প্রথম ডিভোর্সি মহিলা হতে হয় তাহলে এতে অসম্মানের কী হলো? অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে তার অন্যায় মেনে নিয়ে চলতে গেলে দেখা যাবে নিজের অস্তিত্ব একসময় হারিয়ে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের মেয়েরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে পুরুষের পাশাপাশি চলছে। যদি মেয়েরা ঘরেই বসে বসে স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতো, নিজেকে মেয়ে বলে গুটিয়ে রাখতো, আর কথায় কথায় “আমি পারবো না কারন আমি মেয়ে” বাক্যটি উচ্চারণ করতো তাহলে – কানিজ ফাতেমা রোকাসানা বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট হতে পারতেন না, বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না, ড. সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপক হতে পারতেন না, জোহরা বেগম কাজী বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ডাক্তার হতে পারতেন না, শিরিন শারমিন চৌধুরী বাংলাদেশের প্রথম নারী স্পিকার হয়ে সংসদে নিজের স্থান দখল করতে পারতেন না। বাংলাদেশের প্রথম নারী এভেরেস্ট জয়ীর নাম জানো? ” নিশাত মজুমদার”। এই অদম্য সাহসী মেয়েটা যদি ‘ আমি পাহাড়কে ভালোবাসি। তবে আমি নারী, আমি পাহাড়ে উঠবো কী ভাবে?’ বলে এভারেস্ট নামক স্বপ্ন চূড়াকে ভুলে যেত, তাহলে তার মেধা আর পাহাড়ের প্রতি ভালোবাসা এক সময় বন্ধ কুঠুরিতে আজীবনের জন্য বন্দী হয়ে যেত। যদি তোমার উপর অন্যায় হয় তাহলে ভয় না পেয়ে প্রতিবাদ করো, অন্যায়কে প্রতিহত করো। বাংলাদেশের মেয়েরা সেই নিয়মের জাঁতাকলে আর বেঁধে নেই তাপৌষি। বুঝলা?’
-‘ হুম। বুঝেছি। তবে তো তাকে সাহস জাগানোর কেউ তো থাকতে হবে।’
-‘ আগে নিজের লক্ষ্য স্থির করো। সাহস আপনা আপনি নিজের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। আসো তোমাকে একটা গল্প শুনাই। আগে বলো নাদিয়া মুরাদ’কে চিনো?’
-‘ না কে উনি?’
-‘ একজন অসাধারণ সাহসী কুর্দি নারী। ২০১৮ সলে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। কুর্দি সম্পর্কে কোন ধারণা আছে?’
-‘ কুর্দি? ‘
-‘ কুর্দিরা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের আরব, তুর্কি এবং ফারসিদের পর একটি বৃহৎ জাতিগোষ্টী। এরা আরব বিশ্বে সর্ববৃহৎ চতুর্থ জাতিগোষ্ঠী। এদের অবস্থান তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, ইরান সীমান্তে ও আর্মেনিয়ার কিছু অংশ জুড়ে।
তো যা বলছিলাম। ” নাদিয়া মুরাদ “।অতি অল্প শিক্ষায় শিক্ষিত এই কুর্দি মেয়েটি সারা বিশ্বের সামনে এক পৈশাচিক নির্যাতনের অন্ধকার কাহিনী তুলে ধরে। মেয়েটি নিজে বার বার গন ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং তাকে বিক্রি করা হয়েছিল যৌন দাসী হিসেবে । চোখের সামনে ছয় ভাই কে মেরে ফেলতে দেখেছে, প্রতিবেশী বন্ধু তার সম্প্রদায়ের মানুষদের রক্তাক্ত লাশ দেখেছে। নাদিয়া তার ইন্টার্ভিউতে বলেছে, “আমরা মাদ্রাসার জানালা দিয়ে দেখছিলাম কিভাবে ওরা একের পর এক গুলি করে মেরে ফেলছিল । আমি আমার ভাইদের মেরে ফেলা দেখছিলাম ।
ওরা চার বছরে উপড়ে ছেলে শিশু আর নয় বছরের উপরের মেয়েদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল যৌন দাসী হিসেবে আর ৫০ এর উপড়ে নারীদের ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছিল”।
এত কিছুর পরেও মেয়েটা দমে যায় নি। বরং শরীরে ভয়ঙ্কর অত্যাচারের ক্ষত নিয়ে লড়ছে পৃথিবীর সব চেয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসআইএস এর বিরুদ্ধে। নির্যাতিত কুর্দি নারীদের জন্য নিজের জন্য সে এখনো লড়াই করে চেলেছে। এই অতি সাধারণ মেয়ে নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে আগে নিজে প্রতিবাদ করেছে। আইএসআইএস নামক ভয়ানক জঙ্গি গোষ্ঠীর ভয় ওকে দমিয়ে রাখতে পারে নি।
মৃত্যু থেকে বেঁচে আসা নাদিয়া মুরাদ এখনো মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে । নিজের জন্য এবং সমস্ত মানবজাতির জন্য মানবতার উদাহন তৈরি করে যাচ্ছে । ও কিন্তু প্রথম আওয়াজ উঠিয়েছে। প্রথম আওয়াজ সব সময় নিজের হয়। মনের জোর থাকলে অন্য কেউ চাইলেও সেই আওয়াজ বন্ধ করে দিতে পারবে না।’ (তথ্যসূত্র:- গুগল ও ব্লগ)
-‘ এখনো মেয়েটা লড়াই করছে?’
-‘ হুম করছে তো।’
….
এতক্ষণে দুজনের খেয়াল হলো ঘরে ওরা ছাড়া আরও একজন আছে। “দিশা”। তবে দিশা ম্যাডাম গভীর ঘুমে ব্যস্ত। এই মেয়ে হয়তো এত আলোচনার কিছুই শুনে নি। কুম্ভকর্ণের লেডিস ভার্সন একটা। বর্ষণ দিশার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। তাপৌষিও মিটিমিট হাসছে। দিশার পা খাটের বাইরে ; তবে মেঝে স্পর্শ করেনি। মাথায় বালিশ না দিয়ে মাথার বালিশ দুইহাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে পেটের উপর।
-‘ তাপৌষি তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো এখন। আর কিছুক্ষণ পর ভোর। আর দরজা লাগিয়ে ঘুমাবা। বাড়িতে অনেক মেহমান। বুঝছো?’
-‘ জি শুনুন।’
-‘ আর কী প্রশ্ন রে বাবা?’
-‘ এখানে প্রতিটি বৌভাতই কী এমন এক সপ্তাহ দেরীতে হয়?’
-‘ এখানের কয়টা বিয়ে খেয়েছ তুমি?’
-‘ এটাই প্রথম।’
-‘ হা হা হা, না এমন হয় না। তবে এই হঠাৎ করে বিয়ের জন্য এক সপ্তাহ দেরী করে বৌভাত হবে। ওদের ও তো প্রিপারেশন লাগবে তাইনা? আর কোন প্রশ্ন?’
-‘ হ্যাঁ।’
-‘ কী?’
-‘ আপনি বললেন বাড়িতে অনেক মেহমান। কই কাউকে তো দেখছি না।’
-‘ এখন রাত তিনটে বেজে ত্রিশ মিনিট। এসময় কে বাইরে হাটবে? আর তাছাড়াও সবাই নিচ তলায় ড্রয়িংরুমে। সোফা সরিয়ে নিচে বিছানা করে দেওয়া হয়েছে। এক সাথে আজ রাতে সবাই আড্ডা দিচ্ছে দেখো যেয়ে। তোমার খালামনিও ওখানে। দিশা তো ঘুমের রাণী, তাই ওখানে ওকে পাবা না। আমিও ওখানে যাচ্ছি। ঘুমিয়ে পড়ো। আর অবশ্যই গেট লাগিয়ে ঘুমাবা।’
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here