ঝরে যাওয়া বেলীফুল পর্ব -২৮

###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
#পর্ব_২৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

বন্ধ ঘরে , দুটো শরীর , দুটো আত্মা , দুটো মনের মাঝে খেলা অবিরত । ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীর নজর তখন আকাশের চাঁদের দিকে ।

– একটা কথা বলি ?
– হু , বল
– আকাশের অনেক দয়া মায়া তাই না ?
– মানে ?
– হ্যাঁ , সে তার বুকে হাজারো তারাকে আশ্রয় দেয় , একই বুকে চাঁদকে ঠাই দেয় আবার এই একই বুকে সূর্য হেসে উঠে । আবার কখনো মন খারাপে সে অশ্রু ঝরায় বৃষ্টিরুপে ।
– হ্যাঁ , হয়তো বা
– ওই চাঁদটাকে ঘিরে কত তারাদের ছুটোছুটি ।
– হু ,
– তবে চাঁদের গায়েতেও কলঙ্ক আছে ।
– তুই তো অনেক ভালো বলিস ,
– কলেজে পড়ার সময় বাংলা স্যার পড়াতেন । সেইখান থেকেই শিখা ।
– বেলী,,,,,,,,,,,?
– হু ,
-,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কি হলো , নাম ধরে ডেকে চুপ করে গেলেন যে ?
– কিছু না ,
– রুবি আপু আর ফোন দিয়েছিল ?
– নাহ ,
– মানুষটা রাগ করছে অনেক । ফিরিয়ে আনুন তাকে , প্রয়োজনে আমি চলে যাবো ।

বেলীর কথাটা আর সহ্য করতে পারে নি ইরফান । ঝট করেই বেলীর হাত ধরে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে ইরফান । ইরফানের নজর বেলীর দৃষ্টিতে আর বেলী তার শান্ত দৃষ্টি দিয়ে ঘায়েল করছে ইরফানকে ।

– ভুলে গেছিস সে রাতের কথা ?
– কোন রাত ?
– বাহ ভুলে গেলি ?
– মনে পড়ে না ,

” আপনি যখন আমাকে মারবেন আমি কাঁদবো না , একদম কাঁদবো না , শুধু ছাড়তে বলবেন না , সহ্য করতে পারবো না ”
– মনে পড়ে এই কথাটা ?

কথাটা শুনে সেরাতের প্রতিটা কথাই মনে পড়ে যায় বেলীর । সেরাতে বেলীই ইরফানকে বলেছিল না ছাড়তে আর আজ সে বেলীই নিজ থেকে বলে দিল প্রয়োজনে সে চলে যাবে । এখানেই জিদ উঠে ইরফানের ।

– মনে পড়ছে নিশ্চয়ই ,
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– তোকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব না ।
– তাহলে রুবি ,
– জানি না আমি কিচ্ছু জানি না শুধু চাই তুই আমার কাছেই থাকবি । আমার বুকে আমার মনে , সব জায়গাতেই তুই থাকবি ব্যাস ।

এই বলে ইরফানে বেলীকে তার বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয় । একদম শক্ত করে যেন চলে যেতে না পারে । ইরফানের শরীরের উষ্ণতায় বেলীর শরীর যেন আরাম খুজে পায় । বেলীরও ইচ্ছা হয় একটু জড়িয়ে নিতে তার বরকে । কিন্ত লজ্জা নামক জিনিসটা কেন জানি তাকে আটকে রাখে । যেতে দেয় না তাইএ ইরফানের কাছে ।

ইরফান বেলীর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । হাত বুলাতে বুলাতে বেলীর কানের কাছে মুখ এনে আস্তে করে কথা বলে ইরফান ,

– বেলী,,,,,,,,,,,?
– হু ,,
– একটা কথা বলি ?
– হু ,,
– একটু সুখের মিলন হলে , খুব বেশি কি ক্ষতি হবে বেলী ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কি হলো বল , খুব বেশিই কি ক্ষতি হবে ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– এই অন্তরটা তোকে খুব ভালোবাসতে চায় রে বেলীফুল । খুব ভালোবাসতে চায়

ইরফানের মুখ থেকে বেলীফুল ডাকটা শুনে বেলীর মনে হয় কে যেন তার কলিজায় পানি ঢেলে দিয়েছে । তার পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানটা হঠাৎ করেই কেন জানি ভালো হয়ে গেল । ইরফান আবারও বলে ,

– বল না একবার , খুব বেশিই ক্ষতি হবে কি একটু সুখের মিলনে ।
– জানা নাই ,
– জানা নেই , সত্যিই কি জানা নেই ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,
– অনেক জায়গায় বলতে শুনেছি নীরবতা সম্মতির লক্ষণ । আমি কি এই নিরবতাকেই তোর সম্মতি ভেবে নিবো ?

ঠিক তখনই বেলী তার দু’হাতে ইরফানের পিঠটা মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় । নিজেই নিজের হাতের ভাজে চেপে ধরে ইরফানের টি-শার্টটা । ইরফান তখন কিছুই বলেনি । শুধু এক গাল হেসে পরম ভালোবাসায় নিজের মাঝে বেলীকে আঁকড়ে ধরে । আর তার কিছুক্ষণ পরেই ইরফান বেলীকে কোলে তুলে নেয় । বেলীর মুখ যেন লজ্জায় আবৃত এক রাঙা বধূর মুখ লাগছিল । বিছানার কাছে নিয়ে গিয়ে আলতো ভাবেই বেলীকে শুইয়ে দেয় ইরফান । আজ ভালোবাসার সপ্তম আকাশে পদার্পণ করলে ক্ষতি হবে না হয়তো । বেলীর লজ্জা রাঙা মুখ তখন ইরফানকে কাছে চাইছে , খুব করেই কাছে চাইছে । আর ইরফান যেন পলক বিহীন চোখে তাকিয়ে দেখছে তার বেলীফুলকে । আজ দুটো হৃদস্পন্দন না হয় এক হলো । এতে হয়তো ক্ষতি কিছুই হবে না । বড় জোড় নতুন আরেকটা হৃদস্পন্দনের আবির্ভাব ঘটবে । ইরফান বেলীর দিকে অনেকটাই ঝুঁকে যায় । ইরফানের এই ঝুঁকে যাওয়াটাই হয়তো বেলীর সুখের সর্বনাশ ।

অন্ধকার বন্ধ ঘরে দুটো মনের সুখের মিলন ঘটে এই রাতে । আজ রাতে পূর্নিমার চাঁদটাও লজ্জায় তার চোখ জোড়া বন্ধ করে দেয় । দূরে ডাকতে থাকা ডাহুক পাখিটাও আজ একদম চুপচাপ । হয়তো তার মনেও জানান দিয়েছে যে আজ কিছু অপ্রকাশিত ভালোবাসার পূর্ণতা ঘটবে ।

বাহিরে হিম শীতল বাতাস বইছে । পরিবেশটা একদম নিস্তব্ধ । আজ না আছে বেলীর মুখে কথা না আছে ইরফানের মুখে কথা । শুধু আছে ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ আর কিছু সুখের আর্তনাদ । দু’জোড়া হাত যেন আজ মিলেমিশে একাকার । এ যেন এক স্বর্গীয় সুখ ।

পরদিন ,

ভোরের দিকে বেলীর ঘুম ভেঙে যায় । নিজেকে ইরফানের সঙ্গে লেপ্টানো অবস্থস্য আবিষ্কার তার । কাল রাতে ঘটে যাওয়া সুখের মিলনটাই হয়তো আজকে ভোরের লেপ্টে থাকার স্বাক্ষী । ইরফানের শরীরের সাথে নিজের শরীরটা এইভাবে দেখে লজ্জার শ্রেষ্ঠ চূড়ায় অবস্থান করছে বেলীর মন । অবশেষে তাহলে সুখের মিলনটা তাহলে হয়েই গেল । অপ্রকাশিত ভালোবাসাটা অবশেষে প্রকাশিত ভালোবাসার পবিত্রতার ডোরে বাঁধা পড়েই গেল ।
বেলী আস্তে করে ইরফানের পাশ থেকে উঠে যায় । ওয়াসরুমে গিয়ে নিজেকে আয়নায় পর্যবেক্ষণ করে বেলী । শরীরের কিছু কিছু অংশে যেমন ঘাড়ে , হাতে লাল হয়ে আছে । হঠাৎ করেই বাম হাতের কব্জায় নজর দেয় বেলী । সেখানে পুরো ৪ টা আঙুলের ছাপ পড়ে আছে । লাল হয়ে আছে হাতের কব্জিটা । হাতটা দেখে অনায়াসেই হেসে দেয় বেলী । চোখের পানি গুলো টপ টপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে । চোখের এই পানি গুলো হয়তো বেলীর সমস্ত কষ্টের সমাপ্তির স্বাক্ষী হয়েছে আজ ।
ঝরনা ছেড়ে নিজেকে ধুয়ে নেয় বেলী । প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে শাওয়ার নেয় বেলী । ওযু করে একেবারেই বের হয়ে যায় বেলী । ইরফান তখনও ঘুমে কাতর । বেলী পশ্চিম-মুখী হয়ে জায়নামাজে দাঁড়ায় । ফজর নামাজ আদায় করে আজ কোরআন কালীম নিয়ে বসে । ইরফানের ঘুমের যাতে ক্ষতি না হয় তাই গুন গুন করে আস্তে আস্তে কোরআন কালীমের পুরো এক পারা এক বসায় শেষ করে মোনাজাত ধরে বেলী ।

– রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান্নার – হে মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বোত্তম কল্যাণ দান করো এবং আগুনের আযাব হতে আমাদের রক্ষা করো । আল্লাহ পাক তুমিই একমাত্র বুঝো আমার অন্তরে কি চলে । মানুষটাকে আমি ভালোবাসি অনেক ভালোবাসি । তাকে ছেড়ে যেতে পারব না । তার দূরত্বটা আমায় বার বার কষ্ট দেয় । আমি চাইনা আর এই দূরত্বটা বাড়ুক । আমি এটাও চাই না যে রুবি আপু কষ্ট পাক । কারণ আমি কারো অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে পারবো না । তাই তুমি এমন কিছু করো যাতে সেও কষ্ট না পায় । আল্লাহ পাক তুমি সবাইকে ভালো রাখো সাথে আমাকেও ভালো রাখো । আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই আল্লাহ ।

মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বেলী । ওড়নার ভাজ খুলে ভেজা চুল গুলো খুলে দেয় বেলী । চারদিকে ফর্সা হয়ে গেছে । আলো ফুটে গেছে । প্রকৃতি আবার আরেকটি নতুন সকাল উপহার দিল মানবজাতিকে । জানালার পাশে দাঁড়িয়ে উপরে আকাশে নজর দেয় বেলী । আজ বেলী বুঝেছে ভেজা চুলে কতটা ভালোবাসা জড়ানো থাকে ।

আজ ইরফানের অফিস আছে । নিজের হাতে সব নাস্তা বানিয়ে টেবিল সাজিয়ে দেয় বেলী । মিনু রান্নাঘরের বাকি কাজ গুলো করছে । ইরফান রুম থেকে বেলীকে ডাকতে থাকে ,

– বেলী ,,,,, এই বেলী,,,,,,?

ইরফানের ডাক শুনে বেলী হাতের কাজ ফেলেই রুমে দৌড়ে যায় বেলী ।

– জ্বি ,
– কই থাকো ?
– টেবিলে নাস্তা দিলাম ।
– এইদিকে আসো আমার সামনে ।

ইরফানের কথায় বেলী তার সামনে দাঁড়ায় । বেলীর নজর নিচের দিকে । ইরফান কিছুক্ষন বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপর কি যেন ভেবে বেলীর ওড়নার নিচে তার দু’হাত ঢুকিয়ে দেয় । আচমকা এইভাবে হাত দেয়ায় বেলী একটু ঘাবড়ে যায় । পরক্ষনেই বুঝতে পারে ইরফান তার গলায় কিছু একটা পরাচ্ছে । তখনই বেলী ওড়নার ভাজ খুলে দেয় । তারপর যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারে নি সে । তার গলায় ততক্ষণে একটা স্বর্নের চেইন উঠে গেছে । বেলী ইরফানের দিকে অবাক নয়নে তাকায় । তখন ইরফান বেলীর কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলে ,

– এটা আমার পক্ষ থেকে তোমাকে দেয়া প্রথম স্বর্ন ।
– এইসবের কি প্রয়োজন ছিল ?
– সব কিছুতে প্রয়োজন খুজতে নেই । কিছুটা ভালোবাসাও থাকে । বুঝলেন ম্যাডাম ,
– হু ,
– দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার । খেতে দেও , আমি অফিসে যাবো ।
– দেয়া আছে সব আপনি আসুন ।

সুখের মুহুর্ত গুলো কেন যেন খুব দ্রুতই পাড় হয়ে যায় । হয়তো দুঃখের সময় গুলোই পাড় হতে চায় না । এ যেন সুখ দুঃখের এক অসাধারণ মেলবন্ধন । বেলী যেন তার সুখ গুলোকে দু’হাতে কুড়িয়ে নিচ্ছে আর ইরফান যেন তার ভাগের সুখ গুলো বেলীর মাঝে বিলীন করে দিচ্ছে । এই সুখটুকু খুব করে পেতে চায় । যাতে পরে হারিয়ে গেলেও আর আফসোস না থেকে যায় ।

.
.

চলবে……………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here