###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
#পর্ব_৩৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
দেখতে দেখতে সুখে শান্তিতে কেটে যায় ৬ টা মাস । এর মাঝে প্রায় কয়েকবার বেলী অসুস্থ হয়ে গেছে । ইরফানের শান্তি বলতে এই ৬ মাসে সব গায়েব । মিনু একা হাতে অনেকটাই সামলে নিয়েছে সবটা । এই বাসায় একমাত্র মিনু-ই সেই ব্যাক্তি যার উপর ইরফান আর বেলী চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে । মিনু যদি তাদের বিষও দেয় তারা অনায়াসে বিষটাও খেয়ে নিতে রাজি । মিনু এতটাই বিশ্বস্ত তাদের কাছে ।
গ্রাম থেকে বেলীর মাকে আনা হয়েছে । বেলীর শরীর ভালো যাচ্ছে না ইদানীং । মিনুও পারে না আর তাই বেলীর মাকে আনানো হয়েছে ।
এখন বেলীর ৭ মাস প্রায় শেষ হতে চললো । শরীর আস্তে আস্তে ভারী হয়ে যাচ্ছে । বসলে আর তার উঠতে মন চায় না আর শুলে তো উঠতেই চায় না । আগের থেকে অনেকটা সুন্দর হয়ে গেছে বেলী । মেক্সি পরে এখন । ইরফান নিজে পছন্দ করে কাপড় কিনে এনে দেয় । বেলী কখনো দামী দামী কাপড়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না । তাই তার কথা অনুযায়ী ৬০ টাকা গজের কাপড়ই কিনে এনে দেয় ইরফান । আর মিনুকে দিয়ে নিচে মোড়ের মাথার দর্জির দোকার থেকে সেলাই করিয়ে আনে বেলী । বেলী এখন যা পড়ে তাই-ই ভালো লাগে বেলীকে । প্রায় সব রং-ই বেলীকে মানায় ।
ইরফানও বেশ সিন্সিয়ার হয়ে গেছে । এই ৭ মাসে কম করে না হলেও প্রায় ২৫ বার ডক্টরের কাছে নিয়ে গেছে বেলীকে । বেলীর প্রবলেম একটাই বেলীর রক্তের প্লাটিলেট অনেক কম । তাই ১৫ দিন কি ১ মাস পর পর বেলীকে বাসায় এসে সেলাইন পুষ করে দিয়ে যাওয়া হয় । এইসব কিছু ইরফান নিজেই দেখাশুনা করে ।
ইরফান মোটেও চায় না বেলীর একটুও অযত্ন হোক । সে বেলীকে কোন রকম অযত্ন করে না এবং অযত্নে রাখেও না । বেলীর জামা-কাপড় থেকে শুরু করে বেলীর মাথার চুল অবদি পরিপাটি দেখতে চায় সে ।
আর বেলী সে ইদানীং বড় বেশিই খুতখুতে হয়ে গেছে । অল্পতেই রেগে যায় , বিরক্ত হয় , আবার মাঝে মাঝে কাঁদে । তার মন এক এক সময় এক এক রকম থাকে । তাই ইরফান বেচারাও বেলীর কথায় হা/না করে । বেলীর সব কথা-ই ইরফান অনায়াসে শুনে নেয় । ইরফান অনেক এঞ্জয় করে এই সময়গুলোকে । কারণ সে বাবা হতে চলেছে ।
আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে ইরফান । বিকেলের দিকেই চলে এসেছে সে । বেলী তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল । ইরফানকে গেইটের ভেতরে ঢুকতে দেখে বেলীর বুকে মোচড় দিয়ে উঠে । ইরফান কলিংবেল দেয়ার আগেই বেলী গিয়ে দরজা খুলে দেয় । বেলীর এইভাবে দরজা খুলে দেয়া দেখে ইরফানও অনেকটা অবাক । ইরফান হাসি মুখে বেলীর গালে আলতো করে ছুয়ে দেয় , আর বলে
– আজকে একেবারে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছো যে ?
– তুমি এখন এই সময়ে বাসায় ?
– চলে আসলাম ।
– শরীর ভালো তো ?
– আলহামদুলিল্লাহ ।
ইরফান ভেতরে গেলে বেলী দরজা লাগিয়ে দেয় । ইরফান বদলে গেছে । শুধু বদলে যায় নি অনেকটাই বদলে গেছে । নামাজ পড়ে ৫ ওয়াক্ত । ১ ওয়াক্ত নামাজ সে কাযা করে না । অফিসেও নামাজ আদায় করে নেয় । ইরফান রুমে ঢুকতে ঢুকতে বেলীকে জিজ্ঞেস করতে থাকে ,
– মা কি করে ?
– শুয়ে আছে ,
– আর মিনু ?
– মিনুও মায়ের সাথে আছে ।
– মায়ের সাথে মিনুর ভালো জমেছে ,
– হ্যাঁ অনেকটা ।
ভেতরে গিয়ে ফ্যান ছেড়ে বসে ইরফান । এইখানেও বেলীর সমস্যা ।
– ফ্যান ছাড়লা কেন ?
– বাহিরে থেকে আসছি , একটু হাওয়া লাগুক গায়ে ।
বেলী বিরক্তিকর চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকে । ইরফান বুঝে যায় বেলীর বাতাসে সমস্যা হচ্ছে । তাই নিজ থেকেই ফ্যান অফ করে দেয় ।
রাতে খাবার খেয়ে বেলী রুমেই হাটাহাটি করছে আর ইরফান বিছানায় বসে লেপটপে কাজ করছিল । বেলী রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা অবিদি এইভাবেই হাটাহাটি করতে থাকে । আর তার কিছুক্ষন পর বিছানায় এসে ইরফানের পাশে বসে সে । ইরফানের কাঁধে হাত দিয়ে ইরফানকে ডাকতে থাকে সে ,
– শুনছো ,,,,,?
– হু বলো ,
– দেখো না পা গুলা কেমন ফুলে গেছে ।
বেলীর পায়ের দিকে তাকায় ইরফান । আসলেই পা গুলা ফুলে গেছে বেলীর । ডক্টর গতবার বলেছিলেন হাতে পায়ে পানি নামবে । হয়তো তাই ফুলে গেছে । ইরফান লেপটপ অফ করে দেয় । দিয়ে বেলীর দিকে ফিরে ।
– এটা কিছু না , স্বাভাবিক ব্যাপার । ভয় পেও না ।
– পায়ের কামড়ানি কাকে বলে ,
– ব্যাথা বেশি করছে ?
– হু ,
– টিপে দেই ?
– আরে নাহ , লাগবে না ।
ইরফান বেলীর কথা আমলে না নিয়ে বেলীকে শুইয়ে দেয় আর বেলীর পাগুলো টিপতে থাকে ।
– আমার জন্যে যে মানুষটা এত করতে পারে তার এই সময়ে তার সেবা না করলে আমি তো কাফের থেকেও খারাপ হয়ে যাবো বেলী । তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো ।
ইরফানের কথায় বেলী শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে । ইরফান যে এত বদলে যাবে সে ভাবে নি । একজন আদর্শ মানুষ এবং একজন আদর্শ স্বামী হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ইরফান । হয়তো এমনি করে একদিন নিজেকে আদর্শ বাবা হিসেবে গড়ে তুলবে । হালকা মুচকি হাসি দিয়ে বেলী চোখে ঘুম নামায় । আর ইরফান বেলীর ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বেলীর পা গুলো টিপতে থাকে ।
আল্লাহ পাকের এক অদ্ভুত লিলা চলে এই ধরায় । সেই লিলা চলে মনুষ্য জীবনে । মনুষ্য এক জীবনে সব পায় না । আবার অনেকে এক জীবনে সব পাওয়াগুলো না চাইতেই পেয়ে যায় । বেলীও ঠিক তেমন এক মনুষ্য যে এক জীবনে বহুত কিছু হারিয়েছে । হারিয়েছে তার বাবাকে , হারিয়েছে এক সহজ সরল মানুষের ভালোবাসা । এক বুক স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর ঘরে এসেছিল সে । সেখানে পাওয়া হয়নি স্বামীর ভালোবাসা । একদিন হুট করেই আল্লাহ পাক কেন জানি তার ঝোলা পরিপূর্ণ করতে থাকে । তারপর তার গর্ভে আসে এক নতুন প্রাণ । আল্লাহ পাক তার সব টুকু নেয়ামত এক সাথে বেলীর ভাগ্যে ঢেলে দিয়েছেন । এ হয়তো বেলীর পাওনা ছিল । এভাবেই হয়তো আল্লাহ পাকের নেয়ামত আদায় করে নিতে হয় উপরওয়ালার কাছ থেকে ।
আজ ৯ মাসে পড়েছে বেলীর প্রেগন্যান্সির । এই মাসের লাস্টের দিকে ডেট পড়েছে । শরীরের কন্ডিশন ততটা ভালো না বেলীর । নরমাল সম্ভব না তাই সিজারিয়ান করাতে হবে । বেলী যথেষ্ট শক্ত আছে , ভয় পাচ্ছে ইরফান । কারণ বেলীর শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো নেই । গতকাল কোরআন খতম করেছে বেলী । ইরফান মসজিদে মিলাদ দিয়েছে । যে নারী সন্তানসম্ভবা অবস্থায় কোরআন খতম করে তার সন্তান একজন নেককার মানুষ হোন । হয়তো বেলীও এমনটাই চায় ।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বেলী । হঠাৎ করেই পুরনো সব কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায় তার । আজ ইরফানকে বেলীফুল আনতে বলেছে বেলী । ইরফান বার বার করে জিজ্ঞেস করার পরেও বেলী কিছু বলেনি । আজ রাতে সে সাজবে । বন্ধ ঘরে ইরফানের সামনে আজ আবার সাজবে সে । সেই সাদা শাড়িটা পরে খোঁপায় বেলীফুলের মালা পরবে সে । অবশ্য এর কারণ আছে । সেদিন রাতে একবার ইরফান বলেছিল ,
” বেলী , আবার সেই সাদা শাড়িটা পরবা ? শাড়িটায় অনেক সুন্দর লাগে তোমায় ”
তাই ভাবছে আজ একবার পরবে তবে এক পেচ বাঙালি ভাবেই পরবে । তাই বেলীফুল আনতে বলা ইরফানকে ।
ইরফান বেলীফুলের মালাটা এনে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে । রাতে খাবারের পর ইরফানকে প্রায় ৩০ মিনিট রুমের বাহিরে দাড় করিয়ে রেখেছে বেলী । ইরফান প্রায় বিরক্ত হয়ে গেছে। এইভাবে এতক্ষন ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে থাকা যায় নাকি ? তারপর দরজায় নক করে সে ,
– বেলী , এই বেলী ,
– হুউউউউ
– তোর হু আমি বের করবো , দরজা খোল ফাযিল ,
– হি হি হি ,
– বেলী শরীর খারাপ তোমার আর তুমি দরজা আটকে রাখছো । এইগুলা কি ফাইযলামি বেলী ।
– এক মিনিট ,
– এক সেকেন্ডও না , দরজা খুলো ।
তার কিছুক্ষণ পর বেলী দরজা খুলে ইরফানের সামনে দাঁড়ায় । ইরফান আর দরজার ভেতরে ঢুকতে পারেনি । সে সেখানেই ফিট হয়ে যায় বেলীকে দেখে । এ যেন এক সাদা অপ্সরা তার ঘরে । একেবারে বাঙালি নারী বেলী । মাথায় খোঁপা করে বেলীফুলের মালাটা গুজে দিয়েছে । চোখে কাজল , ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক । এক পেচ করে শাড়ি পরে ভরা পেটে দাঁড়িয়ে আছে বেলী । ইরফান যেন ঘোরের মাঝে চলে গেছে বেলীকে দেখে । হঠাৎ করেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় ,
” বেলীফুল ”
বেলী মুচকি হেসে ইরফানের হাত ধরে তাকে রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় । তারপর দরজাটা লাগিয়ে দেয় সে । ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে এক পলকে । এরই মাঝে বেলী ইরফানকে বলে উঠে ,
– কেমন লাগছে ?
-……………..
– এই , কি দেখো এইভাবে ,
– অসাধারণ , মাশা-আল্লাহ । আমার বউ একেবারেই সাদা পরী লাগছে ।
– এইবার গান শুনাও ।
বেলীর এমন অদ্ভুত আবদারে অবাক ইরফান । বার বার না করছে সে , সে তো গান পারে না , কি গান গাইবে । বেলী আরও জেদ করে ,
– তুমি গাইবে না ?
– আমি পারি না তো ,
– না পারলেও গাও , আমি শুনবো
প্রায় কয়েকবার না না করা হয়ে গেছে ইরফানের । কিন্তু বেলী শুনছেই না । তারপর ইরফান চাপা গলায় গান শুরু করে । সাদা শাড়িতে বেলীকে অত্যন্ত সুন্দর লাগছিল । অনেকটা দেবীর মত । বেলীকে দেখে ইরফান সেই দারুণ গানটা তার গলায় ধরে ,
” এই রাস্তা গুলো লাগে বড় অচেনা
আকাশটার সাথে নেই জানা শোনা
আমি তোর প্রেমেতে অন্ধ
ছিল চোখ কান সব বন্ধ
থেমে গেছে জীবনের লেনাদানা
সেই পুরনো রাস্তাটায় আজ একা হেটে যাই
হচ্ছে না হিসাবের বনিবনা
এখন এমনি করে ভালো কেমনি করে বাসি
অন্য কোন পাখিকে
তার চেয়ে ভালো ছিল তুই নিজ হাতে খুন করে
যেতি
আমাকে……………….”
মুগ্ধ নয়নে এক হাতে ইরফানের কাঁধ ধরে অন্য হাতে নিজের ভারী পেটে হাত দিয়ে চাঁদের আলো উপভোগ করে বেলী । আজ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে । এই নিঃশ্বাসে আছে শুধুই শান্তি । বেলীর কোমড় আঁকড়ে ধরে আপন মনে গান গাইছে ইরফান । এ যেম এক অসাধারণ মুহুর্ত । এ যেন এক ভালোবাসার মুহুর্ত । এ যেন এক স্পর্শকাতর অনুভূতি যা মনকে অনায়াসেই ছুয়ে যায় ।
.
.
চলবে…………………………