#ফাল্গুনের_ঢেউ
পর্ব – ৯ #সফর
লেখিকা – Zaira Insaan
পড়ার টেবিলে বসে জানালার ফাঁকে বৃষ্টির খেলা দেখছে মিহি। টেবিলে এক গাদা বই কিন্তু একটাও পড়ছে না ও। বৃষ্টির ছাঁটা আসছে জানালার ফাঁকে। অতি গম্ভীর মুখে কোন এক গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বৃষ্টির খেলা দেখছে। ইলেকট্রিসিটি নেই পুরো ঘরে। টেবিলের ডান পাশে রাখা ছোট টেবিল লাইট ব্যাটারির মাধ্যমে নিভু নিভু জ্বলছে। মিহি বিরক্ত হয়ে এক ঝটকায় হাত দিয়ে বন্ধ করে দিল সেই লাইটটি। পুরো রুম এখন গাঢ় অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বলে রুম কিছুটা সাদা আলো হয়ে আবার অন্ধকার হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকানো দীর্ঘস্থায়ী নয়। কপাল কুঁচকে মিহি ভাবতে লাগল আজ সকালের ঘটনা,,
ভিড় ঠেলে একজনের পাশে দাঁড়িয়েছিল মিহি। সেখানে এক ছেলে সিনিয়র দের কাছে রেগিং এ শিকার হয়েছিল। মিহি ওদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সুবন্ত নামের এক সিনিয়র আপু ওকেও রেগ করছিল। কিন্তু স্নিগ্ধ আসাতেই চুপসে গেল সবাই। বন্ধ হয়ে গেল রেগিং। তার এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিই যথেষ্ট সবকিছু থামানোর জন্য। এক এক করে সবাই কে ঝাড়া মারলো স্নিগ্ধ।
পা দুলিয়ে পুরোনো সব ঘটনা মনে পড়তেই মুখোমন্ডল কেমন যেন হয়ে গেল মিহির। স্নিগ্ধ কেন বারবার তার আশেপাশে থাকে? সে তো সবসময় স্নিগ্ধ কে স্যার হিসেবেই দেখে, তবে!? এর আগেও অনেকেই রেগিং এ শিকার হয়েছিল, তবে মিহির বেলায় কেন স্নিগ্ধ এগিয়ে এলো? অনেক প্রশ্নেই মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। যার উত্তর তার জানা নেই । সবকিছু কেমনটা যেন এলোমেলো। চোখ বুজে মাথায় আস্তে করে হেলিয়ে দিল চেয়ারে। আর কোন কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না তার। পরিশ্রান্ত সে। দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করল মিলি। হাতে আচারের বোয়োম। মিহির পাশে দাঁড়িয়ে আঙুল চেটে চেটে বলে,,
“আচার খাবি?”
“না।”
“নে নে শরম পেতে হবে না। আমি জানি তোর খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছিস না।”
বোয়োম সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল মিলি। মিহি চোখ খুলে কড়া নজরে তাকালো। মিলি বললো,,
“এই জন্যেই তো মানুষ বলে, কারোর ভালা করতে নেই! তবুও আমি বলবো, নে খা।”
মিহি মাথা উঠিয়ে শানিত কন্ঠে বলে,,
“যা এখান থেকে নাহলে এই বৃষ্টিতে বাহিরে রেখে আসবো তোকে, তারপর খাইস তোর আচার।”
থতমত খেল মিলি। যেতে যেতে বলল,,
“যাচ্ছি যাচ্ছি, এমন করে রাগিস ক্যান ভাই!”
বলে যাওয়ার সময় দরজা বন্ধ করে চলে গেল মিলি। মাথাব্যাথা করছে মিহির। চেয়ার সরিয়ে উঠে বেডে শুয়ে পড়লো ও। আজ রাতের খাবার খাবে না প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে।
_____________
সকালে তাড়াতাড়ি ভার্সিটি চলে গেল মিহি। ক্লাস রুমে যাওয়ার পথে সেই সিনিয়র ভাই আপুদের চক্ষু নজরে পড়লো ও। তারা দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে একে দেখে। মিহি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল নিজ পথে। ক্লাস চলাকালীন সময়ে নোটিশ আসলো ক্লাসরুমে। স্যার এসে নোটিশ টা খুলল। শিক্ষাসফর নিয়ে নোটিশ। তনু উৎসুক হয়ে গেল বলল,,
“যাক এতদিনে শহর থেকে হলেও বের হবো।”
“হু”
তনু ওর দিকে নজর দিল এক পলক। বলল,,
“কি ভাই এতো মরা হয়ে আছিস কেন?”
“মাইগ্ৰেন পেইনে ভুগছি।”
তনু ওর মাথায় হাত রাখল বলল,,
“কথা বল ওইদিকে মনোযোগ দিস না, তাহলে পেইন কমবে।”
হঠাৎই ইসকাত স্যার বলে উঠলো,,
“আমাদের ভার্সিটির থেকে শিক্ষসফরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যারা যারা যেতে চাও তারা নাম লিখিয়ে নাও।”
এ শুনে অনেকেই উঠে দাঁড়ালো তারপর নাম লিখিয়ে নিয়ে ফিরে আসলো। তনু মিহির হাত ধরে বলল,,
“চল নাম লিখিয়ে আসি।”
“ধূর আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, তোরা যা কক্সবাজার।”
“এখন এই মাথা ব্যাথার জন্য কোনো কিছু ভাল্লাগছেনা তোর, পরে পস্তাবি রে তুই! আয় না প্লিজ।”
হাত টানাটানি করতেই মিহি নিজেকে শান্ত রেখে বলল,,
“আমার যেতে ইচ্ছে করছে না যে তোরা যা না, প্লিজ আমারে জোর করিস না, হাত ছাড়।”
“ধূর মাইয়া! কি বিরক্তিকর নিরামিষ মানুষ রে।”
তনু হাত ছেড়ে আরো কিছুক্ষণ শায়েস্তা করে চলে গেল নিজের নাম লিখতে। মিহি বসে নিজের কপাল দু আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে ঘষতে লাগল।
_____________
লাইব্রেরীতে এসে রসায়ন বিজ্ঞানের দ্বিতীয় পত্র খুজতে লাগলো মিহি। চোখ জ্বালা করছে তার!
কোন কিছু মনোযোগ দিয়ে খোঁজে পাচ্ছে না। বিরক্ত সূচক শব্দ করে অন্য পাশে গেল। সামনের মানুষটি দেখে চোখ সরল হয়ে গেল ওর। স্নিগ্ধ টুলের উপর দাঁড়িয়ে কোন একটা বই খুঁজছে। গাঢ় নীল রঙের কনুই অব্দি চেক শার্ট। বলিষ্ঠ দেহে চেক শার্টটি বেশ মানাচ্ছে। মুখে কালো মাস্ক। তাও তাকে চিনে ফেলল মিহি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর বই খোঁজার দিকে। স্নিগ্ধ একটু ঝুঁকে বই খুঁজতে নিলে চোখ পড়লো মিহি তে। ওর এমন প্রগাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুটি করে মুখ থেকে মাস্ক নামালো। ধ্যান ভাঙল মিহির। চোখেমুখে রক্তিম আভা ছেয়ে গেল। ওমন করে তাকানোর কি আছে? তাও কাকে!
নিজেকে নিজে এক দফা গালি ছুঁড়ে মারলো। স্নিগ্ধ টুল থেকে নীচে নামলো মিহির দিকে এগিয়ে এসে বলল,,
“শিক্ষাসফরের জন্য নাম লিখাও নি কেন?”
পিলক চমকালো মিহি। স্নিগ্ধ তাহলে লিস্ট দেখেছিল! অধরে কিঞ্চিৎ দূরত্ব হলো। নিজেকে ঠিক করে গুছিয়ে নিয়ে বলল,,
“আমি সেই দিনে খালার বাসায় যাব তো তাই শিক্ষাসফরে যেতে পারবো না।”
চোখ কুঁচকে নিল স্নিগ্ধ। খালার বাসায় যাবে বলে সে শিক্ষাসফরে যেতে পারছে না! কি অদ্ভুত কথা!
সন্দেহ নাগাড়ে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধ। মিহি বুঝতে পেরে বলল,,
“আমি আসি স্যার।”
বলে যেতে নিলে স্নিগ্ধ থামালো ওকে। বলল,,
“সবার সাথে মিথ্যা বলতে পারো বলে এই না যে তুমি আমার সাথেও মিথ্যা কথা বলবে।”
থম মারলো মিহি। কি যে লজ্জাজনক অবস্থা। ইশশ! মিথ্যা বলে ধরে পড়ে যাওয়ার মত লজ্জা বোধহয় আর কিছু না। বড্ড লজ্জা পাচ্ছে মিহি, বড্ড লজ্জা পাচ্ছে! সময় নিয়ে পেছনে ফিরলো। কিন্তু ভুলেও স্নিগ্ধের দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালে বোধহয় লজ্জায় রঙিত হবে। মাথা নীচু করেই রাখলো। স্নিগ্ধ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মিহি ভাবলো,,
এভাবে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে ওকে বিব্রত অবস্থায় ফেলছে কেন!” স্নিগ্ধ শেলফে তৃতীয় স্থানে হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকলো। মিহি বিস্মিত হয়ে তিন চার কদম পিছিয়ে গেল। স্নিগ্ধ তাকে আশ্বাস দিতে নিচ থেকে এক বই নিল। বলল,,
“লিস্টে তোমার নাম লিখে দিয়েছি আমি।”
ভারী অবাক হলো মিহি। হা হয়ে ফট করে তাকালো স্নিগ্ধের দিকে। স্নিগ্ধ ভ্রু কুটি করে তাকাতেই মিহি মুখোভাব চটজলদি ঠিক করে আমতা আমতা করে বলল,,
“কেন স্যার?”
“আমি চাই তুমি শিক্ষাসফর থেকে নতুন কিছু শিখো।”
বিচিত্র আকার ধারন করলো মুখোমন্ডল মিহির। বাহিরে প্রকাশ করলো এটা। ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,,
“কিন্তু স্যার আমি….।”
স্নিগ্ধ ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকাতেই বাকি কথাগুলো বলার সময় ঢোক করে গিলে ফেলল মিহি। মেকি হাসলো। স্নিগ্ধ ‘গুড’ বলে ওর পাশ কেটে চলে গেল।
_____________
মা বাবা কে জানিয়ে আস্তে আস্তে কাপড় গোছাতে লাগল মিহি। রুগল সাহেব ও প্রণিমা কখনো মানা করে না মিহি কে কোথাও যেতে। শুধু মিহি আলসেমির কারণে বিরক্ত হয়ে যেতে চাই না। এবার তো ডায়রেক্ট তার স্নিগ্ধ স্যারেই লিস্টে নাম লিখে দিয়েছে তার। যাওয়ার ছাড়া আর উপায় নেই। তনু পাশে বসে ওর কাপড় গোছানো দেখছে। যেন এক দর্শক। মিহি বিরক্তিতে ফ্যান ফ্যান করছে। তনু এক পর্যায়ে বলে,,
“এতো চেচাচ্ছোস ক্যান ভাই! মাথা ধরিয়ে দিবি নাকি?”
একটা কাপড় ছুড়ে বিছানায় ফেলে বলল,,
“ধূর কিছুই ভাল্লাগছেনা আমার, ফালতু!”
“আরে ওখানে গেলে মজা হবে, প্রচুর মজা করবো আমরা।”
আড়চোখে তাকালো মিহি। বলল,,
“কচু পাতা হবে! কোথাও গেলে আমার ঘুম আসে তাই যেতে ইচ্ছা করে না।”
গাল নাক এক সাইড কুঁচকালো তনু। বলে,,
“সারাদিন ঘুম ঘুম করলে ঘুম তো আসবেই, আরে ভাই ঘুম ছাড়া দুনিয়াতে আরো বহুত কিছু আছে।
মিহি শুনেও আর কিছু বলল না। নিশ্চুপ হয়ে কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরতে লাগল। হঠাৎ মোবাইলে কল ঢুকলো মিহির। কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটি দেখে ভারী চমকালো ও।
(চলবে…)
[ গল্পটা কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখব। সামনে পরীক্ষা। প্রেশারে আছি, গল্পে কোনমতে মনোযোগ বসছে না। তাই সময় নিচ্ছি কিছুদিনের জন্য ]