#ফাল্গুনের_ঢেউ
পর্ব – ১৯ #আপনাকে_পছন্দ_না
লেখিকা – Zaira Insaan
থমকে দাঁড়ায় মিহি। রেলিং শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। পেছন থেকে স্নিগ্ধের এমন ফিসফিস করে বলা কথাগুলো তাকে হতভম্ব করেছে। চোখ জোড়া বড়সড় হয়ে গেল। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পূর্বের শোনা বাক্য মাথায় বারি খাচ্ছে। স্নিগ্ধ এখনো স্থান পরিবর্তন করেনি। মিহির বা কাঁধের কাছে ঝুঁকে রইল। তার তপ্ত নিঃশ্বাস গুলো কাঁধে পড়তেই প্রতিনিয়ত কেঁপে কেঁপে উঠছে ও। কিছুক্ষণ এভাবে যেতেই মিহি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,
“স..সরুন।”
স্নিগ্ধের হুঁশ ফিরতেই দ্রুত সরে যায়। লম্বা দূরত্ব টেনে নেয় নিজেদের মাঝে। মিহি আগের মত কাঁধের কাছে চুল এনে দিল। আস্তে আস্তে ফিরে স্নিগ্ধের দিকে উপুড় চোখে তাকিয়ে দেখে স্নিগ্ধ বুকে দুহাত গুজে দেওয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ওড়নার শেষ অংশ আঙুল দিয়ে মুচড়াতে লাগল মিহি। বুক দ্রিমদ্রিম শব্দ করে তোলপাড় চলছে। স্নিগ্ধ আচরণ ও কথার ধরণ শুনে আঁচ করে ফেলল যে শুভয়কে কে মারলো! স্নিগ্ধ স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,,
“সামনে ক্লাস এক্সাম আছে দ্রুত সুস্থ হতে হবে তোমার।”
মিহি প্রতিত্তর দিল না। দিবে কীভাবে স্নিগ্ধ যেভাবে অবাক করেছে সে কারণে তার মুখ থেকে সাধারণ কথাটুকুও বের হচ্ছে না । স্নিগ্ধের নজরে থাকতেও বিরক্ত, অস্থির লাগছে মিহির। চিন্তা করছে কীভাবে তাকে এখন দূর করা যায়। দৌড়াদৌড়ি করে রুমে ঢুকল মিলি। বারান্দায় এসে স্নিগ্ধের পাশে দাঁড়িয়ে ডেকে বলে,,
“ভাইয়া, মা আপনার জন্য পায়েস বানিয়েছে। পায়েস পছন্দ না আপনার?”
স্নিগ্ধ আগের ঘটনা গুলো ভুলে মিষ্টি ভাব নিয়ে বলে,,
“পছন্দ, অনেক পছন্দ।”
“তো নিচে চলেন তাড়াতাড়ি।”
স্নিগ্ধ হালকা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলে,,
“তুমি যাও আমি আসছি।”
মিলি মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। স্নিগ্ধ পকেটে হাত ঢুকিয়ে মিহির একটু কাছে আসলো, ঠান্ডা গলায় নিম্নকন্ঠে বলল,,
“দ্রুত সুস্থ হয়ে ভার্সিটি আসো। সবাই সহ ‘সে’ অধীর অপেক্ষায় আছে। ভালো থেকো।”
শেষ কথাটুকু বলে মিহি কে ভালোভাবে দেখে নিয়ে চলে যায়। মিহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কাঠ কাঠ গলায় নিজে নিজে বলে,,
“কেন যেন মনে হচ্ছে, আমার সুস্থতা আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।”
___________
চার পাঁচ দিন কেটে গেল। মিহি কে দেখতে শুধু তনু ও বন্নি আসলো এই মাঝ দিনে। নীলয় রাজশাহী গিয়েছে বাবার ব্যবসায়িক কাজে। রুগল সাহেব চার পাঁচ দিনে আসার কথা থাকলেও কোর্ট বিল্ডিং এ জমিনের কাজে আরো দীর্ঘদিনের সময় নিলেন। চাইলেও আসতে পারবেন না তিনি। স্নিগ্ধ সেই দিনের পর থেকে আর আসলো না। মিহির মা’র কাছ থেকে ফোন করে শুধু মিহির খবরটা জেনে নিল। আজ শুক্রবার সবাই ব্যস্ত যে যার কাজে। কাঁধ ও কনুইয়ের ব্যাথা অনেকটা কমে গেল। গতকাল সকালে গিয়ে বড় করে দেওয়া ব্যান্ডাজ টা খুলে আসলো। মিহি আর এখানে বসে থাকতে না পেরে নীচে নামলো। রান্নাঘরে গিয়ে চেয়ারে বসে প্রণিমা কে বলল,,
“একটু পর বের হব আমি।”
“কোথাও যেতে হবে না তোর। চুপচাপ রুমে গিয়ে শুয়ে থাকবি।”
ধমকে বলেন প্রণিমা। মিহি হয়রানি সুরে বলে,,
“শুয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত আমি। তার উপর আমার প্রত্যেক স্টুডেন্ট এর পরীক্ষা সামনে। ওদের পড়া এগিয়ে আনতে হবে। তাই আমি ওদের ও ওদের পড়ালেখা নিয়ে হেলা করতে চাচ্ছি না। এমনিতেই আমি অনেকটা সুস্থ হয়েছি, সো অত টেনশন নিতে হবে না তোমার।”
“টিউশনি করতে হবে না তোর, ছেড়ে দে। সামনে তো তোর ও পরীক্ষা।”
মায়ের কথাই অবাক হয়ে তাকালো মিহি। বলল,,
“টিউশনি ছাড়তে পারব না আমি। ওই পেশাতেই আমি আনন্দ খুঁজে পাই। আর পরীক্ষা প্রস্তুতি নেওয়া আছে আমার। তো সব মিলিয়ে এক ঘন্টার পর বের হব।”
মেয়ের এমন গাঢ় জিদে কিছু বলতে পারলেন না প্রণিমা। সেই নবম শ্রেণী থেকে শুরু করে এখনো অব্দি টিউশনি করে আসছে ও। এতো সহজে কী ছেড়ে দেওয়া যায়? মিহি পা গুটিয়ে বসলো, প্রণিমা বলে,,
“তাহলে স্নিগ্ধ কে বলে যাহ্।”
মিহি চমকে উঠে রেগে গিয়ে বলে,,
“উনাকে বলব কীসের জন্য? কোন দরকার নেই উনাকে খবর দেওয়ার।”
প্রণিমা ভ্রু কুঁচকে বলেন,,
“তুই এভাবে চিল্লাচ্ছিস কীসের জন্য? ও তোর যে কেয়ার করে, আমি তো সেরকম বর খুঁজছি তোর জন্য।”
পিলক চমকে হকচকিয়ে যায় মিহি। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,,
“উল্টাপাল্টা কথা বলছো কেন? উনি আমার স্যার হোন।”
“যেই হোক না কেন, পার্মানেন্ট তো না। আর ও তো মাত্র কিছুদিন…..।”
মিহি প্রণিমা কে থামিয়ে বলে,,
“আমি গোসল করতে যাচ্ছি। এরপর বের হবো।”
বলে প্রণিমা’র বাকি কথা না শুনেই চলে গেল মিহি।
___________
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আসলো। মিহি নিজের ব্যস্তার ফন্দি কেটে নিজ বাসার দিকে যেতে লাগল। সকালের তার মায়ের কথাগুলো কানে বাজতে লাগল। বিরক্ত লাগছে সবকিছু। যতক্ষণ ব্যস্ত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সেইসব কথাগুলো মাথায় আসে না, যখন একটু ফ্রি হয়ে রিল্যাক্স এর প্রয়োজন হয় তখনি, ঠিক তখনি পুরনো ঘটনা গুলো এক এক করে মস্তিষ্ক বিচরণ করতে থাকে।
মায়ের প্রয়োজনীয় ওষুধ পত্র কিনে গাড়ি ড্রাইভ করছিল স্নিগ্ধ। রাস্তায় মিহি কে চোখে পড়ে তার। ভ্রু কুঁচকালো রীতিমত। অসুস্থ শরীর নিয়ে বাইরে ঘুরছে কেন! গাড়ি ঠিক একদম মিহির পাশে এনে থামালো। মিহি ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। চিনতে পেরে বিরক্ত হয় ও। স্নিগ্ধ গ্লাস নামিয়ে রাশভারী গম্ভীর গলায় বলে,,
“গাড়িতে এসে বসো।”
বলে ওপাশ থেকে দরজা খুলে দিল। মিহি বলল,,
“লাগবে না। আমি যেতে পারব।”
“বলছি এসে বসো।”
ঝাঁঝালো কন্ঠ শাসানো সুরে ভয়ে লাফ দিয়ে উঠলো মিহি। চটজলদি ভেতরে এসে বসল। স্নিগ্ধ একই প্রসঙ্গে বলল,,
“বারন করার পরেও কেন শুনো না। নিষেধ করলাম না? এই অবস্থায় না বেরুতে। আর বের হলেও আমাকে ইনফর্ম করতে?”
মিহি প্রতিত্তর দিল না। বিরক্ত লাগছে গা ঘৃণ ঘৃণ করছে। স্নিগ্ধ ওর মাঝে কোন প্রতিফলন না দেখে চুপ করে গেল। মেয়েটাকে হাজার বললেও শুনবে না। বুঝলো। ড্রাইভ করতে লাগল এর মধ্যে বলে,,
“লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, নেক্সট টাইম থেকে এমন করলে তোমার কপালে সর্বনাশ আছে!”
মিহি আঁতকে উঠলো মিনমিন গলায় বলল,,
“আর হবে না এমন।”
“গুড”
মিহি কেন জানি অতিরিক্ত বিরক্ত হচ্ছে তার সাথে থাকতে। এক পর্যায়ে চরম বিরক্ত, ঘৃণায় নিম্নকন্ঠে বলে ফেলল,,
“আপনাকে পছন্দ না আমার!”
হালকা মৃদু স্বরে বললেও কর্ণধারে পৌঁছালো স্নিগ্ধের। থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। একপলক তাকালো মিহির দিকে। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেল। কোনমতে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে মিহি কে ঘরের সামনে এনে দিল। মিহি স্নিগ্ধের দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখে। স্নিগ্ধ শুধু চেয়ে আছে সামনের দিকে। গাড়ি থেকে বেরুনোর আগে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে গেল মিহি।
(চলবে…)