সে এক মনগড়া প্রেমকাব্য পর্ব -১২ ও শেষ

#সে_এক_মনগড়া_প্রেমকাব্য
১২তম_পর্ব
~মিহি

সবাই চাইলেও সবকিছু পায় না। হয়তো আকাশসম প্রত্যাশা থাকলেও স্রষ্টা আমাদের সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করেন না কেননা তিনি জানেন আমাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট কোনটা। রূপম মীরাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে। সে আর নিজের জীবনে মীরার উপস্থিতি চায় না। মীরা থাকুক নিজের জগতে খুশি, রূপম না-হয় অপূর্ণতাতেই ভালো থাকবে কিন্তু আদৌ কি ভালো থাকবে? নাকি ভালো থাকার চেষ্টা করবে?

ধ্রুবকে দিয়ে বেশ চুপিসারেই পাসপোর্টটা আনিয়েছে রূপম। তনয় না পারছে রূপমকে মানা করতে আর না কাউকে জানাতে। ধ্রুবর তো পাগলপ্রায় অবস্থা। রূপমকে আটকানোর জন্য সে পা পর্যন্ত ধরতে প্রস্তুত কিন্তু রূপম কারো কোনো কথাকেই কানে নিচ্ছে না উল্টো বলে রেখেছে যে তাকে আটকাবে, সে যেন রূপমের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে।

অভি বারবার কল করে চলেছে। বিরক্ত হয়ে রিসিভ করলাম।

– “তুমি আমায় ইগনোর করছো মীরা?”

– “আমার-আপনার সম্পর্ক কী যে আপনাকে ইগনোর করবো?”

– “সম্পর্কটা তৈরি করার সুযোগটাই তো দিচ্ছ না তুমি। আমি তো চাই একটা সুযোগ তোমায় আমৃত্যু ভালো রাখার।”

– “দেখুন, আমার একটু সময় দরকার। আমি এখনি কিছু বলতে পারবো না।”

– “আমি তোমায় জোর করছি না মীরা কিন্তু তোমায় একটু একটু করে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি আমি। এখন একটা মুহূর্ত কাটানো মুশকিল আমায় তুমি ব্যতীত। দয়া করো একটু আমার উপর। তোমার নেওয়া সময় আমায় যন্ত্রণা দিচ্ছে মীরা। ভেতর থেকে পুরোপুরি দুর্বল করে তুলছে আমায়। আমার ভালো থাকার কারণটা কি হবে তুমি? প্লিজ?

– “আপনার পাগলামি বন্ধ করুন প্লিজ। আমার পক্ষে শ্রাবণকে ভোলা সম্ভব না। প্রথম ভালোবাসা কখনোই ভোলা যায় না, হোক সে প্রতারক। আপনি যা করছেন তা নিতান্তই পাগলামি। আপনার প্রতি আমার দুর্বলতা আছে তবে তা আমি আপনাকে দেখাতে ইচ্ছুক নয়। কল রাখুন।”

– “তুমি যদি রাজি না হও, আমি কিন্তু আত্মহত্যা করবো মীরা।”

– “আপনি কি ফাজলামি করছেন আমার সাথে? আত্মহত্যা করবেন মানে কী? দুদিন হলো আপনার জীবনে এসেছি আর তাতেই এসব পাগলামি? মরেই যদি যাবেন, তাহলে ভালোবাসলেন আর কোথায়? ভালোবাসলে বাঁচতে হয়, বুঝেছেন?”

– “তোমায় ছাড়া আমি কিছু বুঝবো না। একঘণ্টা সময় দিচ্ছি তোমায়, এর মধ্যে তুমি রাজি না হলে আমি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে দেহত্যাগ করবো।”

– “আজব তো! আপনি কি পাগল?”

– “তোমার প্রেমে পাগল। আর তোমায় না পেলে মৃত!”

খট করে কলটা কেটে দিল অভি। আমার মাথা ঘুরছে। এখানে আসার পর থেকে এমন একটা দিন এলো না আমার জীবনে যেদিন আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি। প্রতিমুহূর্তে একেকটা ঝটকা! কখন কী যে হচ্ছে সবটাই আমার ভাবনাতীত।

ঘরের লাইট চালু-বন্ধ হচ্ছে। ভোল্টেজের সমস্যা, লাইটের সমস্যা নাকি আমার জীবনটাই সমস্যা বুঝে উঠতে পারছি না। খুব সম্ভবত সমস্যাটা আমার ভাগ্য! বারবার আমার ভাগ্য আমায় এমন পরিস্থিতিতে ফেলে যে আমি নিয়তির কাছে বারবার হেরে যায় আর শুধু আমাকে হারিয়েই তিনি ক্ষান্ত হন না! সাথে নিয়ে নেন জীবনের বিশেষ মূল্যবান কিছু।

রূপম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। সে কি সত্যিই চলে যাবে? পাসপোর্ট, টিকেট, যা যা দরকার সবই তো সামনে তবুও কেন এত কষ্ট হচ্ছে তার দেশ ছেড়ে যেতে? মীরাকে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা নাকি সব স্মৃতি মুছে নতুন স্মৃতি গড়তে চাওয়ার যন্ত্রণা? রূপম কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শেষবার একটু বাবা-মায়ের সাথে দেখা করবে? নাহ! ওখানে গেলেই রূপমের যাওয়ার পথে বিপত্তি আসবে। রূপম তনয়কে বললো গাড়ি বের করতে। তনয় বিষাদ দৃষ্টিতে রূপমের পানে চেয়ে না চাইতেও গাড়ি বের করতে গেল। রূপম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কত সহজে সে সব ফেলে যাচ্ছে! এই শহর, এই শহরের স্মৃতিগুলো, বন্ধুদের, পরিবার, তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটা সুন্দর জীবন, সবকিছু ফেলে কিভাবে ভালো থাকবে রূপম? কিন্তু তাকে যে পারতেই হবে। ভালো থাকতে না পারলেও ভালো থাকার অভিনয়টা করে যেতে হবে। সত্যি ভালো থাকার চেষ্টা করার চেয়ে ভালো থাকার অভিনয় করা সহজ!

_________________________________

অভির কথা শোনার পর থেকেই আমি বেশ ভয়ে আছি। সত্যি সত্যি কিছু করে ফেলবেনা তো ছেলেটা? আধঘণ্টার মতো পেরিয়েছে। আমার ভীতির পরিমাণ বাড়ছে। হুট করেই যেন অভির জন্য চিন্তা হতে শুরু করেছে। ছেলেটা এমন পাগলাটে স্বভাবের কেন? সত্যিই কিছু করে ফেললে! আমি নিজেকে ক্ষমা করবো কোন মুখে? ঘড়ির কাঁটাও যেন শত্রুতাবশত জোরে চলছে। দ্বিধাদ্বন্দ্বের শিকলে জর্জরিত আমি। থাকতে না পেরে ফোনটা করেই বসলাম।

– “এই আপনার কি মাথার তার ছেঁড়া? কেন এত পাগলামি করছেন?”

– “তুমি তো ভালোবাসো না আমায়। কল দিলে কেন?”

– “আমি ভয় পাচ্ছিলাম আপনি যদি সত্যিই কিছু করে বসেন!”

– “করতাম! আমি মারা গেলে তোমার কী? তুমি তো আমায় ভালোবাসো না, একটুও ভালোবাসো না। তাহলে আমি যা করি তা তোমাকে এফেক্ট করবে কেন? মরে যাই আমি, তোমার কী?’

– “অভি! প্লিজ!”

– “ভালোবাসোই যখন, স্বীকার করতে দোষ কোথায়?”

– “আপনি পাগল!”

– “হুম, আপনার জন্যে পাগল মহারানি কিন্তু আপনি তো বুঝতেই চাইছেন না!”

– “আমি কল কাটলাম।”

– “ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। কল কাটবে, দুমিনিট পর আমি আর নাই।”

– “আপনিইইই! প্লিজ আমায় বিরক্ত করেন না।”

– “ভালোবাসো সেটা স্বীকার করতে এত টালবাহানা কেন? তোমরা মেয়েরা ভালোবাসার কথা স্বীকার করো না কেন সহজে?”

– “আপনাকে কে বললো আমি আপনাকে ভালোবাসি?”

– “কিছুই বুঝি না নাকি?”

– “বোঝেন যখন, আবার বলতে হবে কেন? বুঝে গেলে তো ভালোই।”

– “মুখে শোনার জন্য কত উৎকণ্ঠা তা তো তুমি বুঝবে না। আমি তো বলেই দিছি, আমি না বললে তুমিও উৎকণ্ঠা থাকতে!”

– “বয়েই গেছে আমার।”

– “ভালোবাসি মীরা!”

– “ভালোবাসি না।”

– “আমার মন ‘না’টুকু কেটে নিয়েছে। ধন্যবাদ মহারানি।”

– “হইছে! এখন সুইসাইডের চিন্তা বাদ দেন।”

– “দিলাম! এখন থেকে প্রতিটা সকাল তোমার কণ্ঠ শুনে যেন ঘুম ভাঙে!”

মুচকি হাসলাম। দ্বিতীয়বার অনুভূত হচ্ছে এসব! জানিনা অনুভূতিগুলো আবারো আমার সাথে খেলছে নাকি সত্যিই অভি আমায় এতটা ভালোবাসে! চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম। ভবিষ্যতে যা হবে, সব যেন মঙ্গলময় হয়!

______________________

ভালোবাসার পরিণতিটা বড্ড অদ্ভুত। একজন মারাত্মক ভালোবেসেও ভালোবাসা পায় না, আরেকজনের সামান্য প্রচেষ্টাই মারাত্মক ভালোবাসার একজন মানুষ পাইয়ে দেয়!

রূপম সবকিছু ছেড়ে চলে যাচ্ছে, পাড়ি জমাতে যাচ্ছে এক ভিন্ন-অচেনা রাজ্যে। স্বজন-পরিজন, বন্ধু সবকিছু ছেড়ে এমন এক রাজ্যে আস্তানা গড়তে চলেছে সে, যেখানে মীরা নামক মেয়েটার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না, মীরার কোনো স্মৃতি তাকে প্রতিমুহূর্তে কুঁকড়ে খাবে না। রূপমের বুকের বা-পাশটায় বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। প্রিয় মানুষটাকে অন্য কারো হতে দেখার মতো যন্ত্রণা বুঝি আর কিছুই নয়।

রাত পেরোচ্ছে। অভির টেক্সটে একটু পর পর জ্বলজ্বল করছে আমার ফোনের স্ক্রিণ। আমার ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটছে। হঠাৎ হঠাৎ হারানোর ভয়ও জেঁকে বসছে। অভির প্রতি নিজের দুর্বলতার কথা ভাবলে ভালো লাগে কিন্তু ভয় হয় যদি অভিও শ্রাবণের মতো আমায় ছেড়ে চলে যায়! প্রথম ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণাটা আমি সামলে উঠেছি মাত্র কিন্তু অভিকে হারালে আমার বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। অভি আর আমার ভালোবাসাটা যেন পূর্ণতা পায়!

ভালোবাসার গল্পগুলো শেষ হয়না! আমরা যেটা দেখি তা কেবল রঙিন সূচনাটুকু, সম্পর্কের ভাঁজে ভাঁজে যে কত তিক্ত অভিজ্ঞতা জন্মায় তা আর কারো দৃষ্টিগোচর হয় না। দেখা যাক অভি আর মীরার এ সম্পর্কের অগ্রযাত্রা কেমন হবে!

সমাপ্ত

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here