#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤️
#পর্ব_০৩
লেখনীতে:আহানিতা
‘প্ প্লি্ প্লিজ, ছুঁবেন নাহ আমায়।যে্ যেতে দিন। আ্ আমি্, আমি বাঁচতে চাই।বাঁচব আমি।দূরে থাকুন প্লিজ।’
জ্ঞান ফিরতেই চারপাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়েই চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম।পুরো শরীর ঘামে ভিজে নাজেহাল অবস্থা।আমি পরনের জামাটা খামচে ধরেই চোখ খিচে বিড়বিড় করে এসব বলতে লাগলাম।অনেকক্ষন পর্যন্তও আশেপাশের লোকটির কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে তাকালাম।চারদিকের অন্ধকার দেখেই ভয়ে বার কয়েক ঢোক গিললাম। কাঁপা কন্ঠে বললাম,
‘ ক্ ক্ কে? ক্ কে আ্ আপ্ আপনি?’
এবারও সামনের লোকটির কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল নাহ।আমার হাত পা খোলাই আছে।তবুও আমি হাত পা নাড়াতে পারছি নাহ।ভয়ে হাত পা অসম্ভব রকম কাঁপছে। নিজের উপর ভর করে এক পা বাড়ানোরও শক্তি নিজের মধ্যে সঞ্চয় করতে পারলাম নাহ আমি।বারবার সেই একই ঘটনা।একই স্মৃতি ঘুরেফিরে আমার মনে আসছে।সেদিনও একইরকম অন্ধকার, ময়লা -ধুলোয় ভরা একটা রুম,সেই তিনজন।এবার দম বন্ধ হয়ে আসল আমার।আর ভাবতে পারছি নাহ আমি।কিন্তু ঐ তিনটে লোক?জ্ঞান হারানোর আগে আমি যে তিনজনকে দেখেছি তারা কোথায়?গায়েব হয়ে গেল তারা?চোখ দিয়ে আবারও গড়াল পানি।ঠিক তখনই একজন কেঁশে উঠল।অন্ধকারে একটা মোমবাতি জ্বালিয়েই সামনে দাঁড়াল।লোকটার মুখ দেখার সুযোগ হলো নাহ আমার।আমি অনবরত চোখের পানি ফেলতেই লোকটা বিরক্ত নিয়ে বলে উঠল,
‘ কাঁদছিস কেন তুই? একে তো এই বোরিং সিচ্যুয়েশন তার উপর তুই!’
মুহুর্তেই বুঝে গেলাম লোকটা কে।অর্কভাই!এবার যেন অল্পবিস্তর সাহস সঞ্চয় হলো আমার মধ্যে।অর্কভাইয়ের উপর কিসের এত ভরসা আমার?কেন সাহস পাচ্ছি আমি উনি পাশে আছে জেনে?উনিই তো এখানে অন্ধকারে রেখে চলে গেলেন কিছুক্ষন আগে।তারপরও উনার উপর এতটা ভরসা রাখা কি বেমানান নয়?যতটুকু আমি জানি দুইবছর আগে সেদিনও তো ছেলেগুলোর হাতে উনিই আমায় ছেড়ে গিয়েছিলেন ধর্ষিতার অপবাদে আমায় তিলে তিলে মারার প্ল্যান বানিয়ে ।তবুও কেন আমি তাকে ভয় পাচ্ছি নাহ যতটা ভয় ঐ তিনটা মুখকে দেখে পেয়েছি?
‘ তোকে ছুঁইনি আমি।ট্রাস্ট মি।’
আমি বড়বড় চোখ করে তাকালাম উনার দিকে।হাত পা এখন ও অল্পবিস্তর কাঁপছে আমার।অর্কভাইয়ের সাথে কথা বলার ইচ্ছে বা শক্তি কোনটাই পাচ্ছি নাহ।অর্কভাই আবারও বললেন,
‘ এই তুই আমাকে এমন ভাবিস?আমি তোর সাথে খারাপ কিছু করব ভেবেছিলি তুই?কিসব বিড়বিড় করে বলছিলি চোখ বন্ধ করে?’
আমি চুপ মেরে বসে রইলাম। হাত জোড়া শক্ত করে হাঁটু ধরে বসেই মাথা উঁচু করে উনার দিকে তাকালাম।অন্ধকার।মোমবাতির আলোয় কেবল উনার জ্যাকেটটাই চোখে পড়ল।উনি আবারও বললেন,
‘মেহুল,তুই ওদের আগে থেকে চিনতি?তাই নাহ?’
উনার মুখ দেখা না গেলেও আমি অবাক হয়ে চাইলাম উনার দিকে।আগে থেকে চিনতাম মানে?আগে থেকে চেনার কি কথা ছিল নাহ?উনি কি জানতেন না আমি ওদেরকে চিনি?কে জানে।আমি এসব ভবতেই অর্ক ভাই হাঁটু গেড়ে সামনে বসলেন।মোমবাতির আলোয় এবার উনার মুখটা চোখে পড়ল।গম্ভীর ভাব চোখেমুখে।চোখমুখের থমথমে ভাব নিয়েই বলে উঠলেন তিনি,
‘ সাব্বির, সিফাত আর আকরামকে তুই চিনিস তাই তো?কি করেছে ওরা তোর সাথে?এত ভয় পেয়েছিলি কেন ওদের দেখে যে সেন্সলেস হয়ে গেলি?এই শীতের রাতেও তুই ঘেমে চুপসে গেছিস ইভেন এখনও ঘাম তোর চোখে মুখে।প্লিজ আন্সার দে মেহুল।চিনিস তুই ওদের?’
আমি নির্বিকারভাবে চেয়ে রইলাম শুধু।অর্কভাইয়ের কথার উত্তরে কথা বলতে চেয়েও আমি কথা বলতে পারছি নাহ।পাশে টেবিলের মতো কিছু একটা পেয়েই মাথা হেলিয়ে সেখানে রাখলাম।আস্তে আস্তে উঠার চেষ্টা করতেই অর্ক ভাই হাতজোড়া দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করলেন।দুই হাত দিয়ে আমার দুই বাহু ধরে উঠে দাঁড় করিয়ে মৃদু কন্ঠে বললেন,
‘ স্যরি, তোকে টাচ করার জন্য।কিন্তু তুই পরে যাবি নিজে নিজে উঠতে গেলে তাই,’
আমি চমকে তাকালাম। এটা অর্কভাই?আমার চেনা অর্কভাই?উনি এতটা সহজ সরল কবে থেকে হলেন?স্যরি বলছেন?আমাকে?আমার ভাবনার মাঝেই উনি পানির বোতল থেকে পানির ঝাপটা দিলেন আমার মুখে।পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের পানিটুকু মুঁছিয়ে নিয়েই পানির বোতলের মুখটা আমার মুখে ধরলেন।আমি ঢকঢক করে পানি খেয়ে তৃষ্ণা মিটালাম।চোখ মিটমিট করে তাঁকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেললাম।উনার দিকে সরু চোখে তাকাতেই উনি আবারও বললেন,
‘ চিনিস ওদের?’
আমি উত্তর দিতে পারলাম নাহ।কম্পনরত হাত পা আর ধুকবুক করা হৎপিন্ড সামলাতেই অস্থির হয়ে উঠলাম।যেন এক্ষুনিই ধপ করে বসে পড়ব আমি।দাঁড়ানোর সেই ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছি।অর্কভাই আমার অবস্থা বুঝতে পেরেই হয়তো কোথায় থেকে একটা পুরোনো চেয়ার এনে আমার সামনে রাখলেন।তারপর হাতের ময়লা ঝারতে ঝারতেই বললেন,
‘ ইটস ওকে।তুই বস।আমি তোকে হ্যাঁ অর না দুটো অপশন দিচ্ছি।তুই যেটা সঠিক সেটাতে মাথা দুলাবি।ওকে?পারবি?’
আমি ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে রইলাম।উনি আমায় বসিয়ে দিলেন।তারপর মৃদু কন্ঠেই বললেন,
‘ শোন, উত্তরটা আমার জন্য অনেকটা ইম্পোর্টেন্ট।প্লিজ বল, তুই ওদের চিনিস? নাহ? নাকি হ্যাঁ?’
আমি মাথা নাড়ালাম যখন উনি হ্যাঁ বলল।সঙ্গে সঙ্গেই উনার ক্ষ্রিপ্ত চাহনি আমার চোখে পড়ল।চোখেমুখে অদ্ভুত রাগ ফুটে উঠল তৎক্ষনাৎ।তবে কি আমি ওদের চিনি শুনে উনি রেগে গেলেন?এতদিন কি জানতেন নাহ আমি ওদের চিনি এই কথাটা?ভাবনার মাঝেই আৎকে উঠলাম আমি।অর্কভাই লাথি মেরে সামনের ভাঙ্গা টেবিলটা সরিয়ে দিলেন।দেওয়ালে বার কয়েক ঘুষি দিয়েই বললেন,
‘ নো, নো!আই কান্ট বিলিভ দিজ!দেই কান্ট ডু দিজ। নো।’
আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম।ভয়ে হাত পা এবার আরও কাঁপছে।উনি কয়েক সেকেন্ড পরই নিজেকে সামলালেন।নিজের মাথার চুল দুইহাত দিয়ে টেনে ধরেই বিরবির করে কিছু বললেন।আমি শুনতে পেলাম নাহ।তারপর অনেকক্ষন পরই নিজেকে শান্ত করে বললেন,
‘ স্যরি,আ’ম রিয়েলি স্যরি মেহুলতা।সেদিন আমি থাকলে হয়তো এমন…’
বাকিটা বললেন নাহ উনি।তারপর চুপ করেই আমার দিকে তাকালেন।আমি ভয়ে নিজেকে ঘুটিয়ে নিয়েই ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম উনার দিকে।উনি আমার দিকে ঝুকেই মৃদু কন্ঠে বললেন,
‘বি নরমাল মেহুল।ডোন্ট বি এফ্রেইড।লিভ ইট ।’
আমি মুখ তুলে চাইলাম।কাঁপা কন্ঠে বলার চেষ্টা করলাম,
‘ আ্ আ্ আমি বা্ বা্সায়’
অর্কভাই আমাকে বাকিটা বলতে না দিয়েই মাথা নাড়িয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ, বাসায় তো নিয়ে যাব তোকে।’
‘ আ্ আম্ আমার বাসায়।’
‘ হু।’
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।উনার ফেমিলির সাথে শপিং?সেটা কি মিথ্যে? কয়েক মিনিট পরই বুঝতে পারলাম আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছি আমি।কথা বলতে পারছি।চাইলে দাঁড়াতেও পারব আমি।অর্কভাইয়ের দিকে সরু চোখে তাকিয়েই উঠে দাঁড়াতে লাগলাম।উনি আমার এক হাত খপ করে ধরেই উঠালেন।ঢুলে পড়তে লেগেও আবার স্থির হয়ে উনার একহাত শক্ত করে খামছে ধরে দাঁড়ালাম।উনার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড।উনিই বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পর রাস্তার একধারে গাড়ি থামিয়ে আমাকে এই অন্ধকার রুমে রেখে কোন একটা কাজ আছে বলে চলে গিয়েছিলেন।উনার কি জানা ছিল না আমি অন্ধকারে ভয় পাই?নাকি ইচ্ছে করেই তখন ভার্সিটি থেকে উনার সাথে যাইনি বলে শাস্তি দিলেন?কিন্তু ওরা তিনজন?ওরা তিনজন কোথায় থেকে আসল?কিভাবে ?আবার গেল কোথায়?
.
অর্কভাই আমায় বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই চলে যেতে লাগলেন।পরক্ষনে আম্মুর ডাকে পেছন ফিরে তাকিয়ে কয়েক পা এগিয়ে আম্মুর সাথে কয়েক মিনিট কথা বললেন।কি বললেন তা আমি শুনলাম নাহ।সোফায় হাত পা ছড়িয়ে একপ্রকার শুঁয়েই আড়চোখে দেখছিলাম।কয়েক মিনিট পরই কথাবার্তার শেষে চলে গেলেন উনি। আমি হালক নিঃশ্বাস ফেলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালাম।কেন জানি ভয় হচ্ছে আমার।অজানা কোন ভয়।ক্লান্তি আর ভয়ে মাথা টগবগ করছিল।ঠিক তখনই মোবাইলে কল আসল।আমি কাঁপা হাতে মোবাইল নিতেই রায়হানের কল দেখে রাগে কল কাঁটলাম।বিরক্ত লাগছে আমার।প্রচুর বিরক্ত।তখনই আম্মু আসল। আমার মাথায় হাত রেখে জ্বর আছে কিনা দেখেই পাশে বসলেন।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,
‘ কাল ভার্সিটি যাওয়ার দরকার নেই।আজকে অর্কের মামা হুট করেই অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় উনারা শপিং করা ক্যানসেল করে ওখানেই গিয়েছেন।কাল যাওয়ার কথা বলছিল, তোমার অসুস্থতার কথা শুনে তাও বাতিল।পরশু যাবে।তুমি অসুস্থ যেহেতু কাল ভার্সিটিতে যাওয়ার দরকার।পরশু একেবারে সুস্থ সবলভাবেই ওখানে যাবে।ওকে?’
আমি মিনমিনে চোখে আম্মুর দিকে তাকালাম।মাথা দুলিয়ে হ্যা বলে চোখ বন্ধ করতেই আম্মু আবারও বলে উঠল,
‘ মেহুল? তোমার বয়স বিশ পেরিয়ে একুশে পড়ল তবুও এত কেন অগোছাল তুমি?এখানে ঘুমাচ্ছ কেন তুমি?উঠে বসো।আমি খাইয়ে দিচ্ছি।খেয়ে রুমে গিয়ে ঘুমোবে।ঠিকাছে?’
আমি বিরক্তি নিয়ে তাকালাম।যার অর্থ আমার এই মুহুর্তে খাওয়ার কোন প্রকার ইচ্ছে নেই।না আছে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমানোর ইচ্ছে।এখানেই ঘুমিয়ে পড়লে কি হবে?আমার আম্মু এত কঠোর কেন?আমার বেলায়ই এত কঠোরতা কেন?আমি অসহায় চাহনিতে তার দিকে তাকাতেই আম্মু মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ ওকে, ঘুমাও।ঘুমালে ভালো লাগবে। তবে হালকা খাবার খেয়ে।আমি তোমায় পেটভর্তি খেতে বলছি না।কেমন?’
আমি মাথা দুলালাম।আম্মু কিচেনে গিয়েই প্লেটে হালকা খাবার এনে আমায় খাইয়ে দিলেন।খাওয়া শেষে জল খাইয়ে দিতে দিতেই বললেন,
‘ এখানেই ঘুমোবে?’
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।আম্মু মৃদু হেসে বলল,
‘ আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো।হিমেল আর তোমার আব্বু আসলে তাদেরকে টিভি চালাতে নিষেধ করে দিব।যাতে তোমার ঘুম না ভাঙ্গে।ঘুমাও।’
আমি ঠোঁট টেনে হাসলাম।ঘুমানোটা আসলেই দরকার।ঘুমোলেই হয়তো পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারব আমি।কিন্তু মনের মধ্যে এতসব প্রশ্ন?ওরা তিনজন কোথায় গেল?আসল কোথায় থেকে?কেনই বা উনি আমি ওদের চিনি কিনা জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন।কেন?অর্কভাইয়ের থেকে সব উত্তর নিতে হবে।সব!
.
আজ ভার্সিটি যাওয়া হয় নি আমার।আম্মুই যেতে দেয়নি আমাকে।ঘরে এদিক ওদিক পায়চারি করেই জানালার পাশ ঘেষে দাঁড়ালাম। দুপুরের মিষ্টি রোদ শরীর ছুঁতেই ভালো লাগল।বাসার সামনে ব্যস্ত রাস্তায় ছুটে চলেছে রিক্সা, ট্রাক আরো কত যানবাহন।জানালায় দাঁড়ালেই আমার বেলকনিটজ চোখে পড়ে খুব সহজেই।সেখানে গোলাপ গাছটায় দুই দুইটো টকটকে লাল গোলাপ ফুটে আছে।আমি গোলাপ দুটোর দিকে তাকিয়েই সেখান থেকে সরে বেলকনির দিকে পা বাড়াতেই মেঘার কন্ঠস্বর শুনে চমকে তাকালাম। পেছন ঘুরে তাকাতেই মেঘার দাঁত কেলানো হাসি চোখে পড়ল।আমি ওকে দেখেই রাগে চোখমুখ লাল করে নিলাম।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
‘ তুই আমার বাসায় আসলি কেন?’
মেঘা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পা বাড়াল আমার রুমে।মুখে দাঁত কেলানো হাসি বজায় রেখে বলে উঠল,
‘ দোস্ত?তুই নাকি সেন্সলেস হয়ে গেছিলি?তা বমি হচ্ছে নাহ দোস্ত?আচার খেতে ইচ্ছে করছে?দোস্ত, বল।তোকে আচার খাওয়ানোর দায়িত্ব আমার।তুই আমায় এই সুখবরটা দিলি না?তোর বাচ্চার রিয়েল আন্টি হই।রিয়েল আন্টি।বললি নাহ আমায়?’
আমি ওর কথা শুনেই হা হয়ে তাকালাম।কি বলছে এই মেয়ে?আজব!
‘ তোর সুখবরের চৌদ্দগোষ্ঠীরে আলুভর্তা বানাব।কালকে তুই আর রায়হান কোন হ্যান্ডসাম ছেলে অর সুন্দরী মেয়ে দেখছিলি?আমারে রেখে যাবিই যখন তখন এত আদিক্ষ্যাতা করে যেতেই বললি কেন?কেন?আমি কি যাওয়ার জন্য কান্না করতেছিলাম?অসহ্য!’
মেঘা আমার দিকে তাকাল।তার মুখ মুহুর্তেই কালো হয়ে এল।এমন একটা ভাব যেন তারা ইচ্ছে করে রেখে যায় নি আমায়।ভুলবশতই রেখে চলে গেছে।মেঘা আমার দিকে তাকিয়েই বলল,
‘ আরেহ, আরেহ উনি।ইহান সাহেব? উনিই আমাকে আর রায়হানকে বলল তুই নাকি আগেভাগেই আমাদের খুঁজে না পেয়ে রিক্সা নিয়ে রায়হানের বাসায় রওনা দিয়েছিস। আমরাও তাই মনে করেই চলে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম উনি সত্যিই বলেছেন।কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি তুই নেই। আসিসই নি।তারপর অনেকগুলো কল দিলাম রায়হান আর আমি মিলে।তুই একবারও রিসিভড করলি নাহ।তুই তো পারতি আসতে।রায়হানের বাসা তো তুই চিনতি।’
আমি ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।মেঘা নিশ্চয় মিথ্যে বলছে নাহ।ইহান ভাই মিথ্যে বলেছে। ইহান ভাইকে মেঘা পছন্দ করে।শত হোক পছন্দের মানুষকে নিয়ে মিথ্যে বলবে নাহ মেঘা।আর ইহান ভাই জানেন মেঘা উনাকে পছন্দ আর বিশ্বাস দুটোই করেন।তাই হয়তো মিথ্যেটা আরো ভালোভাবে বলতে পেরেছেন।কারণ মেঘা উনাকে বিশ্বাস করে নিবেন মিথ্যে বললেও উনি জানতেন।কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়।ইহান ভাই অর্ক ভাইয়ের ফ্রেন্ড।কোনভাবে এটা অর্কভাই করেন নি তো?হু,এটা উনিই করেছেন। শিউর!উনিই তো বলেছিলেন কোনভাবেই রায়হানের বাসায় যদি ক্যান্সেল হয়ে যায়।তারমানে উনিই করেছেন। আমাকে ভাবতে দেখেই মেঘা আবারও বলল,
‘ তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে বলিস নি তো?আন্টি না বললে বলতিও নাহ হয়তো।’
আমার আবারও মন খারাপ হলো বিয়ের কথা শুনে।বিয়েটা ভাঙ্গা জরুরী।মেঘা যখন জেনেই গেছে না বলার আর প্রশ্নই আসে নাহ।আমি হালকা নিঃশ্বাস ফেলেই বললাম,
‘ দুদিন আগেই জেনেছিলাম আমি। বিয়েটা নিয়ে অতোটা সিরিয়াস নাহ আমি তাই বলতে ভুলে গিয়েছিলাম তোদের।স্যরি।’
মেঘা কিঞ্চিৎ রাগ দেখাল।পরমুহুর্তেই দাঁত কেলিয়ে হেসেই বলে উঠল,
‘ অর্কভাই?দি গ্রেট অর্কভাই আমাদের জিজু?আই মিন হবু জিজু?’
ওর হাসি আর বিস্ময় দেখে বিরক্ত ব্যাতীত কিছুই হলাম নাহ আমি।কপাল কুঁচকে বললাম,
‘ দি গ্রট, টি গ্রেট কিছু নাহ।বাবার বন্ধুর ছেলে।’
‘ যায় হোক।এইজন্যই বলি বান্ধবী আমার এত ব্যস্ত কেন?কল দিলে পাওয়া যায় নাহ,ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টিতে নেই।এমন হ্যান্ডসাম পেলে কি আর আমাদের মতো ফ্রেন্ড লাগে?হায়!এই জীবন আমি কেন রাখব আর?কেন?আমার বান্ধবী হ্যান্ডসাম পেয়ে ভুলে বসেছে আমায়।’
আমি কপট রাগ দেখিয়ে তাকাতেই চুপ হয়ে গেল মেঘা।পরমুহুর্তেই চোখ টিপে বলল,
‘ তা দোস্ত?বিয়ে ঠিক হতেই তুমি সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছো, পরবর্তীতে কি নাহ ঘটবে?হায়!’
আমি ওর দিকে তেড়ে গেলাম।দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘ তোর হায় এর মাথায় বারি।কুত্তা!নিজেরাই ব্যস্ত থাকস আবার আমারেই বলস ভুলে গেছি।’
মেঘা কপালে হাত রেখেই অসহায় মুখ করে বলল,
‘ আজ কোন হ্যান্ডসাম পাত্তা দেয় নাহ বলে আমি সিঙ্গেল মরছি।’
‘ তাই নাকি?ওকে। আন্টিকে বলে রাখব বিষয়টা।হ্যান্ডসাম দেখে একটা ছেলে খুঁজে যাতে তোকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দে তার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি কেমন?’
‘ এই ওয়ান মিনিট, বলবি কি তুই আমার আম্মারে?’
আমি মোবাইল খুঁজে নিয়ে ওর আম্মুর নাম্বার খুঁজে নিলাম।ওর সামনে তুলে ধরে বললাম,
‘ যা বলার তাই বলব।তুই যদি চাস এক্ষুনিই কল দিয়ে সবটা বলছি।নো প্রবলেম।’
মেঘা তৎক্ষনাৎ আমার থেকে মোবাইল কেড়ে নিল।আমি এবার হেসে উঠলাম হু হা করে ওর অবস্থা দেখে।পেট চেপে হাসতে হাসতেই বললাম,
‘ এবার জব্দ হ্যান্ডসামের বউ!’
মেঘা চুপচাপ বসে পড়ল খাটে।মোবাইলে কিছু খুঁজতে খুঁজতেই বলে উঠল,
‘ অর্কভাইয়ের নাম্বার কোথায়?হবু জামাইয়ের নাম্বারও রাখলি নাহ?নাকি সেইফটি? ফ্রেন্ডদের থেকে বাঁচার?’
আমি হাসলাম।মেঘা হয়তো অর্কভাইকে কল দিয়ে আমায় জব্দ করবে ভেবেছিল।কিন্তু আমার মোবাইলে যে তার নাম্বার সেইভ করা নেই এটা সে জানেই নাহ।আমি হু হা করে আরেক ধপা হেসেই বললাম,
‘ উনার নাম্বার নেই।শত খুঁজলেও লাভ হবে নাহ।’
মেঘা মুখ কালো করল।মোবাইলটা ছুড়ে রেখেই আমার হাত টানতে টানতে বলে উঠল,
‘ চল তাহলে বাইরে যাই।তোরে পঁচানো হলো নাহ আমার।’
আমি ফিক করে হাসলাম।বাসা থেকে বেরিয়ে এসেই দোকান থেকে জুস কিনে হাতে জুসের বোতল নিয়ে হাঁটছিলাম রাস্তায়। জুস খেতে খেতে মেঘার সাথে বিস্তর কথা বলছিলাম তখন।হুট করেই কোথায় থেকেই একটা বাইক আমাদের পাশ ঘেষেই গেল।সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পায়ে ছিটকে পড়ল রাস্তার পাশে জমানো ময়লা পানি।ভ্রু কুঁচকে দুইজনে তাকাতেই ইহান ভাইকে দেখে আবার হাঁটতে লাগলেই থেমে গেল মেঘা।দাঁতে দাঁত চেপেই বলল,
‘ এই দাঁড়া।এই লোকের মজা দেখিয়ে আসি।কি মিথ্যুক এই লোক।’
আমি অসহায় চোখে তাকালাম।এখন মেঘা কোমড় বেঁধে ঝগড়া করবে।আমি আপাদত এই ঝগড়ার নিরব দর্শক হতে চাইছি নাহ তাই অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালাম।কিন্তু মেঘা তার পাত্তা দিল নাহ।ইহান ভাইকে বাইক থামাতে দেখেই হনহন করে পা বাড়াল সে।ইহান ভাইয়ের সামনে গিয়েই হাতে থাকা জুসের বোতলটার জুস ছুড়ে দিল ইহান ভাইয়ের গায়ে।রেগে গিয়ে বলল,
‘ ঐ ইহান সাহেব,আপনি চোখে দেখেন নাহ?কানা নাকি?রাস্তার পাশে মানুষজন আছে চোখে দেখেননি?’
ইহান ভাই হতবাক হয়ে চাইলেন।যে মেয়েটা উনাকে পছন্দ করেন এতগুলো দিন ধরে, উনার থেকে কোন রেসপন্স না পেয়েও এখনো পর্যন্ত পছন্দ করেন সেই মেয়েটাই এভাবে রাস্তার মাঝে তেজ দেখিয়ে জুস ছুড়ে দিলেন উনার গায়ে?উনি শার্টে পড়া জুসটুকু ঝেরে নিতে নিতেই বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ কি হলো এটা মিস মেঘা?’
মেঘা এবার নিজের পায়ের দিকে তাকাল।কায়দা মাখা পানিতে জুতা সহ পা কালচে হয়ে গিয়েছে। ইহান ভাইকে পা দেখিয়ে বলল,
‘ এটা কি হলো?’
ইহান ভাইয়ের চোখে মুখে আকাশ সমান বিরক্তি দেখলাম।দাঁত চেপে বললেন,
‘ রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটলে এমনটা অহরহ হয়।স্বাভাবিক।’
মেঘাও দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
‘ মেয়েদের পায়ে নোংরা লাগালে এমনটা অহরহ হয়। স্বাভাবিক।’
‘ কপি করছো আমায়?’
মেঘা হেসে বলল,
‘ নাহ তো।আপনাকে ভদ্রতা দেখিয়ে কিছু না বললেও পারতাম কিন্তু কি বলুন তো?আপনি কানা তো কানা, সাথে মিথ্যুক ও।মিথ্যে বলে আমার আর আমার বান্ধবীর মাঝে পেঁচাল লাগিয়ে দিয়েছেন। তাই এমনটা হলো।নাহলে আমি এমন অভদ্রতা করতাম নাহ। হে হে!’
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে মেঘা আবার আমার কাছে ফিরে আসল।আমি নিরবে দাঁড়িয়ে তাদের ঝগড়া দেখলাম।একদিক দিয়ে উচিত কাজ করেছে মেঘা।অর্কভাইয়ের কথামতো মিথ্যে বলার একটা সাজা তো পেয়েছেন ইহান ভাই!আহ শান্তি!অর্কভাইকে না পারি তার বন্ধুকে তো জব্দ করা গেল।
#চলবে….
[