টুকরো স্মৃতির অতলে পর্ব -০২

#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤️
#পর্ব_০২
লেখনীতে:আহানিতা

অর্ক ভাই ইশা আপুর খুব কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে।দুইজনকে দূর থেকে পার্ফেক্ট জুটিই লাগছে।আমি অর্ক ভাইয়ের সাথে পরিচয়ের পর থেকেই তাদের গভীর প্রেমের সাক্ষী হয়েছি বহুবার।আজও নিশ্চয় তাদের প্রেমের কোন এক দৃশ্য আমার সামনে উপস্থাপিত হবে।কে জানে!মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে ম্যাগাজিনের এপাশে কফির মগে চুমুক দিতেই অর্ক ভাই সরে পড়ল সেখান থেকে।ইশা আপু আগের ন্যায় সেইখানে দাঁড়িয়ে থাকল।তার কিছু মুহুর্তের মধ্যেই ইহান ভাই এসে পৌঁছালেন সেখানে।ইহান ভাই অর্ক ভাইয়ের ফ্রেন্ড।আমি চোখ উঁচিয়ে তাকাতেই পেছনে কারো কন্ঠ ভেসে উঠল,

‘ মেহুল! ‘

অর্ক ভাইয়ের কন্ঠ শুনেই জমে গেল হাত পা। এই লোকটার সম্মুখীন আমি যতই হতে চাই নাহ ততই দেখছি সম্মুখীন হতে হচ্ছে।উনার প্রেয়সী সহ আমার সামনে উপস্থিত হয়েছে ভালো কথা!কিন্তু আমাকে ডাকার কি মানে?আমি উঠে দাঁড়িয়ে মেঘা আর রায়হানকে চোখের ইশারায় আসছি বলে সরে আসলাম।অর্ক ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বললাম,

‘ অর্কভাই,আপনি?আমার ভার্সিটিতে কেন?’

উনি আমার দিকে একনজর তাকালেন।গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ এটা কেবল তোর ভার্সিটি নাহ গর্দভ!আমি, , ইহান আর,’

অর্ক ভাইয়ের কথার মাঝেই মুচকি হেসে বললাম,

‘ ইশু? ইশুপাখিরও ভার্সিটি এটা। তাই তো?’

উনি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়েই বললেন,

‘ ইশুপাখি?ইশুপাখি কি?তোর এই শিক্ষা?এই মেয়েকে বিয়ে করার জন্যই আমার বাবার এত শর্ত!ছিঃ!গুরুজনকে রেসপেক্ট করার নূন্যতম শিক্ষাই তো নেই তোর মধ্যে দেখছি।ইশু,ইশুপাখি এগুলো কি?ইশা আপু বল।স্যরি স্যরি, ইশা ভাবি বলবি।বুঝলি?’

আমি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।উনার দিকে তাকিয়েই বললাম,

‘ অবশ্যই!আপনার স্বার্থ মেটার পর যখন আমার জীবন ছারখার হয়ে শেষ হয়ে যাবে তখনই আমি নিজ দায়িত্বে তাকে ভাবি ডাকা শুরু করব অর্ক ভাই।তো আপনাদের ড্যাটিং এ হঠাৎ মেহুলের ডাক পড়ল যে অর্কভাই?কোন বিশেষ দরকার নাকি?’

অর্কভাই মাথার চুলে হাত বুলালেন।মুখ চোখে থমথমে ভাব!পরনে হোয়াইট শার্ট, হাতা ফোল্ড করা আর ব্ল্যাক জিন্স।ডান হাতে ব্ল্যাক ঘড়ি আর চোখে সানগ্লাস।উজ্জ্বল ফর্সা গায়ে চমৎকার মানিয়েছে সাদা রং।চোখেমুখে অদ্ভুত মায়া আর গম্ভীরতা। এই মায়ার জন্যই হয়তো ভার্সিটির অনেক মেয়েরই ভালো লাগার পুরুষ ছিলেন তিনি,হয়তো এখনও আছেন। আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলতেই তিনি বিরক্তি নিয়ে চোখের সানগ্লাস খুলে বলে উঠলেন,

‘ তোকে জাস্ট স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে বিয়ে করছি মেহুল।তুই জানিস সেটা।খুব ভালো করেই জানিস।এর বাইরে কিছুই নয়।সো এভাবে তাকানোর অধিকার তোর নেই।তাকাবি নাহ।বিরক্ত লাগছে আমার।’

রাগে মাথা টনটন করে উঠল তৎক্ষনাৎ। উনার কথামতো দৃষ্টিটা উনার থেকে সরিয়েই অন্যদিকে স্থির করলাম।অর্ক ভাইয়ের প্রতি জম্ম নেওয়া বিশাল ক্ষোভটা আরও জ্বলজ্বলিয়ে সতেজ হয়ে উঠল যেন।তার তৎক্ষনাৎ বলা কথা গুলোর প্রতিউত্তরে কিছু না বলে প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্ঠায় দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলাম,

‘ কিসের জন্য আমার ডাক পড়েছে তাই বলুন।ফালতু কথা বলার আমার অতো টাইম নেই।’

অর্ক ভাই মুখ চোখ কাটকাট করেই বললেন,

‘ রাতভর প্রেমিকের সাথে কলে কথা বলার টাইম তো ঠিকই পাস।এনিওয়েজ মোবাইল কোথায় তোর?ভোর চারটায় তোর মোবাইল ওয়েটিংয়ে থাকে ভালো কথা!সারাদিনে এতগুলো কল ইচ্ছে করেই রিসিভ করিস নি নাকি অন্যকিছু?’

উনার কথাতেই কাঁধে থাকা ব্যাগটার চেইন খুলে তৎক্ষনাৎ খোঁজ লাগালাম মোবাইলের।নাহ!মোবাইল নেই ব্যাগে।হয়তো বাসায়ই রেখে চলে এসেছি।ব্যাগের চেইন মেরে অর্ক ভাইয়ের আহামরি রাগটা পর্যবেক্ষন করেই আরো রাগিয়ে দেওয়ার জন্যই বলে উঠলাম,

‘আপনি যেমন প্রেমিকা নিয়ে ঘুরতে পারেন,দুইজন কাছাকাছি বসতে পারেন,ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেমালাপে ব্যস্ত থাকতে পারেন, ইভেন একে অপরকে খাইয়েও দিতে পারেন তো আমি প্রেমিকের সাথে কথা বলার সময় বের করতে পারব না?নাহলে কিসের প্রেম করি আর কেমনই প্রেমিকা বলুন। আর দ্বিতীয়ত আপনার নাম্বার আমার কাছে নেই।কল করলে আননোন নাম্বারই দেখাবে।আমি আননোন নাম্বার থেকে কল আসলে রিসিভড করি নাহ।আর কিছু?’

‘ ইয়েস। অনেক কিছু!’

অর্কভাইয়ের কন্ঠটা কেমন শুনালো।চোখ চেয়ে উপরে তাকাতেই তার রক্তলাল চক্ষু দেখে ভয়ে হালকা কেঁপে উঠলাম।বুকে দুই হাত গুঁজে রক্তলাল চোখজোড়া নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।আমি ভয়ে, অস্বস্তিতে কপাল ঘষতে ঘষতেই বিরক্তি দেখিয়ে বলে উঠলাম,

‘ অনেককিছু?আমি শুনতে ইচ্ছুক নই।সময় নেই আমার।আমাকে আমার ফ্রেন্ডদের কাছে যেতে হবে অর্কভাই।’

আমি পা জোড়া সেখান থেকে সরিয়েই পা বাড়াব তার আগেই অর্কভাই কঠিন কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ দাঁড়িয়ে যা মেহুল।’

আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।উনার কঠিন কন্ঠ, গম্ভীর চাহনি আর রক্তলাল চক্ষু দেখেই অজানা ভয় বাসা বাঁধল।সরু চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে আবারও বলতে লাগলাম,

‘ সময় নেই আ….’

বাকিটা বলার আগেই আকস্মিকভাবে উনার ঠোঁট ছুঁয়ে গেল আমার কপাল।উনার নিঃশ্বাস উপছে পড়ল আমার কপালে।সাথে সাথেই কেঁপে উঠলাম আমি।লোমকূপ কেঁপে শিহরন বয়ে গেল পুরো শরীর জুড়ে। আমি কয়েক মুহুর্তে বরফের মতো জমে থেকেই পরমুহুর্তে বুঝতে পারলাম কি হচ্ছে।পেছন ফিরে দেখলাম ইশা আপু অর্কভাইয়ের হাত থেকে কিছু নিচ্ছে।আমি বুঝতে পারলাম, অর্কভাই ইশা আপুকে কিছু দিতে গিয়েই দু পা এগিয়ে হালকা ঝুকেছিলেন।যার ফলস্বরূপ উনার ঠোঁট ছুঁয়ে গেল আমার কপালে।আমি স্বাভাবিক হয়ে তৎক্ষনাৎ অর্কভাইয়ের কাছ থেকে সরে এসেই অন্য জায়গায় দাঁড়ালাম।উনি আমায় সরতে বলেননি কেন?এটা কি সবটাই আকস্মিক? নাকি ইচ্ছাকৃত?নাহ নাহহ!ইচ্ছাকৃত কেন হবে?অর্কভাই ইশা আপুকে ভালোবাসেন।আমার কটালে ঠোঁট ছোঁয়ানোর বাহানা কেন খুঁজবেন উনি?উনি তো আমায় ভালোবাসেন নাহ।আমি সব ভাবনা এক তুড়ি দিয়ে ছুগে ফেলাে চেষ্টায় বার কয়েক নিঃশ্বাস ফেললাম।ফিটফিট চোখে এদিক ওদিক তাকাতেই অর্কভাই আমার দিকে ফিরলেন।তৎক্ষনাৎ আমি প্রশ্ন ছুড়লাম,

‘কি করছিলেন আপনি?আমায় সরতে বলেননি কেন?’

অর্কভাই ভ্রু কুঁচকেই বিরক্তি নিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘ কি করছিলাম?’

উনার প্রশ্নে আমি চুপ হয়ে গেলাম।বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে ক্ষ্রিপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে রইলাম।খেয়াল করলাম উনার রাগটা কমেছে।রক্তলাল চক্ষু দেখে সেই ভয় হচ্ছে নাহ।মুখে চোখে সেই কঠিনতা আপাদত নেই।হুট করেই রাগ কমে গেল উনার? ইশা আপু একনজর দেখাতেই কি রাগ কমে গেল উনার?নাকি কিছু দিতে গিয়ে হাতে হাতে আলতো স্পর্ষ ঘটল বলে?নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলাম। ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিতেই অর্কভাই ঘড়িতে নজর ফেলে বলে উঠলেন,

‘ আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে তোকে।’

আমি কিঞ্চিৎ বিরক্তি দেখিয়েই বলে উঠলাম,

‘ এখন?’

অর্কভাই ঠোঁটের নিচে হাত দিয়ে চুলকে ব্যস্ত ভঙ্গিতেই বললেন,

‘ হ্যাঁ।এখনই।কয়েকঘন্টার জন্য।তোর বাসায় বলে দেব।সমস্যা নেই।’

আমি পেছন ফিরে মেঘা, রায়হানের দিকে একবার চাইলাম।মেঘা রায়হানের সাথে কিছু বলছিল।রায়হান কথা বলার মাঝে মাঝেই আড়চোখে আমার দিকে চাইছিল।আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে অর্ক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলাম,

‘ আ’ম স্যরি অর্কভাই!আজকেই রায়হানের বার্থডে।সো ওর সাথে ওর বার্থডে পার্টি এন্জয় করাটা আমার কাছে বেশি ইম্পোর্টেন্ট।আমরা এখান থেকে ওর বাসাই যাব এক্ষুনি।আপনার সাথে গেলে তো তা সম্ভব হচ্ছে নাহ অর্কভাই।’

অর্কভাই বোধ হয় রেগে গেলেন।ফর্সা চোখমুখ কেমন যেন লাল হয়ে গেল।রেগে যাওয়ারই কথা।সবসময় উনার চাওয়া মতোই সবকিছু হয়ে এসেছে। আজ হচ্ছে নাহ।তাই রাগাটাই স্বাভাবিক।উনা ডানচোখের ভ্রু উঁচু করেই জিজ্ঞেস করলেন,

‘ শিউর?’

আমি নির্দ্বিধায় বলে উঠলাম,

‘অবশ্যই শিউর!’

অর্কভাই এবার চুপ থাকলেন।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

‘ আরো দুই মিনিট সময় নে।ওকে?’

‘ কেন?’

‘ যাবি কি যাবি নাহ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।’

আমি নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থেকেই বললাম,

‘ যাচ্ছি নাহ আমি আপনার সাথে কোথাও।কানে ডুকেছে কথা?’

উনি বাঁকা হাসলেন। কি বুঝেই বললেন,

‘ আরো একবার সুযোগ দিচ্ছি।ভেবে বল।’

‘ যাব নাহ আমি। যাব নাহ।’

অর্কভাই হাসলেন।আমি তার হাসির কোন অর্থ খুঁজে পেলাম।উনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করলাম, যাচ্ছি নাহ উনার সাথে তাও উনি হাসছেন?কেন?অর্কভাই হালকা ফু দিয়েই উড়িয়ে দিলেন আমার কপালে আসা চুল।আমার দিকে দুকদম এগিয়েই কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,

‘ ইটস ওকে মিস মেহুলতা।কিন্তু কোন কারণে তোর ঐ রায়হানের বাসায় যওয়াও যদি ক্যান্সেল হয়ে যায়?ইশ!এন্জয় করা তো আর হবে নাহ তোর।এমনিতে অবশ্য তোকে আমার সাথে বেরুতে হবেই।এখন আর তখন।আই ডোন্ট কেয়ার।’

কথাগুলো বলেই উনি পেছন ঘুরলেন।পা বাড়িয়ে চলে গেলেন ইশা আপুদের দিকেই।আর আমি তাকিয়ে রইলাম সেদিকে।রায়হানের বাসায় যাওয়া ক্যান্সেল হবে মানে?আর উনার সাথে বেরুতেই হবে মানে?আমি সরু চোখে চেয়ে ভাবলাম।কিন্তু উত্তর মিলল নাহ। পরমুহুর্তে ওগুলোকে হালকা হিসেবে নিয়ে দু পা বাড়িয়ে মেঘা আর রায়হানের সাথে বসে পড়লাম চেয়ার টেনে।মনে মনে শান্তি লাগছে।উনি উনার ইচ্ছে মতো কোন একটা কাজ করতে পারে নি।হে হে!

.

তখন ভার্সিটির ক্লাস শেষ।মেঘা আর রায়হান আমার কিছুটা আগেই ছিল।এক সিনিয়র আপু হঠাৎ ডাকায় আমি কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিলাম।রায়হান আর মেঘা সামনেই ছিল।কিন্তু অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে।আমি তাদের দুইজনকে কোথাও না দেখেই হতাশ হলাম।এভাবে আমাকে রেখেই চলে গিয়েছে ওরা তিনজন?রায়হানের প্রতি তৎক্ষনাৎ জম্মাল রাগ।রেখেই যখন যাবি তখন ইনভাইট করারও কি দরকার ছিল?অদ্ভুত!ভার্সিটির গেইট পেরিয়ে হা হয়ে এদিক ওদিক ওদেরই খুঁজে চলেছি।না!ওদের কাউকেই দেখছি নাহ।মোবাইল না থাকায় কল দেওয়া ও সম্ভব হচ্ছে নাহ।রায়হান আর মেঘার উপর প্রচন্ড রাগ নিয়ে রিক্সা খুঁজতে লাগলাম।আমি চাইলেই রিক্সা নিয়ে রায়হানের বাসায় যেতে পারব কিন্তু যাব নাহ।একদমই যাব নাহ।আমাকে রেখে চলে যওয়ার দুঃসাহস করল কি করে?কেন করল?জীবনেও আর ওর কোন ইনভিটিশনে যাব নাহ। যাব নাহ।রাগে দুঃখে রিক্সা ডেকে বাসার উদ্দেশ্যেই রওনা হলাম।ওরা দুইজন মোটেই ভালো করল নাহ এটা।মোটেই নাহ।

.

বাসায় ফিরে শাওয়ার নিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতেই সোফায় এসে দড়াম করে বসলাম।পাশ ফিরে হিমেলকে দেখে ভ্রু কুঁচকালাম।হিমেল দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতেই বলে উঠল,

‘ আপু, তোমার বিয়ের শপিং কোনদিন করবা?অনেককিছু কিনতে হবে আমাকে!’

ওর আনন্দ, আগ্রহ দেখে মনে হলো বিয়েটা তারই।এই বিয়েতে আমার কেনাকাটা না করলেও চলবে কিন্তু তার অবশ্যই কেনাকাটা করা লাগবে।এমনকি শুধু কয়েকটা জিনিসয় নয়!তার সব কেনাকাটার লিস্টের সবটুকুই কিনতে হবে।নয়তো বিয়ে স্থগিত অথবা বন্ধ।হিমেলের মুখচাহনি বর্তমানে এমনই দেখাচ্ছে।আমি সরু চোখে তাকিয়েই হালকা নিঃশ্বাস ছাড়লাম।হিমেল আমার থেকে তিন বছরের ছোট।আমার থেকে ছোট হলেও বড় হিসেবে কোনদিন সে আমায় কোন সম্মান দেয় নি।আজ হঠাৎ তুমি সম্বোধনে কপাল কুঁচকালাম।কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে তাকানোর আগেই হিমেল আবার ও বলল,

‘আপু, তুই কি এই বিয়ে হোক চাস নাহ?কাল থেকে দেখছি মুখচোখ কেমন করে রেখেছিস।’

আমি কথা ঘুরানোর জন্যই বললাম,

‘প্রথমে তুমি বললি কেন?’

‘ এমনিই।কয়দিন পর তো চলেই যাচ্ছিস তাই একটু ভালোভাবে কথা বললাম।তোর দেখি তাতেও সমস্যা।’

‘ নাহ, সমস্যা নাহ।এভাবে তুমি বললে কেমন একটা বড় আপু বড় আপু ফিল আসে।বুঝলি?’

হিমেল হাসল। কিছু বলতে গিয়েও বলল নাহ।মোবাইলে গেইম খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।মিনিট পনেরো পর হঠাৎ ঐ দেখলাম ও মোবাইলে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে।আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই আমার কাছে এসে বসে পড়ল।মৃদু কন্ঠেই বলে উঠল,

‘ আপু,রাহাতের বোন আজ মারা গিয়েছে।হাসপাতালে কেবিনে বাচ্চা জম্ম দেওয়ার কিছুটা সময় পরই মারা গিয়েছে।জানিস?’

আমি চুপ রইলাম।রাহাতকে চিনি আমি।হিমেলের ফ্রেন্ড।রাহাতের বোনের বিয়েতে একবছর আগে আমরা পুরো ফেমিলিই গিয়েছিলাম মনে আছে।একবছর আগে বিয়ে হওয়া মেয়েটা আজ বেঁচে নেই শুনতেই অবিশ্বাস লাগল।বয়সে হয়তো আমার থেকে দুই এক বছরের ছোটই হবে রাহাতের বোন।আমি হিমেলের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না জানালাম।হিমেল শুকনো ঢোক গিলেই বলল,

‘তুই বিয়ে করে যাওয়ার পর নিজের যত্ন নিবি। প্রমিজ!’

আমি বড়বড় চোখ করে হিমেলের দিকে তাকালাম।যে ছেলে আমার সাথে অলটাইম ঝগড়া, মারপিট করতে ব্যস্ত থাকে এই ছেলেই আবার আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করছে?ভাবা যায় এসব।ঠোঁট টেনে ওর মাথায় হাত রেখেই বললাম,

‘ কেন তুই আছিস নাহ?তুই নিবি যত্ন।পারবি নাহ?’

হিমেল কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আম্মুর কন্ঠ ভেসে আসল,

‘ হিম এসব কি ধরণের কথা?ওখানে তোমার আপুর যত্নের অভাব হবে বলে শঙ্কা হচ্ছে তোমার?তোমার অর্কভাইয়ের ফেমিলি মেহুলকে নিয়ে যথেষ্ট সেন্সেটিভ এবং কেয়ারিং!তাছাড়া অর্কও তো মেহুলের জন্য অনেকবেশি কেয়ারিং।তুমি শুধু শুধুই এসব নিয়ে ভাবছো নাহ কি?’

আম্মুর কথা শুনে ভ্রু জোড়া কুঁচকে পেছন ফিরতেই চক্ষু চড়কগাছ।এই অর্কভাই এখানেও হাজির?কিন্তু কেন?বারবার আমার সামনে যেচে পড়ে হাজির হচ্ছেন কেন উনি?কি স্বার্থে?আমি সরু চোখে তাকাতেই উনি দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন আমার থেকে।হিমেল পাশ থেকে বলে উঠল,

‘ নাহ আম্মু।আমি তেমনটা ভাবি নি।আপু যা অগোছাল।আমি তো শুধু আপুকে নিজের যত্ন নিতে বলছিলাম।’

আম্মু মৃদু হেসে কিচেনে গেলেন। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি অর্ক ভাই আম্মু আব্বুর কাছে বরাবরই প্রিয়।তার কোন নির্দিষ্ট কারণ আমি খুঁজে পাইনি।রাতুল আঙ্কেলের সাথে বাবার বন্ধুত্ব বেশ ভালোই।সেই সূত্রেই হয়তো অর্কভাইকে এতোটা ভালোবাসেন আম্মু আব্বু যতটা নাহ আমাকে আর হিমেলকে বাসেন।হয়তো আহিকেও অর্ক ভাইয়ের মতো ভালোবাসেন নাহ।আহি অর্কভাইয়ের ছোটবোন।বছর দুই আগে যখন উনার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল অর্কভাই ই সেই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন।বিয়ের বাড়ির এত গুলো লোকের সামনে হনহন করে চলে গিয়েছিলেন উনি।তবুও এত কিসের ভালোবাসা উনার প্রতি আম্মু আব্বুর? এত কিসের ভরসা?আমার ভাবনার মাঝেই আম্মু কিচেন থেকে বলে উঠল,

‘ মেহুল!উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নাও।অর্কের সাথে বেরুবে তুমি।’

আমি কপালের চামড়ায় তিন ভাজ পেলেই জোরে বলে উঠলাম,

‘ মানে?উনার সাথে যাব কেন আমি আম্মু?’

আম্মু আমার কথাটা কানেই নিলেন নাহ।অর্কভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠল,

‘অর্ক বসো।মেহুল দুই মিনিটে তৈরি হয়ে আসছে। কেমন?’

অর্কভাই হালকা হাসল।উনি এদিকে এসে বসার আগেই আমি উঠে পড়লাম।রাগে দুঃখে হনহন করে পা বাড়ালাম আম্মুর দিকে।আম্মু তখন কড়াইতে কিছু করছিল বোধ হয়।আমি তার সামনে গিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলাম,

‘ আম্মু?আমি উনার সাথে কেন যাব?কোথায় যাব?এখন সন্ধ্যা।আমি অপরিচিত কারোর সাথে সন্ধ্যায় বেরুতে চাই নাহ।তাছাড়া উনার আর আমার বিয়ে হয়ে যায়নি যে উনি যা বলবেন তা করা লাগবে আমায়।’

আম্মু ঠিক সেইভাবেই কাজ করতে করতে নির্বিকার গলায় বলল,

‘ ও অপরিচিত নয় তোমার মেহুল।অর্কের সাথে তো তোমার ছোটবেলা থেকেই পরিচিতি।আর দ্বিতীয়ত এই সন্ধ্যায় আমিও তোমায় যেতে দিতাম নাহ যদি অর্কের আব্বু আম্মু কল করে না বলত।উনারা বিয়ের শপিং করবেন।তোমার জন্যও কেনাকাটা করবেন।তাই চাইছিলেন তুমিও যাও।অর্ক তোমায় নিয়ে ওদের বাসায়ই যাচ্ছে এই মুহুর্তে।তারপর যেখানে যাবে সেখানে ওর পুরো পরিবার সহই যাচ্ছো।আহিও তো আছে।এবার আশা করি সমস্যা নেই?’

আমি নিশ্চুপে নিঃশ্বাস ফেললাম।আম্মুর কথার পরিবর্তে আর কোন কথা না বলেই পেছন ফিরে পা বাড়ালাম।অর্কভাইকে হিমেলের সাথে কথা বলতে দেখেই তৎক্ষনাৎ হিমেলকে ডেকে পাঠালাম।আম্মু, আব্বু আগে থেকেই অর্ক ভাইয়ের পক্ষে।আমি চাই নাহ হিমেল ও উনার ভক্ত হয়ে যাক।তাই হিমেলকে ডাকা।উদ্দেশ্য হিমেলকে ওর রুমে পাঠিয়ে দেওয়া।হলোও তাই।হিমেল আসা মাত্রই ঝেড়েঝুড়ে পাঠিয়ে দিলাম ওর রুমে পড়ার টেবিলে।ও কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও পরমুহুর্তে চলে গেল।আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।নিজের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা অফ করে ফ্যান ছাড়লাম।

.

কালো রংয়ের একটা গোলা জামার সাথে কালো রংয়ের লং কোটি পরলাম। সাদা রংয়ের ওড়না গলায় জড়িয়েই স্থির হয়ে বসলাম।চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে বেঁধে ছেড়ে দিয়ে হিমেলকে ডাকলাম বার কয়েক।হিমেলের কোন আওয়াজ না পেয়ে বিরক্তে চোখ মুখ কুঁচকে নিলাম।দরজা খুলে মিনমিনে চোখে উঁকি মারলাম বাইরে।অর্কভাই সোফায় বসে।পাশে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে হিমেলও বসা।অথচ আমার ডাকের জবাব দিল না ও? পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম আম্মু নানা রকমের নাস্তা হাজির করেছে অর্কভাইয়ের সামনে।এটা ওটা বলে মাঝেমাঝে মৃদু হাসছেও আবার আম্মু।আমি ভ্রু কুচকালাম।অর্কভাইয়ের সাথে কথা বলে আম্মু মৃদু হাসছে?অর্কভাই দেখছি সত্যিই আমার আম্মুর মনে জায়গা করে নিয়েছে।আমি ছোট ছোট পা ফেলে বেরিয়ে এলাম।জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে হিমেলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম,

‘ এই হিম! তোকে ডাকছি কখন থেকে। কানে শুনিস নাহ তুই?’

আমার কথা শুনে আম্মু আর হিমেল আমার দিকে দৃষ্টি ফেলে একনজর চাইলেন।হিমেল উঠতে উঠতে বলল,

‘উহ! খেলা দেখছি আপু।দেখছিস নাহ?’

আমি সাইড ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিতে নিতেই বলে উঠলাম,

‘ এক মিনিট?তুই ই নাহ একটু আগে আমায় নিয়ে টেন্সড ছিলি?নিজের প্রতি যত্নশীল হব কিনা তাই নিয়ে?’

হিমেল এবার বিরক্ত নিয়ে বলল,

‘ তাই বলে কি তুই আমায় সময়ে অসময়ে বিরক্ত করবি? ‘

‘ বিরক্ত করছি?’

‘ অবশ্যই!উফস!তোর বিয়েটা হলেই বাঁচি।’

হিমেলের কথাটায় কেন জানি কান্না আসল আমার।অন্যদিন হলে মারপিট বেঁধে যেত এতক্ষনে আমাদের। কিন্তু আজ তা হলো নাহ।আমার নিজেকেই নিজের খুব বিরক্ত লাগছে।বাজেভাবে বিরক্ত লাগছে।যেন পৃথিবীতে এই মুহুর্তে আমার থেকে দ্বিতীয় কোন বিরক্তিকর জিনিস হতেই পারে নাহ।চোখজোড়া হালকা টলমল করল।পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম।অর্ক ভাই তখনই আম্মুকে বলে উঠল,

‘ আন্টি, দেরি হচ্ছে।ও একটু ফার্স্ট রেডি হলে ভালো হয়।’

আমি খেয়াল করে দেখলাম অর্কভাই আমার দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি।উনি সামনের দিকেই তাকিয়ে আছেন।আমি এতটা সময় হিমেলের সাথে কথা বললাম একবার ও চেয়ে দেখেননি।আমি হালকা শ্বাস নিয়ে বললাম,

‘ আমি রেডিই অর্কভাই।’

অর্কভাই এবারও তাকালেন নাহ।আম্মুর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলেই বেরিয়ে গেলেন উনি।আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ মেহুল সাবধানে যাবে।নিজের খেয়াল রেখো।নিচে অর্ক গাড়িতে অপেক্ষা করছে।যাও।’

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে নেমে এলাম।সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একটা কথাই ভাবছিলাম।অর্কভাই কেমন চুপচাপ হয়ে গেল না?তাকাচ্ছেন নাহ, কথা বলছেন নাহ, আবার উনার মতের বিরুদ্ধে কাজ করাতে রাগ ক্ষোভ কিংবা শাস্তিও দিচ্ছেন নাহ।কি হলো?উনার চুপ হয়ে যাওয়া কি ঝড়ের পূর্বাভাসেরই সংকেত?ঠিক যেমন ঝড় আসার আগে পরিবেশ নিরব থাকে তেমন?

.

বদ্ধ অন্ধকার রুম।ধূলো, ময়লায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার।পুরো রুম জুড়ে কেমন এক নিরবতা।আমি ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে ভয়ে ঢোক গিলছি।ঘামে চুপসে গেছে আমার শরীর।গলা শুকিয়ে আসছে অজানা ভয়ে। ঠিক তখনই আমার সামনে জ্বলে উঠল একটা হলদেটে বাতি।হলদে আলোয় তৎক্ষনাৎ আমার সামনে ভেসে আসল তিন তিনটে পরিচিত মুখ।সঙ্গে সঙ্গে কম্পন শুরু হলো আমার শরীরে।অসম্ভব ভাবে কাঁপছে আমার হাত পা।ভয়ে কলিজা কেঁপে উঠল ওদের মুখগুলো দেখেই। বছর দুই আগে ও ঠিক এভাবেই ভয় পেয়েছিলাম আমি। এভাবেই কলিজা কেঁপেছিল। আমি চোখজোড়া মিনমিন করে ওদের দিকে তাকাতেই ঝাপসা হয়ে আসল আমার দৃষ্টি।আবারও মনে পড়ে গেল সেই দুটো শব্দ,”ধর্ষিতা মেহুলতা” সাথে সেই টুকরো স্মৃতি।নাহ, নাহ, আমি ধর্ষিতা নাহ,কিছুতেই নাহ।চোখজোড়া দিয়ে অনবরত পানি গড়াতেই মনে হলো আমি জ্ঞান হারাচ্ছি।চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে আমার।ওই তিনটে মুখও আমার চোখে গোলাটে হয়ে আসছে। কেবল একটা শব্দই মাথায় ঘুরছে, “আমি ধর্ষিতা, ধর্ষিতা মেহুলতা।”

#চলবে…………………

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here