টুকরো স্মৃতির অতলে পর্ব -০১

‘একটা ধর্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করার এত আগ্রহ কেন আপনার অর্ক ভাই?দয়া দেখাচ্ছেন?আমার শরীরের প্রতিটা অঙ্গে এখনো ধর্ষণের চাপ রয়ে যায় নি কি?সদ্য বিয়ে করা বউ একজন ধর্ষিতা মেনে নিতে পারবেন আপনি?আপনি বরং দয়া না দেখিয়ে মত বদলান অর্ক ভাই।আমি নামক নারীটা থেকে দূরে থাকাটাই ভালো হবে আপনার জন্য।’

কথাগুলো অর্কভাইয়ের সামনে বলেই জোরে নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।আকাশে বেশ বড়সড় চাঁদ উঠেছে আজ।শীতের রাতের ঠান্ডা বাতাস শরীর ছুঁতেই ঠান্ডায় হাত পা জমে এল।সঙ্গেই চোখ টলমল করে উঠল অর্কভাইয়ের মুখে তাকিয়ে।কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে এক্ষুনিই বেরিয়ে আসবে হয়তো চোখ দিয়ে ।অর্কভাই নামক মানুষটাই বছর দুই আগে আমাকে একজন মানুষ বলেও গন্য করে নি।সমাজের কাছে অল্পের জন্য আমাকে ধর্ষিতার অপবাদ দেন নি।আর আজ সেই মানুষটাই বছর দুই পর হুট করেই বিয়ের জন্য দ্বিতীয়বার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে আমার পরিবারে?বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত লাগলেও আমি জানি আমার পরিবার এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে। কারণ অর্কভাই আমারই বাবার বন্ধুর গুণধর ছেলে।আমার বাবা মায়ের চোখে অর্ক ভাইয়ের মতো আদর্শ ছেলে আর দুজন হয় না। সবার সামনে ভদ্র, ভালো, আদর্শ এই লোকটিই কতটা খারাপ তা হয়তো আমার থেকে আর কেউ ভালো জানে নাহ।চোখ টলমলিয়ে কান্না গড়িয়ে আসতেই শক্ত চোখে তাকালাম আমি।কান্না দমিয়ে অর্ক ভাইয়ের শান্ত মুখে তাকিয়ে কোথাও অনুশোচনার রেশ ও খুঁজে পেলাম নাহ। না আছে কোন ভয় ভীতির চিহ্ন।তবে চোখে মুখে অদ্ভুত রাগের আভা স্পষ্ট।হাতজোড়া বুকে ভাজ করে রেখেই দাঁতে দাঁত চেপেই বলে উঠলেন তিনি,

‘ মেহুল শোন,আমি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে আসিনি।তোকে জাস্ট আমাকে বিয়ে করতে হবে।এন্ড একবছর পাক্কা সংসার করতে হবে!এরপর একবছর পর তোর যা ইচ্ছে করতে পারবি।ডিভোর্স কনফার্ম ঠিক একবছর পর।আন্ডারস্ট্যান্ড?’

আমি অবাক হয়ে তাকালাম।একটা মানুষ কতটা নিচ মেন্টালিটির হলে বিয়ে নামক পবিত্র বিষয়টিকে এতটা স্বস্তা ভাবতে পারে।তার চোখেমুখে অনুশোচনার লেশমাত্র না দেখেই বোঝা যায় সে বিয়েটা নিজের স্বার্থের জন্যই করছে।কিন্তু কি স্বার্থ?তা জানা নেই আমার।তবে স্বার্থটা যায় হোক উনি কতটা নিচ হলে স্বার্থের জন্য একটা মেয়েকে ব্যবহার করতে পারে।ঠিক কতোটা স্বার্থপর!একটা বছর কি কম সময়?আমি টলমলে চোখে ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়েই বললাম,

‘ কি মনে করেন আপনি আমায়?দুই পয়সার রক্ষিতা?স্বার্থ মিটে গেলেই সব শেষ?ধর্ষিতা বলেই কি আপনি নিজের স্বার্থে আমাকে এভাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অর্কভাই?’

অর্কভাই কিঞ্চিৎ ভ্রু বাঁকিয়েই বলে উঠলেন,

‘ তুই কি বুঝতে পারবি কখনো আমি তোকে কি ভাবি?আই মিন তুই আমার মনের কথা বুঝতে পারবি কখনো?পারবি নাহ।সো ওসব বাদ দে বরং।বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে যা।ওকে?’

রাগে এবার হাত পা কাঁপতে শুরু করল।মাথায় টনটন করে ব্যাথা নামল। অতিরিক্ত রাগে আর ঘৃণায় চোখ দিয়ে বয়ে চলল নোনতা পানি।উনার দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়েই শক্ত কন্ঠে বলে উঠলাম,

‘ আমি এই বিয়ে করছি নাহ।শুনেছেন আপনি?আপনাকে আমি মরে গেলেও বিয়ে করব নাহ মিঃ আহনাফ মাহমুদ অর্ক ।ধর্ষিতা বলে আমার মত প্রকাশের অধিকারও থাকবে নাহ এমন নয়।বিয়ে যদি কখনও করি তবে নিশ্চয় আমার মত অনুয়ায়ী। আপনাকে কোনদিনই নয়।তার প্রশ্নই আসে নাহ!’

অর্কভাই একনজরে আমার দিকে তাকিয়েই হাসলেন।হাসিটা দেখেই জ্বলে উঠল আমার শরীর, মন।বছর দুই আগে একটা মেয়ের জীবন আরেকটু হলেই ধ্বংস করে দিচ্ছিল।তার পৃথিবীটা অন্ধকার করে দিয়েছিলেন।ঠিক বছর দুই পরেই ঐ মেয়েটার সামনে এসেই ঠোঁট টেনে হাসতে বাঁধছে নাহ?বিবেক থাকলে হয়তো বাঁধত।

‘ধর্ষিতা মেহুলতা!সে যায় হোক এট এ্যানি কস্ট তোর বিয়ে আমার সাথেই হচ্ছে মেহুল!এবার মেনে নেওয়া বা না নেওয়া সম্পূর্ণটা তোর ব্যাপার!আশা করি তুই আমাকে জানিস এবং চিনিস।সো বুঝতে পারছিস আহনাফ মাহমুদ অর্ক একবার যা বলে তা করেই ছাড়ে।এন্ড ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল মিস মেহুলতা!’

অর্ক ভাইয়ের কথা গুলো শুনেই আমি ক্ষ্রিপ্ত চাহনিতে তার দিকে তাকালাম।অর্ক ভাইয়ের মুখের হাসিটা আবারও চটাফট জ্বালিয়ে তুলল আমার শরীর।একজনকে কাঁদিয়ে কি সুন্দর হাসছে!অদ্ভুত!লোকটার বিবেক বলে কি আধো কিছু আছে?চোখজোড়া দিয়ে অর্ক ভাইয়ের দিকে তাকিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলাম,

‘ শাট আপ!জাস্ট শ্যাট আপ অর্কভাই।আমি ধর্ষিতা মেহুলতা নই। নই আমি’

‘ তুই সবটা মেনে নিলি এত সহজে।অথচ আমি বলাতেই…’

অর্কভাইকে বাকিটা বলতে না দিয়েই আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,

‘ চুপ!একদম চুপ।চুপ থাকুন আপনি অর্কভাই।’

অর্কভাই স্বাভাবিকই রইল।আমার চিৎকার করায় বা বলা কথাগুলোয় উনি এতটুকুও রিয়েক্ট করলেন নাহ।মিনমিনে চোখে একনজর তাকিয়েই নিজের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।আমি বার কয়েক উনার দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম।জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করেই বলে উঠলাম,

‘ আমার নাম মেহুলতা নয় অর্কভাই। শুনেছেন? দ্বিতীয়বার যদি আপনি আমায় এই নামে ডাকেন আমি বাধ্য হবো আপনার আসল মুখোশ সবার সামনে তুলে ধরতে।’

অর্কভাই শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েই বাঁকা হাসলেন।ছাদের রেলিংয়ে যেখানটায় আমি দাঁড়িয়ে ঠিক সেখানেই আমার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দুইহাত রেলিংয়ে রাখলেন তিনি।আমার দিকে কিছুটা ঝুকে মুখের কাছাকাছি মুখ এনেই বাঁকা হেসে বলে উঠলেন,

‘ সিরিয়াসলি?বাট ইউ নো হোয়াট মেহুলতা?ইউ কান্ট ডু দিজ।ইউ কান্ট ডু দিস মিস মেহুলতা।’

অর্ক ভাইয়ের লম্বা চওড়া শরীর আমার থেকে ঠিক অল্প কয়েক ইঞ্চিই দূরে।উনার নিঃশ্বাস হালকা হলেও ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার কপাল।আর এই নিঃশ্বাসের ছোঁয়াছুঁয়িতেই অস্বস্তি আর বিরক্তিটা আমার আকাশ ছুঁলো।ক্ষ্রিপ্ত কন্ঠেই বললাম,

‘ সরে দাঁড়ান অর্কভাই।’

‘ না সরলে?কি করবি তুই পুঁচকো?’

আমি রাগে হাঁসফাস করে উঠলাম তৎক্ষনাৎ।অতিরিক্ত রাগ আর কষ্টে চোখ দিয়ে টপাটপ পানি পড়ছে এখনও।যে মানুষটাকে সহ্য করতে পারি নাহ, দুই দুইটা বছর কেবল ঘৃণা করে এসেছি। সে মানুষটাই হঠাৎ এতগুলোদিন পর কেন আবার!কেন?স্বার্থ! সবটাই স্বার্থের জন্য করছে অর্কভাই আমি জানি।তবুও বাবা মাকে বলার মতো আমার কাছে কোন কথা নেই।কিইবা বলব আমি?বিয়েটা ভাঙ্গার মতো শক্ত কোন প্রমাণ যে আমার হাতে নেই।বাবা মা হয়তো বিশ্বাসই করবে নাহ আমার কথা।এই বয়সে বিয়ে করতে চাই নাহ তাই হয়তো মিথ্যে বলছি, এমনটাই ভেবে নিবে আমার বাবা মা।কিন্তু সত্যিই যদি আসলেই বুঝত বিয়েটা ভাঙ্গা কতোটা জরুরী।তবে সামনের এই লোকটির সাথে আমার জীবন জড়াত নাহ।নতুন করে আবারও ধ্বংস হতো নাহ আমার জীবন।কোনভাবেই নাহ।আমি অস্বস্তিতে নিঃশ্বাস ছেড়েই বলে উঠলাম,

‘ সরুন অর্কভাই।মেয়ে দেখলেই এত গায়ে পড়া স্বভাব কেন আপনার?ইচ্ছে হলে যেসব মেয়েকে টাকা দিয়ে কেনা যায় সেসব মেয়ের সাথেই গিয়ে সময় কাঁটান না।তারা তাদের শরীর এমনিতেই দিয়ে দিবে।আপনাকে এত ঢলাঢলি করতে হচ্ছে নাহ তাহলে।কিন্তু আমার সাথে গায়ে পড়া স্বভাব দেখাতে আসবেন নাহ। একদমই নাহ।’

অর্কভাইয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে এল এবার।চোখেমুখে কঠিন রাগ জ্বলজ্বল করে উঠল।উজ্জ্বল ফর্সা মুখ হঠাৎ করেই রক্তিম হয়ে উঠল।শার্টের হাতা ঠিক করে মাঝখানের কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব টুকুও কমাতে থেকেই বলে উঠলেন তিনি,

‘ গায়ে পড়া স্বভাব?মেয়ে দেখলেই গায়ে পড়ি?ওকে!তোকে দেখাব আজ গায়ে পড়া স্বভাব ঠিক কতটুকু আমার!সেকেন্ডলি টাকা দিয়ে শরীর কেনা যায়।তাহলে তোকে কিনে নি মেহুল?শরীর তো তুইও দিবি তাহলে তাই না?’

‘শাট আফ অর্কভাই,মুখ সামলে কথা বলুন!’

কথাটা বলেই নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে অর্কভাইকে ধাক্কা দিতেই ঢিলে হলো রেলিংয়ে থাকা উনার হাতের বাঁধন।তৎক্ষনাৎ উনার হাতের ফাঁক দিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেই জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লাম।তারপর পেছন ফিরে দৌড় লাগাতে নিতেই অর্ক ভাই হাত টেনে ধরলেন।পেছনদিকে না ফিরেই নিজের হাতটা ছাড়ানোর উদ্দেশ্যে টানতে লাগলাম আমি। কিন্তু অর্কভাইয়ের ছাড়ার কোন প্রতিক্রিয়া না দেখেই ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে তাকালাম আমি।তেজ নিয়ে হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম,

‘ হাউ ডেয়ার ইউ অর্ক ভাই?আমাকে টাচ করার সাহস হয় কি করে আপনার?’

উনি প্রতিউত্তরে কিছুই বললেন নাহ।যেন কথাগুলো তার কানপর্যন্ত গেলই নাহ।আগের মতোই নির্বিকার চাহনিতে তাকিয়ে হাসছেন।যে হাসিটা দেখলেই আমার গায়ে জ্বালা ধরে।রাগে ঘৃণায় ভেতরটা থিতিয়ে উঠে উনার এই হাসিটা দেখলে।আমি কয়েক মুহুর্ত হাত ছাড়াতে চেয়েও যখন ব্যর্থ হলাম তখন চুপ মেরে দাঁড়িয়ে গেলাম।উনার মুখ চাহনিতে তাকিয়েই করুণ কন্ঠে বললাম,

‘ হাত ছাড়ুন।’

‘ছাড়ছি নাহ।’

উনার সোজা উত্তরে রাগে ফোসফাস করে উঠলাম আমি।পা দিয়ে উনার পায়ে সজোরে লাথি মেরেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।ভেবেছিলাম লাথিতে উনি ব্যাথা পেয়ে হাতের বাঁধন ঢিলে করবেন অথবা ছেড়ে দিবেন।কিন্তু ছাড়লেন নাহ তিনি।একইভাবে হাত চেপে ধরেই রক্তলাল চক্ষু নিয়ে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি কয়েক মুহুর্ত তার সেই লাল চোখজোড়ার দিকে তাকিয়েই ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম।মৃদু কন্ঠে বললাম,

‘ অর্কভাই ব্যাথা লাগছে।’

‘ লাগুক!ব্যাথা লাগার জন্যই ধরেছি।’

উনি আরো জোরে চেপে ধরলেন হাত।ব্যাথায় দাঁত চেপে রেখে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করতেই চোখ দিয়ে টপাটপ পানি গড়াল। ব্যাথায় কাঁতরে উঠলাম আমি।অস্ফুট স্বরেই বললাম,

‘ অ্ অর্ক ভাই সত্যিই ব্যাথা লাগছে।’

অর্কভাই কয়েক সেকেন্ড তাকালেন।তারপর কি বুঝেই হাত ছেড়ে দিলেন।আমার দিকে আর না তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই আমি পেছন থেকে বলে উঠলাম করুন স্বরে,

‘দাঁড়ান অর্কবাই, আমি কি ক্ষতি করেছি আপনার?কেন আমিই প্রত্যেকবার আপনার স্বার্থের সাথে জড়িয়ে যাই?কেন?এসব কি সত্যিই আমার প্রাপ্য ছিল অর্কভাই?কোন অপরাধের মাশুল?কি ক্ষতি করেছি আমি?’

অর্কভাই পেছন ফিরে চাইলেন না দ্বিতীয়বার।কেবল দাঁড়িয়ে পড়লেন।তারপর ঘটঘট করেই বললেন,

‘ কে বলেছে তুই আমার ক্ষতি করেছিস?উহ!ক্ষতি করিস নি তো।কিন্তু তোর দোষ এটাই যে তুই আড়াইবছর আগে হুট করেই আমায় চিনতে পারলি।এই চিনতে পারাটাই আমার জীবনের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।আর আমি আমার জীবনের কাঁটাগুলো খুব সহজে হয়তো মিশিয়ে দি গুড়োগুড়ো করে নয়তো উঠিয়ে নি।

‘ মানে?’

‘ তুই ছোট!অতো মানের অংক তুই না বুঝলেও চলবে।জাস্ট যেভাবে চলছে মেনে নে।যদি আমার প্ল্যানে কোনভাবে বাঁধা দিস তো আমার থেকে খারাপ কিন্তু কেউ হবে নাহ মেহুল!মাইন্ড ইট!’

কথাগুলো অর্ক ভাই কঠিন কন্ঠেই বললেন।কি সুন্দর হুমকি দিয়ে দিলেন উনি।তার হুমকিতে আমার হৃদয় কেঁপে উঠলেও কিছুতেই বুঝানো যাবে না আমি ভয় পেয়েছি।ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়েই ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম।দম নিয়েই বলে উঠলাম,

‘ আপনার হুমকিকে আমি ভয় পাচ্ছি নাকি অর্কভাই?’

অর্কভাই পেছন ফিরে চাইলেন এবার।ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলেন,

‘ আহনাফ মাহমুদ অর্কের হুমকিতে ভয় পাবি নাহ তুই?হাস্যকর!তোর চোখমুখে স্পষ্ট এখনো সেই ভয়, কান্না, সব!ঠিক দুইবছর আগের মতোই।’

‘ অর্কভাই!’

‘ দ্যাটস ট্রু মেহুলতা!’

আমি এবার দ্বিগুণ বেগে কেঁদে দিলাম।চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে।উনার দিকে তাকিয়েই আকুতির স্বরে বললাম,

‘ অর্কভাই, আমি চাই না আপনি নামক মানুষটার সাথে আমার বিয়ে হোক।কখনোই চাই নাহ।আপনার মতো একটা মানুষ আমার জীবনসঙ্গী হোক আমি চাই নাহ।প্লিজ! আমার আর আপনার বিয়েটা আটকে দিন অর্কভাই।প্লিজ!আমি চাই না আপনি নামক মানুষটার সাথে আমার আর দেখা হোক, আর কথা হোক।চাই নাহ আমি।’

অর্কভাই কথাগুলো সেভাবে নিলেনই নাহ বোধ হয়। পরনের জ্যাকেটের কলার ঝারতে ঝারতেই বললেন,

‘তোর কি মনে হয় আমি অতোটা ভালো মেহুল?এই চিনলি আমায়?সো স্যরি ফর দ্যাট মেহুল।আমি অতোটাও ভালো নাহ যে তোর কথামতো অনুরোধ গুলো রাখব।আমি খুব ভালো করেই জানি তুই আঙ্কেল আন্টিকে এই বিয়েতে না করতে পারবি নাহ।সো বিয়েটা হচ্ছেই।এর বাইরে বাকি সব চিন্তা ঝেড়ে নে।আগামী সপ্তাহে তোর আর আমার বিয়ে।বিয়ের প্রস্তুতি নে। আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট? ‘

‘অর্ক ভাই, প্লি প্লিজ।’

‘ স্যরি! আহনাফ মাহমুদ অর্ক নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কারো রিকুয়েস্ট রাখে নাহ।তোর যদি এই বিয়েতে এতই আপত্তি তো আই প্রমিজ,বিয়ের একবছর পর তুই তোর রাস্তায় আমি আমার রাস্তায়।বাট বিয়েটা হচ্ছেই।’

কথাটা বলেই অর্কভাই পিছু হাঁটলেন।আমি চেয়ে রইলাম তার যাওয়ার দিকে।একটা বিয়ে তার কাছে এমন খেলনা?সিঁড়ির দরজা দিয়ে পেরিয়ে একের পর এক সিঁড়ি পেরিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আমি সেদিক পানে তাকিয়েই দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললাম।সত্যিই দুইবছর আগে তাকে না চিনলে আজ আমাকে এই দুর্দশার সম্মুখীন হতে হতো নাহ।ভার্সিটিতে তখন আমি নতুন।অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী।অর্ক ভাই তখন আমার ভার্সিটির মাস্টার্সে পড়ুয়া সিনিয়র ভাই।ভার্সিটিতে এডমিট হওয়ার ছয়মাসেও আমার সাথে তার পরিচয় হয় নি।ছয়মাস পরই অনাকাঙ্খিত ভাবে একদিন লাইব্রেরিতে তার সাথে দেখা হয়েছিল।বাবার মোবাইলে প্রায়সয় উনার ছবি দেখা হতো।তাছাড়া ছোটবেলায় উনার সাথে আমার একপ্রকার সখ্যতাও ছিল।পরবর্তীতে অবশ্য উনাদের বাসায় তেমন যাওয়া হতো নাহ বলে দূরত্ব বেড়েছিল। তবুও উনাদের পুরো পরিবারকেই ভালোভাবে চিনতাম উনি ব্যাতীত।সেদিন উনাকে দেখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে পরমুহুর্তেই যখন উনার এক বন্ধু উনাকে অর্ক বলে ডাকলেন তখনই শিউর হলাম এই সেই বাবার বন্ধুর ছেলে অর্ক ভাই।ভদ্রতার খাতিরেই সেদিন তাকে সালাম জানিয়েছিলাম।কে জানত সেদিনের পরিচয়ের রেশ আমাকে আজও বইতে হবে।ভার্সিটিতে উনার শেষ যেদিন ছিল সেইদিন পর্যন্ত উনি আমায় কাঁদিয়েছেন,জ্বালিয়েছেন।মাঝখানের দুইবছর বেশ ভালোই কেটেছিল আমার।কিন্তু আবারও সেই একই মানুষটাই হঠাৎ আমার জীবনে এসে হাজির!

.

ভোর চারটা!

মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল তৎক্ষনাৎ।মাথা ঝিমঝিম করছে।তবুও চোখজোড়া টানাটানা করে মেলতেই মোবাইলের স্ক্রিনে রায়হানের নাম্বারটা দেখেই উঠে বসলাম।উপরে থ্রি মিসড কল লেখা ভাসছে।রায়হানই কল দিয়েছিল।ঘুমে টের পাইনি হয়তো।চতুর্থবারে ঘুমটা ভেঙ্গেই গেল।কল রিসিভ করে কানে নিতেই রায়হান ওপাশ থেকে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,

‘ শুভ সকাল মেহুলরানী!উঠে তাড়াতাড়ি আমার এসাইনমেন্টটা কম্প্লিট করে ফেলুন।জাগিয়ে দেওয়ার জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ দিবেন।মনে করিয়ে দিলাম।’

আমি চোখ বড়বড় করে চেয়ে চোখ বন্ধ করলাম আবার।ব্লাঙ্কেটটা গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে বালিশে মাথা রাখলাম।মৃদু স্বরে বললাম,

‘ তোর এসাইনমেন্ট হয়ে যাবে।তার জন্য এত সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গানোর কোন প্রয়োজন ছিল নাহ ফাজিল!প্রায় কম্প্লিটই হয়ে আছে।বাকিটা ঘুম থেকে উঠে করব।বাই।’

রায়হান সরু কন্ঠেই বলল

‘ করবি তো?’

আমি বিরক্ত হলাম।কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললাম,

‘ একদমই করব নাহ।তোর চাকর আমি?প্রত্যেকবার তোর এসাইনমেন্ট আমিই কেন করব? হয়েছে?’

‘মেহুল, প্লিজ, আজকেই এসাইনমেন্ট শো করা লাগবে।প্লিজ করে আনবি। তার বিনিময়ে তুই যা চাস তা পাবি।’

আমি ঘুমঘুম কন্ঠেই বললাম,

‘ করব নাহ যখন বলেছি করব নাহ।’

রায়হান ওপাশ থেকে অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ প্লিজ দোস্ত।’

আমি পিক করে হেসে দিলাম।তারপর টানটান গলায় বললাম,

‘ ওকে। আমি যা বলব তাই করতে হবে পরে, আই মিন যা চাইব তাই দিতে হবে।মনে থাকবে? ‘

কথাটা বলেই কল কাঁটলাম।পরপরই আরেকবার রিংটোনের আওয়াজে বিরক্ত হলাম আমি।কপাল কুঁচকে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়েই আননোন নাম্বার দেখে বিরক্তে চোখ মুখ কুঁচকে নিলাম।বিরক্ত নিয়ে কলটা কেঁটে মোবাইল অন্যপাশে ছুড়ে রাখলাম তৎক্ষনাৎ।

.

দুইদিন পর,

তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁইছুঁই।ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা তিন সংখ্যা বরাবর।আকাশ ছোঁয়া রোদে চোখ রাখতেই দৃষ্টি সরু হয়ে এলো আমার।কপাল কুঁচকে আসল তৎক্ষনাৎ।অদূরে ক্যন্টিনে মেঘা বসে। হাতে তার কফির মগ।মাঠের এদিকটায় কেবল কাঠফাঁটা রোদের আভির্বাব।আমি কয়েকনজর তাকিয়ে মেঘার দিকে পা বাড়াতেই দৌড়ে আসল রায়হান।আমার সাথে পা চালিয়েই বলে উঠল,

‘ দোস্ত আজ আড্ডা দিবি আমাদের ছাদে?আমার বার্থডে আজ!উইশও করলি নাহ।যায় হোক মেঘা রাজি।তুই রাজি হলেই পার্টি কনফার্ম!’

আমি চোখের চাহনি রায়হানের দিকে রাখতেই সে একগাল হাসল।ফর্সা চিপচিপে গড়নের শরীরে চেকের শার্ট।কপালের চুল ঘামে লেপ্টে পড়েছে কপালে।আমি একনজর তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসেই বললাম,

‘ তাহলে তোদের পার্টি সম্পূর্ণ আমার উপর নির্ভর করছে রায়হান?’

রায়হান মৃদু হেসে লম্বা পা ফেলে বলল,

‘ ইয়েস। তাড়াতাড়ি আয় ।’

বলেই তাড়াতাড়ি পা ফেলে ক্যান্টিনে ডুকল রায়হান।আমি আগের মতোই পা ফেলে ক্যান্টিনের দরজায় পৌঁছুলাম।চারকোণা টেবিলের পাশে রাখা চারটে চেয়ার,তারমধ্যে দুইটি চেয়ার খালি।বাকি দুইটিতে মেঘা, রায়হান বসা।দু পা বাড়িয়ে চটফট বসে পড়তেই মেঘা বলে উঠল জটপট,

‘ ঐ দেখ,’

আমি দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে যাব ঠিক তখনই আমার থেকে কিছুটা দূরে দেখতে পেলাম অর্ক ভাইকে।ভার্সিটিতে বছর দুই হলো আমি অর্ক ভাইকে দেখিনি।কিন্তু হঠাৎ অর্ক ভাইকে ভার্সিটির ক্যান্টিনে দেখেই ভ্রু কুচকে তাকালাম।পাশে অতি সুন্দরী রমণী ইশা আপু।অর্ক ভাইয়ের প্রেয়সী।দুইজনকেই বছর দুই ভার্সিটির চত্ত্বরে দেখিনি আমি।এমন কি অর্ক ভাইয়ের সাথে দুইবছর পর দুইদিন আগেই দেখা হয়েছিল আমার।আমি চোখ ছোটছোট করে কফিতে চুমুক দিতে দিতেই আড়চোখে তাকালাম তাদের দিকে।কাউকে খুঁজছেন হয়তো।আমাদের টেবিলের দিকে মাথা ঘুরাতে নিতেই আমি সামনের ম্যাগাজিনটা মেলে ধরলাম মুখের সামনে।উদ্দেশ্য আমার মুখ যাতে তারা দেখতে না পায়!

#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤️
#সূচনা_পর্ব
লেখনীতে: আহানিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here