অনুতাপ পর্ব -২৩+২৪

#অনুতাপ
#ত্রয়োবিংশ_প্রহর #Yasira_Abisha (#Fatha)

একা জীবন কাটানো বেশ কঠিন, রুহি আগে বুঝতে পারতো না কিন্তু এখন ঠিকি বুঝতে পারে। ইরাদ ওকে রেখে যাওয়ার পরে যেখানে যেখানে ইরাদের স্মৃতি আছে, সেসব জায়গা রুহি ত্যাগ করেছে। রুহি আজও ঠিক তেমনি ভালোবাসে ইরাদকে যতটা আগে ভালোবাসতো। যদিও যোগাযোগ নেই কোনোভাবেই তবুও ভালোবাসা তো শেষ হবার নয়। কারণ রুহি যখন থেকে ভালোবাসা বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই ওর ধ্যানে জ্ঞ্যানে ইরাদ ছিলো। আজকে রুহি ২ মাস পরে সিলেট যাচ্ছে, ইন্টার্নি শেষ করে রুহির আর ঢাকা যায়নি। সিলেটে হাসপাতালে রুহির নতুন জয়েনিং কাল থেকেই আজ তাই সকাল বেলায় রুহির ফ্লাইট আছে।

বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যে রুহি সিলেট চলে এলো। রুহি বাসায় আসার খুশিতে ওর খালা খালু সবাই মিলে ওকে বরণ করে নিলো, আর আজ না এলেও রুহির খালা অর্থাৎ মেঘার মা শান্তি পেতেন না। মেয়েটাকে কিছুদিন পরপর এক নজর না দেখলে সে থাকতেও পারেন না। আর কিছুই ক্ষনই তো মেয়েকে কাছে পাবেন উনি কারণ আজকে রাতেই মেঘার ও মা মিলে সিংগাপোর যাবেন মেঘার শাশুড়ীকে নিয়ে উনার অসুস্থতার জন্য। আর আগেভাবেই ওখানে সবকিছু ঠিক করে রেখেছে দিবা সেখানে। কারণ শত কাজই থাকুক না কেনো নিজের মায়ের চিকিৎসা করানোর জন্য মেয়ের তো সাথে যাওয়াই লাগে। অবশ্য এই ডাক্তারের খোজ রুহিই এনে দিয়েছে তাদের।

সারাদিন খালা আর বোনের সাথে পার করার পরে রুহি তাদের বিদায় দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। খালু এখনো বাড়ি ফিরেনি কাজে বাইরে আছেন, এইজন্য রুহি ওপরে চলে এলো ওর ঘরে এবং এসে গোসল করে হলুদ আর লাল একটা জামা পরে বসে রইল অজি চেয়ারে, বাইরে আবহাওয়াটা আজকে বেশ পরিমাণে গরম ছিলো রুহি ঘরটা ঠান্ডা করার জন্য উঠে গিয়ে জানালাটা লাগালো দরজা আটকে দিলো, আলমারি থেকে এসির রিমোটটা নেওয়ার জন্য একটা পাট খুলতেই এসির রিমোটের নিচে ইরাদের টিশার্টের দিকে নজর যায় রুহির। এটা ও রাতারগুলের ট্রিপ থেকে নিয়ে এসেছিলো। কেনো যেনো কলিজার ভেতরে একটা কামড় দিয়ে বসলো। এই সিলেটের সাথে তো রুহির বেড়ে ওঠা, ওর প্রেম ওর ইরাদের কাছে নিয়ে আসা, এবং এখান থেকেই বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া ওদের। কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
অনেক দিন পর রুহি সিলেট এসেছে, ইরাদকে ছাড়া এখন আর আগের মতো হাসি পায় না কিছুতেই। মেয়েটা যতটা হাস্যজ্বল ছিলো ঠিক ততটাই চুপচাপ থাকে এখন, এমন নয় রুহি গম্ভীর হয়ে গেছে তবে আগের মতো মন থেকে হাসি পায় না। সবার সামনে হাসে ঠিকি কিন্তু প্রতি রাতে একটা চাপা কষ্ট ওর মনে ধরে। আজকে এই রাতটা তো ও ইরাদের বুকে মুখ গুজেও কাটিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস? রুহি আজকে একদম একা। মেঘা অনেক চেষ্টা করেছে রুহির এই একাকিত্ব দূর করতে তবে এই একাকিত্ব ঘুচবে কি করে?রুহি যে হাজারো চেষ্টা করে ইরাদের জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারে না। এই লোকটা সব কিছুই যে রুহির মনে এক অন্যতম জায়গা দখল করে রেখেছে৷ রুহি ভেবে নিয়েছে ইরাদ না থাকলে নাই, ওর স্মৃতি গুলো জড়িয়ে নিজেকে ঘিরে রাখবে ও। আর কারো দরকার নেই এই জীবনে। সকালে নতুন হাসপাতালে ওর জয়েনিং শুরু হবে। এখন ঘুমিয়ে যাওয়াটাই ভালো ইরাদের টিশার্টটা নিজের বুকে নিয়ে রুহি ঘুমিয়ে গেলো। মাঝ রাতে হঠাৎ করেই রুহির ঘুম ভেঙে গেলো, গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো আশেপাশে ইরাদ আছে, রুহির কাছে আছে ও। পরক্ষণেই মনে হলো
” উনার টিশার্টটা কাছে তাই হয়তো বা মনে হচ্ছে উনিই আমার কাছে”
রুহি ঘুমিয়ে পড়লো আবারো।

.

সকাল বেলা রুহি ঘুম থেকে উঠে একবারে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে চলে এলো এবং এসেই পাপা কে খোঁজ করতে শুরু করে,
সামনে কাজের মেয়ে টুনি পড়তেই ওকে জিজ্ঞেস করে,
– পাপা কোথায়?
– বড় সাহেব ঘুমায়
রুহি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১০টা বাজে,
– এই সময় পর্যন্ত কোনোদিন ও পাপা ঘুমায় না।
– না মানে আপা
টুনি আমতা আমতা করছে দেখে রুহি ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কিছু হয়েছে?
– কালকে বড় সাহেব এক্সিডেন্ট করসিলো আপা। এইজন্যই এখন ঘুমায়।
রুহি সাথে সাথে হকচকিয়ে উঠে
– এক্সিডেন্ট মানে?
– হুম আপা পায়ে ব্যাথা পাইসেন অনেক
– আমাকে ডাকিস নি কেনো?
– অন্য একজন সাহেব আসছিলো উনিই স্যারের সাহায্য করসিলেন আর উনি ডাক্তার ও ছিলেন তাই বড় সাহেব বলসে আপনাকে না জাগাইতে ঘুম থেকা।
রুহি খুব চিন্তায় পড়ে যায় ওর খালুর জন্য। কারণ এই মানুষটাকে ও নিজের আপন বাবার মতো ভালোবাসে। রুহি তাড়াতাড়ি করে তাকে দেখার জন্য ঘরে চলে যায়। রুহিকে দেখে সোবাহান সাহেব উঠে বসেন,
– আরে মা আয়
– পাপা তোমার পায়ে কি হয়েছে দেখি?
-ডান হাতটা খানিকটা ছিলে গেছে,
রুহি দেখলো ঠিকি বলেছে উনি,
– আমাকে ডাকো নি কেনো পাপা? কিছু মেডিসিন তো নিতে হবেই।
– মেডিসিন নিয়েছি তো।
এই যে দেখ
এই বলে রুহিকে মেডিসিন বক্স এগিয়ে দিলো সোবহান সাহেব।
রুহি দেখলো সব গুলো ঠিক মেডিসিনই দেওয়া হয়েছে তাকে এবং পায়ে ঠিক মতোই ব্যান্ডেজ করা আছে।
– পাপা এগুলো?
– যে আমায় প্রাণে বাচিয়েছিলেন সেই কাল আমার জীবনে দূত হয়ে এসেছিলেন
– মানে?
-একজন ডাক্তারের সাথে দেখা হয়েছিলো, আজকে তার কারণেই আমার জীবন বেচে গেছে।
– কিভাবে পাপা?
– কাল আমি যখন সিলেট ঢুকি আমার গাড়ির ড্রাইভার হার্ট এট্যাক করে তখন গাড়িতে আমি আর সেই ছিলাম তখন আমি এয়ারপোর্টের দিকে। ঠিক তখনই একটা বড় গাছের সাথে গাড়িটা বাড়ি খায়। তখন আমি বেড় হয়ে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় পেছন থেকে একটা বাস আসছিলো খেয়াল করিনি যদি ওই ভদ্র লোক না থাকতেন তাহলে আমি আজকে মারাই যেতাম সে আমার হাত টেনে ধরে যার ফলে মাটিতে পড়ে যায় অন্য সাইডে তখনই হাতটা ছিলে যায়। এবং উনি আমাদের ড্রাইভারকে নিয়ে সোজা হাসপাতালে যান আমিও ছিলাম সেখানেই আমার ট্রিটমেন্ট এবং ড্রাইভারের ট্রিটমেন্ট ও করেন৷ এতো বড় একজন ডাক্তার উনি, উনি ঢুকার সাথে সাথে পুরো হাসপাতাল ভরে তাকে সালাম দেওয়া শুরু করে গিয়েছিলো। নেহাৎ একজন ভালো মানুষ, বিন্দুমাত্র গরিমা নেই তার মনে তার চেহারায় তা স্পষ্ট ফুটে উঠছিলো। এবং রাতে সেই আমাকে বাড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন।
– আচ্ছা পাপা আমি খাবার পাঠাচ্ছি, তুমি খাবার খেয়ে এখন ঘুমাও, আজকে পুরো রেস্টে থাকবে। আর আমাদের ড্রাইভার কোন হাসপাতালে আছেন?
– সিলেট মেডিকেলে।
– আমার ও তো আজ থেকেই জয়েনিং ওখানেই। তাকে আমি দেখবো তুমি চিন্তা করো না
– ঠিক আছে মা তুই খেয়ে তারপর যাস কিন্তু।
-ওকে পাপা।

রুহি মনে মনে আল্লাহ কে অনেক শুকরিয়া করলো আর সেই অচেনা ডাক্তারকেও। আজকে উনি ছিলো বলে দুটো প্রাণ বেচে গেলো। প্রথম দিন রুহির বেশ ভালোই কাটলো, ড্রাইভার সাহেব ও এখন ভালো আছেন। তাকে দেখে তো এলো রুহি কিন্তু কোন ডাক্তার চিকিৎসা করেছে তা জিজ্ঞেস করতে আর খেয়াল ছিলো না।
বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে এমন সময় এসব মনে পড়ে আর পাপার চকলেট পেস্ট্রি কেক খুব পছন্দ, আজকে পাপা যেহেতু বাসায় আছেন তাই সেক্ষেত্রে রুহির ইচ্ছে হলো আজ পাপার জন্য পাপার পছন্দের শপ থেকে কেক নিয়ে যাবে ও। যেই কথা সেই কাজ।
রুহি কেক নেওয়ার জন্য শপে গেলো, বেশ ভিড় ছিলো আজকে প্রায় দুটো রো তে ভাগ হয়ে অর্ডার করতে হচ্ছে সবকিছুই। রুহির একটা কেক পছন্দ হয়। ঠিক তার পাশে খুব সুন্দর করে একটা লাল কালারের কেকের মধ্যে
“2 yrs of Togetherness
I love you Baby” লিখা
রুহি কেকটা দেখে মুচকি হাসলো, নিশ্চিত কোনো কাপলের এই কেকটা যেহেতু তিন’দিন বাদে ভ্যালেন্টাইন্স ডে। এমন সময় রুহি নিজের কেক নিয়ে কথা বলতে ব্যাস্ত এবং পাশ থেকে চিরচেনা কন্ঠে ভেসে এলো
– বিল টা কতো এলো?
আওয়াজটা শুনে রুহির কলিজা ধুক করে ওঠে,
রুহি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে মনের ধারণাটাই ঠিক, পাশের ছেলেটা ইরাদ৷ নীল একটা শার্ট পড়ে দাড়িয়ে আছে ও। রুহি ওকে দেখে তাকিয়েই আছে, এটা সত্যি কি মিথ্যা রুহির মাথায় আসছে না।
পাশ থেকে ইরাদ রুহিকে দেখে নিজেও অবাক হয়ে যায়। রুহি কোনো কথা বলছে না,
ইরাদ ও রুহিকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে৷ আজ তিন বছর পর এই চেহারাটা ইরাদ কত কাছ থেকে দেখছে। ওদের ঘোর ভেঙে গেলো ওয়েটারের কথায়।
-ম্যাম আপনার বিল ১৫৪০টাকা
রুহি টাকাটা দিয়ে ইরাদকে দেখে আর কিছু বললো না,
– রুহি কেমন আছেন?
রুহি খুব কষ্টে নিজের চোখের জল আটকে বললো,
-ভালো, আপনি?
– আমিও ভালো আছি
– সিলেটে?
– হুম কাজে এসেছি বাংলাদেশে কিছুদিন হলো
– আপনি?
– আমিও কাল এসেছি
– বিয়ে করেছেন?
ইরাদের এমন প্রশ্ন রুহি একদম এক্সপেক্ট করে নি৷ কিছুটা হকচকিয়ে উঠে ও। ইরাদের কেকটা দেখে রুহির খুব খারাপ লাগে। কেনো যেনো যেই মানুষটার জন্য ও এভাবে একা জীবন পার করে যাচ্ছে তাকে বলতেও ইচ্ছা করলো না,
” না করিনি বিয়ে, তোমার প্রতি আমার কোনো মোহ ছিলো না। ভালোবাসা ছিলো আছে আর হ্যাঁ থাকবে। আর হ্যাঁ আমি একা আছি, পেরেছি তোমায় ছাড়া নিজেকে গুটিয়ে নিতে”
তাই রুহি বললো,
– হুম বিয়ে করেছি। আচ্ছা আমি আসি আজকে একটু তাড়া আছে।
এই বলে রুহি প্রস্থান করে আর এক মিনিট ও না দাড়িয়ে।

আর এদিকে প্রায় তিন বছর পর ইরাদ বাংলাদেশে ফিরেছে। রুহির চলে যাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো ইরাদ,
” হুম বিয়ে করেছি। ”
কথাটা বারবার কানে বারি খাচ্ছিলো ইরাদের, কলিজার ভিতরটা কেমন যেনো লাগতে শুরু করে। এক হাহাকার এক রাশ শূন্যতা ঘিরে ধিরে মনের মাঝে।
#অনুতাপ
#চতুর্বিংশ_প্রহর #Yasira_Abisha (#Fatha)

” হুম বিয়ে করেছি। ”
রুহির মুখে এমন কিছুই ইরাদ আশা করেছিলো, সে চাইতো রুহি জীবনে আগে বাড়ুক। নতুন করে বাচুক, অল্প বয়সের মোহ তে না থাকুক। মেঘা আর ইরাদ যে ভুল করেছিলো সেটা যেনো রুহি না করে কারণ আর বিচ্ছেদ ইরাদ নিতে পারবে না। রুহিকে যে ইরাদ বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে। এখন ওকে ছাড়া কোনোমতে থাকতে পারছে যদি মেয়েটা সবটুকু দিয়ে ইরাদের হয়ে তারপএ দূরে যেতে চায় তাহলে তো ইরাদের আএ বাচা সম্ভব হতো না। নিজেকে ভেঙে গেলে একবার গড়া যায়, কিন্তু বারবার কি তা আদও সম্ভব হবে? নাহ সম্ভব হবে না। তাই তো রুহি ইরাদের প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করার পরে ইরাদ তা সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান করে দেয় আর চাইতো রুহি এই মোহ থেকে বেড়িয়ে আসুক তাদের বয়সের ব্যাবধান ১৩-১৪ বছরের ইরাদ এখন প্র‍্যাক্টিক্যালি চিন্তা ভাবনা করতে পারে কিন্তু রুহি তো পারতো না তখন এইজন্যই তো জীবনে ভুল পথে রুহি পা বাড়াক এটা ইরাদ চায় নি। চেয়েছে সামনের জীবনে অন্য কাউকে ওর জীবনে বরণ করে নিবে ও। তবে এখন রুহিকে দেখে যতটা খুশি লাগছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট লাগছে
“হুম বিয়ে করেছি”
এই কথা টুকু শুনে, শত হোক ইরাদ ও তো একজন মানুষ ওর মনটা একদম পুড়ে যাচ্ছে।
কথাটা বারবার কানে বারি কামড়ে ধরছে, কলিজার ভিতরটা কেমন যেনো লাগতে শুরু করেছে। এক হাহাকার এক রাশ শূন্যতা ঘিরে ধিরে মনের মাঝে।

.

দূরে আসার পরে রুহির চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে শুরু করেছে। ফর্সা চেহারাটা একদম লাল হয়ে গেছে, ইরাদ বিয়ে করে নিয়েছে এই জিনিসটা রুহি একদম মানতে পারছে না। মনে মনে ভাবছে ও,” কিভাবে পারলেন উনি? আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে? আমি কি উনাকে ভালোবাসি এটা উনি বুঝতে পারেন নি? এতো গুলো বছর একা একাই কাটিয়ে দিলাম তার কথা ভেবে। আর উনি আমাকে ছেড়ে অন্য জনের হয়ে গেলেন? আমার ভালোবাসায় কি কোনো কমতি ছিলো? ধ্যানে জ্ঞ্যানে সর্বদা এই মানুষটাকেই চেয়েছি আর আজকে কি রূপ একটা কঠিন দিনের সম্মুখীন হতে হলো আমার? ” বাড়ি গিয়ে রুহি সারাদিনেও আর দরজা খুলে নি। ওপরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বসে ছিলো নিজের ঘরে, যাওয়ার আগে অবশ্য টুনিকে বলে গেছে
– পাপাকে কেকটা দিস আর মেডিসিন গুলো ঠিক মতো খাইয়ে দিস।
-ঠিক আছে আপা
রুহির মুড এই তিন বছর ধরে এমনি হয়ে গেছে, এই ভালো এই খারাপ। সবাই এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে এটা দেখতে দেখতে তবে আজকে রুহির চেহারাটা অনেক অসহায় দেখাচ্ছিলো। এতো মায়াভরা চোখ গুলো কান্নায় ছলছল করছে দেখে টুনির খুব খারাপ লাগে। ও বুঝতে পারে আপা নিশ্চিত কাউকে ভালোবাসে যে উনাকে ভালোবাসে না। কারণ এই ব্যাপারে দিবা ও মেঘাকে কথা বলতে ও শুনেছে তবে রুহির সামনে কেউ কিছু বলে না। কারণ রুহি যাকে ভালোবাসে সে রুহির সাথে কোনো রকম যোগাযোগেই নেই।

সন্ধ্যা ৭টার দিকে সোবহান সাহেব বসে টিভি দেখছিলেন, তখন দারোয়ান তাহার এসে বলে
– স্যার একজন সুন্দর করে স্যার আসছে আপনার সাথে দেখা করার জন্য, বলতেসেন উনি ডাক্তার কালকে দেখা হইসে। আমি বাইরে থাকতে বলছি আপনি অসুস্থ দেখা করবেন কি না তাই জানতে আসছি?
সোবহান সাহেব বুঝতে পারলেন উনি কালকের সেই ডাক্তার যে উনাকে প্রাণে বাচিয়ে ছিলেন। তার কথা ভেবেই মুখে এক বিশাল হাসি ফুটে উঠে উনার।
তখনই বলে উঠেন
– আরে হতচ্ছাড়া, তাড়াতাড়ি উনাকে স্বসম্মানে বাসার ভেতরে নিয়ে আয়।
সাথে সাথে তাহার বুঝে যায় নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ অতিথি এসেছেন নাহয় কোনোদিন ও সোবহান সাহেব এতো খুশি হতেন না। সোবহান সাহেব এমন একটা মানুষ যে সবাইকে এভাবে বরণ করেন না।

-টুনি এদিকে আয় তাড়াতাড়ি,
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো টুনি
– জ্বি?
– নাস্তার ব্যাবস্থা কর আর আমার মেয়েকে ডাক দে
– আচ্ছা চাচা। কেউ আইতাসে?
– হুম কালকের যে ডক্টর আমায় প্রাণে বাচিয়েছে সে এসেছেন।
টুনি খুশি হয়ে নাস্তা বানাতে চলে গেলো।

আর এদিকে তাহার এক দৌড় দিয়ে তার জন্য দরজা খুলে দিলো, সে গাড়ি সহ ভেতরে প্রবেশ করলো। তখনই সামনে এসে তাহার বললো,
– স্যার মাফ করবেন, আমি আপনাকে প্রথম দেখসি আজকে, আপনি যে বিশেষ অতিথি আমি জানতাম না।
তাহার পাশে থাকা অন্য দারোয়ানকে ইশারা করে বললো,
-আমজাদ গাড়ি করুক আপনি আগে ভেতরে আসেন।
একটা হাসি দিয়ে ছেলেটা বললো,
-ঠিক আছে আসুন।

ভেতরে আসতেই গেটের সামনে সোবহান সাহেব নিজে দাড়িয়ে থেকে এক হাত দিয়ে তাকে ধরে ভিতরে নিয়ে গেলো,

– আসসালামু আলাইকুম কেমন আছেন আংকেল?
– আলহামদুলিল্লাহ বাবা। আপনি কেমন আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আংকেল। আমার বন্ধুর আজকে এনিভার্সারি ছিলো ওর বাসা কাছেই ওর সাথে দেখা করে যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে তাই ভাবলাম আপনার অবস্থা কেমন দেখে যাই। কাল তো আপনার নাম্বার নেই নি নাহয় ফোন করেই জিজ্ঞেস করতাম।
– না না বাবা, ভালো করেছেন আপনি এসেছেন আমি তো আপনার নামটাও জিজ্ঞেস করতে পারি নি। আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার বদলে যেভাবেই আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাই সেটাই কম হবে।
– এটা কিছু না আংকেল। এটা তো একজন ডাক্তার হিসেবে আমার দ্বায়িত্ব। আর আমার নাম হচ্ছে ডক্টর ইরাদ আহসান।
– খুব সুন্দর আর রুচিসম্মত একটা নাম বাবা আপনার। আপনি মানুষটা যেমন আপনার নামটাও ঠিক তেমনি।
– দোয়া করবেন আংকেল।
– অবশ্যই বাবা। তা আপনি কি হার্টের ডাক্তার বাবা?
– জ্বি আমি কার্ডিওলজি সার্জন।
– আপনাকে কোনোদিন আগে এই এলাকায় দেখিনি যে?
– আমি বেসিকালি ঢাকার অংকেল। কিন্তু আমেরিকা থাকি আর সেখানেই প্রাক্টিস করছি।
আমি আর আমাদের টিমের আরো দু’জন ডাক্তার একজন আই স্পেশালিষ্ট অন্যজন ই এন টি স্পেশালিষ্ট আমরা তিনজন কলে এসেছি বাংলাদেশে এক সপ্তাহ আগে। বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়া লাগবে কাজের জন্য। আর মোটামুটি সমস্যা গুলো বেশি সিলেটের দিকে। গত সপ্তাহে আমি রংপুর ছিলাম আর সিলেট এসেছি কালকেই, কিছু অপারেশন এর জন্য আর আমরা কিছু প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়েছি যার কারণে বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকায় আমাদের যাওয়া লাগবে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য।
– মাশাল্লাহ খুব ভালো। কোন হসপিটালে আছেন আপনি?
– সিলেট মেডিকেলে আছি আংকেল।
– তাই নাকি? আমার ছোট মেয়েও তো ওখানেই জয়েন করেছে। এই বছরই ইন্টার্ন শেষ হয়েছে ওর। দোয়া করবেন ও যেনো আপনার মতো ভালো মনের একটা ডাক্তার হতে পারে।
– অবশ্যই দোয়া করি অংকেল।
– আপনার পরিবার ও সাথে এসেছে?
– না আমি একা আছি এখানে।
ইরাদকে সোবহান সাহেবের বেশ পছন্দ হয়েছে, ছেলেটা বিয়ে করেছে কি না তা জানার খুব আগ্রহ লাগছে উনার। রুহির জন্য এইরকম একটা পাত্র হলে খুব ভালো হবে, ছেলে দেখতে রাজপুত্র। ব্যাবহার ভালো, পেশায় ডাক্তার, সমাজে ভালো অবস্থানে আছে। সবটা মিলে ভালো হবে রুহির সাথে।
– পরিবারে কে কে আছে আপনার?
– মা বাবা মারা গেছেন। ভাইয়া ভাবি আর বাচ্চারা লন্ডন থাকেন। ছোট বোন বিয়ে হয়ে গেছে সে ঢাকায় আছে।
-আর?
– আর কেউ নেই আংকেল।
– আমার দুই মেয়ে বড়টা বিয়ে হয়ে গেছে এখানেই কাছে থাকে। আর ছোটোটার কথা তো বললামই বাবা ওর সবে ডাক্তারী পাশ হলো। এখন ভালো একটা পাত্র দেখে ওকে বিয়ের ব্যাবস্থা করতে চাচ্ছি তাহলে শান্তি পাবো।
– আল্লাহ মন মতো পাত্র মিলিয়ে দেক আংকেল দোয়া করি।
– হ্যাঁ বাবা
ঠিক তখনই টুনি চা নাস্তা নিয়ে আসে,
সোবহান সাহেব- রুহিকে ডাক দে
রুহি নামটা শুনে ইরাদের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো
– যাচ্ছি
খাবারের মধ্যে আজকের রুহির কেনা সেই চকলেট কেকটাও আছে। এই রুহিও ডাক্তার আর ইরাদের রুহিও ডাক্তার। সবটা তো আর একটা মানুষের সাথে কো ইনসিডেন্ট হতে পারে না। তাহলে কি এই আংকেলের মেয়েই ইরাদের রুহি? আর আংকেল তো বললেন সে মেয়ের জন্য পাত্র দেখবেন তাহলে কি রুহি আজকে মিথ্যে কথা বলেছে?
ইরাদের মাথায় কিছুই আসছে না। আর যদি মিথ্যেও বকে রুহি তাহলে কেনো বললো? ইরাদকে তো এই কথা বলার না যদি ও ইরাদের জন্যই অপেক্ষা করে থাকে? যাই হোক ইরাদ সিদ্ধান্ত নিলো রুহিকে দেখেই যাবে ও।
কিন্তু প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মতো হয়ে গেলো রুহি নামছে না এমন সময় হাসপাতাল থেকে ইরাদের জন্য কল আসে ইমারজেন্সি।
জরুরি ভাবে যেতেই হবে এখন তাই কিছুই করার ছিলো না ইরাদের। সরাসরি ইরাদ তখন হাসপাতালে যায় এবং সেখান থেকে ইরাদ বাড়ি ফিরে আসে।

সোবহান সাহেবের কথায় রুহিকে এরপর টুনি ডাক দেয় নিচে আসার জন্য
– আপা আপা দরজা খুলেন।
-কেনো?
– নিচে কালকের স্যার আসছে?
– কে?
– যিনি চাচার জান বাচাইসিলো
– আচ্ছা তুই যা আসতেসি।
রুহি কান্নায় কান্নায় চেহারা ফুলিয়ে ফেলেছে তাই গোসল করে রুহি নিচে এলো যাতে ওকে ফ্রেশ দেখা যায় নাহয় মানুষের সামনে তো যাওয়া যাবে না। গেলেই নানান প্রশ্ন করা হবে ওকে। যার উত্তর রুহি একদম দিতে চায় না। তবে রুহি নিচে আসতে আসতে ইরাদ বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে।

আজ বাড়ি ফিরে সে পরদিনের অপেক্ষায় লেগে যায়। আজকে সাদিকের (ইরাদের বন্ধু) বিয়ের তিন বছর পূর্তিতে ইরাদ কেক ফুল আর গিফটস নিয়ে সাদিক আর ভাবীকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য যায় আর তখনি রুহির সাথে ওর দেখা হয়ে যায়। কালকের আশায় ইরাদ বসে রইলো হসপিটালে গিয়ে ও দেখবে কোন রুহি মেয়েটা যে নতুন জয়েন করেছে সিলেট মেডিকেলে, সে কি ইরাদের রুহি নাকি অন্য রুহি?
আর আজকে রাতে ইরাদ রুহির লিখা ডায়েরিটা পড়বে। এতো গুলো বছর মেয়েটাকে দূরে রেখেছে ওর ডায়েরিটা ও পড়ে নি যেনো মায়া বেড়ে না যায়। কিন্তু এটা ইরাদের ভূল ধারনা ছিলো, রুহির প্রতি যা ভালোবাসা হওয়ার তা দূরে থেকেই হয়েছে কমেনি বিন্দু পরিমাণ ও।

আর এদিকে রুহি নিচে আসতেই রুহিকে ওর পাপা বলে উঠলো,
– মা রে তোর জন্য একটা সুপাত্র পেয়ে গেছি।
– পাপা?
– হুম ছেলেটা অসম্ভব পরিমাণে ভালো। তুই দেখিস, দেখলে নিজেও না করতে পারবি না।
– পাপা আমি এখন বিয়ে করবো না।
– এখন করিস না মা৷ তুই আজকে বড্ড দেরি করে ফেললি নামতে নাহয় দেখে নিতে পারতি ছেলেটা কি যে ভদ্র, ভালো আর অমায়িক।
এর থেকে ভালো ছেলে আমি আর দেখিনি। যে আনম্যারিড আর আমি সত্যি বলত্ব তোর জন্য এমন ছেলেই চাই।
– আচ্ছা পাপা আমার মাথাটা খুব ধরেছে ঘুমাই একটু?
– আচ্ছা মা যা তুই।
এদিকে সোবহান সাহেব খুব খুশি অন্য দিকে রুহির কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে একদম। পাপা বিয়ের কথা কেনো তুললেন? আমিতো বিয়ে করতে চাই না ইরাদ ছাড়া অন্য কাউকে।
“ইয়া আল্লাহ, কেনো এতো এতো পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় আমার? এই যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারি না। প্লিজ এই জীবনের একটা বিহিত করো”

আর অন্যদিকে ইরাদ রয়েছে পরদিনের অপেক্ষায়, রুহির আসল রহস্য জানার অপেক্ষায়।

(চলবে…)
(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here