অন্তরিন প্রণয় পর্ব -২৭

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২৭

– এটা কে রে?লালা টুকটুকে বউ!
জুহির কথায় কিঞ্চিৎ হাসে সেহেরিশ।কেইনের দিকে এক পলক তাকিয়ে সেহেরিশ তার হাত থেকে ফোনটা নিজের হাতে তুলে নেয়।
– জুহি তুই কেমন আছিস?
– ভালো থাকার কি কথা?আমি নেই আর তুই বিয়ের আসরে বসে গেলি।
– আসলে সবটা হুট করেই হয়ে গেছে।
– হুম, তাই বলে আমাকে না জানিয়ে।
সেহেরিশ প্রত্যুত্ত করলো না।মাথা নুইয়ে নেয়।একা রুমে এই মূহুর্তে কেইনের সাথে বসে আছে ভাবতেই অপ্রস্তুত লাগছে।সেদিন কেইনের মুখে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা বন্ধুত্বের মাধুর্য নষ্ট করে দিয়েছে।ইসস হেসে খেলে কতবার যে কেইনকে সেহেরিশ জড়িয়ে ধরেছে তার ইয়াত্তা নেই।কিন্তু এখন কেইনকে দেখলেই অন্যরকম অনুভূতি হয়।

– সেহেরিশ তো বিজি আছিস। আমি বরং রাখছি আর নার্ভাস হবি না একদম।সব ঠিক ঠাক হবে অল দা বেস্ট।
জুহির সঙ্গে আর কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দেয় সেহেরিশ।কেইনের দিকে ফোন বাড়িয়ে দিলে কেইন তা হাতে তুলে নেয়।

– আমার সঙ্গে কথা বলছিস না কেন সেহেরিশ?যা হয়েছে তা বাদ তুই সুখী থাক এটাই আমি চাই।
– না আসলে….
– থাক,শাক দিয়ে মাছ ঢাকিস না।কাল গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে তুন্দ্রের সঙ্গে কথা বলেছিস কিন্তু আমার সঙ্গে একটু কথাও বললি না।ভালোবাসি প্রকাশ করেছি বলে কি পর হয়ে গেছি?শুন সেহেরিশ যা হয়েছে তা সমাপ্ত তুই আমার ফ্রেন্ড ছিলি তুই আমার ফ্রেন্ড থাকবি।
– আমি জানি কেইন।
– আফীফ ভাই তোকে অনেক ভালোবাসবে।সে তো আমার থেকেও হতভাগা আট বছর তোর অপেক্ষায় ছিল কিন্তু কাছে না পেয়েও নিখুঁত ভাবে ভালোবেসে যায়।

সেহেরিশ পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে কেইনের দিকে।আজ ছেলেটাকে বড্ড অচেনা লাগছে।এটা সেই কেইন না যে কেইন লাফিয়ে ঝাপিয়ে সবার মাঝে বেঁচে থাকে।এটা সেই কেইন যে কেইন চাপা আর্তনাদ লুকিয়ে রেখে হাসছে।

কেইনের সেহেরিশের পাশে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।
– সেহেরিশ একবার জড়িয়ে ধরবি?
সেহেরিশ উঠে দাঁড়ায়।কেইনকে শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরে।কেইনের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠেছে তবে সেহেরিশের মাঝে ভর করেছে ভয়।আফীফ দেখে ফেললে কেলেংকারী হয়ে যাবে।
.
গতকাল গায়ে অনুষ্ঠান শেষে আজ বিয়ের আয়োজন।সেহেরিশ লাল লেহেঙ্গায় তৈরি হয়ে আছে।ঢাকা থেকে ওয়েডিং প্লানার সহ বিউটি পার্লার থেকে সাজানোর জন্য মেয়ে আনার ব্যবস্থা করে আফীফ।সেহেরিশ তার বাবাকে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত সবটা খুলে বলায় তিনি কিছুটা রাগ মুক্ত হয়েছেন।তবে মেয়ের বিয়ে নিয়ে তার মাঝে আনন্দের শেষ নেই।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে।রাতের দেওয়ান মঞ্জিল ঝলমল করছে হরেক রকম লাইটের সাজসজ্জায়।কিছুক্ষণ পরেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে।
সেহেরিশ মৌ’কে নিয়ে বকবক করতে ব্যস্ত ।আফীফ নিজের রুম থেকে তৈরি হয়ে সেহেরিশের রুমে একবার উঁকিঝুঁকি দেয়।সেহেরিশকে একা মৌয়ের সঙ্গে দেখে সুযোগ বুঝে রুমে ঢুকে যায়।

– মৌ সোনামণি যাও তোমার মামনি ডাকছে।
আফীফের কন্ঠে চমকে তাকায় দুজনে।মৌ আফীফের ইশারা বুঝতে পেরে এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।আফীফ সুযোগ বুঝে দরজাটা বন্দ করে সেহেরিশের সামনে দাঁড়ায়।সেহেরিশ কাপঁছে আফীফের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসে।
– কি হলো মিসেস আফীফ আপনি কাঁপছেন কেন?
আফীফের মুখে ‘মিসেস আফীফ’ শব্দটা শুনেই শিউরে উঠলো সেহেরিশ।মানে কি বিয়ে না হতেই মিসেস বানিয়ে ছাড়লো এই লোক।
– তিন কবুল এখনো পড়িনি যে মিসেস আফীফ বলবেন।
– পড়ার দরকার নেই আফীফ দেওয়ানের চোখ যখন পড়েছে তখনি তুমি আমার হয়ে গেছো।তা আপনি কাঁপছেন কেন?
– প…প্রথম বার বিয়ে করছি তো তাই।
– আমি কি সপ্তমবার বিয়ে করছি নাকি?

সেহেরিশ থতমত খেয়ে যায়।কি বলবে ভেবে পায় না।আফীফ তার দিকে এক পা দুই পা করে এগিয়ে আসতে সেহেরিশ পিছিয়ে যায় কিন্তু বেচারি বেশি দূরে গিয়ে পারলোনা তার আগেই আফীফ হাত টেনে সামনে এনে দাঁড় করায়।
– পালিয়ে যাবে কোথায়?আজকের পর থেকে বন্দিনি আফীফের কাছে।
– তাই তো ভয় লাগছে যদি কখনো না ছাড়েন।
– ছাড়বো কেন?যা চাইবে তাই পাবে শুধু আমার হয়ে থেকো।

সেহেরিশ মিষ্টি করে হাসে।আফীফ তার দিকে তাকিয়ে আবদার সুরে বলে,
– একটা চুমু খাবো?
– না।
– একটা, শুধু একটা।
– আমার মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে
– উহুহ উল্টা পালটা বাহানা দেখাবে না আমায়।

আফীফ এগিয়ে এসে সেহেরিশের কপালে চুমু খায়।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সাড়ে সাতটা বাজতে দেখেই তাড়া দিয়ে বলে,

– আমি বরং যাই বিয়ের সময় এসে গেছে।
– যাই বলতে নেই, বলুন আসি।আমার জন্য ভালোবাসার পবিত্রতার দলিল নিয়ে আসবেন।
– জো হকুম আমার দিলের রানী।
.
বিয়ে বাড়ির উৎসব আয়োজনে আজ একজনের আনন্দের সীমা নেই।না সে দাওয়াতে ব্যস্ত নয় বরং অন্ধকার মিশ্রিত রুমে বসে আছে।কেননা আজ তার মুক্তি হবে।আফীফ যখন সেহেরিশের হয়ে যাবে তখনি তার মুক্তি হবে।শর্ত এটাই ছিল!

অন্য একটি রুমে জ্বলমলে আলোর ব্যবস্থা।পুরো রুমটা সাজানো বেশ যত্ন সহকারে কিন্তু সেই রুমের মানুষটির বোধ নেই।ঘুম ভাঙ্গলেই এক নাগাড়ে তার মুখে একটা কথাই বাজে ” আমার কিছু চাই না আমি বাচঁতে চাই”আমার কিছু চাইনা আমি বাঁচতে চাই”

ব্লাক হাউজে এই দুটো রুম বিশেষ ভাবে নিরাপত্তার মাঝে আছে।বাকি রুম গুলো ব্যবহার করা হয় আপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য।আফীফের কাছে সবচেয়ে প্রিয় শাস্তি অপরাধীকে মেরে ফেলা নয়,বরং একলা একা একটি রুমে রেখে মানবসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা।বছরের পর বছর বাইরের আলোহীন বন্দ ঘরের মানুষটির বার বার তখন ইচ্ছে হয় একটু খানি বাইরের দৃশ্য দেখার পরিবারের মানুষগুলোকে দেখার।

.
সেহেরিশ একা রুমে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে।জানালা দিয়ে বেশ কয়েকবার আড়ালে আফীফকে দেখতে পায়।তৎক্ষনাৎ লজ্জায় চোখ মুখ অসাড় হয়ে আসে।রুমে পাইচারি করতে করতে সেহেরিশের কানে আসে মোবাইলে ভাইব্রেশনের শব্দ।সেহেরিশ বিছানার উপর আফীফের ফোন দেখে হাতে তুলে নেয়।একটি নাম্বার থেকে বেশ কয়েকবার ফোন আসছে। নাম্বারটি সেভ করা ‘জিউ’ নামে।সেহেরিশ দোটানায় পড়ে যায় জিউ কি ছেলেদের নাকি মেয়েদের নাম।ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতে সেহেরিশ ফোনটা রেখে দেয়।এক নাগাড়ে নয়টি কল আসে সেই নাম্বার থেকে অবশেষে মেসেজের শব্দে আবারো মোবাইল হাতে নেয় সেহেরিশ।

স্বাভাবিক মুখে সেহেরিশ মেসেজটি পড়লেও মেসেজ পড়ার পর সেহেরিশের মুখের অবস্থা আর স্বাভাবিক নেই।রাগে থরথর করছে কাঁপছে তার শরীর।নিজের মোবাইলটি হাতে তুলে নিয়ে মারুফাকে ফোন করে সে,
– ফুফি যা বলছি মন দিয়ে শুনো।
– কি বলবি বল।
– আমি সন্ধান পেয়ে গেছি।পাপাকে দেওয়া কথাও আমি রাখবো।পাপার কসম আমি অমান্য কর‍তে পারবো না।তোমাকে কিছু ট্রিক শিখিয়ে দিচ্ছি দোহায় লাগে প্রয়োজনে তুন্দ্রকে নিয়ে সবটা কাজ করো সময় নেই আমাদের হাতে মাত্র ১ ঘন্টা আছে।তুমি শুনো…………..

সেহেরিশ কথা শেষ করে আবারো আফীফের ফোনের দিকে তাকায়। বিড়বিড় করে তার মুখ থেকে একটাই শব্দ বের হয় “বেইমান”।

.
গায়ের ভারী লেহেঙ্গাটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে সেহেরিশ।বিয়ে বাড়ির বেশির ভাগ এখন ঘুমে কাতুর অবস্থায়।বাইরের একটু আগের বিয়ের আয়োজন এখন নিভুনিভু অবস্থায়।আফীফ বিশেষ ফোনকলে বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে। দায়িত্ব দিয়ে যায় আহনাফ দেওয়ান মুনিফ এবং মামুনের কাছে।কিন্তু সবার অবস্থা এখন ঘুমন্ত।কিছুক্ষণ আগে সেহেরিশের কথায় মারুফা সবার শরবতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেন যার দরুনে পুরো বাড়িটা ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতা ছেঁয়ে যায়।যেহেতু আফীফ বাড়িতে নেই তাই কাজটা বেশ সুবিধা ভাবে সম্পূর্ণ করে মারুফা।সেহেরিশ তাদের সবার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।কিন্তু বিপাক ঘটলো সেহেরিশের ক্ষেত্রে। সেহেরিশের পাসপোর্ট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।বেশ কয়েক মিনিট খুঁজে না পাওয়ার পর হাল ছেড়ে দিয়ে দ্রুত ব্লাক হাউজের দিকে এগিয়ে যায়।সবাই মিলে ব্লাক হাউজের দরজা খুঁজে পেলেও দরজায় পিন সিস্টেম হওয়ার কারনে সবাই থমকে যায়।

– ক..কি করবো আমরা পাপা?
– সেহেরিশ আমার কসম লাগে যা হয়েছে বাদ দে।কাউকে মুক্ত করতে হবেনা আমাদের।প্লিজ,চল আমরা চলে যাই এতটা সুযোগ আর কখনো পাবো না।
– কিন্তু পাপা আমার কারনে পারভিন আন্টি বন্দি হয়ে আছে এখানে।তাকে আমার মুক্তি করতেই হবে।
– চুপ কর।আমি যা বলছি তাই কর।
বাড়ির বাকি সবাই সেহেরিশকে তাড়া দিতে থাকে।তুন্দ্র সেহেরিশের হাত টেনে নিয়ে যেতে চাইলে সেহেরিশ ঠোঁট কামড়ে কান্না সুরে বলে,
– আফীফের ভালোবাসা মিথ্যা নয়।আমি উনাকে ঠকাতে চাই না।

সেহেরিশ কথা শেষ করার আগেই তার গালে চড় পড়ে।হ্যা চড়’টা খুরশীদ আনওয়ার দিয়েছেন।সেহেরিশ দু’কদম পিছিয়ে যেতেই কেইন তাকে আগলে ধরে।
– কু*বাচ্চা এই দিন দেখার জন্য আমি তোকে বড় করেছি।দুইদিনের ছেলেটার জন্য তোর মায়া লাগে আর আমি তোর মা পরিবারটার জন্য মায়া লাগেনা।এখনি তোকে ত্যাজ্য করবো আমি।
খুরশীদ আনওয়ারের ধমকে ভয় পেয়ে যায় সেহেরিশ।
– প..পাপা আমি যাবো।

সেহেরিশ ভয় পেয়ে যায়।তার মস্তিষ্ক যেন অকেজো হয়ে গেছে।জীবনের এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েনি।
ভাবনার মাঝেই সেহেরিশের হাতে টান পড়লো।হ্যা কেইন তাকে নিয়ে ছুটছে আফীফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য। সেহেরিশ যন্ত্র মানবের মতো কেইনের সাথে ছুটছে।দুচোখে তার জল।দুনিয়া উলটে গেলেও সেহেরিশ অস্বীকার কর‍তে পারবেনা আফীফ’কে সে ভালোবাসে।সত্যি ভালোবাসে।আফীফ কি তার জীবনে আর ফিরে আসবে না দেখা হবে না তাদের?সেহেরিশের বার বার চোখে ভাসছে সেই দৃশ্য।আফীফকে বলা কথা গুলো।ভাবতেই ভেততটা মুষড়ে যাচ্ছে,

“যাই বলতে নেই, বলুন আসি।আমার জন্য ভালোবাসার পবিত্রতার দলিল নিয়ে আসবেন।

সেহেরিশ তো চলে যাচ্ছে আফীফকি তার জীবনে ফিরে আসবে?

বাড়ির গেট থেকে বের হতেই সেহেরিশ বিড়বিড় করে বলে,
– আলবিদা…

#চলবে…
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here